সৃষ্টির মনের কথা

“ভালবাসা কী করে প্রমাণ করা যায় বল তো? ভালবেসেই তো? আজ যখন আদালতে আমাকে বলা হল ‘প্রমাণ করুন আপনি দেশকে ভালবাসেন’, আমি ভাবলাম কী করে করি? কেমন করে প্রমাণ করা যায় যে আমি আমার দেশকে ভালবাসি?”

দুঃসময়। বড় দুঃসময়ে বেঁচে আছি। সকালের কাগজ ১৯৯২ এর স্মৃতি উশকে দিয়ে লিখছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ হুমকি দিয়েছে রাত পোহালেই দু লক্ষ লোক ঢুকে পড়বে অযোধ্যায়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮৯ মনে করানো রথযাত্রার প্রস্তুতি। রাজ্য সরকার শীর্ষস্থানীয় আমলাকে পাঠিয়েছে বিজেপির সাথে যাত্রাপথ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে। আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
ওদিকে আসামে ডিটেনশন ক্যাম্পে ভিড় বাড়ছে, বহু পরিবার ছিন্নভিন্ন, আত্মহত্যার পর আত্মহত্যা। সংসদে পাশ হওয়ার অপেক্ষায় নতুন নাগরিকত্ব আইন। যে আইন পাশ হলে অহিন্দু মানুষের ভারতের নাগরিক হওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে” শুধু কবিতার পংক্তি হয়ে যাবে।
এসব ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি। আর বিরোধীদের রাজনীতিটা কিরকম?
দিন দুয়েক আগে কংগ্রেস নেতা সি পি যোশী বললেন একমাত্র একজন কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রীই পারেন রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। মনে করিয়ে দিলেন যে রাজীব গান্ধীই বাবরি মসজিদের তালা খুলিয়ে পুজো আচ্চার ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। যোশী আরো বলেছেন হিন্দু ধর্মটা একমাত্র ব্রাক্ষ্মণরাই বোঝে। নরেন্দ্র মোদী, উমা ভারতী এরা আর কী জানবে? নীচু জাতের লোকেদের হিন্দু ধর্ম নিয়ে কথা বলার কোন অধিকারই নেই। যোশীজিকে যিনি ধমকে দিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ, সেই রাহুল গান্ধী কেবল মন্দির থেকে মন্দিরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁর সম্পর্কে তাই হিন্দুত্বের ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসাডর বিজেপি প্রশ্ন তুলেছিল তিনি কি হিন্দু? উত্তরে কংগ্রেস মুখপাত্র বলেছিলেন রাহুল যে শুধু হিন্দু তাই নয়, তিনি রীতিমত পৈতেওয়ালা হিন্দু।
বাংলার অগ্নিকন্যা তথা কর্ণধার বিজেপিকে আটকাতে দীর্ঘদিন অব্দি সাধারণ মুসলমানকে ভুলে ইমাম, মোয়াজ্জেমদের সমর্থনে ভর দিয়ে চলছিলেন। বছরখানেক হল সেসব চাপা দিতে আবার ব্রাক্ষ্মণ সম্মেলন, বজরংবলী পুজো, জনসভায় গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ, দুর্গা বিসর্জনের বিষণ্ণতাকে আমুদে কার্নিভালে পরিণত করায় মেতেছেন। তাতেও যথেষ্ট হচ্ছে না মনে করে শেষমেশ আয়করদাতাদের টাকা পুজো কমিটিগুলোকে বিলিয়েছেন। এন আর সি নিয়ে দিনকতক লোকলস্কর নিয়ে বিস্তর চেঁচামেচি করার পর এখন স্পিকটি নট। অবশ্য ওটা নিয়ে বেশি পরিশ্রম কেনই বা করতে যাবেন? তিনিই তো প্রথম সাংসদ যিনি সীমান্তবর্তী এলাকায় সিপিএম বাংলাদেশ থেকে লোক ঢোকাচ্ছে, এদের বার করে দেওয়া হোক — এই দাবী করে লোকসভার স্পিকারের দিকে কাগজ ছুঁড়েছিলেন।
আর বামপন্থীরা? সর্ববৃহৎ পার্টির নেতাদের একাংশ তো মনে করছেন বিজেপিকে হারাতে উপর্যুক্ত কংগ্রেসেরই হাত ধরা দরকার এক্ষুণি। নিজেদের লড়ার ক্ষমতার উপর এমন আস্থা আর কাদের আছে? এন আর সি, নাগরিকত্ব বিল নিয়ে বামেদের যে কী মতামত কে জানে! শীর্ষ নেতৃত্ব একবার বলেছিলেন দেখতে হবে নিরপরাধ লোকের যেন হয়রানি না হয়। মানে মানুষের নাগরিকত্ব নির্ধারণে তার বংশপরিচয়কে মানদণ্ড ধরায় বোধহয় তাঁদের আপত্তি নেই। যাহা লিগ্যাসি তাহাই লিগাল।
অর্থাৎ দেশের সর্বত্র তাঁদের ভারতীয়তা, তাঁদের দেশপ্রেমের প্রমাণ চাওয়া হচ্ছে মানুষের কাছে। এই প্রমাণ দীর্ঘকাল ঠারেঠোরে চাওয়া হত এদেশের মুসলমানদের কাছে। এখন ঘাড় ধরে চাওয়া হচ্ছে। আসামের অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষেরাও সেই আওতায়। সংখ্যালঘুদের প্রতি মুহূর্তে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁরা অপ্রিয়, অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক। তাঁদের খুন করলে শাস্তি হয় না চাকরি হয়, ধর্মস্থান ভেঙে দিলে অপরাধ হয় না মন্ত্রিত্ব হয়, গালাগালি দিলে বাহাদুরি হয়।
এমতাবস্থায় প্রায়শই “সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় — দ্বেষ।” মনটা এমন কোন সৃষ্টি খুঁজতে থাকে যার মনের কথা ভালবাসা। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম অনুভব সিনহার ছবি ‘মুল্ক’ (দেশ)। হিন্দু, মুসলমানের ইতিহাসের সঙ্গমস্থল বেনারসের পুরনো বাসিন্দা বৃদ্ধ আইনজীবী মুরাদ আলি মহম্মদকে কাঠগড়ায় উঠতে হল এবং প্রমাণ করতে বলা হল তিনি তাঁর মুল্ক অর্থাৎ দেশকে ভালবাসেন। তিনি নিয়মিত আয়কর দেন, পুলিশের খাতায় কখনো তাঁর নাম ওঠেনি, এমনকি গাড়ি চালানোর সময়ও কখনো ট্র‍্যাফিক আইন ভাঙেননি। কিন্তু ওসব যথেষ্ট নয় একথা প্রমাণের জন্যে যে তিনি দেশপ্রেমিক। সন্ত্রাসবাদী নন।
ধর্মীয় মৌলবাদ আমাদের উঠোন পেরিয়ে চলে আসছে আমাদের সবার শোবার ঘর অব্দি। তফাৎ শুধু এই যে সংখ্যালঘুর মৌলবাদকে ঢুকতে হচ্ছে লুকিয়ে চুরিয়ে, সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ আসছে সামনের দরজা দিয়ে। আলি মহম্মদের ভোলেভালা ক্লাস টেন পাশ ভাই বিলালের ছেলে শাহিদ, যাকে ছোটবেলায় ধরে বেঁধে কোরান পড়িয়ে ওঠা যায়নি, সে কাশ্মীরের বন্যাত্রাণে অর্থসাহায্য করছে ভাবতে ভাবতে হয়ে গেল জেহাদি নেটওয়ার্কের সদস্য। আর বাড়ির উল্টোদিকের পান বিক্রেতা চৌবে, যে আলি সাহেবের প্রাণের বন্ধু, তার অকর্মণ্য ছেলে বুক ফুলিয়ে “দেশের কাজে” নেমে পড়ল বাইকের সামনে পতাকা লাগিয়ে। কী সেই কাজ? লোকলস্কর ডেকে এনে আলি সাহেবের গ্যারেজ ভেঙে দেওয়া, হিন্দু উৎসবের আগে লাউডস্পিকারের মুখটা মুসলমানদের বাড়ির দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যাতে তারা টের পায় “গোটা দেশ তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ”, রাতে আলি সাহেবের বাড়িতে পাথর ছোঁড়ার আয়োজন, দেয়ালে এবং দরজায় লিখে দেওয়া “TERRORIST”, “GO TO PAK”।
এই ছবিতে অনুভব সিনহার সবচেয়ে বড় কাজ সম্ভবত আমাদের অনেকের মনে তৈরি হওয়া চড়া একরঙা ছবিগুলো মুছে দেওয়া। এ ছবির হিন্দুরা নানারকম, মুসলমানরাও তাই।
ধর্মপ্রাণ অথচ গোঁড়ামিহীন আলি মহম্মদ আছেন, কোরান ঠিকমত না পড়েও জেহাদী হওয়া ভাইপো শাহিদ আছে, অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াডের ভুয়ো এনকাউন্টারবাদী অফিসার দানিশ জাভেদও আছেন। তিনি মনে করেন সন্ত্রাসবাদীদের গ্রেপ্তার না করে শেষ করে দেওয়া উচিৎ কারণ তারা মুসলমানদের বদনামের কারণ।
হিন্দুদের মধ্যে চৌবে আছেন, যিনি স্ত্রীকে লুকিয়ে বন্ধু আলির বাড়িতে কোরমা, কালিয়া খেতেন অথচ শাহিদের অপরাধ প্রকাশ হতেই বিরাট হিন্দু হয়ে উঠলেন এবং নিঃসংশয়ে বুঝে নিলেন “আমার ছেলে ঠিকই বলে। ওরা ঐরকমই।“ কিন্তু আলি সাহেবের আরেক বন্ধু সোনকর আছেন, যিনি ১৯৯২ এর ৬ই ডিসেম্বরের অভিশপ্ত রাতে চৌবেকে সঙ্গে নিয়ে আলি সাহেবের পরিবারকে দাঙ্গাবাজদের হাত থেকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিলেন। যিনি গোটা মহল্লার বিরুদ্ধে গিয়ে আলি সাহেবের পুরো পরিবারকে সন্ত্রাসবাদী প্রমাণ করার চেষ্টা চলার সময়ে পাশে থাকলেন। আলির প্রবাসী ছেলে এসে যখন বলল এ বাড়ি ছেড়ে তার সাথে ইংল্যান্ড চলে যাওয়াই ভাল, তখন সোনকরকে দেখিয়েই আলি সাহেব বললেন “আমরা চলে যাব? আমি নিজেকে কী জবাব দেব? যে আমি দেশদ্রোহী? পাড়ার লোককে সোনকর কী জবাব দেবে? ও বলবে ও দেশদ্রোহীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল?”
সর্বোপরি আছেন আরতি মহম্মদ — আলি সাহেবের হিন্দু পুত্রবধূ। একজন বেপথু হয়েছে বলে পুরো পরিবারটাকে সন্ত্রাসবাদী প্রমাণ করার প্রচেষ্টাকে বিফল করার দায়িত্ব শেষ অবধি যার ঘাড়ে পড়ে। মুসলমানদের ঝামেলা মুসলমানরাই সামলাক, কোর্ট তো বলে দিয়েছে ওরা টেররিস্ট — বাবা-মায়ের এইসব আবোলতাবোল কথাবার্তা উড়িয়ে দিয়ে ঘাড় সোজা করে লড়ে যায় মেয়েটি। অথচ বেনারসে আসার আগে স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদের মুখে দাঁড়িয়েছিল সে, কারণ আলি সাহেবের ছেলে আফতাব চাইছিল সন্তানের জন্মের আগেই যেন তার ধর্মটা ঠিক করে রাখা হয়। শুনানিতে যাওয়ার সময় কিন্তু সে মন্দিরের প্রসাদী ফুল মাথায় ছুঁইয়ে যায়।
আরো এক দল মানুষ আছেন আলি সাহেবের মুল্কে, যাদের কথা না বললেই নয়। কিছু লোক যারা মসজিদে নমাজ পড়তে এসে তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় শাহিদ আর বিলালের শাহাদাত উদযাপন করতে আসার জন্যে এবং প্রবল ধমক খায়। আলি সাহেব তাদের জানিয়ে দেন শাহিদ যা করেছে তা শাহাদাত নয়, সন্ত্রাস। যারা তাঁর বাড়িতে পাথর ছুঁড়েছে তারাও যে সন্ত্রাসীই সেকথা তিনি বলে এসেছেন এফ আই আর নিতে অনিচ্ছুক দারোগাকে।
মসজিদে ফিসফিসিয়ে কথা বলা লোকগুলোর দলেই পড়েন সরকারপক্ষের উকিল সন্তোষ আনন্দ। সাক্ষ্যপ্রমাণ না-ই থাক, মুসলমানবিদ্বেষের কোন অভাব নেই তাঁর মধ্যে। তিনি জানেন এখন কেস জিততে হলে বিচারবিভাগকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে হয়; হোয়াটস্যাপ, ফেসবুককে হাতিয়ার করতে হয়।
ছায়াছবি হিসাবে অনায়াসেই আরো ভাল হতে পারত ‘মুল্ক’। তাপসী পান্নু আরো জোরালো আরতি হতে পারতেন, আদালতে তাঁর অতি মূল্যবান closing argument চিত্রনাট্যের সাহায্য পেলে আরো কম বক্তৃতা হতে পারত। বিচারকের শেষ কথাগুলোও, যদিও অত্যন্ত জরুরী, অতটা বক্তৃতার মত না শোনালে নিঃসন্দেহে আরো ভাল হত। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় কথা এই সময়ে এই ছবিটার প্রয়োজন ছিল। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আলি সাহেবরূপী ঋষি কাপুর যখন সন্তোষ আনন্দরূপী আশুতোষ রানাকে প্রশ্ন করেন “আমার দেশে আমাকে স্বাগত জানানোর অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে?” তখন প্রশ্নটা তাঁর একার থাকে না, কোটি কোটি ভারতবাসীর হয়ে দাঁড়ায়। সেইসব ভারতবাসীর যাঁদের পান থেকে চুন খসলে পাকিস্তানি বলে সম্বোধন করা হয়, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের সময়ে যাদের দিকে আড়চোখে, বাঁকা হেসে তাকানো হয়।
তবে সবচেয়ে মনে রাখার মত মুহূর্ত তৈরি হয় আদালতে নয়, বাড়ির ছাদে। ভাই বিলালের উকিল থেকে কেসে অন্যতম অভিযুক্ত হয়ে যাওয়ার পর শব্দহীন বিনিদ্র রাতে পুত্রবধূকে আলি সাহেব বলেন “তবসসুম যখন বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এল, তখন আমার সাথে খুব ঝগড়া করত, বলত ‘তুমি আমায় ভালবাস না।’ আমি বলতাম ‘বাসি তো। খুব ভালবাসি।’ ভালবাসা কী করে প্রমাণ করা যায় বল তো? ভালবেসেই তো? আজ যখন আদালতে আমাকে বলা হল ‘প্রমাণ করুন আপনি দেশকে ভালবাসেন’, আমি ভাবলাম কী করে করি? কেমন করে প্রমাণ করা যায় যে আমি আমার দেশকে ভালবাসি?”
দেশকে ভালবাসার প্রশ্ন উঠতে তাঁর মনে পড়ল প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা, মায়ের কথা নয়। “ভারত মাতা কি জয়” স্লোগানের পরাভবে পূর্ণিমার তাজমহলের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুরাদ আলি মহম্মদের দেশপ্রেম।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন।

Leave a Reply

%d bloggers like this: