মনে রাখবেন, ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যখন এক ধর্ষিতা আর তার সঙ্গী দিল্লীর ঠান্ডায় উলঙ্গ, রক্তাক্ত, মৃতপ্রায় অবস্থায় রাস্তায় পড়েছিল তখন তাদের সাহায্য করতে একটি মানুষও এগিয়ে আসেনি অথচ তা নিয়ে মোমবাতি মিছিল করতে লোকের অভাব হয়নি। আর ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট একজন ধর্ষকের শাস্তির প্রতিবাদে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায়। নিরস্ত্র, নিরীহ অবস্থায় নয়, রীতিমত খুনে মেজাজে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেছে বহু মহিলা এই ধর্ষকটির জন্যে কান্নাকাটি করছেন। মগজধোলাই কোন পর্যায়ে গেলে এটা সম্ভব একবার ভেবে দেখুন। মানলাম যে এই ভিড় সংগঠিত করা হয়েছে গোলমাল পাকানোর জন্য। কিন্তু একজন ধর্ষককে সমর্থন করার জন্যে এত লোককে সংগঠিত করা যে সম্ভব হচ্ছে (যে মূল্যেই হোক) তা মগজধোলাই ছাড়া একেবারেই অসম্ভব। সেই মগজধোলাইটা কী এবং কত প্রাচীন সেটা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ।
ঘটনা হল যে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার গর্ব আমরা করে থাকি, এটা তার এক বিরাট উত্তরাধিকার। দেবদাসী এদেশের অতি প্রাচীন প্রথা তবে সেটা মন্দিরে সীমাবদ্ধ। কিন্তু শিষ্যদের বাড়ির মেয়েরা গুরুর ভোগ্য — এ বিশ্বাসটার ইতিহাসও কিন্তু আমাদের দেশে বেশ লম্বা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা হুতোম প্যাঁচার নকশায় দেখছি খোদ বাংলায় হিন্দু বাড়িতে মেয়ের বিয়ে হলে পরিবারের গুরু ফুলশয্যায় বসে থাকতেন। তিনি “প্রসাদ করে দিলে” তবে স্বামী-স্ত্রী মিলিত হতে পারত। হুতোম সকৌতুকে লিখেছেন কিভাবে এক পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত স্বামী খাটের তলায় লুকিয়ে থেকে যথাসময় বেরিয়ে এসে এক গুরুর মাথা ফাটিয়ে দেন, অতঃপর প্রাণভয়ে গুরুরা এই প্রসাদ করার অভ্যেস ত্যাগ করেন। অতএব ঐ যে দেড় লক্ষ লোক মনে করেছে তাদের গুরু নির্দোষ, ঐ যে সাক্ষী মহারাজ বলে শাসকদলের এক গেরুয়া মাফিয়া ধর্ষণ প্রমাণিত হওয়ার পরেও গুরমিত নামক বরাহনন্দনটিকে পুণ্যাত্মা বলেছে, এরা কিন্তু সত্যিই মনে করে গুরুর অধিকার আছে শিষ্যাদের একটুআধটু ভোগটোগ করার। আমাদের এই ধর্মশাসিত দেশে ব্যাপারটা এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। গুরুবাদী দেশ তো। “মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা।” ফলে এদেশের অধিকাংশ পুরুষই মনে করে ধর্ষণ তার জন্মগত অধিকার। যাদের পেটে বিদ্যে আছে, ঘটে বুদ্ধি আছে — তারা এই মনোভাব গোপন করতে জানে, বাকিরা জানে না। ঠিক এই কারণেই আইন marital rape বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করে না, ধর্ষণের আইন অনুযায়ী অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীর সাথে যৌন সংসর্গ ধর্ষণ বলে গণ্য হলেও অপকম্মটি মেয়েটির স্বামী করলে ধর্ষণ বলে ধরে না। এই আমাদের প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য, যা সমস্ত নারীকেই মা বলে ভাবতে শেখায় আর পুরুষকে শেখায় যে কোন নারীকেই সে ইচ্ছে হলেই মা বানিয়ে দিতে পারে, দোষ নেই। ভাগ্যিস সায়েবরা এসে আমাদের পাশ্চাত্যের আদবকায়দা শিখিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিল, নইলে রামমোহন, বিদ্যাসাগরের লাশ পড়ে যেত তবু এদেশের মেয়েরা সতী হয়েই চলত, বালবিধবারা পাড়া প্রতিবেশীর সন্তানের মা হয়েই চলত। দেশের শিল্পোন্নত রাজ্যগুলো আবার এই পিছিয়ে পড়া বাংলার মত রামমোহন, বিদ্যাসাগর পায়নি কিনা তাই উনিশশো আশির দশকেও রূপ কানোয়ারকে সতী বানিয়েছে। শাহ বানোর নামটা মনে রাখা সোজা, এই মহিলার নামটা মনে পড়ে না সহজে।
নেহরু, আম্বেদকরদেরও বলিহারি। যে দেশ যা নয় তাকে তাই করে তোলার চেষ্টা! কতবড় সাহস! দেশের লোক গুরু ছাড়া বাঁচতে পারে না আর ওনারা বানাতে গেলেন সেকুলার দেশ। যত্তসব বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত মোগল আর সোনার চাঁদের দল। এতদিনে দেশটা ধর্মের পথে ফিরছে, গুরুদের হাতে ফিরছে
গুরুর ধর্ষণ মাপ
ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা হুতোম প্যাঁচার নকশায় দেখছি খোদ বাংলায় হিন্দু বাড়িতে মেয়ের বিয়ে হলে পরিবারের গুরু ফুলশয্যায় বসে থাকতেন। তিনি “প্রসাদ করে দিলে” তবে স্বামী-স্ত্রী মিলিত হতে পারত। হুতোম সকৌতুকে লিখেছেন কিভাবে এক পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত স্বামী খাটের তলায় লুকিয়ে থেকে যথাসময় বেরিয়ে এসে এক গুরুর মাথা ফাটিয়ে দেন, অতঃপর প্রাণভয়ে গুরুরা এই প্রসাদ করার অভ্যেস ত্যাগ করেন