আদিখ্যেতা নিপাত যাক

বাংলা ছবির পোস্টারে আজকাল আকছার ছবির নাম, পাত্রপাত্রীদের নাম লেখা হয় রোমান হরফে। ছবি দেখতে ঢুকেও দেখা যায় নাম দেখানো হচ্ছে রোমানে। এসব দেখে দর্শকের কিছু মনেও হয় না কারণ অনেক দর্শক, বিশেষ করে অল্পবয়সীরা, বাংলা অক্ষর পড়তেই পারেন না — এটাই তো বাস্তব। তাহলে আবার “আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই” উদ্ধৃত করার ন্যাকামি কেন?

বছরে দুটো দিন ভারতীয় বাঙালির বাংলা ভাষার প্রতি প্রেম উথলে ওঠে। যেসব হতভাগ্য শিশু উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনি আর নাককাটা রাজাকে চেনে না, সুকুমারের আশ্চর্য জগৎ থেকে বঞ্চিত তাদের বাবা-মায়েরাও ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ বিদীর্ণ করে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে নানা কথা লেখে। ভারতবর্ষের বাঙালি এভাবে কাকে ফাঁকি দিতে চায় বুঝি না।
বাংলা টিভি সিরিয়ালে গল্পের পরিস্থিতি অনুযায়ী হিন্দি ছবির গান বাজানো হয়, দীর্ঘদিন হল বাংলা ছায়াছবি তৈরি হচ্ছে তামিল, তেলুগু ছবির গল্প টুকে, বলিউডি নাচ গান সহযোগে। সেসব সিনেমা, সিরিয়াল যে কেউ দেখছে না তা-ও নয়। উনিশশো আশি নব্বইয়ের দশকে, নাহয় সিপিএমের দোষেই, চালু হয়েছিল ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে দৌড় প্রতিযোগিতা। সে স্কুল ভাল কি মন্দ দেখার দরকার নেই, নামটা কলকাতার কোন বিখ্যাত স্কুলের মত শোনালেই হল। এখন আবার নতুন প্রবণতা হয়েছে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষার জায়গা থেকেও সরিয়ে হিন্দীকে সেই জায়গাটা দেওয়া। সেটা না করে আর উপায় নেই কারণ বহুকাল হল কে কত শিক্ষিত তার প্রমাণ হিসাবে ধরা হয় তার গড়গড়িয়ে ইংরিজি বলতে পারার ক্ষমতাকে, ইদানীং আবার নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করতে গেলে কথার মধ্যে “ইয়ার”, “ঠিক হ্যায়,” “ক্যা বাত করতা হ্যায়” এসব বলা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। তা হোক। আপনি কেমন ভাষায় কথা বলবেন সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু তাহলে আবার একুশে ফেব্রুয়ারি বা পয়লা বৈশাখ নিয়ে গদগদ হওয়ার কী আছে?
বাংলা ছবির পোস্টারে আজকাল আকছার ছবির নাম, পাত্রপাত্রীদের নাম লেখা হয় রোমান হরফে। ছবি দেখতে ঢুকেও দেখা যায় নাম দেখানো হচ্ছে রোমানে। এসব দেখে দর্শকের কিছু মনেও হয় না কারণ অনেক দর্শক, বিশেষ করে অল্পবয়সীরা, বাংলা অক্ষর পড়তেই পারেন না — এটাই তো বাস্তব। তাহলে আবার “আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই” উদ্ধৃত করার ন্যাকামি কেন?
দেখুন তো, কিরকম পিছিয়ে পড়া মানসিকতা আমার! বাংলা বাংলা করতে গিয়ে এই বিশ্বায়নের যুগে বাঙালিরা পিছিয়ে পড়ুক আর কি। আমি একেবারে মৌলবাদী, তাই না?
মজার কথা হচ্ছে বাঙালি যখন বাংলার কদর করত তখন তারও সারা ভারতবর্ষে কদর ছিল। আর বাংলার কদর করার জন্যে বাঙালি কখনো অন্য ভাষার দোর বন্ধ করে দেয়নি। ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এবং সবচেয়ে ভাল ইংরিজি বাঙালিই শিখেছিল। কিন্তু তারজন্যে আমাদের পূর্বসুরিরা মাতৃভাষাকে বিসর্জন দেননি। সতীদাহ প্রথা রদের জন্য দিল্লীশ্বরের পক্ষ থেকে ইংল্যান্ডে বক্তৃতা দিতে যাওয়া রামমোহন রায় বহুভাষাবিদ ছিলেন, বাংলাতেও পন্ডিত। মাইকেল মধুসূদনের মত ইংরিজি পরবর্তীকালের কোন কনভেন্টশিক্ষিত বাঙালির আয়ত্ত হয়েছে কি?
বাংলা সাহিত্যও অন্য ভাষার সাহিত্যের রস টেনে স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছে শুরু থেকেই, সে বিদ্যাসাগরের দিকেই তাকান আর বুদ্ধদেব বসুর দিকেই তাকান। আমাদের সেরা কবিদের উপর ইংরিজি এবং ফরাসী কবিতার প্রভাব নিয়ে আস্ত বই লেখা যায়। এমনকি যে কবি “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি/ তাই পৃথিবীর রূপ আমি খুঁজিতে যাই না আর” লিখেছেন তিনিও সব দরজা বন্ধ করে বসেছিলেন না।
বাংলার রঙ্গমঞ্চও তো গিরীশ ঘোষ থেকে শুরু করে শম্ভু মিত্র হয়ে সুমন মুখোপাধ্যায় পর্যন্ত বিদেশী নাটকের থেকে যেমন নিয়েছে তেমন ফিরিয়েও দিয়েছে।
সুতরাং মাতৃভাষার চর্চা করার জন্য বাঙালির মৌলবাদী হওয়ার দরকার কখনো পড়েনি, পড়বেও না। বাঙালি কখনো ভাষা নিয়ে মৌলবাদী হয়নি বলেই ফাদার দ্যতিয়েন বলে এক দূরবিদেশী আজীবন বাংলার চর্চা করে গেলেন। বাংলা নাটকেরও তো পথ চলা শুরু রুশদেশের গেরাসিম লেবেদেফের হাত ধরে।
তবে আপনি বাংলার চর্চা করবেন কি করবেন না সেটা আপনার ব্যাপার। ইচ্ছে হলে আপনি, আপনার পরিবার খাঁটি সাহেব হয়ে উঠুন, কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বছরে দুদিন বাংলা ভাষার জন্যে কান্নাকাটি কোন পাপ স্খালনের জন্যে?

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading