হাসছি মোরা হাসছি দেখো: বীর দাসের বীরত্বে দুই ভারতের পর্দা ফাঁস

বীর দাস যে কথাগুলো সহজ ভাষায় বলেছেন, সেগুলো দেশের কোনো বিরোধী নেতা এখন পর্যন্ত বলেননি।

কিসে আমাদের হাসি পায়? এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমরা কারা — সে প্রশ্নের উত্তর। হাসি যে এভাবে মানুষ চেনায় তা ২০১৪ পরবর্তী ‘স্বাধীন’ ভারতে বাস না করলে বোধহয় বোঝা হত না। এখন হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক, টুইটারে অনবরত হাসির উপাদান আসে। চাইলেই এমন ব্যবস্থা করা সম্ভব যাতে সারাদিন মোবাইলে কেবল চুটকিই আসতে থাকবে। কদিন পরে গুগল যখন বুঝবে আপনি হাসবেন বলেই বাঁচেন, তখন আপনাকে খবর হিসাবেও নানারকম চুটকি, মিম আর হাস্যকর ভিডিও পাঠাতে থাকবে।

আমরা সবাই হাসছি, গোটা দেশ হাসছে। সবাই, সবকিছুই হাসির পাত্র। একজন নিরস্ত্র লোককে গুলি করে মেরে ফেলেছে পুলিস, এক উল্লসিত মানুষ লাফিয়ে উঠে তার বুকে লাথি মারছে। তেমন হোয়াটস্যাপ গ্রুপে থাকলে এ নিয়েও একাধিক চুটকি পড়তে পারবেন। একটা মিছিলের লোকেদের পিছন থেকে এসে পিষে দিয়ে চলে গেছে একটা গাড়ি। পিষে যাওয়া লোকগুলোকে নিয়েও কৌতুক করা সম্ভব। তাছাড়া মহিলারা কত বোকা তা নিয়ে, একইসঙ্গে তারা পুরুষদের কেমন দাঁতের উপর রাখে তা নিয়েও অজস্র কৌতুক বিতরণ হয় আজকাল। মুসলমানদের রক্ষণশীলতা, পুরুষদের দাড়ি আর মহিলাদের বোরখা নিয়েও দারুণ বুদ্ধিমান এবং প্রবল শিক্ষিত লোকেরা মাথা খাটিয়ে হাজার হাজার জোক ও মিম তৈরি করছেন। আজকাল হাসির প্রয়োজনীয়তা এত প্রবল, যে নাচগানের অনুষ্ঠানেও লোক না হাসালে টিআরপি পাওয়া যায় না। আর হাসাতে হলে যে জাতিবিদ্বেষপূর্ণ বিদ্রুপ করতেই হবে তা স্বতঃসিদ্ধ। কদিন আগেই নাচের অনুষ্ঠানের এক সঞ্চালক গৌহাটির এক শিশুশিল্পীকে দর্শকদের সামনে হাজির করেছেন “চাইনিজ”, “মোমো”, “চিং চং” বলে।১ এসব দেখেও আমাদের হাসি পায়। রসিকতাটাকে জাতিবিদ্বেষপূর্ণ বললে আরও বেশি হাসি পায়। কারণ জাতিবিদ্বেষও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত, যতক্ষণ না বিদ্বেষটা আমাদের জাতির প্রতি ধেয়ে আসে।

কিসে আমাদের হাসি পায় না? এর উত্তরও বলে দেবে আমরা কারা। পেট্রোল, ডিজেলের লাগামছাড়া দাম নিয়ে রসিকতা করলে আমাদের হাসি পায় না। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে রসিকতা করলে আমাদের হাসি পায় না। দেবদেবীদের নিয়ে, পৌরাণিক চরিত্রদের নিয়ে রসিকতা করলেও আমাদের হাসি পায় না। দেশের দোষত্রুটি, দুর্নীতি নিয়ে রসিকতা করলে আমাদের হাসি পায় না। শুধু হাসি পায় না তা-ই নয়, ওসব নিয়ে রসিকতা করলে আমরা বেজায় চটে যাই। চটে গিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা আর মনে থাকে না। তখুনি আমরা তেড়ে গাল পাড়ি, রসিকতা করা বিদূষক বা কার্টুনিস্টকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলি। আমাদের মধ্যে যারা উদ্যোগী, তারা এফ আই আর পর্যন্ত করি। কিন্তু এই আমরাই সব নই। আমাদের আরেক দল আছে।

এই আমাদেরও হাসি পায়। আমরা মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে হাসাহাসি করি। ভারত ১৯৪৭ সালে নয়, ২০১৪ সালে স্বাধীন হয়েছে শুনে হাসাহাসি করি। যারা এসব বলে তাদের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামীর সংখ্যা যে শূন্য, তা নিয়ে হাসাহাসি করি। প্রধানমন্ত্রীর দাড়ি আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভুঁড়ি নিয়ে রসিকতায় হাসি। আমরা লক্ষ্মণের শক্তিশেল পড়ে হাসি, যানে ভি দো ইয়ারোঁ ছবির শেষ দৃশ্য দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ি। আর কিসে আমাদের হাসি পায়? প্রধানমন্ত্রী সমেত দেশের সবচেয়ে দায়িত্বপূর্ণ লোকেদের কার্যকলাপ এবং অবলীলাক্রমে দিন কে রাত, রাতকে দিন করার ক্ষমতা দেখে হাসি পায়। পেঁয়াজের দাম এত বাড়ছে কেন জিজ্ঞেস করলে অর্থমন্ত্রী যখন বলেন “আমি পেঁয়াজ খাই না”, তখন আমাদের হাসি পায়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আলেকজান্ডারকে না হওয়া যুদ্ধে হারিয়েছিলেন শুনে আমাদের হাসি পায়। গুজরাটে পথের ধারে আমিষ খাবার বিক্রি করতে দেওয়া হবে না শুনেও হাসি পায়, কারণ আমরা নিরুপায়। আমরা কেবল হাসতে পারি, আর কিছুই করতে পারি না। মানুষ তো কেবল মজা পেয়ে হাসে না, চরম দুর্দশাতেও হাসে। আমাদের এখন সেই অবস্থা। দেশের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা যখন বলেন নাগরিক সমাজের সাথেও লড়তে হবে, তখনো আমাদের হাসি পায়। কিন্তু ভয়ে হেসে উঠতে পারি না। যখন দেশের সেনাবাহিনীর প্রধান গণপিটুনিকে বৈধ ঘোষণা করেন, তখনো হাসতে পারলে আমরা খুশি হতাম। কিন্তু সাহস হয় না, কারণ আমাদের গায়ে ‘দেশদ্রোহী’ ছাপ দিনরাত পড়ে। ‘সন্ত্রাসবাদী’ ছাপ পড়তে কতক্ষণ?

এই দুই আমরা — ভারতের বাসিন্দা। দুটো ভারত। এই দুটো ভারতের কথাই বিদূষক বীর দাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি সেন্টারে দাঁড়িয়ে হলভর্তি দর্শকের সামনে বলেছেন। বস্তুত, তিনি কোনো রসিকতা করেননি। কোনো চুটকি বলেননি। কেবল ভারতে ঘটে যাওয়া কতকগুলো ঘটনা পরপর আউড়ে গেছেন। তাতেই এক ভারত এফআইআর করে ফেলেছে, অন্য ভারত উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে। কারণ বীর দাস যে কথাগুলো সহজ ভাষায় বলেছেন, সেগুলো দেশের কোনো বিরোধী নেতা এখন পর্যন্ত বলেননি। প্রথিতযশা সাংবাদিকদের অধিকাংশ হয় মিথ্যে বলার শিল্পে দড় হয়ে উঠেছেন, নয় নিরপেক্ষতার অজুহাতকে ঢাল করে ফেলেছেন। এখনো সত্য খোঁজার, সত্য লেখার, সত্য দেখানোর সাহস যাঁদের আছে তাঁরা সিদ্দিক কাপ্পানের মত কারাগারে পচছেন। অবিনাশ ঝায়ের মত খুন হচ্ছেন। সমৃদ্ধি সকুনিয়া আর স্বর্ণা ঝায়ের মত আটক হচ্ছেন।

হয়ত বীরও কোনোদিন আটক হবেন অথবা তাঁর পেশার বারোটা বাজিয়ে দেওয়া হবে, যেমনটা মুনাওয়ার ফারুকির ক্ষেত্রে করা হল। হয়ত বীর, কুণাল কামরা, বরুণ গ্রোভাররা মুসলমান নন বলেই কিছুটা বেশি সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বীর বুঝিয়ে দিলেন তিনি কোন ভারতের সঙ্গে আছেন। তিনি সার্থকনামা।

আমাদের বাংলায় হবে সেই ছেলে কবে? এখানে আপাতত পদ্মলোচন নামের কানা ছেলেদের ছড়াছড়ি। কেবল অরাজনৈতিক, মোটা দাগের যৌন রসিকতার উদযাপন চলছে। যে দেশের সাংবাদিকরা বিকিয়ে যায় সে দেশ নিশ্চয়ই দুর্ভাগা, কিন্তু যে জাতির বিদূষকরা সুবিধাবাদী — তাদের দুর্দশা আরও বেশি। বাঙালি এখন সেই জাতি। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই হিন্দি বলয়ের অনেকের ভিডিও দেখা যায়, যাঁরা বীরদের মত বিখ্যাত না হলেও যোগী আদিত্যনাথের মত ভয়ঙ্কর লোককে নিয়েও রসিকতা করতে ভয় পান না। বাংলায় তেমন কেউ কই? ভাবলে অবাক লাগে, এই ভাষারই একজন কবি লিখেছিলেন সেই পংক্তিগুলো, যা বীরকে ভুল প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগা ভারতীয়দের মনের ভাব প্রকাশ করেছে নিখুঁতভাবে

অভয় দিচ্ছি, শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?

বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!

আমি আছি, গিন্নি আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে —

সবাই মিলে কামড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।

তথ্যসূত্র

১। https://www.republicworld.com/entertainment-news/television-news/kiren-rijiju-condemns-raghav-juyals-remarks-says-such-comments-harm-national-integrity.html

২। https://www.bignewsnetwork.com/news/271724114/journalist-killed-in-bihar-protest-erupts-in-madhubani

৩। https://www.ndtv.com/india-news/2-women-journalists-detained-after-they-accused-tripura-police-of-intimidation-granted-bail-2611637

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত