বড় দেশের দিন

আপনার যদি মনে হয় আমার ছেলে/মেয়ে ক্রিসমাস ক্যারল শিখে কেরেস্তান হয়ে যাবে, হলে সমূহ সর্বনাশ, তাহলে ঐসব স্কুলে পড়াবেন না। কে মাথার দিব্যি দিয়েছে পড়াতে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের দুবছর আর প্রাথমিক শিক্ষার বছরচারেক বাদ দিলে আমার গোটা ছাত্রজীবন কেটেছে গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

আমাদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন থেকে বেরিয়ে এসে নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একজন সন্ন্যাসী। সেই স্কুলে আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, তখন ছাত্রদের জন্য একটা আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল যার বিষয় ছিল ‘ধর্ম কি কুসংস্কার?’ বিতর্ক প্রতিযোগিতার মত এতেও পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল এবং প্রথম হয়েছিল ক্লাস সিক্সের একটি ছেলে, যার মূল বক্তব্য ছিল “হ্যাঁ, আচারসর্বস্ব ধর্ম অবশ্যই কুসংস্কার।”

আমাদের স্কুলে দুর্গাপুজো হত, একেবারে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে।

এই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পরে ভর্তি হলাম রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সদর দপ্তরের নাকের ডগায় থাকা কলেজে। সম্পূর্ণ আবাসিক কলেজ, যেখানে সকাল সন্ধ্যে হোস্টেলের ঠাকুরঘরে প্রার্থনায় বসতে হয়। যদিও ঠাকুরের আসনে তিনজন মানুষের ছবি আছে, তবু ব্যাপারটাকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে কোনভাবেই চালানো যায় না। কারণ প্রার্থনায় রামকৃষ্ণ, সারদা, বিবেকানন্দ ছাড়াও হিন্দু দেবদেবীর বন্দনা করা হয়। কিন্তু সেই প্রার্থনায় যাওয়া নিয়ে কোনদিন আমার সহপাঠী জাহির আর আমিনুলের মুখ ভার দেখিনি। স্পষ্টতই ওদের বাবা-মায়েদেরও এ নিয়ে কোন আপত্তি ছিল না। জাহির আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন হওয়ায় এ নিয়ে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। ও বলেছিল “আমার বাবা তো ঠাকুর দেবতা মানে না। তাছাড়া এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিসিপ্লিন, জেনেশুনেই তো এসেছি। আর আমি প্রার্থনায় বসে আমার ভগবানের কাছেও প্রার্থনা করতে পারি। কেউ তো আটকাচ্ছে না।” পরেও আমার সহপাঠী ইফতে খারুল, আসিফ, ইমরান, ইকবাল — এদের কাউকেই এ নিয়ে একটা শব্দও খরচ করতে দেখিনি, প্রার্থনায় যেতে ওদের কোনরকম আপত্তি আছে এমন মনে করবারও কোন কারণ ঘটেনি।

এত কথা বলবার কারণ বড়দিন পালন নিয়ে যে বদমাইশিটা শুরু হয়েছে সেইটা। বহু লেখাপড়া জানা হিন্দু, যাদের ধর্মপালন বছরে একবার বাড়িতে লক্ষ্মী, সরস্বতী বা কালীপুজো করায় সীমাবদ্ধ, পেটে বোম মারলেও এক লাইন শুদ্ধ সংস্কৃত বেরোবে না, তারাও গত কয়েকবছর ধরেই নিজেদের হিন্দু পরিচিতি সম্পর্কে দেখছি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সচেতন হয়ে উঠেছে। “আমি গর্বিত যে আমি হিন্দু” বলাটা বেশ একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে বছরসাতেক হল। ভাবখানা এমন যেন ওকে কেউ বলেছে “এ মা, তুই হিন্দু? ছ্যা ছ্যা ছ্যা! দূর হ! এবার থেকে তুই আমার বাড়ি এলে আলাদা থালা বাসনে খেতে দেব।” অথবা হিন্দু বলে ওকে ট্রেন থেকে মেরে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে অথবা নতুন জায়গায় গিয়ে বাড়িভাড়া পাচ্ছে না। মজার কথা, এরকম গর্বিত হিন্দুরা আবার লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ছেলেমেয়েকে খ্রীষ্টান মিশনারিদের স্কুলে ভর্তি করে। তাতে ক্ষতি নেই। বহুবছর ধরে ঐ স্কুল, কলেজগুলো এদেশে উচ্চমানের শিক্ষা দিয়ে আসছে, রামকৃষ্ণ মিশনের মতই। কিন্তু সমস্যা এই যে হিন্দু বাবা-মায়েদের এখন এক অদ্ভুত ধারণা হয়েছে “ওরা কায়দা করে নিজেদের ধর্ম প্রচার করছে।”

কি আশ্চর্য! এরা নাকি লেখাপড়া শিখেছে! আমার সন্তানকে আমি জেনেশুনে খ্রীষ্টান সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীদের পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করলাম, তা তাঁরা তো সেভাবেই শিক্ষা দেবেন যেভাবে দেওয়া ভাল বলে তাঁরা মনে করেন। ওঁরা তো ওঁদের স্কুল কলেজের নিয়মকানুন গোপনও করেন না কখনো। ডন বসকো, অ্যাসেম্বলি অফ গড চার্চ, লোরেটো বা সেন্ট জেভিয়ার্স তো আর হগওয়ার্টস নয় যে ভেতরে কী হচ্ছে বাইরের মাগল বাবা-মায়েরা জানতে পারে না। আপনার যদি মনে হয় আপনার ছেলে/মেয়ে ক্রিসমাস ক্যারল শিখে কেরেস্তান হয়ে যাবে, হলে সমূহ সর্বনাশ, তাহলে ঐসব স্কুলে পড়াবেন না। কে মাথার দিব্যি দিয়েছে পড়াতে? আজ অব্দি তো শুনলাম না লিলুয়ার কোন বাবা-মা পুলিশে ডায়রি করেছেন যে তাঁদের বাড়ির ছেলেকে ফাদাররা জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে ডন বসকোয় ভর্তি করেছে। বরং অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও সেখানে ভর্তি করতে পারলেন না বলে বিলাপ করতে শুনি বহু বাবা-মাকে।

তাহলে আর এস এস প্রোপাগান্ডায় এই নির্বোধের মত আত্মসমর্পণ করে কী প্রমাণ করছেন আপনি? নিজের হিন্দু পরিচিতি না উজবুক পরিচিতি?

স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে খ্রীষ্টান বানানোর প্রকল্প যদি মিশনারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর থাকত তাহলে কলকাতার সচ্ছল বাঙালিদের মধ্যে অ্যাদ্দিনে খ্রীষ্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যেত বোধহয়। নিজের ধর্ম নিজের বুকের মধ্যে রাখুন, মাথায় উঠতে দেবেন না। সবাই জমিয়ে কেক খান, বড়দিনে আনন্দ করুন। না করলে ক্ষতি আপনার। আমি নাস্তিক কিন্তু লক্ষ্মীপুজোর খিচুড়ি, ঈদের সেমাই, ছটের ঠেগুয়া বা ক্রিসমাসের কেক — কোনটাই ছাড়ি না। কেন ছাড়ব? এই যে নানা স্বাদ এটাই তো আমার দেশের মজা, এই মজা উপভোগ করার জন্যে মানুষ হওয়াই যথেষ্ট, বিশ্বাসী হওয়ার দরকার পড়ে না। আপনি যদি এর একটা খান, অন্যগুলো না খান সেটা আপনার ক্ষতি। সে তো লোকে প্যালারাম বাঁড়ুজ্জের মত আলু পটল আর সিঙিমাছের ঝোল খেয়েও বেঁচে থাকে। অমন বাঁচায় আনন্দ কই?