দিলীপবাবুর দান: জীবনানন্দ দাশ

তোমরা যে মোটা মোটা মানে বইগুলো পড়, ও দিয়ে যেন খবরদার জীবনানন্দকে পাকড়াও করতে যেয়ো না

jd

মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের কাছ থেকে ঠিক কী পাই আমরা? শিক্ষা বললে বোধহয় উত্তরটা দায়সারা হয়। কারণ শিক্ষা শুধু তাঁরাই দেন না। বাবা-মা দেন, আত্মীয়রা দেন, বন্ধুবান্ধবও নিজের অজান্তেই ভাল মন্দ নানারকম শিক্ষা দেয়। কিন্তু সেই সব শিক্ষাই যে আমাদের মনে থাকে এমন নয়। অথচ কোন মাস্টারমশাইয়ের কাছে শেখা কোন কোন জিনিস আমরা সারা জীবন ভুলতে পারি না। সত্যি কথা বলতে, দীর্ঘ কর্মজীবনের সব ছাত্রছাত্রীকে কোন মাস্টারমশাই বা দিদিমণিরই মনে থাকে না। অথচ এমন মানুষ পাওয়া বিরল যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁদের ক্লাস করতে হয়েছে তাঁদের কাউকে একেবারে ভুলে গেছে। এই বৈপরীত্যের কারণ শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক বলে মেনে নেওয়া যায় না। কারণ শিশু শ্রেণী থেকে শুরু করে লেখাপড়া শেষ করা অব্দি কম শিক্ষক, শিক্ষিকার ক্লাস করে না একজন মানুষ। অথচ অনেক বৃদ্ধকেও দেখেছি স্কুলের মাস্টারমশাইদের দিব্যি মনে রেখেছেন। আসলে সম্ভবত আমরা শিক্ষক শিক্ষিকাদের থেকে এমন অনেক জিজ্ঞাসা পাই যা সারা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে। তার কিছু ক্লাসঘরেই, কিছু হয়ত ক্লাসঘরের বাইরে। প্রমথ চৌধুরীর কথা যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে “সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই স্বশিক্ষিত।” অতএব শিখতে হয় নিজেকেই, কেউ শেখাতে পারে না। কিন্তু কী শিখব, কেন শিখব, কোনটা শিখলে আমার ভাল লাগবে — প্রিয় মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা বোধহয় সেটাই ধরিয়ে দেন। কেউ খুব ভাল পারেন কাজটা, কেউ আবার তত ভাল পারেন না। যাঁরা ভাল পারেন তাঁরাই বোধহয় বেশি করে মনে থেকে যান। আজ সকালের কাগজে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে পাতা জোড়া লেখা পড়তে পড়তে যেমন আমার মনে পড়ছিল সেই মাস্টারমশাইয়ের কথা, যিনি জীবনানন্দে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে আমাদের পাঠ্য ছিল এই কবিতাটা:

তোমার বুকের থেকে একদিন চ’লে যাবে তোমার সন্তান
বাংলার বুক ছেড়ে চ’লে যাবে, যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে,
আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে
ডুবে যায়, — কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে দিকে রূপশালী ধান
একদিন; — হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান,
আমারে কুড়ায়ে নেবে অন্ধকারে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে —
হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্ক্ষার — তবুও তো
চোখের উপরে
নীল মৃত্যু উজাগর — বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ —

কখন মরণ আসে কেবা জানে — কালীদহে কখন যে ঝড়
কমলের নাল ভাঙে — ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিখের প্রাণ
জানি নাকো;— তবু যেন মরি আমি এই মাঠ-ঘাটের ভিতর,
কৃষ্ণা যমুনার নয় — যেন এই গাঙুড়ের ঢেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখেমুখে — রূপসী বাংলা যেন বুকের উপর
জেগে থাকে; তারি নীচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।

আমাদের কবিতাটা পড়িয়েছিলেন দিলীপবাবু। তিনি গম্ভীর মানুষ। তাঁকে কখনো হা হা করে হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তাঁর হাসি স্মিত, তিনি রাগে ফেটে পড়তেন না, ফুটতেন। সর্বদা ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন। ফুল পাঞ্জাবীর হাতা কনুইয়ের উপর পর্যন্ত গোটানো থাকত। চোখে থাকত সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা, চুল উলটে আঁচড়ানো। দূরদর্শনের সাদাকালো আমলে তোলা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যে ভিডিও এখনো মাঝেসাঝে দেখানো হয়, অনেকটা সেইরকম চেহারা। স্যার অবশ্য অতটা ছিপছিপে ছিলেন না। একটা হাত মুড়ে বুকের কাছে ধরা পাঠ্য বই আর ডাস্টার, অন্য হাতে চক নিয়ে দিলীপবাবু ক্লাসে আসতেন।

জীবনানন্দের কবিতাটা যত দিন ধরে আমাদের পড়িয়েছিলেন, তত দিন ধরে সম্ভবত অন্য কোন লেখা পড়াননি। প্রথম দিনই বললেন “এবার তোমরা যে কবিতাটা পড়তে যাচ্ছ, এর তুল্য কিছু আগে কখনো পড়নি।”

বেয়াড়া প্রশ্ন করার মত ছাত্র কোনকালে কম ছিল না। একজন জিজ্ঞেস করল “স্যার, ট্রামের তলায় কোন মানুষ কী করে চাপা পড়ে?”

আমরা তটস্থ। ভেবেছি রাশভারী দিলীপবাবু ভয়ানক রেগে যাবেন। কিন্তু তিনি স্মিত হেসে বললেন “কোন মানুষ কী করে চাপা পড়ে জানি না বাবা। তবে ইনি জীবনানন্দ দাশ, যে কোন মানুষ নন। এঁকে কোন ছকে ধরা যায় না। তোমরা যে মোটা মোটা মানে বইগুলো পড়, ও দিয়ে যেন খবরদার জীবনানন্দকে পাকড়াও করতে যেয়ো না। কবিতাটা বারবার পড়। এমনিতে আমাদের যা অভ্যেস আর কি। মানে বই পড়ব, বইটা পড়ব না। সেটা এঁর ক্ষেত্রে করেছ কি মরেছ।”

কবিতাটা পড়াতে পড়াতে মাঝে মাঝে আমাদের মুখগুলো দেখতেন। কোন মুখে একটু আগ্রহের উদ্ভাস, কোন মুখ একেবারে অনাগ্রহী, কোন মুখ দুর্বোধ্যতায় হাবুডুবু — এসবই খেয়াল করতেন বোধ করি। পড়াতে পড়াতে একদিন “কৃষ্ণা যমুনার নয় — যেন এই গাঙুড়ের ঢেউয়ের আঘ্রাণ” পংক্তিতে পৌঁছেছেন। একজন প্রশ্ন করল “স্যার, ঢেউয়ের আবার গন্ধ হয় নাকি?”

“পুকুর বা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কোন গন্ধ পাওনি কখনো?”

ছেলেটি মাথা নেড়ে না বলায় দিলীপবাবু বড় অসহায়ের মত হাসলেন। তারপর বললেন “সত্যি। এ বড় অন্যায়। যাঁরা পাঠ্য ঠিক করেছেন তাঁদের বোধহয় এতখানি দাবী করা উচিৎ হয়নি তোমাদের কাছে। ক্লাসরুমে বসে কী করেই বা ঢেউয়ের গন্ধ বুঝবে তোমরা? তাছাড়া এত কিছু অনুভব করতে বলাও কি উচিৎ? অনুভব না করেই যখন পরীক্ষায় নম্বর পাওয়া যায়। তবে বাবা কবিতা তো পাঠকের একটু বেশি মনোযোগ দাবী করে। কবি তো আমার মত স্কুল মাস্টার নন যে তোমাকে বুঝিয়ে দেওয়া তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়বে। পাঠ্য হওয়ার জন্যে তো কবিতাটা লেখেননি কবি। দ্যাখো না একটু চেষ্টা করে, যদি ঢেউয়ের গন্ধটন্ধ পাও?”

আমাদের তখন দুর্বিনীত হওয়ার বয়স। আমি আর আমার এক বন্ধু তখন মনে করি আমাদের আশ্চর্য কাব্যপ্রতিভা আছে। আমরা দুজনেই তখন পাঠ্য কবিতার অক্ষম অনুকরণ দিয়ে কবিতার খাতা ভরিয়ে ফেলছি। অতএব যেদিন কবিতাটা পড়ানো শেষ হল এবং দিলীপবাবু বললেন কারো কোন প্রশ্ন থাকলে করতে, সেদিন আমার বন্ধুটি জিজ্ঞেস করল “স্যার, ভবিষ্যতে কোন কবি যদি জীবনানন্দের মত লিখতে পারে?”

দিলীপবাবু মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বললেন “সে হবার নয়। ইনি যে পথে হেঁটেছেন সে পথে বাংলা কবিতার ইতিহাসে আগেও কেউ হাঁটেননি, পরেও কেউ হাঁটেননি। যে হাঁটবে তার পরিণতি হবে জীবনানন্দের মতই। কত লোকে কত কথা বলেছে। কেউ বলেছে নৈরাশ্যবাদী কবি, কেউ বলেছে নির্জনতার কবি। এঁর মত হওয়া যায় না। আর হতে যাবেই বা কেন? নিজের মত হও।”

ক্লাসের শেষদিকে এসে বললেন “কবিতাটা তো পড়ালাম। কিন্তু বলে দিই, দেখা গেছে বোর্ডের পরীক্ষকরা জীবনানন্দের কবিতার প্রশ্নের উত্তরে নম্বর দেয়ার ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। অতএব যারা বেশি নম্বর পেতে চায় তারা জীবনানন্দকে ছোঁয় না। তোমরাও নির্ঘাত তাই করবে। তবে কেবল নম্বর পাওয়ার জন্যে কবিতা পড়া খুবই দুর্ভাগ্যের। জীবনানন্দ তোমাদের নম্বর পাইয়ে দিতে পারবেন না। তবে যদি একটু ভাল লাগিয়ে নিতে পার, তাহলে এমন অনেক কিছু পেতে পার যা আমারও জানা নেই।”

আরও পড়ুন শ্রদ্ধেয়

যেন রহস্যোপন্যাস। শেষে সাংঘাতিক কিছু আছে সেই আভাসটুকু দিলেন কিন্তু কী আছে বললেন না। ঐ খোঁচাটুকুই আমায় বাধ্য করল রূপসী বাংলা বইটার খোঁজ করতে। পরে আরো অন্যান্য। আজও যখন জীবনানন্দ পড়তে গিয়ে কোন পংক্তিতে আটকে যাই, দুর্বোধ্য মনে হয়, স্যারের কথাগুলো মনে করি। “কবি তো আমার মত স্কুল মাস্টার নন যে তোমাকে বুঝিয়ে দেওয়া তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়বে। পাঠ্য হওয়ার জন্যে তো কবিতাটা লেখেননি কবি। দ্যাখো না একটু চেষ্টা করে, যদি ঢেউয়ের গন্ধটন্ধ পাও।”

দিলীপবাবু আমায় জীবনানন্দ দিয়েছেন। তাঁর ক্লাসে আজও বসে আছি।

%d bloggers like this: