এই কথাটি মনে রেখো

মাত্র দুজনের কথা বলব, যাঁরা মুসলমানও নন আবার হিন্দুবিরোধী বলেও চিহ্নিত নন। কতটা ধর্মাচরণ করতেন জানি না, তবে জন্মসূত্রে হিন্দুই

সোশাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট খুব শেয়ার হচ্ছে। কিছু মৃত মানুষের ছবি। বলা হচ্ছে ভোট দেওয়ার সময় আমাদের মনে রাখবেন। সেই ছবিগুলোর মধ্যে যেমন আখলাক, পহলু, জুনেদ, আফরাজুলরা আছে তেমনি গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গিরাও আছেন। এঁরা হয় ইসলাম ধর্মাবলম্বী, নয় হিন্দুবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত।
আমি এত জনের কথা বলব না, মাত্র দুজনের কথা বলব, যাঁরা মুসলমানও নন আবার হিন্দুবিরোধী বলেও চিহ্নিত নন। কতটা ধর্মাচরণ করতেন জানি না, তবে জন্মসূত্রে হিন্দুই।
প্রথম জনের নাম সুবোধ কুমার সিং। উত্তরপ্রদেশের দাদরির আখলাক আহমেদের হত্যার তদন্ত করে চার্জশিট দাখিলকারী এই পুলিশ অফিসার গত তেসরা ডিসেম্বর বুলন্দশহরে তথাকথিত গোরক্ষকদের হাত থেকে আরো কিছু মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বিফল হন এবং গণপিটুনিতে প্রাণ হারান।
দ্বিতীয় জন হেমন্ত করকরে। মহারাষ্ট্র পুলিশের সন্ত্রাসবাদদমন শাখার প্রধান ছিলেন এক সময়। মালেগাঁও বিস্ফোরণের তদন্তকারী অফিসার হিসাবে হিন্দু সন্ন্যাসিনী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করেন। কান টানলে মাথা আসার মত তার ফলে আস্ত একটি সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। সেই নেটওয়ার্কে অনেকের সঙ্গে বাঙালি গেরুয়াধারী অসীমানন্দ আর সেনাবাহিনীর লোক লেফটেন্যান্ট কর্নেল পুরোহিতও ছিলেন (গত কয়েক দিনে আপনি হোয়াটস্যাপ বা ফেসবুকে যা-ই পড়ে থাকুন না কেন, ঘটনা হল সেই কেসে আজ অব্দি প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর নির্দোষ বলে ঘোষিত হয়নি। সে শারীরিক অসুস্থতার কারণে আপাতত মুক্ত)। ইতিমধ্যে ২৬শে নভেম্বর ২০০৮ মুম্বাইতে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয়। হেমন্ত সেই আক্রমণের মোকাবিলা করতে গিয়ে নিহত হন।
শহীদের সংজ্ঞা কী? যিনি দেশের প্রতি নিজের কর্তব্য পালন করতে গিয়ে প্রাণ হারান তিনি কি শহীদ? যদি তাই হয় তাহলে সুবোধ এবং হেমন্ত দুজনেই শহীদ। পুলওয়ামায় নিজেদের অজ্ঞাতে ৩৫০ কিলোগ্রাম আর ডি এক্স বিস্ফোরণে যে জওয়ানরা প্রাণ হারালেন তাঁরা যদি শহীদ হন, সজ্ঞানে নিজের জীবন বাজি রেখে কর্তব্য করতে গিয়ে নিহত এই দুই পুলিশকর্মীও শহীদ।
গত পাঁচ বছরে সরকারের সমালোচক, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে মুখ খোলা নাগরিকদের চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্যে দেশের সর্বোচ্চ নেতা নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল নিউজ অ্যাঙ্কর পর্যন্ত সকলে চিৎকার করেছেন “সিয়াচেনে আমাদের জওয়ানরা লড়ছে, আর তোরা…”। অর্থাৎ জওয়ানদের, শহীদদের সম্মানার্থে মুখ বুজে সমস্ত সরকারী অপদার্থতা এবং অন্যায় মেনে নিতে হবে। তাই বলছি, এবার ভোট দিতে যাওয়ার সময় আর কিছু না হোক, অন্তত মনে রাখুন ক্ষমতাসীনরা সুবোধ আর হেমন্ত — এই দুই শহীদের প্রতি, জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরে, কিরকম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন।
গত দোসরা মার্চ সুবোধের হত্যার ঘটনায় চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ, বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের পুলিশ। যে ৩৮ জনের নামে চার্জশিট দাখিল হয়েছে তাদের মধ্যে সঙ্ঘ পরিবার সগৌরবে বর্তমান। বজরং দল তো বটেই, বিজেপির যুব নেতারও নাম আছে। আর সবে গতকাল, জামিনে জেলের বাইরে থাকা মালেগাঁও বিস্ফোরণে অভিযুক্ত প্রজ্ঞা বলেছেন হেমন্ত তাঁর অভিশাপেই নিহত হয়েছেন।
হে মোর দুর্ভাগা দেশ, এই সেদিন আমরা অ্যান্টি ন্যাশনাল তকমা পেলাম জাতীয়তাবাদীদের থেকে। কারণ আমরা প্রশ্ন তুলছিলাম শহীদদের শহীদ হতে হল কেন। আর আজ নিজের কাজ করতে গিয়ে শহীদ হওয়া পুলিশ অফিসারকে অবলীলায় “রাবণ” বলতে পারল সাংসদ পদপ্রার্থী, বলতে পারল “আমার অভিশাপেই লোকটা মরেছে।” শুধু বলল নয়, বলে সমর্থনও পেয়ে গেল। তাকে কোন অ্যাঙ্কর দেশদ্রোহী বললেন না, দেশের সবচেয়ে বড় জাতীয়তাবাদী দল বলল “ওটা ওনার ব্যক্তিগত মতামত।” প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বললেন না যে এ একজন শহীদকে অপমান করেছে।
সাধারণ মানুষের মধ্যেও মহিলা বিলক্ষণ সহানুভূতি কুড়িয়েছে টিভি ক্যামেরার সামনে কান্নাকাটি করে, হেমন্ত তার সাথে কত দুর্ব্যবহার করেছেন সেকথা বলে। কেউ কেউ বলছেন “পুলিশের লোকেদের কখনো বিশ্বাস করা যায় না। ওরা ভীষণ নৃশংস।” স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন একজন মহিলাকে, একজন সাধ্বীকে পুলিশ অত্যাচার করেছিল, তখন কেউ কিছু বলেনি কেন? মজার কথা সোনি সোরির যৌনাঙ্গে পাথর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল শুনে এই মহা সংবেদনশীল ব্যক্তিরা কখনো “আহা” বলেন না। অথচ সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্ত মহিলাকে তদন্তকারী অফিসারের রসগোল্লা খাওয়ানো উচিৎ ছিল বলে মনে করছেন। একবার গুগল করলেই দেখতে পাবেন সারা ভারতবর্ষে তেমন সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে প্রতিনিয়ত কত মুসলমান যুবককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের দিয়ে অপরাধ স্বীকার করিয়ে নেওয়ার জন্যে কি অকথ্য অত্যাচার করা হয়। মজার কথা, তৎসত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কোন অপরাধ না করেও মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারান্তরালে কাটিয়ে ভাঙাচোরা মানুষগুলো বেকসুর খালাস পায়। সেখানে এই মহিলার বাইকখানা যে সরাসরি বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হয়েছিল, সেকথা আজ অব্দি অপ্রমাণিত হয়নি। হেমন্তের প্রভাবমুক্ত এন আই এ দ্বারা নবলিখিত চার্জশিটেও বলা হয়েছে বাইকটা ওঁর হলেও উনি ব্যবহার করছিলেন না দু বছর যাবৎ।
অনেকে আবার দেখছি বোম ফাটিয়ে মানুষ মেরেছে বেশ করেছে, দেশ ভাগের সময়ে যে মুসলমানরা মানুষ মেরেছিল তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। এটা ওদের মতাদর্শ। ওরা নিজেদের জায়গায় ঠিক। এইসব কথাবার্তা বলছেন। চমৎকার যুক্তি সন্দেহ নেই। এই যুক্তি অনুযায়ী আই এস, আল কায়দা, জৈশ ই মহম্মদ, হাফিজ সঈদের জামাত উদ দাওয়া — সকলেই নিজেদের জায়গায় ঠিক। দুনিয়া জুড়ে ইসলামিক রাষ্ট্র হওয়া উচিৎ, কাফেরদের হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি করা উচিৎ — এগুলো তাদের মতাদর্শ।
মানতে রাজি তো? ভেবে দেখুন। মনে রাখুন। মানুষ যখন বধির হয়ে যায়, জীবিতদের কণ্ঠ শুনতে পায় না, তখন মৃতদের কণ্ঠের উপরেই নির্ভর করতে হয়। কারণ মৃত মানুষ মিথ্যে বলে না।

বিঃ দ্রঃ খারাপ কথা বলে দিয়ে পরে দুঃখপ্রকাশ করার কৌশলটা বহু ব্যবহারে জীর্ণ। যাঁরা ঠিক ঐ কথাটাই শুনতে চেয়েছিলেন তাঁরাও বোঝেন বক্তা আসলে মোটেই দুঃখিত নন। অতএব যাঁরা মনে করেন বলা উচিৎ হয়নি, তাঁদেরই বা দুঃখপ্রকাশকে পাত্তা দেওয়ার কী আছে?

আমার সন্ততি

ভেবে দেখলাম যে অক্ষয় ধন আমার সন্তানকে দিয়ে যেতে পারি তা হল সমাজ, সংসারের সঙ্গে, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের বোধ

ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

— শঙ্খ ঘোষ (বাবরের প্রার্থনা)

যেদিন বাবা হয়েছি সেদিন থেকে ভেবে চলেছি, মানুষ পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার সময় সন্তানকে যা যা দিয়ে যেতে পারে তার মধ্যে কোনটা সবচেয়ে মূল্যবান?
অনেকে টাকাপয়সা, ধনসম্পদ দিয়ে যান। টাকার দাম মুদ্রাস্ফীতির কারণে দিন দিন কমে, সম্পত্তির মূল্যও নানা কারণে বাড়ে কমে। কথায় বলে কুবেরের ধনও ফুরিয়ে যায়। ফলে সন্তানকে যত ধনসম্পত্তিই দিয়ে যান না কেন, তার মূল্য অবিকৃত থাকবে না।
সফল, কৃতি মানুষেরা তাঁদের সন্তানদের খ্যাতি দিয়ে যান। কিন্তু সেই খ্যাতি বজায় রাখতে হলে সন্তানকেও বিখ্যাত বাবা কি মায়ের মত প্রতিভাবান এবং সফল হতে হয়, যা প্রায়শই হয় না। উপরন্তু বাবা-মায়ের খ্যাতির অপব্যবহার করে সন্তান তাঁদের দুর্নামের কারণ হচ্ছে — এমন দৃষ্টান্তই চোখে পড়ে বেশি। উপেন্দ্রকিশোরের পরে সুকুমার, সুকুমারের পর সত্যজিৎ নেহাতই ব্যতিক্রম। সে জন্যেই মনে থাকে। ঈশ্বরচন্দ্রের পরে নারায়ণচন্দ্রই বরং বেশি দেখা যায়।
আমরা সাধারণ মানুষ। এ যুগে সন্তানের ভোগ করার মত যথেষ্ট সম্পত্তি রেখে যাওয়ার সুযোগ আমাদের অনেকেরই হবে না। মৃত্যুর পরেও সন্তান “অমুকের ছেলে” বা “তমুকের মেয়ে” হিসাবে সমাজে অতিরিক্ত সম্মান, সুযোগসুবিধা বা খ্যাতি ভোগ করবে তেমন সম্ভাবনাও নেই। তবে কি এমন কিছুই নেই যা আমাদের মৃত্যুর পরেও সন্তানদের সম্পদ না হোক, অন্তত ছাতা হিসাবে কাজ করতে পারে? আমার সন্তানের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সীমা তবে আমার শরীর? সেই শরীর অবলুপ্ত হওয়ার পর আমার সাথে সম্পর্কের কোন মূল্যবান অর্জন তার কাছে থাকবে না? তাহলে কেন দেশ কাল নির্বিশেষে বাবা-মায়েরা নিজের জীবনের চেয়েও সন্তানের মঙ্গলকে ঊর্ধ্বে স্থান দেন? আমাদের অষ্টাদশ শতকের কবির কেন মনে হল ঈশ্বরীর দেখা পেলে বাংলার নিরক্ষর পাটনী প্রার্থনা করবে “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”? প্রায় তিনশো বছর পরের কবির কেন মনে হল ভাগ্যান্বেষী উজবেক যোদ্ধা বাবর, যার সাথে সেই বাঙালি পাটনীর কোন দিক থেকে কোন মিল নেই, তিনিও নিজের ঈশ্বরের কাছে বলতেন, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও আমার সন্তানের জীবন দাও? কবির কল্পনা তো আকাশ থেকে পড়েনি, এমনই আকুতি বিভিন্ন ভাষায় কত বাবা-মাকে তো আজও উচ্চারণ করতে দেখি আমরা। সেই বাবা মায়েরা তাহলে জীবন ফুরোলেই ফুরিয়ে যাবেন সন্তানের কাছেও?
কেউ কেউ বলবেন বাবা-মা শিক্ষা দেন, জীবনে নিজের পায়ে দাঁড় করান। সেটাই তো সারাজীবন সঙ্গে থাকে। সেকথা ঠিক, কিন্তু সে অবদান বাবা-মায়ের অনন্য অবদান নয়। মানুষ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের থেকেও শিক্ষা পায়, সর্বোপরি শিক্ষক শিক্ষিকাদের থেকে পায়। এবং যে শিক্ষা সে পায় তার বেশিরভাগটাই স্বোপার্জিত। বাবা-মা বড় জোর সুযোগ তৈরি করে দেন।
ভেবে দেখলাম যে অক্ষয় ধন আমার সন্তানকে দিয়ে যেতে পারি তা হল সমাজ, সংসারের সঙ্গে, সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের বোধ। সুসময়ে, এবং দারুণ দুঃসময়ে, সেই বোধ তাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের প্রত্যেককে আমাদের বাবা-মায়েরাও জেনে বা না জেনে ঐ বোধই দিয়ে গেছেন, দিয়ে যাচ্ছেন। ইতিহাসের কোন মুহূর্তে ঠিক কোন জায়গাটায় আমি দাঁড়িয়ে আছি এবং তার সাপেক্ষে বর্তমানে আর ভবিষ্যতে আমার কোথায় দাঁড়ানো উচিৎ সেই বোধ সচেতন বাবা-মায়েরা আমাদের দিয়ে যান জেনে বুঝে। আর যে বাবা-মায়েরা তত সচেতন নন আসলে তাঁরাও স্থান নির্দেশ করে দিয়ে যান তাঁদের কথাবার্তায়, জীবনচর্যায়।
কথাটা নতুন করে উপলব্ধি করলাম টিভিতে তথাকথিত গোরক্ষকদের হাতে নিহত পুলিশকর্মী সুবোধ কুমার সিং এর ছেলে অভিষেকের কথা শুনতে শুনতে।
সুবোধ কুমার খুন হওয়ার পর যত সময় যাচ্ছে তত পরিষ্কার হচ্ছে যে খুন হওয়ার দিনের ঘটনাবলী সুপরিকল্পিত, হঠাৎ উত্তেজিত জনতা তাঁকে হত্যা করেনি। তিনি সাম্প্রতিক অতীতে গোহত্যার “অপরাধে” প্রথম যে খুনটা হয়েছিল দাদরিতে, সেই খুনের তদন্তকারী অফিসার ছিলেন। সেই খুনের অপরাধীদের হাজতবাস করার পেছনে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল। বদলি হয়ে বুলন্দশহরে এসে পড়ার পরেও আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে আপোষ না করে তিনি হিন্দুত্ববাদীদের যথেষ্ট বিরাগভাজন হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী বলেছেন সুবোধ কুমারকে প্রায়শই খুনের হুমকি দেওয়া হত। খবরে প্রকাশ বিজেপি নেতারা বুলন্দশহর থেকে তাঁর বদলি দাবী করেছিলেন অতি সম্প্রতি। বিপদের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন জেনেও সুবোধ কুমার ঘটনার দিন পুলিশ ইন্সপেক্টর হিসাবে যা কর্তব্য ঠিক তাই করছিলেন। কোন সাহস তাঁকে প্রণোদিত করেছিল তা বলার জন্যে তিনি নেই, তা দেশ হিসাবে আমাদের ব্যর্থতা। কিন্তু বাবা হিসাবে তাঁর সাফল্য এই অন্ধকারে আমাদের ক্ষীণ আলো দেখাচ্ছে।
সকালের কাগজে মুন্ডিতমস্তক যে ছেলেদুটির ছবি কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বসা আমাকে ক্ষিপ্ত করে তুলছিল, সেই বাবা হারা কিশোর যখন টিভির পর্দায় বলে “শুধু মুখ্যমন্ত্রীকে নয়, সারা ভারতের লোকের কাছে আমার আবেদন, হিন্দু মুসলমান নিয়ে দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হিংসা দয়া করে বন্ধ করুন,” তখন বোঝা যায় সুবোধকুমার ছেলেটির সঙ্গেই আছেন।
আরো পরিষ্কার হয় যখন অভিষেক বলেন “আমার বাবা একটা কথাই বলতেন ‘আর কিছু হতে পার না পার, সুনাগরিক হও। সব ধর্ম, সব জাতির লোকই এক। তুমি কারো চেয়ে বড় নও, কারো চেয়ে ছোটও নও।”
বাবা খুন হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে এই ভাষায় এই কথাগুলো বলতে পারা মুখস্থ বিদ্যায় সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী যে বিদ্যার বলে মধ্যে মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর বন্দনা করেন সে বিদ্যার কর্ম নয় এসব। অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে শুধু ক্রিয়া, বিশেষণের জোরে এসব কথা বেরোয় না। অভিষেক যখন আমাদের সবাইকে সাবধান করেন এই বলে যে আমরা আত্মহননের পথে এগোচ্ছি; পাকিস্তান, চীনের দরকার নেই, আমরাই একে অপরের অনেক বড় শত্রু হয়ে উঠছি; তখন বোঝা যায় অভিষেকের প্রয়াত বাবা, এবং অবশ্যই মা, এই যুগসন্ধিক্ষণে তার যে স্থান নির্দেশ করেছেন সে সেই স্থানের যোগ্য হয়ে উঠছে। এইখানে মৃত সুবোধ কুমারের জিত, হত্যাকারীদের হার। হত্যাকারীদের সরকার তাঁর নামে রাস্তার নামকরণ করুক আর না-ই করুক, সুবোধ কুমার সন্তানের মধ্যে বেঁচে রইলেন। আমাদেরও বাঁচার রাস্তার সন্ধান দিলেন।
এত কথা বলার পরে একটা প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। সন্তান কি সবসময় বাবা-মায়ের দেখানো অবস্থান মেনে নেয়? নেয় না। প্রকৃতপক্ষে সর্বদা মেনে নেওয়া উচিৎও নয়। কারণ অনেক বাবা-মা এমন অবস্থানও ঠিক করেন যা সমাজের পক্ষে, সন্তানের চারপাশের মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, পশ্চাৎমুখী। সেইসব বাবা-মায়েদের অবাধ্য সন্তানেরাই যুগে যুগে সমাজকে বদলে দেন, এগিয়ে নিয়ে যান। সেই জন্যেই আমাদেরও বারবার ভাবতে হবে সন্তানকে ঠিক কোথায় দাঁড়াতে বলছি। কার পক্ষে, কার বিপক্ষে? তাকে যে অবস্থান নিতে শেখাচ্ছি তা শুধু তার জন্যে ভাল, না আর পাঁচজনের জন্যেও ভাল — সেকথাও ভাবতে হবে। এমনি এমনি তো আর ঠাকুমা, দিদিমারা বলতেন না “প্রসব করলেই হয় না মাতা।”

%d bloggers like this: