কোরোকোরো কোমিক্কু কমিক্স এবং বিশ্বকাপে এশিয়া

আইএসএলের কথা ভেবে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করছে? জাপান কিন্তু স্রেফ জে-লিগ চালু করে ক্ষান্ত হয়নি। গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া তাদের স্বভাব নয়। জাপানে স্কুল ফুটবলকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়।

“চীন, ব্রহ্মদেশ, অসভ্য জাপান,/তারাও স্বাধীন, তারাও প্রধান” কিন্তু ভারত ঘুমিয়ে আছে – এমন বিলাপ করেছিলেন কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সে শ দেড়েক বছর আগেকার কথা। আজকের বাঙালি চীন, জাপানকে অসভ্য দেশ ভাবার ভুল করে না। কিন্তু চারবারের বিশ্বকাপ জয়ী জার্মানিকে জাপান এক গোলে পিছিয়ে পড়েও হারিয়ে দিল দেখে ভারতের ঘুমিয়ে থাকা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস যে পড়ে না – এমন কথা হলফ করে বলা যায় না।

অবশ্য এবারের বিশ্বকাপ যেভাবে আরম্ভ হয়েছে, তাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করলে আর থামা শক্ত হবে। আয়োজক কাতার বাদে এশিয়া মহাদেশের সব দেশই রীতিমত সাড়া জাগিয়ে শুরু করেছে। শুক্রবার রাতে নেদারল্যান্ডস আর ইকুয়েডরের খেলা ড্র হওয়া মাত্রই কাতারের বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। কিন্তু তার কিছুক্ষণ আগেই বিশ্বখ্যাত গ্যারেথ বেলের ওয়েলসের বিরুদ্ধে রোমহর্ষক জয় হাসিল করেছে ইরান।

ইরান কিন্তু প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আধ ডজন গোল হজম করেছিল। খেলা নয়, প্রশংসিত হয়েছিল ইরান দলের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে অস্বীকার করা। মাহসা আমীনীর রাষ্ট্রীয় হত্যার পর ইরান এখন আন্দোলনে উত্তাল। কেবল মহিলারা নন, বহু পুরুষও গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ইরান যখন একের পর এক গোল খাচ্ছিল গ্যারেথ সাউথগেটের দলের কাছে, তখন বহু শহরে উল্লাসে ফেটে পড়ছিলেন মানুষ। কারণ জাতীয় দল, স্বভাবতই, তাঁদের কাছে দেশের সরকারের প্রতীক। তৎসত্ত্বেও ম্যাচের পর ইরান অধিনায়ক এহসান হজসফি জানান, তাঁরা সরকার নয়, দেশের মানুষেরই পাশে আছেন। এই দুঃসাহসের কী ফল হজসফি ও তাঁর সতীর্থরা পরিবার সমেত ভোগ করবেন তা দেশে ফিরলে হয়ত টের পাওয়া যাবে। বলা বাহুল্য, ইরান সরকার পিঠ চাপড়ে দেওয়ার জন্য বসে নেই।

ইতিমধ্যেই খানিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে নিশ্চয়ই, ফলে ওয়েলসের বিরুদ্ধে ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মিলিয়েছেন হজসফিরা। কিন্তু সেসব চাপ সামলেও ‘খেলতে পারে না, শুধু প্রতিবাদ করতে পারে’ এই বিদ্রূপ কড়ায় গণ্ডায় চুকিয়ে দিয়ে নব্বই মিনিট আপ্রাণ লড়াই করার পর শেষ মুহূর্তে দুটো গোল দিয়ে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। ইংল্যান্ড বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হওয়ায় ইরানের সামনে এখনো পরের রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ২০১৪ আর ২০১৮ বিশ্বকাপেও যথাক্রমে আর্জেন্টিনা এবং স্পেনের মত দলের সঙ্গে জোরদার লড়াই করেছিল তারা, হেরেছিল ১-০ গোলে। সুতরাং এবার দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছলে তা হবে দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল।

ইতালিয়া ৯০-এর ক্যামেরুন থেকে শুরু হয়েছিল আফ্রিকার দলগুলোর বিশ্বকাপ মাতিয়ে দেওয়া খেলা। কোনোবার নাইজেরিয়া, কোনোবার সেনেগাল চমকে দিয়েছে। ২০১০ বিশ্বকাপে শেষ মুহূর্তে লুই সুয়ারেজ হাত দিয়ে গোল আটকে না দিলে হয়ত প্রথম আফ্রিকান দল হিসাবে ঘানা সেমিফাইনালেও পৌঁছে যেত। সেই আফ্রিকা এবারে এখনো নিষ্প্রভ, বরং এশিয়া চমকে দিচ্ছে।

এমনিতে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপে এশিয়ার সবচেয়ে ধারাবাহিক দল। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন আর জার্মানি ছাড়া তারাই একমাত্র দল যারা গত দশটা বিশ্বকাপেই খেলেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। একমাত্র ২০০২ সালে ঘরের মাঠে সেমিফাইনালে পৌঁছনো ছাড়া তাদের বলার মত কোনো সাফল্য নেই। এবারে যথেষ্ট শক্তিশালী উরুগুয়ের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র দিয়ে শুরু করা আশাব্যঞ্জক। যদিও গ্রুপ এইচ বেশ কঠিন।

কোচ হার্ভে রেনার্ড ছাড়া সৌদি আরব আর সকলকেই চমকে দিয়েছে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে। চমক আরও বাকি আছে কিনা সময় বলবে, তবে সৌদির সাফল্যে তাদের কোচের অবদান কিন্তু অনেকখানি। রেনার্ড কোনো কুলীন ইউরোপিয় ক্লাবের কোচ ছিলেন না কখনো, কিন্তু আফ্রিকা, এশিয়ার খেলোয়াড়দের মনমেজাজ, শক্তি-দুর্বলতা তাঁর নখদর্পনে। জাম্বিয়া আর আইভরি কোস্টকে আফ্রিকা কাপ অফ নেশনস খেতাব জিতিয়েছিলেন। সে কারণেই তৈল ধনে ধনী সৌদি কর্তারা তাঁকে জাতীয় দলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

জাপানের চমক কিন্তু এক ম্যাচে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তাদের এই সাফল্যের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে তৎকালীন লিগের খোলনলচে বদলে ফেলে জে-লিগ চালু করার মাধ্যমে। বয়স্ক বাঙালি ফুটবলপ্রেমীদের বিলক্ষণ মনে আছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ব্রাজিলিয় ট্র‍্যাজিক নায়ক জিকোর জাপানের লিগে খেলতে আসার কথা। আরও বহু ফুটবলোন্নত দেশের তারকাই সেসময় জাপানে খেলতে আসেন। তবু জাপান এশিয় ফুটবলে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠলেও বিশ্ব স্তরে তেমন ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি তখনই। আজকের অবস্থায় পৌঁছতে সময় লেগেছে।

আইএসএলের কথা ভেবে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করছে? জাপান কিন্তু স্রেফ জে-লিগ চালু করে ক্ষান্ত হয়নি। গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া তাদের স্বভাব নয়। জাপানে স্কুল ফুটবলকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশু বয়স থেকে শুরু হয় স্কাউটিং। ‘নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ কাগজের এক প্রতিবেদন বলছে, জাপানি শিশুদের মধ্যে ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ ৩৫ বছর ধরে করে চলেছেন টম বায়ার বলে এক আমেরিকান। আটের দশকে অবসর নেওয়ার পর তিনি জাপানেরই বাসিন্দা হয়ে যান। ছোটদের জন্য একগুচ্ছ ফুটবল স্কুল খোলেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। আরও মজার কথা, সে যুগে ছোটদের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় কমিক্সে ‘কোরোকোরো কোমিক্কু’-তে ফুটবল শেখার কায়দাকানুন শিশুপাঠ্য করে লিখতে থাকেন। সেদিন জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে দিল যে জাপান দল, তাদের তিনজন ফুটবলার – মিনামিনো, দোয়ান আর এন্দো – বায়ারের সেই স্কুলগুলোর ছাত্র ছিলেন।

আরও পড়ুন জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত

এত কাঠখড় পুড়িয়ে জাপানি ফুটবল এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে বিশ্বকাপের ২৬ জনের দলের সাতজন খেলেন বুন্দেশলিগায় আর একজন জার্মানির দ্বিতীয় ধাপের লিগে। এঁদের মধ্যে জার্মান লিগে সবচেয়ে বেশি সমীহ করা হয় মাঝমাঠের খেলোয়াড় দাইচি কামাদাকে। তিনি খেলেন এইন্ট্রাখট ফ্র‍্যাঙ্কফুর্টে। জার্মানির বিখ্যাত ক্লাব ভিএফবি স্টুটগার্টের স্কাউটরা কদিন আগেই জাপানের শোশি হাইস্কুলের ছাত্র আনরি চেইসুকে সই করিয়েছে। সে ইতিমধ্যেই জাপানের অনূর্ধ্ব-১৭ ও ২৩ দলে খেলে ফেলেছে।

অর্থাৎ জাপান ফুটবলে সূর্যোদয় সবে শুরু হয়েছে। চলতি বিশ্বকাপেই তারা সাফল্যে দক্ষিণ কোরিয়াকে টপকে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবার বাকি তিনটে ম্যাচে তেমন কিছু করতে না পারলেও আগামীদিনে বিশ্ব ফুটবলে সমীহ করার মত এশিয় শক্তি হয়ে ওঠার পথে তারাই সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত