শাহীনবাগ: কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে…

ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে। দুটিই একই গোত্রের বাক্য – এমন ধারণা নিয়েই আমরা বুড়োধাড়ি হয়ে উঠেছিলাম। আমরা, মানে যাদের জন্ম স্বাধীনতার অনেক পরে। সূর্যের পূর্ব দিকে ওঠা নিয়ে যেমন আলোচনা করার কিছু নেই, তেমন ধর্মনিরপেক্ষতাও কোনো আলোচ্য বিষয় নয় – এমনটাই আমরা শিখেছিলাম। ধর্মনিরপেক্ষতা যে চর্চা করার জিনিস, তা ভাবিনি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধূলিসাৎ হওয়ার পরেও সমাজ, রাষ্ট্র বা বিদ্যায়তন এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেনি। অমুক অমুক রাজ্যে দাঙ্গা হয়, আমাদের রাজ্যে হয় না – এই তথ্যটুকুতেই আমাদের প্রয়োজন মিটে গিয়েছিল। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায় যারা, তারা যে একদিনের জন্যও নিজেদের মতাদর্শের চর্চা বন্ধ করেনি বাবরি ধ্বংস তার প্রথম প্রমাণ। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতেই ভারতের নাগরিকত্ব আইন বদলে ফেলা সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চার অভাবকে নরেন্দ্র মোদী সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মত করে ভরা বাজারে উলঙ্গ করে দিতে পারেনি আর কিছুই। ২০১৯ সালে যখন ওই আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হল, তখন প্রথমবার ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা, তার ভালমন্দ নিয়ে খোলাখুলি বিতর্ক শুরু হল। সরকারের উদ্দেশ্য তা ছিল না। কিন্তু এত বড় দেশের সব মানুষকে নিজের মর্জি মত চালাতে মহম্মদ বিন তুঘলক বা ঔরঙ্গজেবই পারেননি, মোদী কোন ছার। দিল্লির শাহীনবাগে পথে বসে পড়লেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, দেশের আরও নানা জায়গায় তৈরি হল অনুরূপ শাহীনবাগ। সে আন্দোলনের দুটি সবচেয়ে ইতিবাচক দিক – মহিলা, বিশেষ করে রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের মহিলারা আন্দোলনের নেতৃত্ব হাতে তুলে নিলেন; আর তরুণ-তরুণীরা পথে নেমে এল। আমরা যারা জরুরি অবস্থা দেখিনি, তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিনি, তারা তো অল্পবয়সীদের রাজনৈতিক উদাসীনতাতেই অভ্যস্ত। নিজেরাও উদাসীন ছিলাম।

কোভিড-১৯ এসে না পড়লে দেশের অযুত শাহীনবাগ থেকে কী প্রাপ্তি হতে পারত সে আলোচনায় আজ আর লাভ নেই। কিন্তু মানতেই হবে, নাগরিকত্ব আইনবিরোধী আন্দোলনে আর কিছু না হোক, সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। সংখ্যার জোরে আইন পাস করিয়েও আজ পর্যন্ত নাগরিকত্ব দেওয়ার নিয়মকানুন ধার্য করে দেশব্যাপী কাজটা শুরু করতে পারেনি। এনপিআর-এনআরসির জুজু এখনো দেখানো চলছে, কিন্তু আসামের বিভীষিকাময় কর্মসূচির জাতীয়করণ আজও সম্ভব হয়নি।

আরো পড়ুন বিজেপি মুখপাত্র বিতাড়ন: হিন্দুত্বের টাইম আউট, খেলা শেষ নয়

নিঃসন্দেহে অপ্রাপ্তি অনেক। শাহীনবাগ ও তদ্রূপ আন্দোলনগুলোর পাশে মৌখিকভাবে দাঁড়ালেও বিজেপি বাদে দেশের অন্য দলগুলো সক্রিয় অবস্থান নিতে পারেনি। ফলে আন্দোলন অলিগলিতে ছড়াল না। ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা না থাকার ফলস্বরূপ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ ভাবলেন, ওটা মুসলমানদের আন্দোলন। নাগরিকত্ব গেলে ওদের যাবে, আমাদের কী? ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চার যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল তা হাত গলে ম্যানহোলে তলিয়ে গেল।

তবে থেকে যাবে কিছু দৃশ্য, যাদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। মিছিলে পাশাপাশি আম্বেদকর আর গান্ধীর ছবি হাতে হাঁটছে যুবক-যুবতী। ‘কলকাতার শাহীনবাগ’ পার্ক সার্কাসে ঠিক মাঝখানে বসানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে, সমবেত জনতা গাইছে ‘জনগণমন’। তাছাড়া শাহীনবাগের নামে মিথ্যে দোষারোপ করে লাগিয়ে দেওয়া দিল্লি দাঙ্গায় নিষ্ক্রিয়তা থেকে, এমনকি নিজের দলের মুসলমান নেতাকেও বিসর্জন দেওয়া থেকে চেনা গেল আসল অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে। জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা। আমীর আজীজের ভাষায় ‘সব ইয়াদ রখখা যায়েগা’

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত