হারানের নাতজামাই: স্মৃতিমেদুরতার নাটক

শিউরে ওঠার অনুভূতি কিন্তু হারানের নাতজামাই নাটকের শেষে হল না। যদিও শেষে মঞ্চে নির্মিত হল মাণিক লিখিত পুলিসকে ঘিরে ধরার দৃশ্য, যা দেখে মন্মথর মনে হয় “মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারাণের বাড়ীর লোকের জন্য চারদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে!”

ব্যর্থ বিপ্লব আর বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকার বলতে যা যা পড়ে থাকে তার মধ্যে প্রধান কি মধ্যবিত্ত স্মৃতিমেদুরতা? প্রশ্নটা আমার মত মাঝবয়সীর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ না দেখেছি তেলেঙ্গানার গণসংগ্রামের পার্টিকে, না দেখেছি ১৯৬৪ সালে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার আগের পার্টিকে। কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর দ্বারা সংগঠিত তেভাগা আন্দোলনের মত কোনো বিদ্রোহ আমার জীবনে দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি। নকশাল আন্দোলনের মত কোনো বিপ্লব প্রচেষ্টাও দেখিনি। সবটাই আমার কাছে হয় ইতিহাস, নয় গল্পকথা। তেভাগা আন্দোলন বলতে ছোট থেকে শুনে আসা সলিল চৌধুরীর ‘ঘুমভাঙার গান’ ক্যাসেটটার কথাই প্রথমে মনে পড়ে। সে জিনিসও প্রযুক্তিগত কারণে এখন আর চলে না। মাঝে মাঝে রোদে দিয়ে তাজা রাখার চেষ্টা করি না তা নয়, কিন্তু ক্যাসেট বাজাতে গেলে যে যন্ত্রটি দরকার তা বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে বহুকাল আগে। ঊর্ধ্বমুখী মধ্যবিত্ত অস্তিত্বে সপ্তাহান্তে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলে হারানের নাতজামাই নাটকের মঞ্চায়ন দেখতে যাওয়া তাই অদেখা বিদ্রোহের ওম নেওয়ার চেষ্টা মাত্র।

গত ১৯ মার্চ (রবিবার) মধুসূদন মঞ্চে যাদবপুর রম্যাণীর নাটক দেখতে গিয়েছিলাম ওই ওমটুকু নিতেই। পর্দা ওঠার পরে যখন দেখি মঞ্চসজ্জায় চোখে পড়ার মত জায়গা করে নিয়েছেন চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ হোড় এবং নিভু নিভু আলোয় কৃষকদের বৈঠক চলছে, যা অবধারিতভাবে মনে পড়ায় সোমনাথ হোড়ের আঁকা একটি বিখ্যাত ছবিকে, তখনই আমার অদেখা বিদ্রোহের পরিবেশ তৈরি করতে সফল হয়ে যান মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পকে নাট্যরূপদানকারী অরুণ মুখোপাধ্যায়।

আমাদের যুগের শহুরে মধ্যবিত্ত বামপন্থার সঙ্গে লোকায়ত সংস্কৃতির ব্যবধান দুস্তর। লোকায়ত সংস্কৃতি আর আমরা বিপ্লবী সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি তা বিপ্রতীপ কোণে অবস্থান করে বললেও ভুল হয় না। আমাদের বামপন্থী গান, কবিতা, ছবি – সবকিছুরই মুখ পশ্চিম দিকে ঘোরানো। আমরা যতজন ‘বেলা চাও’ বা ‘জন হেনরি’ শুনেছি, ততজন যে ‘মাউন্টব্যাটেন মঙ্গলকাব্য’ শুনিনি তা হলফ করে বলা যায়। এই নাটক দেখলে আঁচ পাওয়া যায়, এমনটি চিরকাল ছিল না। গোটা নাটক জুড়ে উদাত্ত কণ্ঠে গান গেয়ে চরণদাস (অভিজিৎ) চরিত্রটি বিদ্রোহকে কৃষক পরিবারের উঠোনে শক্ত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। গ্রামের যাত্রাদল এবং সে দলের অভিনেতাদের বিদ্রোহের সঙ্গে তলে তলে জড়িয়ে থাকাও বিপ্লবী সংস্কৃতি আর লোকায়ত সংস্কৃতির মেলবন্ধন তুলে ধরেছে। এর তুঙ্গ মুহূর্ত তৈরি হয় যখন হারানের (মাণিকের বানান অনুযায়ী হারাণ) বাড়ির দাওয়ায় কৃষকদের সঙ্গে মিলে চরণদাস শোনায় সদ্য বাঁধা গান ‘ন্যাংটার নেই বাটপাড়ে ভয়’। গানটি বাঁধা হয়েছে রামপ্রসাদী ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না’ গানের সুরে। গোটা নাটকে ওই একটি সময়েই মনে হল প্রেক্ষাগৃহের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি বড় বেশি সক্রিয়। আমার দেশের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবনধারণ করা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে আমার অপরিচয়ের পরিমাণ শিরশিরানি ধরিয়ে দিল। কী হতে পারত আর কী হচ্ছে – সেকথা ভেবে বিষণ্ণ লাগল। হয়ত অপ্রাসঙ্গিক, তবু খেয়াল হল, যে মঙ্গলশঙ্খ ছাড়া হিন্দু বাড়ির পুজোআচ্চা চলে না সেই শাঁখ বাজিয়েই এককালে এ দেশে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিদ্রোহীদের সাবধান করে দেওয়া হত – পুলিস আসছে। আজ মন্দিরের মাইক থেকে জানান দেওয়া হয় – অমুক মুসলমানের বাড়ির ফ্রিজে হিন্দুদের পূজনীয় প্রাণির মাংস আছে। চলো বিহিত করে আসি।

মাণিক গল্পের নামে হারাণ চরিত্রটিকে রেখেছিলেন বটে, কিন্তু আখ্যানে সে চরিত্রের ভূমিকা নগণ্য। অরুণবাবুর নাট্যরূপে হারাণের অভিনয় করার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে এবং সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন প্রবীণ অভিনেতা শ্যামল চক্রবর্তী। গল্পের মতই এই নাটকেও অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ময়নার মা। মেক আপের দিক থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাজানো গোছানো মনে হলেও দেবলীনা চক্রবর্তী সব মিলিয়ে মন্দ নন। বিশেষত দারোগা মন্মথর (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়) মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভুবন মণ্ডলকে বাঁচানোর দৃশ্য, যা আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু, সেখানে তিনি চমৎকার। মন্ডলের চরিত্রে চন্দন সেন বা চণ্ডী ঘোষের চরিত্রে মেঘনাদ ভট্টাচার্যের অভিনয় নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তাঁদের অভিনয় ক্ষমতা তো প্রমাণিত। তবে মথুর চরিত্রে সৌমিত্র মিত্র অতখানি মাতাল না হলেও হয়ত ক্ষতি ছিল না। হারানের নাতজামাই নাটক দেখতে গিয়ে কেষ্ট মুখার্জিকে মনে পড়া খুব সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।

দর্শককে টিকিটের দাম চুকিয়ে দেওয়ার তাগিদেই কিনা জানি না, এই নাটক হাস্যরস সৃষ্টির দিকে একটু বেশিই নজর দিয়েছে। উপরন্তু চণ্ডী ঘোষ আর সাতকড়ি (সৌমিত্র বসু) কতটা খারাপ লোক তা প্রমাণ করতে গিয়ে যেসব দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে সেগুলি বড় বেশি করে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বেশি বয়সে যেসব উচ্চকিত বাংলা ছবিতে অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেগুলির কথা মনে পড়ায়। কোনো সাহিত্যকর্মের নাট্যরূপ দেওয়ার অভিশাপই এই। যা যা সংযোজিত হল তা আখ্যানে নতুন মাত্রা যোগ করল কিনা সে প্রশ্ন দর্শকের মনে এসেই পড়ে। বাংলার জোতদাররা সব সাধুপুরুষ ছিল এমন দাবি নিশ্চয়ই কেউ করে না, মাণিক তো করতেন না বটেই। কিন্তু এখানে গ্রামের বিধবা হরিমতীর (সুজাতা সরকার) সঙ্গে চণ্ডী ঘোষের যে অবৈধ সম্পর্ক দেখানো হয়েছে তা বিদ্রোহকে কতখানি ঘনীভূত করেছে তা অন্তত আমার কাছে স্পষ্ট নয়।

অবশ্য মাণিকের গল্পের মূল সুর বিদ্রোহ হলেও এই নাটক সেখান থেকে বেশ খানিকটা সরে গেছে। ফলে হারানের নাতজামাই জগমোহনের চরিত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। মাণিকের জগমোহন ফিটফাট কড়া ধাতের লোক, পেলবতার লেশমাত্র নেই। অরুণবাবুর জগমোহন (শুভঙ্কর মুখার্জ্জী) তোতলা, বাপের সামনে কেঁচো হয়ে থাকে, রামায়ণ পালায় জটায়ুর চরিত্রে অভিনয় করে এবং এতটাই পেলব যে সীতার ভূমিকায় অভিনয় করা মেয়েলি স্বভাবের রসিক (গৌতম সেন) তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনাদায়ী রুপোর গয়নার জন্যে বউকে শ্বশুরবাড়িতে ফেলে রাখা নিয়ে মাণিকের জগমোহনের বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। সে শ্বশুরবাড়ি যায় বউয়ের জন্যে মনটা হু হু করেছে বলে নয়, লোকমুখে বউয়ের ব্যভিচারিণী হওয়ার গল্প শুনে। ময়নাদের গ্রামের বিদ্রোহী মেজাজ যে তাকে আদৌ স্পর্শ করেছে এমন ইঙ্গিত মাণিক প্রায় শেষ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত দেন না। দারোগা মন্মথ ময়নার থুতনিতে হাত দিতে এলে সে যে “লাফিয়ে এসে ময়নাকে আড়াল করে গর্জে ওঠে”, তা কতটা বউয়ের প্রতি প্রেমে আর কতটা অধিকারবোধে সেকথা ভাবার ভার মাণিক পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।

আরও পড়ুন মায়ার জঞ্জাল: যে কলকাতা দেখতে পাই না, দেখতে চাই না

অরুণবাবুর জগমোহন কিন্তু ময়নার প্রেমে ডগমগ। এত প্রেম থাকতে সে আগে কেন বউকে নিতে ছুটে আসেনি সাতকড়ির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে। এই নাটকে ময়না সত্যিই অন্য কারোর সঙ্গে রাত কাটিয়েছে কিনা সে প্রশ্ন করতে জগমোহন আসেও না, আসে তার বাবা সাতকড়ি। এসে বলে বউকে সে আর ঘরে নেবে না। জগমোহন বরং পরে এসে বাবার সিদ্ধান্ত নস্যাৎ করে এতদিন পরে বউয়ের সঙ্গে প্রেম করতে বসে। মাণিকের গল্পের সুস্পষ্ট রাজনীতি নাটকের এই শেষ দৃশ্যে এসে একেবারে ভেঙে পড়ে। গল্প পড়লে পরিষ্কার হয়, যে কেবল কৃষক নেতা মণ্ডল নয়, একটি গোটা পরিবার বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রামের মানুষের কাছে। জগমোহনও যে শেষপর্যন্ত বিদ্রোহের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, ময়নাকেও স্ত্রী হিসাবে পাশে নিয়েছে – এতগুলো কথা মাণিক বুঝিয়ে দেন একটিমাত্র বাক্যে – “ময়না তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়েই রক্ত মুছিয়ে দিতে আরম্ভ করে জগমোহনের।” শিউরে উঠে পাঠক বুঝতে পারে, জগমোহন মণ্ডল না হলেও, আগের রাতে পুলিসকে ধোঁকা দেওয়ায় যুক্ত না থাকলেও গ্রেপ্তার বরণ করেছে বিদ্রোহের দায় স্বীকার করে। আগের রাতে যে হারানের নাতজামাই ছিল সে বিদ্রোহী, আজ সকালে যে হারানের নাতজামাই সে-ও বিদ্রোহী। এ যেন সুকান্ত ভট্টাচার্যের সেই অমোঘ পংক্তি “বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।”

এই শিউরে ওঠার অনুভূতি কিন্তু হারানের নাতজামাই নাটকের শেষে হল না। যদিও শেষে মঞ্চে নির্মিত হল মাণিক লিখিত পুলিসকে ঘিরে ধরার দৃশ্য, যা দেখে মন্মথর মনে হয় “মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারাণের বাড়ীর লোকের জন্য চারদিকের গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে!” কিন্তু তার আগেই অরাজনৈতিক হয়ে গেছে নাটকটি। ফলে জোতদার আর পুলিসকে যখন মঞ্চে ঘিরে ফেলে সশস্ত্র কৃষকরা, আর বেজে ওঠে “হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো”, তখন ছোটবেলা থেকে শুনে আসা গানের স্মৃতিমেদুরতাটুকু নিয়েই বেরিয়ে আসা যায় প্রেক্ষাগৃহ থেকে। তার বেশি কোনো সঞ্চয় থাকে না। সে অবশ্য আমার মুদ্রাদোষও হতে পারে। আমি তো কখনো রক্তে ধান বুনিনি, আমি পঞ্চাশ টাকা কিলো মিনিকিট চালের ভাত খাই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

মায়ার জঞ্জাল: যে কলকাতা দেখতে পাই না, দেখতে চাই না

মায়ার জঞ্জাল দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছিল, এ যেন অবচেতনে সত্যজিৎ রায়ের মহানগর ছবির সিকুয়েল।

ধরুন, আপনি কলকাতা ময়দানের আশপাশ দিয়ে বাসে, ট্যাক্সিতে বা বাইকে চেপে যাচ্ছেন। একটি ইমারত আপনার চোখে পড়বেই। ও জিনিস না দেখে আপনি ওখান দিয়ে যেতেই পারবেন না। কারণ আশপাশের যাবতীয় ইমারতকে ছাড়িয়ে আকাশে উঠেছে ওই বিয়াল্লিশ তলা বাড়িটি। রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো চরতে আসেননি, এলে হয়ত ওই ইমারত দেখে তাঁর “তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে” মনে পড়ে যেত। আমি রবীন্দ্রনাথের ভাষার অপকর্ষের যুগের কিবোর্ডচি (কলমচি বলার মানে হয় না), ফলে আমার কবিতার লাইন-টাইন মনে পড়ে না। আমার লেখাপড়া যেটুকু, বুদ্ধিসুদ্ধির যে হাঁটুজল গভীরতা, তাতে কেবল উত্থিত লিঙ্গের কথা মনে পড়ে। আবার যদি ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস ধরে সায়েন্স সিটি ছাড়িয়ে যাদবপুর-সন্তোষপুর অভিমুখে যান, তাহলে দেখবেন ডান হাতে পাশাপাশি অমন দু-দুখানি দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলির নাম ট্রাম্প টাওয়ার। উত্থিত লিঙ্গ রাস্তাঘাটে প্রদর্শন করা পৃথিবীর সমস্ত সভ্য দেশে কেবল অসভ্যতা বলে গণ্য হয় তা নয়, আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে। অমন করলে আপনাকে সহনাগরিকদের যৌন হয়রানি করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা যেতেই পারে। কিন্তু কোনো সভ্য দেশেই ধনের প্রদর্শনী অসভ্যতা বলে গণ্য হয় না, আইনত অপরাধও নয়। বরং ইদানীং ওটিই সভ্যতার লক্ষণ। কলকাতা সেদিক থেকে ভারতের অন্য শহরগুলির তুলনায় অনেক পরে সভ্য হতে শুরু করেছে, ফলে এখন একের পর এক অমন ইমারত তৈরি হয়েই চলেছে। ফর্টি টু, ট্রাম্প টাওয়ার, আরবানা, আরও বানা। নইলে পশ্চাদপর হয়ে পড়ব আমরা। উল্লিখিত ইমারতগুলির মত বিরাট না হলেও, কলকাতা শহরে এখন উঁচু পাঁচিল আর ইয়াব্বড় সিংহদ্বারযুক্ত, প্রবেশ-প্রস্থানে কড়াকড়িসম্পন্ন লম্বা লম্বা ইমারতের অভাব নেই। সাম্প্রতিককালের বাংলা ছবিতে এই ধরনের ইমারতের বাসিন্দাদের জীবন ঘনঘন ধরা পড়ে। কলকাতা মানেই তারা – দেখলে এমন ধারণাই তৈরি হয়। আগামীকাল (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) অবশ্য এমন একটি ছবি মুক্তি পাচ্ছে, যেখানে ওই ইমারতগুলি যে জঞ্জাল উৎপাদন করছে, যে জঞ্জালে চাপা পড়ে যাচ্ছে বাকি শহরের বহু মানুষ, গোটা শহর হয়ে যাচ্ছে ধাপার মাঠ, সেই জঞ্জাল দেখানো হয়েছে – মায়ার জঞ্জাল।

গত বছরের শেষদিকে ঝিল্লি বলে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল সামান্য কিছু প্রেক্ষাগৃহে, যা আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। যাঁরা দেখেছেন তাঁদের মুখে শুনেছি এবং পত্রপত্রিকাতেও পড়েছি, সেই ছবিতে ক্যামেরা সত্যিকারের জঞ্জালের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। একটি কাগজে এ কথাও পড়েছি যে একটি শোতে ছবি শুরু হওয়ার খানিকক্ষণের মধ্যে একজন দর্শক দৃশ্যের অভিঘাত সহ্য করতে না পেরে প্রেক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে যান। মায়ার জঞ্জাল সে তুলনায় অনেক নরম ছবি। এখানে এমন কোনো দৃশ্যের জন্ম দেননি পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী, যা দেখে বমি পাবে বা মাথা ঘুরবে। নামেই প্রকাশ, তিনি মূর্ত জঞ্জাল নয়, বিমূর্ত জঞ্জাল দেখাতে চেয়েছেন। সে কাজে কতটা সফল বা ব্যর্থ হয়েছেন তার বিচার সিনেমাবেত্তারা করবেন, কিন্তু আমার ভাল লাগছে এই দেখে যে বাংলা ছবির পরিচালকরা শেষমেশ ক্লেদজ কুসুম পর্দায় তুলে আনতে বেরিয়ে পড়েছেন।

কোভিড অতিমারীর আগেই তৈরি হয়ে যাওয়া, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির সুযোগ না পাওয়া এই ছবির আখ্যানাংশের অবলম্বন হিসাবে কাজ করেছে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুটি গল্প – ‘বিষাক্ত প্রেম’ এবং ‘সুবালা’। কিন্তু যেভাবে আজকের কলকাতা জ্যান্ত হয়ে উঠেছে পর্দায় – তার অপরাধ জগৎ, দলীয় ও বৃহত্তর রাজনীতি, ধ্বস্ত অর্থনীতি, তার চাপে আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলি সমেত – তাতে পুরনো হিট ছবির রিমেকের রমরমার যুগে দাঁড়িয়ে এই পুনর্নির্মাণের মুনশিয়ানার চেয়েও সাহসটি বেশি প্রশংসনীয় বোধহয়।

ছবি দেখতে দেখতে সাংবাদিকসুলভ বদভ্যাসে মনে হচ্ছিল, গত এক-দেড় বছরে বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করা মানুষগুলির সবরকম দুর্দশার জন্য অতিমারীকে নন্দ ঘোষ বানানোর যে চল হয়েছে, এ ছবিকে তার জবাব হিসাবে খাড়া করা যায়। অতিমারীর আগেও যে মানুষ ভাল ছিল না, মধ্যবিত্ত দ্রুত গরিব হয়ে যাচ্ছিল আর বেঁচে থাকার জন্য সৎ-অসৎ, এক নম্বরি-দু নম্বরির ভেদ রাখা একদা লাল পতাকা নিয়ে মিটিং মিছিল করা আদর্শবাদী মধ্যবিত্তের পক্ষেও সম্ভব হচ্ছিল না – তা এ ছবি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

মার্কস সাহেব কী বলেছেন জানি না, গত বিশ বছরে নিজের চোখে যা দেখেছি তা হল, গরিব দুরকমের। এক, যে আজন্ম গরিব এবং কালো পথে না হাঁটলে সেভাবেও বাঁচতে পারবে না। দুই, যে মধ্যবিত্ত ছিল, যার টনটনে আত্মসম্মানবোধ এবং নীতিজ্ঞান ছিল। এখন সেসব বিসর্জন না দিলে জাতও যায়, পেটও ভরে না। এই দু ধরনের গরীবকে একইসঙ্গে দেখতে পাব আমার সময়ের কোনো বাংলা ছবির পরিচালকের ছবিতে – সে আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ইন্দ্রনীল মায়ার জঞ্জালে আশা ফিরিয়ে দিলেন। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনায় এই দুই ধরনের গরিবকে পর্দায় একেবারে রক্তমাংসের করে তুলেছেন সোহেল মন্ডল, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অপি করিম, চান্দ্রেয়ী ঘোষরা।

ঋত্বিক একেবারে সাধারণ, চলতি কথায় যাদের এলেবেলে বলা হয়, তেমন লোকের চরিত্রে এতবার অভিনয় করেছেন এবং এত জীবন্ত করে তুলেছেন যে মনে হয় তাঁকে মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে আনলেও ওরকম একটি চরিত্রে যথাযথ অভিনয় করে ফেলবেন। কিন্তু নিজের জীবনের রাশ, এমনকি বউয়ের রাশও হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ায় যুগপৎ নিষ্ফল আক্রোশ এবং অসহায় হতাশার যে অভিনয় তিনি এই ছবিতে করেছেন, তা দগদগে ঘা হয়ে থাকে। সোহেলও দক্ষ বাজিকরের হাতের পুতুল খুচরো সমাজবিরোধী হিসাবে, যৌনকর্মীর প্রেমে পড়ে যাওয়া কিন্তু লোভের দাস একজন মানুষ হিসাবে দারুণ পরিমিত। 

তবে সোহেলের চরিত্রের একটি দিক কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যা তৈরি করে। তা হল তাঁর সংলাপের ভাষা। তিনি খিস্তি দিচ্ছেন যথার্থ গুন্ডাদের মতই, কিন্তু তা বাদে তাঁর মুখের বাংলা অনেকটাই কলকাতার ভদ্রলোকদের মত শোনায়। খিস্তি বাদ দিলে ঋত্বিকের মুখের ভাষার সঙ্গে সোহেলের মুখের ভাষা প্রায় এক। তাঁর অপরাধ জগতের সঙ্গীসাথীদের ভাষার ক্ষেত্রেও একই কথা মনে হয়। এমনকি নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের মধ্যেও চান্দ্রেয়ী ঘোষ বাদে অন্য অভিনেত্রীদের মুখের ভাষা যেন বড় বেশি ‘মান্য’ বাংলা, অবশ্যই খিস্তি বাদে। যেখানে সমরেশ বসুর প্রজাপতি উপন্যাসের সুখেনের ভাষা আশা করেছিলাম, সেখানে যেন বিবর উপন্যাসের বীরেশের ভাষা উঁকি মারছে। বাংলাদেশ থেকে স্বামীর সঙ্গে কলকাতায় বেড়াতে এসে বিক্রি হয়ে যাওয়া চান্দ্রেয়ীর চরিত্রের মুখের ভাষাতেও কি পূর্ববঙ্গীয় টান খানিক থাকা উচিত ছিল? নাকি কলকাতার খদ্দেরদের চাহিদায় সে ভাষা পালটে নিতে হয়? খটকা রইল। কারণ কদিন আগেই প্রতিভা সরকারের লেখা একটি গল্পে উত্তরবঙ্গ থেকে এসে সোনাগাছির বাসিন্দা হয়ে যাওয়া দুই যৌনকর্মীর কথা পড়েছি। তাদের একজন উত্তরবঙ্গীয় ভাষা কিছুতেই ছাড়তে চায় না।

অভিনয়ের দিক থেকে অবশ্য চমকে দেন চান্দ্রেয়ী। যদিও তাঁর অনেককিছু বলার, অনেককিছু করার আছে। যিনি প্রধানত মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করে যান এবং সেভাবেই নিজের সীমিত ক্ষমতায় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়ে যান, সেই গৃহবধূর চরিত্রে মনে রাখার মত অভিনয় করেছেন অপি করিম। তাঁর চমকে দেওয়া কাজ ছিল না, তাঁকে দেখলেই মনে হয় – আরে! একে তো চিনি! ভাত আছে, ভাতের সঙ্গে মুখরোচক ব্যঞ্জন নেই। রোজ রোজ একই জিনিস দিয়ে ভাত খেতে খেতে গলা দিয়ে আর নামে না। কোনো কারণে আত্মসম্মানে আঘাত লাগায় ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে গেলেন বাবা, নীরব হয়ে রইলেন মা – এ দৃশ্য গত শতকে মধ্যবিত্ত জীবন পেরিয়ে আসা আমাদের অনেকের কাছেই চিরচেনা। সেইসব মায়েদের মুখ অপি প্রস্থেটিক মেক-আপের চেয়েও নিখুঁতভাবে ধারণ করেছেন নিজের মুখে।

আরও পড়ুন ‘অলৌকিক মেগা সিরিয়াল দেখা সমাজের সত্যজিতের ছবি দেখার কোন কারণ নেই, তিনি উপলক্ষ মাত্র’

এক সময়কার ক্রীড়া সাংবাদিক অশোক দাশগুপ্ত একবার ক্রিকেট নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলেন, নাম ছিল ‘বেণুদা কী বলবে’। সেখানে বেণুদা গল্পের কথককে বলেছিলেন, ক্রিকেট খেলায় উইকেটরক্ষকের কাজ হল চোখে না পড়ে নিজের কাজ করে যাওয়া। যদি কোনো উইকেটরক্ষক খুব বেশি চোখে পড়ে, বুঝতে হবে সে ভাল কিপিং করছে না। মায়ার জঞ্জালে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্র উইকেটরক্ষকের। তিনি প্রবাদপ্রতিম সৈয়দ কিরমানির মতই প্রশান্ত কিপিং করেছেন। অন্যদিকে ব্রাত্য বসু যেন হাতে জমে যাওয়া ক্যাচ নিতে গিয়েও বিস্তর লম্ফঝম্প করলেন।

সিনেমাশাস্ত্রে দীক্ষিতরা নিশ্চয়ই মায়ার জঞ্জাল দেখে বেশকিছু অপূর্ণতা চিহ্নিত করতে পারবেন। আমার মত ছাপোষা দর্শকের পক্ষে তা সম্ভব নয়। দেয়াল জোড়া এলইডি টিভিতে বিদেশি সুনীল সাগরের শ্যামল কিনার দেখে অপির শূন্য দৃষ্টির শট আর তারপরেই তাজপুরের সমুদ্র সৈকতে স্বামী-স্ত্রীর শুয়ে থাকার শট আমাকে দ্রব করে ফেলে। এ আমার জীবনযাপনের মধ্যবিত্ততা তো বটেই, হয়ত রুচিরও। তবে মনে হয় আমার মত দর্শকদের কল্পনাশক্তির উপর পরিচালকের ভরসা বেশ কম। নইলে জঞ্জাল কুড়ানি মহিলাকে অতবার না দেখালেও চলত।

সিনেমার ভাষায় যাকে সিকুয়েল বলে, তার বাংলা প্রতিশব্দ কী জানি না। মায়ার জঞ্জাল দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছিল, এ যেন অবচেতনে সত্যজিৎ রায়ের মহানগর ছবির সিকুয়েল। মনে হওয়ার পিছনে ছবির আখ্যানাংশ কতখানি দায়ী আর হিন্ডেনবার্গ, ফোর্বসের প্রতিবেদনের পর গৌতম আদানির শেয়ারের দাম পড়ে যাওয়ায় আমার এলআইসি পলিসি আর স্টেট ব্যাঙ্কে জমা টাকাগুলির জন্য উদ্বেগ কতখানি দায়ী – তা অবশ্য বলতে পারব না। তবে ১৯৬৩ সালের মহানগর যে আজ ষাট বছর পরে মায়ার জঞ্জালেই পরিণত হয়েছে তাতে বিশেষ সন্দেহের অবকাশ নেই। সিনেমার পর্দায় নিজের চারপাশ, নিজের জীবন এবং যাদের আমরা দেখতে চাই না বলেই দেখতে পাই না – তাদের দেখার আগ্রহ থাকলে এ ছবি দেখার মত। এটুকু বলতেই পারি।

পুনশ্চ: অপ্রাসঙ্গিক, তবু ছবিটি ভাবাল বলেই আরও কিছু কথা বলি। মুক্তি পাওয়ার আগেই যে এই ছবি দেখে ফেললাম সে আমার পেশাগত তথা সামাজিক অবস্থানের বিশেষ সুবিধা। এ ছবি আসলে যাদের কথা বলে, তাদের প্রায় কারোরই সে সুবিধা নেই। উপরন্তু, শহর গ্রাম মফস্বলের এক পর্দার সিনেমা হলগুলিকে গিলে নিয়েছে যে মাল্টিপ্লেক্স শিল্প, তার দাপটে এ ছবি মুক্তি পাওয়ার পরেও ওই মানুষগুলি দেখে উঠতে পারবে কিনা জানি না। আমার ধারণা বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না দেখতে যারা একসময় হল ভরাত, উবের ওলা চড়া শহুরে দর্শকের চেয়ে মায়ার জঞ্জাল তাদের স্পর্শ করতে পারত অনেক বেশি। কিন্তু এ ছবি নিয়ে প্রযোজক, পরিচালক তাদের কাছে পৌঁছবেন কী করে? সেই দর্শকদের সিনেমা দেখতে আসার পথ তো বহুকাল আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলা ছবির পাশে দাঁড়ানোর অনেক আবেদন আজকাল বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অথচ যখন প্রয়োজন ছিল, তখন বাংলা ছবি ওই বিরাট অংশের দর্শকের পাশে দাঁড়ায়নি।

সে দোষ কি শুধুই একুশ শতকের নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতির? তার আগেও কি কখনো ভেবে দেখেছি, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী আমরা, দেশভাগের কেবল গল্প শোনা আমরা মেঘে ঢাকা তারা দেখে যেভাবে মথিত হই, আট বা নয়ের দশকে বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে এ দেশে চলে আসা আমার বাড়ির কাজের লোকটি তার চেয়েও বেশি মথিত হতে পারে। তাকে একদিন দেখানো যাক? আমরা কি জাঁক করে ভাবিনি, পথের পাঁচালী দেখে ওরা কিছুই বুঝবে না? এই আমরাই আবার মহৎ শিল্পের সর্বজনীন আবেদন নিয়ে বক্তৃতা দিই, প্রবন্ধ লিখি। আজ বাঙালি সংস্কৃতির যে সংকট তা হয়ত অনেকখানি এইজন্য, যে ভাল ভাল জিনিস সব নন্দন চত্বরে ‘আমাদের কালচার’ হয়ে রয়ে গেছে। সব বাঙালির সংস্কৃতি হয়ে ওঠেনি।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: