ক্রিকেট জেনেশুনে বিশ করেছে পান

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে।

শোয়েব আখতার যখন বল করতেন, মনে হত গোলাবর্ষণ করছেন। এখন বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়ার সময়েও প্রায় একই মেজাজে থাকেন। আজকাল প্রাক্তন ক্রিকেটাররা ভারতীয় ক্রিকেট সম্পর্কে কথা বলার সময়ে অতি মাত্রায় সাবধানী। কারণ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড চটে গেলে এ দেশে ধারাভাষ্যের মহার্ঘ সুযোগ পাওয়া যাবে না, কোনো একটা ভূমিকায় আইপিএলের কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজে ঢুকে সারা বছরের রোজগার দু-আড়াই মাসে করার সুযোগও হাতছাড়া হবে। শোয়েব পাকিস্তানি হওয়ায় ও দুটো দরজাই তাঁর জন্যে বন্ধ। সম্ভবত সে কারণেই নিজের দেশের বাবর আজম সম্পর্কে যেরকম তীর্যক মন্তব্য করেন, বিরাট কোহলি সম্পর্কেও সেভাবেই কথা বলেন। কোহলিকে আক্রমণ করে কদিন আগে বলেছেন “আমি কোহলিকে অনুরোধ করব ও যেন ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত খেলে। তাহলে আরও ৮-৯ বছর সময় পাবে। ভারত ওকে হুইলচেয়ারে বসা অবস্থাতেও খেলাবে এবং একশোটা শতরান করা পর্যন্ত খেলতে দেবে। আমার মনে হয় ও অবসর পর্যন্ত অন্তত ১১০ খানা শতরান করে ফেলবে।”

কোনো সন্দেহ নেই ভারতীয় ক্রিকেটে ব্যক্তিপূজা এমন প্রবল, যে কপিলদেবকে রিচার্ড হেডলির টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড ভাঙার জন্য, আর শচীন তেন্ডুলকরকে শততম শতরান করতে দেওয়ার জন্য, খেলোয়াড় হিসাবে ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও খেলতে দেওয়া হয়েছিল। মহেন্দ্র সিং ধোনি অবশ্য রেকর্ড ভাঙার জন্য খেলে যাননি। তাঁর ফিনিশ করার ক্ষমতা ফিনিশ হয়ে গিয়ে থাকলেও বোর্ড সভাপতি এন শ্রীনিবাসনের কোম্পানির ডিরেক্টরকে বাদ দেয় কোন নির্বাচকের সাধ্যি? বরং সেই ২০১১ সালে নির্বাচক কমিটির বৈঠকে ধোনিকে টেস্ট থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ায় নির্বাচক মহিন্দর অমরনাথের চাকরিই নট হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং কোহলিও যদ্দিন ইচ্ছা খেলে যেতেই পারেন। কিন্তু শোয়েবের ভুল হয়েছে অন্য জায়গায়।

কোহলির এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শতরানের সংখ্যা ৭৫ (টেস্ট ২৮, একদিনের ক্রিকেট ৪৬, আন্তর্জাতিক টি টোয়েন্টি ১)। যতদিন পর্যন্তই খেলুন, আরও ২৫ খানা শতরান কোথা থেকে আসতে পারে ভেবে দেখুন। পরপর দুটো ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে ব্যর্থ হওয়ার পর (পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্মরণীয় ইনিংসটা বাদ দিলে) ৩৪ বছরের কোহলিকে আর ওই ফরম্যাটে খেলানো হবে কিনা দেবা ন জানন্তি। বয়স বাড়লে টেস্টে শতরান করা যে ক্রমশ কঠিন হয়ে যায় তা তো কোহলির গত চার বছরের খেলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাহলে হাতে রইল পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট, যাতে কোহলিকে এখনো মাঝে মধ্যে স্বমহিমায় দেখা যায়। কিন্তু ওই ফরম্যাটটির নিজেরই যে বাঁচা দায়।

শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে। মাত্র ছমাস পরেই পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপ, তাও আবার ভারতে। যেখানে পঞ্চাশ গ্রাম ওজনের প্লাস্টিক বল দিয়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হলেও খেলা দেখতে লোক জমে যায়। এই তো কদিন আগে ভারত-অস্ট্রেলিয়া একদিনের সিরিজ হয়ে গেল, তার আগে বাংলাদেশে সিরিজ হল। সেখানে গুরুত্বহীন ম্যাচে হলেও ঈশান কিষণ দ্বিশতরান করলেন, কোহলি শতরানের খরা কাটালেন। এমন সময়ে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট নিয়ে এমন কথা কেন? ঘটনা হল, যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে। সারা পৃথিবীতে টি টোয়েন্টি লিগগুলোর, মানে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের যত রমরমা হচ্ছে, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের দর্শক তত কমছে। মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, যে কর্মকর্তারাও চান না ওটা বেঁচে বর্তে থাক। নইলে ১৩ নভেম্বর ২০২২ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি ফাইনালের পর ১৭, ১৯ আর ২২ তারিখ কেন তিনটে একদিনের ম্যাচ খেলবে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড? মাত্র চারদিন আগে দাপটে কুড়ি ওভারের বিশ্ব খেতাব জয় করা ইংল্যান্ড তিনটে ম্যাচেই গোহারা হারে। সেই ফলাফলকে গুরুত্ব না দিলেও হয়ত চলে, ইংল্যান্ডের পর্যুদস্ত হওয়ার দায় ক্লান্তির উপর চাপানো তো একেবারেই চলে না, কারণ ইংল্যান্ডের একদিনের দলের অনেকেই ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দলে ছিলেন না। কিন্তু আসল কথা হল অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ইংল্যান্ড খেলছে আর গ্যালারিতে মাছি তাড়ানোরও লোক নেই – এ জিনিস দুদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। খেলাগুলোর টিভি রেটিংয়ের অবস্থাও ছিল শোচনীয়।

এটা একমাত্র দৃষ্টান্ত নয়। ভারতেও যে কোনো দলের সঙ্গে খেলা থাকলেই মাঠ ভরে যাওয়ার দিন চলে গেছে। আইপিএলে টিকিটের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে, সাংবাদিকরা সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে বাধ্য হন “দয়া করে কেউ টিকিট চাইবেন না।” কিন্তু পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে অন্তত কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরুর মত বড় শহরে সে সমস্যা হয় না। শুধু যে দর্শকদের আগ্রহ কমছে তা নয়, খেলোয়াড়দেরও আগ্রহ কমছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার, ইংল্যান্ডের টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস ইতিমধ্যেই একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে বসে আছেন। মানে গত বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় এবার বিশ্বকাপে খেলবেন না। তাঁর বয়স কিন্তু মাত্র ৩১। গতবছর জুলাই মাসে অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর ডিসেম্বরে অবশ্য স্টোকস বলেছিলেন তিনি শুধু বিশ্বকাপটা খেলার কথা ভেবে দেখতেও পারেন। কিন্তু অবসর নেওয়ার যে কারণগুলো দেখিয়েছিলেন, সেগুলো লক্ষ করার মত। তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন, বড্ড বেশি ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। তিন ধরনের ক্রিকেটের ধকল তাঁর শরীর নিতে পারছে না।

এই সমস্যা একা স্টোকসের নয়। ইংল্যান্ডের জোরে বোলার জোফ্রা আর্চার চোট পেয়ে মাঠের বাইরে বসেছিলেন বেশ কয়েক বছর, চলতি আইপিএলে মাঠে ফিরলেন। ভারতের যশপ্রীত বুমরা কবে ফিরবেন এখনো পরিষ্কার নয়। বিশ্ব ক্রিকেটে প্রায় সব দলের শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররাই বারবার চোট পাচ্ছেন, বিরাম নিতে হচ্ছে। কারণ আইপিএল দিয়ে যা শুরু হয়েছিল, সেই ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জয়যাত্রা এখন ম্যাগেলানের মত পৃথিবী পরিক্রমায় বেরিয়েছে। পাকিস্তান সুপার লিগ, লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশের সঙ্গে এ বছর থেকে যোগ হল দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টোয়েন্টি আর সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর আইএল টি টোয়েন্টি। শেষের দুটো আবার ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক দেওয়ার ব্যাপারে আইপিএলের ঠিক পরেই। দুটো লিগেই দল কিনেছেন চেন্নাই সুপার কিংস, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস, কলকাতা নাইট রাইডার্স, দিল্লি ক্যাপিটালস, লখনৌ সুপার জায়ান্টস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, রাজস্থান রয়ালসের মত দলের মালিকরা। ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগগুলো খেলোয়াড়দের যা পারিশ্রমিক দিচ্ছে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া কোনো দেশের ক্রিকেট বোর্ডের কম্ম নয়। ফলে ছাড়তে হলে একজন ক্রিকেটার জাতীয় দলের হয়ে খেলাই যে ছাড়বেন, ফ্র্যাঞ্চাইজের খেলা নয়, তা বলাই বাহুল্য। টেস্টের প্রতি স্টোকসের ভালবাসা আছে বলে একদিনের ক্রিকেট ছেড়েছেন, কেউ টেস্ট খেলাও ছাড়তে পারেন।

ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডের বোর্ড মিলে বিশ্ব ক্রিকেটকে যে ছাঁচে ঢেলেছে ২০১৪ সাল থেকে, তাতে অনেক ক্রিকেট বোর্ডেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা। ফলে ক্রিকেটারদের ইচ্ছার কাছে মাথা নোয়ানো ছাড়া উপায় নেই। এমনকি নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ডও বাধ্য হয়েছে ফর্মের তুঙ্গে থাকা ট্রেন্ট বোল্টকে কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে অব্যাহতি দিতে। অর্থাৎ তিনি হয়ত টেস্ট ক্রিকেট আর খেলবেনই না, একদিনের ক্রিকেট কতটা খেলবেন তাতেও সন্দেহ আছে। আইপিএলের পারিশ্রমিকের সঙ্গে অবশ্য ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডও এঁটে উঠতে পারবে না অদূর ভবিষ্যতে। ইংল্যান্ডের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ কাগজের প্রতিবেদক টিম উইগমোর গত সপ্তাহেই লিখেছেন, আইপিএলের ক্রিকেটাররা যে পারিশ্রমিক পান তা আরও তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব। কারণ এত বড় ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া লিগ পৃথিবীর অন্য যেসব খেলায় আছে, সেখানে দলগুলো মোট রাজস্বের অর্ধেক বা তারও বেশি খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক হিসাবে দিয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনবিএ (বাস্কেটবল লিগ) এনএফএল (আমেরিকান ফুটবল লিগ) এবং এমএলএসে (বেসবল লিগ) অন্তত ৪৮% দেওয়া হয়। ইংল্যান্ড ফুটবলের প্রিমিয়ার লিগ ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে রাজস্বের ৭১% খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের পিছনে ব্যয় করেছিল। সেখানে আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজগুলো ব্যয় করে ১৮% বা তারও কম।

আরও পড়ুন বিশ্বকাপে কী হবে ভুলে যান, আইপিএল দেখুন

অতএব বুঝতেই পারছেন, শুধু পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট কেন, সারা বছর ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খেলে বেড়িয়ে ভবিষ্যতে টেস্ট ক্রিকেট খেলার উৎসাহও কজন ক্রিকেটারের থাকবে সন্দেহ। স্বভাবতই খেলার গুণমানের তফাত হবে, দর্শকদের আগ্রহেও ভাঁটা পড়বে। যেমন এই মুহূর্তে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের ক্ষেত্রে হচ্ছে। টেস্টের দর্শক ভারতেও কমে গেছে বেশ কিছুদিন হল। সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে সপ্তাহান্তে কোহলির শতরান পূর্ণ করার দিনেও গ্যালারিতে মানুষের চেয়ে চেয়ার বেশি দেখা যাচ্ছিল। তবু কৌলীন্য আছে বলে কোহলি, স্টোকস, জো রুটের মত খেলোয়াড়রা এখনো ওই ক্রিকেটটা খেলতে চান। পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটের কিন্তু অবস্থা সঙ্গীন। বাঁচিয়ে রাখতে কী করা যায়? স্টোকস বলেছিলেন, সম্প্রতি রবি শাস্ত্রীও বলেছেন খেলাটাকে চল্লিশ ওভারে নামিয়ে আনার কথা। রোহিত বলেছেন নয়ের দশকের মত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট ফিরিয়ে আনা যায় কিনা ভেবে দেখা উচিত। কিন্তু খেলোয়াড়দের ম্যাচ খেলার সংখ্যা যদি না কমে, ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের পরিমাণ কমানোর দিকে যদি কর্তারা নজর না দেন, তাহলে চল্লিশ ওভারের ম্যাচ খেলতেই বা সেরা খেলোয়াড়দের কী করে পাওয়া যাবে?

কর্তাদের কাছে একদিনের ক্রিকেট এখন পরের ছেলে পরমানন্দ, যত গোল্লায় যায় তত আনন্দ। কারণ সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জন্য আরও বেশি সময় পাওয়া যাবে। ওখানেই তো যত মধু। আইপিএলে দল বাড়িয়ে ম্যাচের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, কারণ মিডিয়া স্বত্ব বেচে পাওয়া টাকার পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ২০১৮-২২ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছিল ১৬,৩৪৭.৫০ কোটি টাকায়, আর ২০২৩-২৭ আইপিএলের মিডিয়া স্বত্ব বিক্রি হয়েছে ৪৮,৩৯০ কোটি টাকায়। আইপিএল নামক এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসটির জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল নিজেদের সূচিতে প্রতি বছর আড়াই মাস খালি রেখেছে। কারণ আইপিএলে ম্যাচের সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। বাড়তে বাড়তে ২০২৭ সালে তা পৌঁছবে ৯৪-তে। সঙ্গে থাকবে অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ। তারপর পঞ্চাশ (বা চল্লিশ ওভারের) খেলা খেলবেন কারা? সে বছর বিশ্বকাপেই বা কতজনকে ফিট অবস্থায় পাওয়া যাবে? তাই বলছিলাম, কোহলি যদি ২০৩১ অব্দি খেলেও ফেলেন, শতরানের সেঞ্চুরির জন্য সবচেয়ে লাগসই ফরম্যাটটার অস্তিত্ব থাকবে কিনা সন্দেহ।

এই সময় কাগজের অধুনালুপ্ত রাবিবারিক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত

ইংল্যান্ডের নতুন ক্রিকেট ভারতীয়দের যা শেখাল

১৯৯৬ বিশ্বকাপে একদিনের ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ে সনৎ জয়সূর্য আর রমেশ কালুভিথরনার জুটি বিপ্লব ঘটিয়ে দেওয়ার কিছুদিন পরের কথা। একটা ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে দুরমুশ হওয়ার পর ভারত অধিনায়ক শচীন তেন্ডুলকরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আগে ব্যাট করে কত রান করলে এই শ্রীলঙ্কাকে হারানো যাবে বলে মনে হয়? শচীন অসহায়ের মত উত্তর দিয়েছিলেন, বোধহয় এক হাজার। গত মঙ্গলবার এজবাস্টনে পুরস্কার বিতরণের সময়ে যশপ্রীত বুমরার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, মার্ক বুচার যদি জিজ্ঞেস করতেন চতুর্থ ইনিংসে কত রানের লক্ষ্যমাত্রা দিলে ইংল্যান্ডকে হারানো যাবে বলে মনে হয়, তাহলে বুমরা শচীনের উত্তরটাই দিতেন। টেস্ট ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে যদি কোনো দল ৩৭৮ রান মাত্র তিন উইকেট হারিয়ে তুলে পঞ্চম দিন মধ্যাহ্নভোজের বিরতির আগেই খেলা শেষ করে দেয়, তাহলে হেরে যাওয়া দলের অধিনায়ক এছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারেন? এজবাস্টনে যা ঘটেছে তা আরও বেশি চমকপ্রদ, আরও সুদূরপ্রসারী এই জন্যে যে টেস্টের ইতিহাসে এই প্রথমবার কোনো দল পরপর চারটে ম্যাচ চতুর্থ ইনিংসে আড়াইশোর বেশি রান তুলে জিতল। এই রানগুলো যে গতিতে তোলা হয়েছে সেটাও টেস্ট ক্রিকেটে চট করে হয় না। ইংল্যান্ডের ক্রিকেট সাংবাদিক, সমর্থকরা আদর করে এই ধারার ব্যাটিংয়ের নাম দিয়েছেন ‘ব্যাজবল’ – দলের কোচ ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ডাকনাম ব্যাজ, সেই কারণে। ঘটনাটা যেহেতু একবার মাত্র ঘটেনি, পরপর চারবার ঘটে গেল, সুতরাং মানতেই হবে ব্যাজবল একটা নতুন ধারা। ব্যাজবল টেস্ট ক্রিকেটের প্রচলিত ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহ। যতক্ষণ ইংল্যান্ডের বাইরে নানারকম পরিবেশে, নানারকম পিচে এ জিনিস করা হচ্ছে ততক্ষণ একে বিপ্লব বলা চলবে না ঠিকই। কিন্তু প্রয়াসটা যে বৈপ্লবিক তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

এই সহজ কথাটা মেনে নিতে কিন্তু ভারতীয়দের প্রচণ্ড অসুবিধা হচ্ছে। এজবাস্টন টেস্টের আগে থেকেই ইংল্যান্ড যা করছে তা যে নতুন কিছু নয়, তা ঠারেঠোরে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে সাধারণ দর্শক – সকলেই বলছিলেন। জোর গলায় ব্যাজবল নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি শুরু হয়ে যায় ঋষভ পন্থ ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ইনিংসে খেলে ফেলতেই। ইংল্যান্ড ব্যাটিং প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ হওয়ায় তাচ্ছিল্যের মাত্রা বেড়ে যায়। জনি বেয়ারস্টোর একা কুম্ভের মত শতরানকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের দেখাদেখি ক্রিকেটভক্তদের মধ্যেও সিরিজ সম্প্রচারকারী টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন মাফিক ইংল্যান্ডকে ধোলাই দেওয়া হচ্ছে বলে উল্লাস চলছিল। চতুর্থ দিন দুপুরে ভারত যখন ৩৭৮ রানের লক্ষ্যমাত্রা খাড়া করে অল আউট হয়ে গেল, তখন আমরা কত অসাধারণ দল, আমাদের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই ব্যাজবল কেমন অশ্বডিম্ব প্রসব করল – এসব উচ্চমার্গীয় আলোচনা চলছিল। কিন্তু বার্মিংহামে সন্ধে নামার আগেই গলা নামিয়ে ফেলতে হল সকলকে। বেয়ারস্টো আর ইংল্যান্ড অধিনায়ক বেন স্টোকস ফর্মে থাকলে তবেই ব্যাজবল খেলা সম্ভব – এমনটা ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন যে বিশেষজ্ঞরা, তাঁরা দেখলেন ইংল্যান্ডের দুই নড়বড়ে ওপেনারই দারুণ আত্মবিশ্বাসে আক্রমণাত্মক ব্যাট করলেন। জ্যাক ক্রলি কিছুটা সাবেকি ওপেনারদের ঢঙে খেললেও অ্যালেক্স লিজ শামি, বুমরা, সিরাজ – সকলকেই আক্রমণ করলেন। বাঁহাতি ব্যাটারের অফস্টাম্পের বাইরে তৈরি হওয়া পিচের ক্ষত কাজে লাগিয়ে রবীন্দ্র জাদেজা ভেলকি দেখাবেন বলে আশা ছিল। লিজ প্রথম ওভার থেকেই তাঁকে আক্রমণ করে সে আশায় জল ঢেলে দিলেন। সব মিলিয়ে ওভার পিছু পাঁচ রান করে নিয়ে ইংল্যান্ড একশো পেরিয়ে গেল। এরপর অস্থায়ী অধিনায়ক বুমরা দ্রুত দুটো উইকেট তুলে নিয়ে কিছুটা আশা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু অতঃপর যা ঘটল, তাকে ক্রিকেটের সাহেবি পরিভাষায় কী বলে সে কথা থাক, গোদা বাংলায় বলে দুরমুশ করা। ক্ষণেকের জন্য বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে জো রুট লিজের রান আউটের কারণ হয়ে না দাঁড়ালে হয়ত ভারতের হারের ব্যবধানটা আরও হতভম্ব করার মত হত। যা-ই হোক, শেষপর্যন্ত রুট আর বেয়ারস্টো যথাক্রমে ৮২.০৮ আর ৭৮.৬২ স্ট্রাইক রেটে ৩৪টা চার আর দুটো ছয় মেরে কার্য সমাধা করেছেন।

ভারতীয় পণ্ডিতরা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না। ম্যাচের পর স্টুডিওতে বসে সঞ্জয় মঞ্জরেকর মাথা নেড়ে বললেন এই ব্যাটিংটা ব্যাজবল নয়, এটা হল “সেন্সিবল ব্যাটিং”। মানে মোগলসরাইয়ের নাম দীনদয়াল উপাধ্যায় নগর, টালিগঞ্জের নাম উত্তমকুমার। সঞ্জয় একা নন। ম্যাচটা শেষ হয়েছে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল; অজিত আগরকর, বীরেন্দর সেওয়াগ, ওয়াসিম জাফররা এখনো অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন এটা প্রমাণ করতে যে ইংল্যান্ড নতুন কিছু আবিষ্কার করেনি। আপাতত যে তত্ত্বটি খাড়া করা হয়েছে, তা হল এমন ব্যাটিং তো ঋষভ পন্থই করে। এ আর নতুন কী? অনেকে ভিভ রিচার্ডস, সেওয়াগ, জয়সূর্য, অ্যাডাম গিলক্রিস্টেরও নাম করেছেন। পণ্ডিতদের (এবং ভারতীয় ক্রিকেট দলের ভক্তদের) বোঝানো দুঃসাধ্য যে কোনো একজন ব্যাটারের টেস্টে একদিনের ক্রিকেটের মেজাজে ব্যাটিং ব্যাজবল নয়, নতুন কিছুও নয়। স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যানই তো একবার একদিনে ৩০০ রান করেছিলেন (১১ জুলাই ১৯৩০)। কিন্তু একটা আস্ত টেস্ট দলের ব্যাটিং কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্য কিছু না ভেবে রান তাড়া করে যাওয়া, এক থেকে এগারো নম্বর, সবাই সেই নীতি মেনে ব্যাট করছে – এমনটা টেস্টের ইতিহাসে হয়নি। জো রুটের মত কপিবুক ব্যাটার নিয়মিত স্পিনারদের সুইচ হিট মারছেন, জোরে বোলারদের ব্যাট উল্টে স্লিপের মাথার উপর দিয়ে মাঠের বাইরে পাঠাচ্ছেন। অর্থাৎ দলের পরিচালকরা এটাই চাইছেন। স্টোকস এজবাস্টনে টস জিতে বলেছিলেন, তাঁর দল রান তাড়া করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। টেস্ট ম্যাচে টসে জিতে ফিল্ডিং নেওয়া হবে না প্রথমে ব্যাট করা হবে, তা ঠিক হচ্ছে পিচ বা আবহাওয়ার চরিত্র দেখে নয়, রান তাড়া করার পারদর্শিতা মাথায় রেখে – এ জিনিস অভূতপূর্ব। শুধু টেস্ট খেলা নয়, খেলাটাকে নিয়ে আলোচনা করার মানদণ্ডটাই তো বদলে দিল ইংল্যান্ড। ব্যাজবল বলুন বা অন্য কিছু বলুন, নামে কী আসে যায়? ব্যাজবলকে যে নামেই ডাকা হোক, তার সুগন্ধ কমে না। মুশকিল হল, আমরা ভারতীয়রা আর খেলার সুগন্ধ পাই না, সেটা সামরিক লড়াইসুলভ প্রতিহিংসার পূতিগন্ধে চাপা পড়ে যায়। আমাদের দলকে প্রত্যেক খেলায় জিততে হবে, আম্পায়ারের প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত আমাদের পক্ষে যেতে হবে। অন্যথা হলে আমাদের খেলোয়াড়রা দাঁত নখ বের করে ফেলেন, আমরাও গ্যালারিতে বা টিভির/মোবাইলের সামনে বসে ব্যাপারটা জাতীয় সংকট হিসাবে ধরে নিয়ে ফুঁসতে থাকি। প্রতিপক্ষের ভাল বোলিং বা ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতাই যখন হারিয়ে গেছে, তাদের দলগত উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে তারিফ করার ক্ষমতা আর থাকবে কী করে?

তবে প্রাক্তন ক্রিকেটাররা কী বললেন; বিশ্লেষক, সাংবাদিকরা কী টুইট করলেন আর তার প্রভাবে সাধারণ ক্রিকেটভক্তদের কী প্রতিক্রিয়া হল তা নিয়ে আলোচনার দরকার হত না, যদি না প্রতিপক্ষের অভিনবত্বকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা খোদ ভারতীয় ক্রিকেট দলের মধ্যেই দেখা যেত। এজবাস্টনে ভারত যেভাবে খেলেছে, তাতে মনে করা অমূলক নয় যে বুমরা আর কোচ রাহুল দ্রাবিড়ও ব্যাজবল ব্যাপারটাকে স্রেফ ইংরেজ মিডিয়ার অতিকথন বলেই ধরে নিয়েছিলেন। তাই তার জন্যে আলাদা করে কোনো পরিকল্পনা করেননি। নইলে হু হু করে রান হয়ে যাচ্ছে দেখেও রানের গতি কমানোর জন্যে চতুর্থ দিন রক্ষ্মণাত্মক ফিল্ডিং সাজানো, রক্ষণাত্মক বোলিং করা হল না কেন? তাহলে কি ধরে নেওয়া হয়েছিল, কোনোভাবে কয়েকটা উইকেট ফেলতে পারলেই ইংল্যান্ড ম্যাচ বাঁচানোর কথা ভাববে, যেমনটা টেস্ট ক্রিকেটে চিরকাল হয়ে এসেছে? দ্বিতীয় ইনিংসে ভারতের ব্যাটিং দেখেও মনে হয়নি, তারা এমন একটা দলের জন্য লক্ষ্য স্থির করছে যারা পরপর তিনটে টেস্টে ঝড়ের গতিতে আড়াইশোর বেশি রান তাড়া করে জিতেছে। চেতেশ্বর পুজারা ছাড়া আর কেউ যত বেশি সময় সম্ভব ব্যাট করে ইংল্যান্ডের রান তোলার সময় কমিয়ে ফেলার কথা ভেবেছেন, এমন লক্ষণ দেখা যায়নি। ঋষভ যে সময়ে যে শট খেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে আউট হলেন, তাতেও মনে হয় তাঁর ধারণা হয়েছিল যথেষ্ট রান উঠে গেছে। এরপর দ্রুত যা পাওয়া তা-ই বোনাস। এমনিতে ৩৭৮ রান যথেষ্ট বলে মনে হওয়া দোষের নয়। কিন্তু ভিডিও অ্যানালিস্ট, পরিসংখ্যানবিদ ইত্যাদি বাহিনী সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট দল নিউজিল্যান্ড সিরিজের কথা জেনেও এত নিশ্চিন্ত থাকতে পারল?

অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনটে টেস্টে (দক্ষিণ আফ্রিকায় শেষ দুটো টেস্ট আর এজবাস্টন) চতুর্থ ইনিংসে বোলাররা চরম ব্যর্থ হওয়ার পর যে ভারতীয় বোলিংকে এতদিন পাইকারি হারে সর্বকালের সেরা তকমা দেওয়া হচ্ছিল, তাকে নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। আসলে অন্ধ হলে যে প্রলয় বন্ধ থাকে না, সে কথাটা অন্য সব ক্ষেত্রের মত ক্রিকেটেও আমরা অনেকদিন হল ভুলে থাকা অভ্যাস করেছি। তার ফল দেখে এখন মাথা চুলকোতে হচ্ছে। বোলারদের আর দোষ কী? ইংল্যান্ডের মত ফর্মে থাকা, জয়ের ছন্দে থাকা ব্যাটিংয়ের বিরুদ্ধে যদি আপনি তিনজন বোলার আর দুজন আধা অলরাউন্ডার নিয়ে খেলতে নামেন, তাহলে এমন ফল হওয়া তো অস্বাভাবিক নয়। বিশেষ করে যখন পিচ ম্যাচের শেষ দুদিনে বোলারদের যতটা সাহায্য করার কথা ততটা করল না।

তিনজন খাঁটি পেসারের সঙ্গে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মত একজন খাঁটি স্পিনারকে খেলানো হয়নি, খেলেছেন শার্দূল ঠাকুর আর রবীন্দ্র জাদেজা। এই একই কৌশল বিরাট কোহলি আর রবি শাস্ত্রীও নিয়েছিলেন ম্যাচের পর ম্যাচ। তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে রোহিত শর্মা (এ ম্যাচে বুমরা)-দ্রাবিড় জুটিও একই কৌশল নিচ্ছে। জাদেজাকে আধা অলরাউন্ডার বললে অনেকে যারপরনাই রাগ করেন, কিন্তু সত্যিটা হল দেশের মাঠে তিনি একজন ম্যাচ জেতানো স্পিনার। কিন্তু বিদেশে ক্রিকেট খেলার সময়ে তিনি একজন শক্তিশালী ব্যাটার, যিনি সামান্য হাত ঘোরাতে পারেন। গত ৪-৫ বছরে বিদেশের মাঠে ভারতের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটার হলেন ঋষভ আর জাদেজা। ভারতের তিন, চার আর পাঁচ নম্বর সেই ২০১৮-১৯ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরের পর থেকেই নড়বড়ে। পুজারা, বিরাট আর অজিঙ্ক রাহানে যতগুলো ইনিংসে একসাথে সফল হয়েছেন তার চেয়ে বেশি ইনিংসে ব্যর্থ হয়েছেন। উদ্ধার করেছেন নীচের সারির ব্যাটাররা। কখনো ঋষভ, কখনো বোলারদের সঙ্গে নিয়ে জাদেজা। অতএব উপরের তিনজনের ব্যর্থতা ঢাকতে তাঁর ব্যাটটা দরকার, তাতে বোলিং শক্তিতে যতই ঘাটতি হোক। একই কারণে বল হাতে তেমন সাফল্য না পেলেও হার্দিক পাণ্ড্যাকে এগারোটা টেস্ট খেলানো হয়েছিল। চোটের কারণে হার্দিক সরে যাওয়ার পর আনা হয়েছে শার্দূলকে। হার্দিকের তবু কিছুটা গতি ছিল, শার্দূলের তা-ও নেই। পিচ থেকে একেবারে সাহায্য না পেলে, প্রধান বোলাররা প্রথম দিককার উইকেটগুলো না নিতে পারলে শার্দূলের পক্ষে সফল হওয়া কঠিন। মূলত বুমরা আর শামি দীর্ঘকাল দারুণ ফর্মে থাকায় এইসব ফাঁকফোকর ধরা পড়েনি। তাঁরা এখন প্রাকৃতিক নিয়মেই ফর্ম হারাচ্ছেন, আর ফাঁকগুলো বিরাট হাঁ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

রাহানেকে অনেক ব্যর্থতার পরে বাদ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পুজারা আর বিরাট এখনো খেলে যাচ্ছেন। পুজারার কোনো ব্র্যান্ড ভ্যালু নেই, তিনি সাদা বলের ক্রিকেটে জায়গা করে নিতে পারেননি, আইপিএলও খেলেন না। তাই তাঁর যোগ্যতা নিয়ে তবু প্রশ্ন তোলা চলে। তিনি প্রথম একাদশ থেকে বেশ কয়েকবার বাদ গেছেন। উপর্যুপরি ব্যর্থতার পর ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কা সিরিজেও বাদ পড়েছিলেন, কাউন্টি ক্রিকেটে ঝুড়ি ঝুড়ি রান করে ফেরত আসতে হয়েছে। কিন্তু বিরাট হলেন অনির্বচনীয় গুণের আধার। ২০১৮-১৯ মরসুমের অস্ট্রেলিয়া সফরের পর থেকে বিরাট বা পুজারা কেউই ধারাবাহিকভাবে রান করেননি। নভেম্বর ২০১৯ থেকে দুজনের পারফরম্যান্স পাল্লা দিয়ে খারাপ হয়েছে। প্রথম জনের গড় ২৯.৬৪, দ্বিতীয় জনের ২৮.৩১। কিন্তু দলে বিরাটের জায়গা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না। সকলেই জানে, তিনি যে কোনো দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর ৭১তম শতরানটি করে রানে ফিরবেন। ততদিন জাদেজা, শার্দূলরা তাঁর রানগুলো করে দেবেন না কেন?

আরও পড়ুন বড় ক্রিকেটারে নয়, বিরাট ব্র্যান্ডে মোহিত জনগণমন

শাস্ত্রী-কোহলির দেখানো এই পথেই রাহুল-রোহিত হাঁটছেন যখন, তখন এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই ভারতীয় ক্রিকেটের ক্রমমুক্তি হবে নিশ্চয়ই। বছরের গোড়ায় যখন নতুন লোকেদের হাতে ভারতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল, তারপর সাঁইত্রিশ পেরনো ঋদ্ধিমান সাহাকে দ্রাবিড় জানিয়ে দিলেন তাঁর কথা আর ভাবা হবে না, তখন মনে হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট সত্যিই বদলাচ্ছে। কিন্তু এখন আবার সবাই চলতি হাওয়ার পন্থী। অফ ফর্মে থাকা বিরাট, সদ্য কোভিডের জন্য টেস্ট না খেলা অধিনায়ক রোহিত প্রমুখ বিশ্রাম নেবেন। তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজে একদিনের ম্যাচে ভারতের অধিনায়কত্ব পাচ্ছেন সাঁইত্রিশের দিকে এগোনো শিখর ধাওয়ান।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

ভারতীয় ক্রিকেট বয়স ঢেকে ফেলছে বিজ্ঞাপনে

অ্যালাস্টেয়ার কুককে নিশ্চয়ই ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে আছে। টেস্ট ক্রিকেটে বারো হাজারের বেশি রান করা ব্যাটারকে এমনিতেই কোনো ক্রিকেটপ্রেমী ভোলেন না। তার উপর কুক জীবনের প্রথম এবং শেষ টেস্ট খেলেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধেই, আর দুটোতেই তিন অঙ্কের রান করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ২০১১ সালে ভারতের অভিশপ্ত ইংল্যান্ড সফরের সময়ে এজবাস্টন টেস্টে ক্রিকেটজীবনের সর্বোচ্চ স্কোরেও (২৯৪) পৌঁছন। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেলা কুক এখনো দাপটে কাউন্টি ক্রিকেট খেলছেন। এ মরসুমে এসেক্সের এই ওপেনারের গড় এখন ৬০। পাঁচটা ম্যাচেই তিনটে শতরান করে ফেলেছেন এবং দুই দশকব্যাপী প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট কেরিয়ারে আগে কখনো যা পারেননি, তা ঘটিয়ে ফেলেছেন গত ম্যাচে। দুই ইনিংসেই শতরান করেছেন।

এদিকে কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে ইংল্যান্ডের টেস্ট দলের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে। জো রুটের কাছে ইংল্যান্ডের কর্মকর্তা, ক্রিকেটপ্রেমী – সকলেরই বিরাট আশা ছিল। কিন্তু ব্যাটার হিসাবে যথেষ্ট সফল হলেও অধিনায়ক হিসাবে রুট একেবারে ব্যর্থ হয়েছেন। গত আঠারোটা টেস্টের মধ্যে মাত্র একটা জিতেছে ইংল্যান্ড। ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। যে যে কারণে ইংল্যান্ডের এমন হাঁড়ির হাল, তার অন্যতম হল ওপেনারদের ব্যর্থতা। কুক অবসর নেওয়ার পর থেকে অনেককে নির্বাচকরা সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু কেউই ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি। কুক ইতিমধ্যে স্যার অ্যালাস্টেয়ার কুক হয়ে গেছেন। মানে ক্রিকেট মাঠে তাঁর কীর্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন স্বয়ং রানী এলিজাবেথ। জাতীয় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড সম্প্রতি খোলনলচে বদলে ফেলেছে। নতুন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট হয়েছেন প্রাক্তন ক্রিকেটার রব কী, নতুন টেস্ট অধিনায়ক বেন স্টোকস আর টেস্ট দলের কোচের দায়িত্বে এসেছেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। দেশটার নাম ভারত হলে এতদিনে হাউস অফ কমন্সে সব দলের সাংসদরা মিলে রেজলিউশন পাস করাতেন, নতুন অধিনায়ক আর কোচকে কুককে অবসর ভেঙে ফিরে আসতে বলতেই হবে। কুক নিজেও শতমুখে সংবাদমাধ্যমকে বলে বেড়াতেন, তিনি এখনো দারুণ ফিট এবং জীবনের সেরা ফর্মে রয়েছেন।

কিন্তু দেশটার নাম ইংল্যান্ড। কয়েকদিন আগে কুককে এক সাক্ষাৎকারে রব কীর নিয়োগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ভালই তো। ইংল্যান্ডের ক্রিকেটের এখন একেবারে নতুন করে শুরু করা উচিত। নিজের সম্পর্কে কোনো কথাই বলেননি। বরং বলেই দিলেন যে পুরনো সবকিছু ভুলে এগোনো উচিত।

স্নেহময় জ্যাঠামশাইরা পরীক্ষায় ফেল করা ভাইপোদের উৎসাহ দেওয়ার জন্যে এরকম বলতেন। তা কুকজেঠুর বয়স কত? সাঁইত্রিশ বছর চার মাস। চলতি আইপিএলে গত ম্যাচটা (তা-ও বিপক্ষের দ্রুততম বোলার লকি ফার্গুসন কোনো অজ্ঞাত কারণে বল করতে এলেন বিরাট আর ফ্যাফ দু প্লেসি সেট হয়ে যাওয়ার পর এবং মাত্র দু ওভার বল করলেন) বাদ দিলে চূড়ান্ত ব্যর্থ (তিনটে ম্যাচে প্রথম বলে আউট; ১৪ ম্যাচে ৩০৯ রান, গড় ২৩.৭৬) বিরাট কোহলির বয়স কত? সাড়ে তেত্রিশ। অর্থাৎ কুক বিরাটের বয়সেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তাঁর এখনকার ফর্ম দেখে মনে করা অমূলক নয় যে অবসর না নিলে তিনি এতদিনে শচীন তেন্ডুলকরের টেস্ট ক্রিকেটে মোট রানের রেকর্ড (১৫,৯২১) আর সবচেয়ে বেশি টেস্ট খেলার রেকর্ড (২০০) – দুটোরই কাছাকাছি পৌঁছে যেতেন। অথচ এখন কনিষ্ঠরা পারছে না দেখেও ফিরে আসার নাম করছেন না। বোর্ডও এখন পর্যন্ত তাঁর নাম করেনি। ভক্তরা কেউ কেউ সোশাল মিডিয়ায় কুকের নাম ভাসিয়ে দিয়েছে, কিন্তু প্রাক্তন ক্রিকেটাররাও তা নিয়ে বিশেষ উৎসাহ প্রকাশ করছেন না। এদিকে বিরাটকে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক – অনেকেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। তিনি নাকি একটানা অনেকদিন খেলে ফেলেছেন, কদিন বিশ্রাম নিলেই হইহই করে রানে ফিরবেন। বিরাটও গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচের আগে আইপিএলের সরাসরি সম্প্রচারকারী সংস্থাকে সাক্ষাৎকারে বললেন তাঁর উপর দিয়ে সত্যিই অনেক ধকল গেছে, তাই বিশ্রাম নিলে ভালই হয়। মজার কথা, বিশ্রাম নেওয়া যে প্রয়োজন সেটা তাঁর আইপিএলের শেষ লগ্নে এসে খেয়াল হল। বিরাট মনে করেন আমাদের প্রাক্তন ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট রবি শাস্ত্রীর চেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁর নেই। তিনি শুধু বিরাটকে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেননি, বলেছেন বিশ্রামের পর বিরাট আরও ছ বছর খেলতে পারে। অর্থাৎ কুক যে বয়সে ফর্মে থেকেও জ্যাঠামশাইয়ের ভূমিকা উপভোগ করছেন, বিরাট সেই বয়সেও খেলে যাবেন। অথচ বিরাটের ফর্ম কিন্তু এবারের আইপিএলে হঠাৎ উধাও হয়েছে এমন নয়। এই সাইটেই আগে লিখেছি, কোনো ধরনের ক্রিকেটেই তিনি তেমন প্রভাব ফেলতে পারছেন না অনেকগুলো বছর হয়ে গেল।

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নতুন করে শুরু করার কাজটা আগেই করেছে, কারণ আইসিসি টুর্নামেন্টে বারবার ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা দরকার। শাস্ত্রীর জায়গায় এসেছেন রাহুল দ্রাবিড় আর সাদা বলের অধিনায়ক করা হয়েছিল রোহিত শর্মাকে। বিরাট টি টোয়েন্টি ক্রিকেট ছাড়া অন্যগুলোর লাগাম নিজের হাতে রাখতে চেয়েছিলেন, বোর্ড সে গুড়ে বালি দিয়ে পরে টেস্ট ক্রিকেটেও রোহিতকেই নেতা করে দিয়েছে। তা রোহিতের বয়স কত? পঁয়ত্রিশ। টেস্ট ক্রিকেট কোনোদিনই রোহিতের সেরা মঞ্চ ছিল না। ন বছর আগে টেস্ট অভিষেক হলেও এতদিনে মোটে পঁয়তাল্লিশটা টেস্ট খেলেছেন, শতরান মাত্র আটটা। বিদেশে প্রথম শতরান পেলেন গত ইংল্যান্ড সফরে। তিনি আসলে সাদা বলের যম। অথচ গত ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টিতে বিরাটের পাশাপাশি তিনিও ব্যর্থ হয়েছিলেন, এবার আইপিএলেও মোটেই রানের মধ্যে নেই (১৩ ম্যাচে ২৪৮ রান; গড় ২০.৪৬)। একাধিকবার আইপিএল খেতাব জয়ী মুম্বাই ইন্ডিয়ানস যে এবার পয়েন্ট টেবিলের একেবারে তলায় পড়ে আছে, তার অন্যতম কারণ রোহিতের খারাপ ফর্ম।

এ বছর ফের ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি। স্বয়ং অধিনায়ক এরকম ফর্মে থাকলে দলের অবস্থা কী হবে? উপরন্তু দলের সবচেয়ে বড় তারকা বিরাটকে দীর্ঘদিন ধরে টি টোয়েন্টির উপযোগী দেখাচ্ছে না। তিনি ইদানীং এত সাবধানে ব্যাট করছেন (বৃহস্পতিবার গুজরাট টাইটান্সের বিরুদ্ধে ৫৪ বলে ৭৩ রান করার আগে অব্দি স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৩.৪৬), যে তিনি বড় রান করলে দলের মোট রান ভাল জায়গায় পৌঁছনো শক্ত। অথচ এই দুই তারকা থাকতে ঋতুরাজ গায়কোয়াড়, রাহুল ত্রিপাঠী, রাহুল টেওটিয়াদের মত বড় শট নিতে পারা ব্যাটারদের দলে জায়গা হবে না।

তবে ভারতীয় ক্রিকেট যে ভারত দেশটার মতই পিছন দিকে এগোতে চাইছে, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই দুজন নন। সাঁইত্রিশ বছরের কুক যদি জেঠু হন, আগামী ৭ জুলাই একচল্লিশে পা দিতে চলা মহেন্দ্র সিং ধোনি নিঃসন্দেহে পিতামহ ভীষ্ম। তাঁর যে ইচ্ছামৃত্যু, তা সেই ২০১১ সালেই প্রমাণ হয়ে গেছে। দল পরপর আটটা টেস্ট হারার পরেও ধোনির অধিনায়কত্ব যায়নি, বরং সে প্রস্তাব নির্বাচন কমিটির মিটিংয়ে তোলার পরে মোহিন্দর অমরনাথের নির্বাচকের চাকরি গিয়েছিল। ভারতের একদিনের ক্রিকেটের দলও ধোনিকে বয়ে বেড়িয়েছে বছর চারেক। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল আর বড় শট নিতে পারেন না, অন্য প্রান্ত থেকে কেউ সে কাজটা করলে তিনি বড়জোর এক-দুই রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখতে পারেন, যা অনেকসময় জেতার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তবু তাঁকে অবসর নিয়ে প্রশ্ন করলে বেজায় রেগে যেতেন। ২০১৬ ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি থেকে ভারতের বিদায়ের পর তো নির্লজ্জতার শিখরে উঠেছিলেন। এক অস্ট্রেলিয় সাংবাদিক এই প্রশ্ন করায় তাঁকে সাংবাদিক সম্মেলনের ডায়াসে ডেকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি ধোনির অবসর দেখতে চান কিনা। তিনি তো আর ভারতীয় নন, যে কোনো আত্মীয় পরিজন থাকবে যে ধোনির জায়গায় খেলতে পারে।

এন শ্রীনিবাসনের থেকে ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন বলেই ধোনি একদিনের ক্রিকেট খেলতে পেরেছেন ২০১৯ বিশ্বকাপ অব্দি। অথচ ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে চার, ছয় মারার ক্ষমতা তো বটেই, গড়ও কমে গিয়েছিল। কেরিয়ারের ব্যাটিং গড় যেখানে পঞ্চাশ, সেখানে এই চার বছরের গড় নেমে এসেছিল চুয়াল্লিশে। চারে নেমে খেলতে না পারলে টিভি স্টুডিওতে বসে বিশেষজ্ঞ প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বলতেন ধোনিকে পাঁচে খেলানো উচিত। পাঁচে না পারলে বলতেন ছয়ে। অর্থাৎ দল তাঁকে বয়ে বেড়াত। কালে ভদ্রে একটা ম্যাচে উইনিং স্ট্রোক নিলেই ফের সবাই মনে করিয়ে দিত, ধোনি সর্বকালের সেরা ফিনিশার। আর ধোনিকে এসব জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বারবার বলতেন, আগের মত অত ছয় মারেন না তো কী হয়েছে? তিনি তো ফিট আছেন। যেন খেলাটা ক্রিকেট নয়, জিমন্যাস্টিক্স।

আসলে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে অনেক সমস্যা মিটে যায়। তাই ধোনি নির্বিঘ্নেই খেলে ফেলেন আরও একটা বিশ্বকাপ। কিছু বিশেষজ্ঞ আর অন্ধ ভক্ত আজও বলেন “যদি গাপ্টিলের থ্রোটা উইকেটে না লাগত…”। ভুলে যান যে ধোনি সেদিন পঞ্চাশে পৌঁছতে লাগিয়েছিলেন বাহাত্তরটা বল, মাত্র একটা চার আর একটা ছয় মেরেছিলেন। রবীন্দ্র জাদেজা ৫৯ বলে ৭৭ রান করেছিলেন বলে নিউজিল্যান্ডের জয়ের ব্যবধান আরও বড় হয়নি – এটুকুই সান্ত্বনা। নইলে শেষ ওভারে ধোনির ভেলকি দেখানোর সম্ভাবনা আরও আগেই শেষ হয়ে যেত। রাজনীতিতে প্রচারযন্ত্র অনুকূল হলে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু খেলার মাঠে পরিণাম বদলানো যায় না।

আরও পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

এতদিন পরে হৃদয় খুঁড়ে আবার এসব বেদনা জাগাতে হচ্ছে, কারণ এবারের আইপিএলে ধোনি ওই জাদেজাকেই হাসির পাত্র বানিয়ে ছেড়েছেন। এমনিতে চেন্নাই সুপার কিংসের মালিক শ্রীনিবাসনের কোম্পানি ইন্ডিয়া সিমেন্টসের অন্যতম ডিরেক্টর ধোনি। সুপার কিংস দলটা সে অর্থে তাঁর নিজের সম্পত্তি। যার ব্যাট, যার উইকেট তাকেই খেলতে নেব না – এ জিনিস পাড়া ক্রিকেটেই চলে না, আইপিএলে কী করে চলবে? ফলে ধোনির উইকেটরক্ষায় যতই শিথিলতা আসুক, ব্যাট হাতে ধারাবাহিকতা যতই কমে যাক, এ দলে তিনি যতদিন খেলতে চাইবেন ততদিনই খেলবেন। সমস্যা হল, তিনি কেবল খেলছেন না, খেলতে গিয়ে অন্যদের কোণঠাসা করছেন। আইপিএল শুরু হওয়ার মুখে ঘটা করে ঘোষণা করা হয়েছিল, পিতামহ অধিনায়কের সিংহাসনটি স্নেহভাজন জাদেজার হাতে ছেড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরু হতেই দেখা গেল ফিল্ডিং সাজানো, বোলিং পরিবর্তন – সবকিছুতেই ধোনির কথাই শেষ কথা। জাদেজা নেহাতই রাবার স্ট্যাম্প। অবশ্য তাতেও সুপার কিংস দলের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হওয়া আটকায়নি। কিন্তু ব্যাটে, বলে ব্যর্থ জাদেজা নটা খেলার মধ্যে ছটা হারার পর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতে চাইলেন। ধোনি মুকুট ফিরিয়েও নিলেন, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঋতুরাজ সিংয়ের মত তরুণতর কাউকে দায়িত্ব দিলেন না। তাহলে মরসুমের শুরুতে নেতৃত্ব ছেড়ে দেওয়ারই বা কী প্রয়োজন ছিল? জাদেজাও তো তেত্রিশ পেরিয়েছেন, কচি খোকাটি নন। তাঁর হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে কোন মহৎ উদ্দেশ্যসাধনের আশা ছিল? জাদেজা এই মুহূর্তে চোট-আঘাতের কারণে মাঠের বাইরে। এই টানাপোড়েনে তাঁর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল কিনা তিনি মাঠে না ফেরা পর্যন্ত জানা যাবে না। যদি ধরে থাকে, তাহলে সুপার কিংসের চেয়ে বেশি ক্ষতি কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট দলের।

আসলে বাকি পৃথিবী সামনের দিকে তাকাতে চায়, আর আমরা চাই অতীতের গৌরবে বুঁদ হয়ে থাকতে। এ আমাদের জাতীয় চরিত্র। তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে অতি বড় ক্রিকেটারেরও ক্ষমতা কমে আসে, আজ না কমে থাকলেও পরের বড় টুর্নামেন্টটা আসতে আসতে যে কমে যেতে পারে – এসব কথা না তাঁরা নিজেরা মানেন, না তাঁদের ভক্তকুল মানে। তারকারা আয়নায় মুখ দেখতে পান না, কারণ মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে। ফলে ব্যাটে বলে হচ্ছে না, পা বলের লাইনে যাচ্ছে না, রিফ্লেক্স কমে গেছে, বহু বছর ধরে অতিমাত্রায় জিম করার ফলে টানা দু ঘন্টা ব্যাট করলেই পেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে – এসব যখন ক্রিকেটার নিজে বুঝতে শুরু করেন, তখনো সবাই মিলে কানের কাছে বলতে থাকে “ও কিছু নয়। কদিন ব্রেক নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।” এমনটাই এনডর্সমেন্টের যুগে ভারতীয় ক্রিকেটে হয়ে আসছে। যেনতেনপ্রকারেণ চল্লিশ অব্দি খেলে যাওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন শচীন। ধোনি ভাবলেন তিনিই বা কম কিসে? হয়ত পঁয়তাল্লিশকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছেন। বিরাট ভাবছেন তিনি তো কোনো অংশে ধোনির চেয়ে কম যান না। রোহিত সবে অধিনায়ক হলেন, পঞ্চাশ ওভার আর কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে তাঁরও ঝুড়ি ঝুড়ি রান আছে। তিনিই বা চল্লিশ অব্দি খেলার কথা ভাববেন না কেন? “ক্রিকেটের ঈশ্বর” তো শচীন, কুক তো নন। ফলে টেওয়াটিয়া, ত্রিপাঠীদের বেলা মেঘে মেঘেই বাড়বে।

ঋদ্ধিমান সাহার বেলায় দ্রাবিড় ভদ্রভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এই ছেলেখেলা তিনি চলতে দেবেন না। এই ২০২২ সালেও উনবিংশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের গন্ধে মাতাল বাঙালি তা নিয়ে বিস্তর গোল করেছিল। এবারের আইপিএলে গুজরাট টাইটান্সের ওপেনার হিসাবে ঋদ্ধিমানের সাফল্যে আবার গুঞ্জন শুরু হয়েছে। ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টির দল নির্বাচনের সময়ে যদি তরুণদের সুযোগ দেওয়ার নীতি ভুলে গিয়ে তারকাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু মানতেই হবে, পোর্টফোলিওতে যথেষ্ট পরিমাণ এনডর্সমেন্ট থাকলে ঋদ্ধিমানের বয়সও ঢেকে যেত।

*সব পরিসংখ্যান ১৯ মে, বৃহস্পতিবারের গুজরাট টাইটান্স বনাম রয়াল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর ম্যাচ পর্যন্ত

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

%d bloggers like this: