আজ জুটেছে, কাল কী হবে লাতিন আমেরিকার ফুটবলের?

জিদান প্রয়াত সক্রেটিসের মত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন না। মারাদোনার মত ফিদেল কাস্ত্রো বা কিউবাপ্রীতিও নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে জিদানের মনুষ্যত্বের কাছেই টাকার অঙ্কটা অশ্লীল বলে মনে হয়েছিল।

ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুই নাকি বলেছিলেন, আমার পরেই আসবে প্লাবন। লিওনেল মেসি এখন পর্যন্ত তেমন কিছু বলেছেন বলে জানা যায়নি। তবে বিশ্বকাপ ফাইনালই যে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে তাঁর শেষ ম্যাচ ছিল সেকথা তো জানা গেছে। এখন প্রশ্ন হল, আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের ভবিষ্যৎ কী? দিয়েগো মারাদোনা ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ থেকে ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হন। পরে পাকাপাকিভাবে অবসর নেওয়ার সময়ে বলেন, আমার পরে অনেকদিন বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছবে না আর্জেন্টিনা। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। ১৯৯০ সালে রোমে তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার ২৪ বছর পরে আবার আর্জেন্টিনা ফাইনালে পৌঁছয় ২০১৪ সালে রিও দি জেনেইরোতে। মারাদোনার মত মেসির আমলেও আর্জেন্টিনা দুবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলল। আবার কবে ফাইনালে পৌঁছবে? প্রশ্নটার পরিসর আরেকটু বড় করে নেওয়া যাক? লাতিন আমেরিকার কোনও দল আবার কবে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলবে? বা লাতিন আমেরিকার দলগুলোর ভবিষ্যৎ কী? প্রশ্নগুলো বৈধ, কারণ বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিলও শেষবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে কুড়ি বছর হয়ে গেল। কেবল ফাইনালে পৌঁছনোকেই সাফল্যের প্রমাণ হিসাবে ধরে নিয়ে অবশ্য কোনও আলোচনা করা যায় না। কিন্তু ঘটনা হল গত তিন দশকে সামগ্রিকভাবেই লাতিন আমেরিকা বিশ্বকাপে ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে ইউরোপের তুলনায়।

এমনিতেই চিলে, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা বা প্যারাগুয়ের মত দলে মাঝেমধ্যে কয়েকজন চোখ টানার মত ফুটবলার আসেন, তখন তাঁদের নিয়ে হইচই হয়। কিন্তু দল শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপে বেশিদূর এগোতে পারে না। উরুগুয়ে দুবার বিশ্বকাপ জিতেছিল সেই গত শতকের প্রথমার্ধে, স্মরণকালে তাদের সেরা বিশ্বকাপ ২০১০। মূলত দিয়েগো ফোরলানের নৈপুণ্যে আর লুই সুয়ারেজের আক্ষরিক অর্থে হাতযশে সেমিফাইনালে উঠে তারা হেরে যায় এবং প্লে অফে জার্মানির কাছে হেরে চতুর্থ স্থান দখল করে। তাই বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকার ফুটবল মানে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাই। সেই ব্রাজিল পরপর তিনটে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয় দুই সহস্রাব্দের সন্ধিকালে। তারপর ২০১৪ সালের আগে আর সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি এবং ঘরের মাঠে মারাকানা স্টেডিয়ামের সেই সেমিফাইনাল ব্রাজিল সমর্থকদের পক্ষে বিভীষিকা হয়ে আছে। এবারের ব্রাজিলকে অনেক বেশি জমাট দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল নেইমার-নির্ভরতাও নেই। কিন্তু সেই ব্রাজিলও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিল। আর্জেন্টিনা ১৯৯০ আর ২০১৪— এই দুই ফাইনালের মাঝে একবারও শেষ চারে পৌঁছয়নি। স্বভাবতই আর্জেন্টিনার এবারের সাফল্যে ইউরোপের আধিপত্য খর্ব হল বলে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে অনেকের যে উল্লাস, তার স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দিহান হওয়ার কারণ আছে। আধিপত্য আদৌ খর্ব হয়েছে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ আছে। আগামীবার থেকে বিশ্বকাপ ৪৮ দলের হয়ে গেলে ইউরোপের প্রাধান্য উল্টে বেড়েও যেতে পারে। প্রশ্ন হল, এমন হচ্ছে কেন? ২০০২ থেকে ২০২২— এই দুই দশকে এমন কী ঘটল যে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা ক্রোয়েশিয়ার চেয়েও কম ধারাবাহিক হয়ে পড়ল? ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড তো বটেই, গত ২০ বছরে বুলগেরিয়া, রোমানিয়ার মত বিশ্বকাপে অনিয়মিত দলের সামনে পড়লেও কেন হেরে যায় লাতিন আমেরিকার দানবরা? এইসব প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরও। সে উত্তর মাঠের ভিতরে খুঁজলে অগভীর জবাব পাওয়া যাবে।

বিশ্বকাপে ইউরোপের বাইরের যে দলগুলো খেলতে এসেছিল, তাদের সকলের খেলোয়াড় তালিকার দিকে তাকালেই একটা জিনিস চোখে পড়ে। প্রত্যেক দলেই ইউরোপে ক্লাব ফুটবল খেলা খেলোয়াড়দের সংখ্যা প্রচুর। বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ২৬ জনের দলে রিজার্ভ বেঞ্চের গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আর্মানি আর মাঝমাঠের খেলোয়াড় থিয়াগো আলমাদা ছাড়া সকলেই ইউরোপের কোনও না কোনও ক্লাবের খেলোয়াড়। একমাত্র আর্মানিই খেলেন নিজের দেশের ক্লাব রিভার প্লেটে। ব্রাজিল দলের ছবিটাও খুব আলাদা নয়। অতিরিক্ত গোলরক্ষক ওয়েভার্তন খেলেন সাও পাওলোর পালমেইরাসে আর মাঝমাঠের এভের্তোন রিবেইরো, আক্রমণভাগের পেদ্রো খেলেন রিও দি জেনেইরোর ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোতে। এছাড়া রক্ষণভাগের দানি আলভেস খেলেন মেক্সিকোর উনিভার্সিদাদ নাসিওনাল এসিতে। আর সবাই ইউরোপে খেলেন। আফ্রিকার দেশগুলোর দল ঘাঁটলেও একই ব্যাপার দেখা যাবে। এমনকি এবার চমকে দিল যে জাপান দল, তাদেরও ২৬ জনের মধ্যে শুধু জার্মানির লিগেই খেলেন আটজন। এর সরাসরি ফলাফল হল, ফুটবলে ঘরানা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। আফ্রিকা বা এশিয়ার ক্ষেত্রে সেটা খুব বড় কথা নয়। কারণ বিশ্ব ফুটবলে এই দুই মহাদেশ এতটাই পিছিয়ে থেকে শুরু করেছে যে তাদের এখনও নিজস্ব ঘরানা বলে কিছু তৈরি হয়নি। ইউরোপে খেলতে খেলতে বরং তাদের লাভই হয়। কবি লিখেছিলেন “দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে”। এশিয়া, আফ্রিকার এখনও নেওয়ার পালা চলছে। অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে হয়ত দেওয়ার পালা আরম্ভ হবে। কিন্তু লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা নয়। লাতিন আমেরিকার নিজস্ব ঘরানা ছিল। সারা পৃথিবীর লাতিন আমেরিকান ফুটবলের ভক্তরা তাতেই মোহিত হয়েছিলেন। সেই ঘরানার প্রাণ হল ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, যা চোখের আরাম। সে খেলাকেই ‘জোগো বোনিতো’ অর্থাৎ ‘বিউটিফুল গেম’ বলা চলে। কিন্তু ফুটবল তো মানুষ খেলে। দেবতারা খেলে না, রোবটরাও নয়। ফলে সারা বছর যেভাবে খেলছেন একজন ফুটবলার, তিনি কালেভদ্রে জাতীয় দলের হয়ে একেবারে অন্য দর্শনে, অন্য কায়দায় খেলবেন কী করে? সেকথা জাতীয় দলের কোচকেও বুঝতে হয়, গা জোয়ারি চলে না। ফলে লাতিন আমেরিকান ফুটবলের রহস্য নষ্ট হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীই আসলে খেলে ইউরোপের খেলা। সে খেলায় ইউরোপকে হারাতে যে কালঘাম ছুটে যাবে আর সকলের তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু ক্ষতি শুধু ওটুকু নয়।

কিলিয়ান এমবাপের একটা মন্তব্যে নাকি বেজায় চটেছেন আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। সেই কারণেই দুর্ভেদ্য গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ ফাইনাল শেষ হওয়ার পর থেকে এমবাপেকে বিদ্রুপ করেই চলেছেন, একেকসময় তা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করছে। এমবাপে কিছুদিন আগে বলেছিলেন “ইউরোপে আমাদের সুবিধা হল সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে নেশনস লিগের মত উচ্চমানের ম্যাচ খেলি। ফলে আমরা যখন বিশ্বকাপে যাই তখন তৈরি হয়ে যাই। কিন্তু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকায় এইরকম সুযোগ পায় না। সেখানকার ফুটবল ইউরোপের মত উন্নত নয়। সেই কারণেই গত কয়েকটা বিশ্বকাপে ইউরোপিয়ানরাই জিতেছে।” এমিলিয়ানোর অসভ্যতাকে সমর্থন না করেও তাঁর আবেগকে ধরতে পারা সম্ভব। শুধু তো আর্জেন্টিনা নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার ফুটবল সম্পর্কেই একটা বড় কথা বলেছেন এমবাপে। খোদ ফ্রান্সকেই হারিয়ে দিয়ে মুখের মত জবাব দেওয়া হয়েছে বলে ভাবতেই পারেন এমিলিয়ানো। কিন্তু এমবাপের কথাটা ভেবে দেখার মত।

ইউরোপের চেয়ে লাতিন আমেরিকার ফুটবল যে পিছিয়ে পড়েছে তার পরিসংখ্যানগত প্রমাণ ইতিমধ্যেই দিয়েছি। তবে এমবাপে উদাহরণ দিতে গিয়ে একটু ভুল করেছেন। উয়েফা নেশনস লিগ চালু করেছে সদ্য। উদ্দেশ্য ক্লাব ফুটবলের দাপটে আন্তর্জাতিক ফুটবলের আকর্ষণ কমে যাওয়ার সমস্যা সামলানো। কিন্তু তাতে একটা বড় জিনিস স্বীকার করে নেওয়া হয়, সেটা হল ফুটবল খেলাটাকে চালায় আসলে ক্লাব ফুটবল। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইউরোপের ক্লাব ফুটবল। লাতিন আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে বছর বিশেক হল, আর নেশনস লিগের বয়স মাত্র তিন। লাতিন আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে কারণ তাদের ক্লাব ফুটবল পিছিয়ে পড়েছে। কেন পিছিয়ে পড়ল? কারণটা বিশুদ্ধ অর্থনীতি। ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, জার্মানির দ্বিতীয় সারির ক্লাবগুলোও যে পারিশ্রমিক দিতে পারে তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারে না আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় দুই ক্লাব চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিভার প্লেট আর বোকা জুনিয়র্সও। নেইমারকে খেলানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না ব্রাজিলের ফ্ল্যামেঙ্গো বা পালমেইরাস। আফ্রিকার ক্লাবগুলোর সঙ্গে তো আরও দুস্তর ব্যবধান।

এমন নয় যে লাতিন আমেরিকার খেলোয়াড়দের ইউরোপে চলে যাওয়া এই সহস্রাব্দেই শুরু হয়েছে। মারাদোনা, ক্যারেকা, রোমারিও, বেবেতো, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, রবার্তো কার্লোসরাও বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, নাপোলি, জুভেন্তাস বা এসি মিলানে খেলেছেন। কিন্তু তাঁদের সার, জল দিয়ে বড় করে তুলত আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের ফুটবলব্যবস্থাই। তারপর তাঁদের খেলা দেখে চড়া দামে কিনে নিত ইউরোপের ক্লাবগুলো। মারাদোনার মারাদোনা হওয়া শুরু বোকা জুনিয়র্সে। কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে তিনি ফিরেও যান নিজের দেশে, তাঁর শেষ ক্লাব নেউয়েলস ওল্ড বয়েজ। কিন্তু ফুটবলের অর্থনীতি যেভাবে বদলে গেছে তাতে মেসি নিজের মাইনে কমাতে রাজি হয়েও বার্সেলোনাতেই থাকতে পারলেন না, আর্জেন্টিনায় ফিরে যাওয়া তো দূরের কথা। অবশ্য মেসি আর্জেন্টিনা ছেড়েছেন অনেক ছোট বয়সে। চে গুয়েভারার জন্মস্থান রোজারিওর রুগ্ন শিশু মেসির প্রতিভা ছোটবেলাতেই চিনে নিয়ে বিশ্বখ্যাত লা মাসিয়ায় তুলে এনেছিলেন বার্সেলোনার স্পটাররা। মেসি ও তাঁর পরিবারের হয়ত কিছুটা কৃতিত্ব প্রাপ্য তিনি স্পেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ না করে আর্জেন্টিনার হয়েই সারাজীবন খেললেন বলে। কিন্তু ঘটনা হল পৃথিবী জুড়ে বেড়ে চলা অর্থনৈতিক বৈষম্যের সুযোগে কচি বয়সেই ইউরোপে চলে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার ফুটবল প্রতিভা। মেসির মত ছোট বয়সে না হলেও, কেরিয়ার শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই। তারপর আর কিসের ঘরানা? গোটা পৃথিবীকে এক অর্থনীতির ছাঁচে ঢালাই করার যে পরিকল্পনা বিশ্বায়ন বা নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতির, তারই ফলশ্রুতিতে গোটা পৃথিবীর ফুটবলই আসলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে ইউরোপের ফুটবল। জার্সির রংটুকুই যা আলাদা। মেসির মত জন্মগত প্রতিভা সকলের থাকে না, ফলে ফুটবলের সৌন্দর্য সিস্টেম ছাপিয়ে সকলের পায়ে জায়গা করে নিতেও পারে না। যে তরুণ আর্জেন্টাইন বা ব্রাজিলিয়ানের ফুটবল শিক্ষা হবে ইউরোপের কোচের হাতে, সারাবছর খেলবেন ইউরোপে, তিনি ড্রিবল করায় বিশ্বাস করবেন কম। এটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন বোর্ডের ঘরে যে ধন আছে, ক্রিকেটের ঘরে সে ধন আছে?

ফুটবলের আলোচনায় অর্থনীতি শব্দটা দেখেই যাঁরা নাক কুঁচকে ভাবছেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে রাজনীতি এনে ফেলা হচ্ছে বা ইউরোপ কেবল টাকার জোরে সবাইকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে বলায় যাঁরা রাগ করছেন তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই ২০১৩ সালের কথা। সে বছর ওয়েলশ ফুটবলার গ্যারেথ বেলকে ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরো (১৩১.৮৬ মিলিয়ন ডলার) দাম দিয়ে কিনে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। সেটা তখনকার রেকর্ড ট্রান্সফার ফি। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন এবং সেইসময় রিয়ালে কার্লো আনচেলোত্তির সহকারী জিনেদিন জিদান বলেই ফেলেন “আমাকে দশ বছর আগে কেনা হয়েছিল ৭৫ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার) দিয়ে আর আমি বলেছিলাম আমি অত দাম পাওয়ার যোগ্য নই। এখন আমার মনে হয় কোনও খেলোয়াড়ই এত দাম পাওয়ার যোগ্য নয়। এটা স্রেফ ফুটবল। দুর্ভাগ্যজনক, দুর্বোধ্য যে এত টাকা কেন খরচ করা হচ্ছে।” জিদান প্রয়াত ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার সক্রেটিসের মত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন বলে তো শোনা যায় না। মারাদোনার মত ফিদেল কাস্ত্রো বা কিউবাপ্রীতিরও খবর নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে আলজিরীয় অভিবাসীদের সন্তান জিদানের মনুষ্যত্বের কাছেই কোথাও টাকার অঙ্কটা অশ্লীল বলে মনে হয়েছিল। এখন ২০২২, সর্বকালের সবচেয়ে দামি ট্রান্সফারের তালিকায় প্রথম দশেরও বাইরে চলে গেছেন বেল।

পুরো তালিকাটা দেখুন এখানে। তারপর ভেবে দেখুন, মার্কিনি মদতে বারবার নির্বাচিত সরকার পড়ে যায়, অর্থনীতির দফারফা হয়ে যায় যে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, ভেনিজুয়েলা, পেরুতে— সেখানকার ফুটবল কী করে লড়বে ইউরোপের সঙ্গে? কুড়ি বছর পরে একবার একটা দলের বিশ্বকাপ জয় কি সত্যিই কিছু প্রমাণ করে? এ মাসেই আর্জেন্টিনায় মুদ্রাস্ফীতির হার ৯৯ শতাংশে পৌঁছবে বলে মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। বুয়েনস এয়ার্সের রাস্তা ভরিয়ে মেসির দলকে অভিবাদন জানিয়েছে যে হবু ফুটবলাররা, তাদের কজন ওই নীল-সাদা জার্সি গায়ে চাপানোর সঙ্কল্প বজায় রাখতে পারবে? প্রশ্নটা শুধু আবেগের নয়। মারাদোনার দল যখন বিশ্বকাপ জিতেছিল তখনও আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু দুনিয়াটা বদলে গেছে। বার্সেলোনা ছেড়ে কোনও নিঃস্ব নাপোলিকে ইতালি, ইউরোপের রাজা করতে যাননি মেসি। গেছেন কাতারি ধনকুবেরদের অর্থে পুষ্ট প্যারিসের ক্লাবে। যেখানে তাঁর পাশে খেলেন নেইমার আর এমবাপে— সবচেয়ে দামি ট্রান্সফারের তালিকায় যথাক্রমে এক আর দুই নম্বরে থাকা ফুটবলার।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত

মেসি বিশ্বকাপ জিতলেন, শিল্প বিশ্বজয়ী হল আবার

মেসি কানায় কানায় ভরে উঠলেন। তিনি কী ভাবছিলেন জানি না, কিন্তু কাল টিভির পর্দাজোড়া উল্লাসে মনে হচ্ছিল কে যেন নেই।

আলতামিরার গুহাবাসীরা কি প্লেনে চড়ে দেশ দেশান্তরে যেতে পারত? না। তারা কি কম্পিউটার ব্যবহার করত? না। তারা কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের কাজ যন্ত্রকে দিয়ে করাতে পারত? তাও নয়। তারা কি একটা বোতাম টিপে কয়েক হাজার মাইল দূরের জনপদ ধ্বংস করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছিল? মোটেই না। তারা কি ক্যান্সারাক্রান্ত মানুষের মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়ার উপায় জানত? একেবারেই না। কিন্তু তারা বাইসন আঁকতে পারত। সে বাইসন দেখতে অর্থ আর সামর্থ থাকলে আজও সারা পৃথিবীর মানুষ ছুটে যায়। মানুষের আর কিছুই থাকে না, শিল্পটুকুই থেকে যায়। যতদিন না আমাদের এই গ্রহটা মহাবিশ্বের অনিবার্যতায় জীবজগৎহীন জড়পিণ্ডে পরিণত হচ্ছে, ততদিন আর সব কিছু বদলে যাবে, ফুরিয়ে যাবে। থেকে যাবে আমাদের শিল্প।

সেইজন্যেই সাফল্যের চেয়েও শিল্প আমাদের চোখ টানে বেশি, স্মৃতির বেশি জায়গা অধিকার করে। দিয়েগো মারাদোনা তাই অনেকের চেয়ে কম গোল করে, অনেকের চেয়ে কম ট্রফি জিতেও বহু মানুষের হৃদয়সম্রাট হয়ে রয়েছেন। ক্লাবের হয়ে লিওনেল মেসির চেয়ে বেশি খেতাব ভবিষ্যতে জিততেই পারেন কোনো ফুটবলার, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোই তো খুব পিছিয়ে ছিলেন না। মেসির চেয়ে বেশি গোল হয়ত কিলিয়ান এমবাপেও করে ফেলবেন। কিন্তু যেসব দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন দেড় দশকের বেশি সময়, কাতারের ফুটবল মাঠে যেসব ছবি এঁকেছেন গত একমাস – সেগুলো দিয়েই স্মৃতির মণিকোঠায় মেসির জায়গা পাকা হয়ে গেছে, মারাদোনার মতই। আর কে না জানে স্মৃতির কোনো লেবেল লাগে না, শিল্পে কোনো GOAT হয় না, কোনো র‍্যাঙ্কিং চলে না। এমন কোনো সঙ্গীতরসিক আছেন কি যিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের গান শুনতে ভালবাসেন বলে পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর গান শোনেন না, হিসাব করেন দুজনের মধ্যে কে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ? আমাদের স্মৃতি তো নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগামী ভিড়ে গাদাগাদি ট্রেনের কামরা নয়, যেখানে উত্তমকুমারের চকিত চাহনির পাশে জায়গা হবে না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দীপ্তির।পথের পাঁচালী পড়ে কাঁদলে পুতুলনাচের ইতিকথা-র নির্লিপ্তিতে মুগ্ধ হওয়ার জায়গা থাকবে না – এত সীমিত নয় মানবিক আবেগ।

আর যদি শিল্প জয়যুক্ত হয়? কাল তেমন এক রাত ছিল।

বার্সেলোনার জার্সিতে তিনি যত ফুল ফুটিয়েছেন ইউরোপের মাঠে মাঠে, আর্জেন্টিনার নীল-সাদা জার্সিতে লাতিন আমেরিকায়, দক্ষিণ আফ্রিকায়, রাশিয়ায় – সব সত্ত্বেও থেকে যাচ্ছিল অপূর্ণতা। রত্নখচিত মুকুটে যে কোহ-ই-নূর না থাকলে আর সবই বৃথা মনে হয়। শুধু আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মনে হয় তা নয়, মেসির মুখ দেখলে বোঝা যেত তাঁর নিজেরও মনে হয়। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির কাছে হারের পর সর্বত্রগামী হয়েছিল মেসির অশ্রুসিক্ত ছবি।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

পৃথিবীর মানচিত্রে আর্জেন্টিনার একেবারে অন্য প্রান্তে থাকা ফুটবলে অনুন্নত দেশ ভারতের বাসিন্দা আমরা বিশ্বকাপ দেখি স্রেফ আনন্দের খোঁজে। আমরা প্রাক্তন উপনিবেশ, আমরা তৃতীয় বিশ্ব। স্বভাবতই এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন সফল ইউরোপের চেয়ে বেশি ঝুঁকে থাকে শিল্পী লাতিন আমেরিকার দিকে। ভারতে যখন থেকে বিশ্বকাপ লাইভ দেখা যায় তখন থেকেই নিখুঁত জার্মানি, ইতালি বা লড়াকু চেক রিপাবলিক, ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের আবেগকে বেশি উস্কে দেয় ক্যামেরুন বা নাইজেরিয়া। আজও কি বেশ কাছের মানুষ মনে হয় না রজার মিল্লাকে? এ দেশে যারা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা স্পেনের সমর্থক তাদের মনও তো আসলে কেড়ে নিয়েছিলেন ডেভিড বেকহ্যাম, জিনেদিন জিদান, ইনিয়েস্তার মত বল প্লেয়াররা – ছবি আঁকার নৈপুণ্যে। মানুষ হিংসুটে, মানুষ দাঙ্গাবাজ, মানুষ অকারণে মানুষকে অপমান করে। আইজ্যাক আসিমভ যথার্থই লক্ষ করেছিলেন, মানুষ একমাত্র জীব যারা অন্য জীবকে খাঁচায় পোরে। তবু তো মানুষ যে আনন্দ দেয় তার আনন্দ কামনা করে। খেলার মাঠে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেন শিল্পী ফুটবলাররা। তাই তাঁদের প্রতি পক্ষপাত থাকবেই। বহু মানুষ তাই চেয়েছিলেন, মেসির হাতে যেন একবার বিশ্বকাপটা ওঠে। য়োহান ক্রয়েফ কখনো বিশ্বকাপ ছুঁতে পারেননি, জর্জ বেস্টের সে সুযোগই ছিল না। সে দুর্ভাগ্য যেন মেসির না হয়।

হয়নি। কাল সেই উদ্দাম হাওয়ার রাত ছিল। অন্তত গত চল্লিশ বছরের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিশ্বকাপের ফাইনাল। যেখানে ৩৫ বছরের মেসি প্রথমার্ধেই পেনাল্টি থেকে গোল করলেন, মাঠজুড়ে খেললেন। মাঝমাঠে নিজেদের গোলের দিকে মুখ করে বল পেলেন মেসি, মেসি থেকে জুলিয়ান আলভারেজ, আলভারেজ থেকে ম্যাক অ্যালিস্টার, ম্যাক অ্যালিস্টার থেকে আংহেল দি মারিয়া – ছবির মত গোল হল। আশি মিনিট একতরফা খেলা হওয়ার পর মেসির এক হাত যখন বিশ্বকাপে, তখন ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটো গোল করে ফ্রান্সকে ম্যাচে ফেরালেন এরপর যিনি বিশ্বের অবিসংবাদী সেরা ফুটবলার হয়ে উঠবেন, সেই এমবাপে।

তারপর অতিরিক্ত সময়ের শেষ প্রান্তে ফের গোল দিয়ে মেসি যখন উচ্ছ্বাসে ভাসছেন, ভাবছেন সোনার পরী এবার তাঁর হাতের মুঠোয়, তখনই সামান্য ভুলে পেনাল্টি। হাওয়া ঘুরে গেল আবার। তারপর যদি বনস্পতির বিরাট ছায়া না দিতেন সোনার দস্তানার অধিকারী এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, হয়ত প্যারিসেই উড়ে যেত সোনার পরী।

নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল, এ যুগের সেরা ফুটবল শিল্পীর মুকুটে কোহ-ই-নূর বসিয়ে দেওয়ার ফাইনাল।

মেসি কানায় কানায় ভরে উঠলেন। তিনি কী ভাবছিলেন জানি না, কিন্তু কাল টিভির পর্দাজোড়া উল্লাসে মনে হচ্ছিল কে যেন নেই। সেই তিনি, যিনি ২০১০ সালে মেসির দলের কোচ হয়েও এমন অস্থির পদচারণা করতেন সাইডলাইনে যে মনে হত নিজেই নেমে পড়বেন। যিনি গত বিশ্বকাপেও গ্যালারিতে ছেলেমানুষের মত হাসতেন, কাঁদতেন, চিৎকার করতেন আর্জেন্টিনার ম্যাচে। যিনি ভিআইপি, তবু ভিআইপি নন। যাঁর সঙ্গে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের ফুটবল খেলতে না জানা একজন সাধারণ আর্জেন্টিনা সমর্থকের কোনো তফাত থাকত না, উদ্বিগ্ন সঙ্গীসাথীরা পিছন থেকে জামা ধরে টেনে রাখতেন – পাছে মানুষটা টাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। ১৯৮৬ সালে প্রায় একা দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর পর যিনি জীবদ্দশায় আর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দেখতে পেলেন না, আমূল বদলে যাওয়া ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্ব ফুটবলে ২০ বছর পর লাতিন আমেরিকার বিশ্বজয়ের রাতে সেই আকাশলীন দিয়েগোকে বলতে ইচ্ছে করছিল

ফিরে এসো মারাদোনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার…

মেসি
ছবি @ElDiegoPics টুইটার হ্যান্ডেল থেকে

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

Messi, Mbappe, Pele and Maradona in grand finale

Believers could hold this as proof that matches are made in heaven because there could not have been a more fitting finale to the most competitive World Cup in memory.

One can only see Pele’s Brazil up against Diego Maradona’s Argentina in the FIFA video game, but reality has refused to be left too far behind. It has set up Kylian Mbappe’s France against Lionel Messi’s Argentina. Believers could hold this as proof that matches are made in heaven because there could not have been a more fitting finale to the most competitive World Cup in memory. Japan have beaten Germany; Saudi Arabia have defeated Argentina and Tunisia have beaten France in this edition. Africa got its first World Cup semifinalist in Morocco, who got rid of Spain and Portugal. In short, this World Cup has made the glorious uncertainties of the game the only certainty. In such a World Cup, to have two finalists who started the tournament as favourites feels like a twist in the tale.

There could not be a better final for a neutral. On one hand is Messi, compared both fairly and unfairly to Maradona, in what would be his last World Cup match going by his own assertion. On the other is the obvious heir to Messi’s throne as the best footballer in the world – Mbappe.

Just as Pele was a boy wonder when Brazil won their first World Cup in 1958, Mbappe was an eye-catching teen when France won it in Russia four years back. One could already see his brilliance and wonder what he could become. Today, Mbappe is the scariest predator in attacking third since Brazil’s Ronaldo in 1998 and 2002. The French has scored nine World Cup goals so far and he is just 23. Thus he has broken Pele’s record for most World Cup goals before turning 24. His place among the all-time World Cup greats seems inevitable, especially if he scores in the final. And we are not even discussing his assists, his sheer presence on the field which makes the opposition lose track of threats like Olivier Giroud, Antoine Griezmann or Ousmane Dembele.

How incredible Didier Deschamps’ lot is can be gauged from the fact that they have had all bases covered without having Karim Benzema in attack, Paul Pogba and Ngolo Kante in the midfield. Not that the French defenders have not fluffed their lines at all – they conceded two penalties against England for example – but the imposing figure of Hugo Lloris under the bar has not let them concede many.

This French side has looked unbeatable (not counting the Tunisia loss when Deschamps basically fielded his reserve bench) but they are up against Argentina. Messi’s Argentina. If football is more art than a game for you, it is difficult not to love Messi, no matter which team you support. This, by far, has been his best show at a World Cup. Like Mbappe, Messi has scored five goals so far. But even more captivating has been his overall control of the game, the culmination of which was his hypnotism of Croatian defender Josko Gvardiol in the semifinal. The resultant assist to young sensation Julian Alvarez sealed the final berth and this happened when people were not finished discussing Messi’s final pass to Nahuel Molina for Argentina’s first goal against the Netherlands in the quarterfinal.

Unlike his previous World Cups, Messi, at 35, has looked like a free bird in the company of talents like Alvarez, Lautaro Martinez, Alexis Mac Allister, Rodrigo de Paul et al. They have been so efficient that Lionel Scaloni could give a player of Angel de Maria’s calibre breaks. The defence of Nicolas Otamendi, Cristian Romero, Nicolas Tagliafico, Marcos Acuna et al has been solid after the Saudi disaster. Even more solid has been Emiliano Martinez with the gloves. Two saves in the penalty shootout against the Dutch reminded one of Sergio Goycochea, who kept rescuing Maradona’s side from one shootout after another in Italia 90. Having someone like that under the bar is reassuring for those who think Messi deserves to sign off with the World Cup in his hand, for the joy he has provided millions with for almost two decades.

Read IPL auction: Where privilege holds court

But is Messi really up against France or is he up against Maradona? The emotional genius who took Argentina to glory almost single-handedly in 1986, set the bar so high that even Messi has found it beyond reach till now. The bar shall not be lowered and to be honest, nobody deserves the World Cup more for what he has done over the years. The team that plays better over the all-important 90 minutes deserves it. That was West Germany in 1990 and Germany in 2014. That is why Maradona and Messi had to end those evenings in tears. Maradona is remembered as much for his success as his imperfections. Can squeaky clean Messi script the perfect ending?

Originally published in The Meghalayan

কোরোকোরো কোমিক্কু কমিক্স এবং বিশ্বকাপে এশিয়া

আইএসএলের কথা ভেবে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করছে? জাপান কিন্তু স্রেফ জে-লিগ চালু করে ক্ষান্ত হয়নি। গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া তাদের স্বভাব নয়। জাপানে স্কুল ফুটবলকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়।

“চীন, ব্রহ্মদেশ, অসভ্য জাপান,/তারাও স্বাধীন, তারাও প্রধান” কিন্তু ভারত ঘুমিয়ে আছে – এমন বিলাপ করেছিলেন কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সে শ দেড়েক বছর আগেকার কথা। আজকের বাঙালি চীন, জাপানকে অসভ্য দেশ ভাবার ভুল করে না। কিন্তু চারবারের বিশ্বকাপ জয়ী জার্মানিকে জাপান এক গোলে পিছিয়ে পড়েও হারিয়ে দিল দেখে ভারতের ঘুমিয়ে থাকা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস যে পড়ে না – এমন কথা হলফ করে বলা যায় না।

অবশ্য এবারের বিশ্বকাপ যেভাবে আরম্ভ হয়েছে, তাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে শুরু করলে আর থামা শক্ত হবে। আয়োজক কাতার বাদে এশিয়া মহাদেশের সব দেশই রীতিমত সাড়া জাগিয়ে শুরু করেছে। শুক্রবার রাতে নেদারল্যান্ডস আর ইকুয়েডরের খেলা ড্র হওয়া মাত্রই কাতারের বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। কিন্তু তার কিছুক্ষণ আগেই বিশ্বখ্যাত গ্যারেথ বেলের ওয়েলসের বিরুদ্ধে রোমহর্ষক জয় হাসিল করেছে ইরান।

ইরান কিন্তু প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আধ ডজন গোল হজম করেছিল। খেলা নয়, প্রশংসিত হয়েছিল ইরান দলের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে অস্বীকার করা। মাহসা আমীনীর রাষ্ট্রীয় হত্যার পর ইরান এখন আন্দোলনে উত্তাল। কেবল মহিলারা নন, বহু পুরুষও গ্রেপ্তার হচ্ছেন। ইরান যখন একের পর এক গোল খাচ্ছিল গ্যারেথ সাউথগেটের দলের কাছে, তখন বহু শহরে উল্লাসে ফেটে পড়ছিলেন মানুষ। কারণ জাতীয় দল, স্বভাবতই, তাঁদের কাছে দেশের সরকারের প্রতীক। তৎসত্ত্বেও ম্যাচের পর ইরান অধিনায়ক এহসান হজসফি জানান, তাঁরা সরকার নয়, দেশের মানুষেরই পাশে আছেন। এই দুঃসাহসের কী ফল হজসফি ও তাঁর সতীর্থরা পরিবার সমেত ভোগ করবেন তা দেশে ফিরলে হয়ত টের পাওয়া যাবে। বলা বাহুল্য, ইরান সরকার পিঠ চাপড়ে দেওয়ার জন্য বসে নেই।

ইতিমধ্যেই খানিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে নিশ্চয়ই, ফলে ওয়েলসের বিরুদ্ধে ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মিলিয়েছেন হজসফিরা। কিন্তু সেসব চাপ সামলেও ‘খেলতে পারে না, শুধু প্রতিবাদ করতে পারে’ এই বিদ্রূপ কড়ায় গণ্ডায় চুকিয়ে দিয়ে নব্বই মিনিট আপ্রাণ লড়াই করার পর শেষ মুহূর্তে দুটো গোল দিয়ে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে। ইংল্যান্ড বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হওয়ায় ইরানের সামনে এখনো পরের রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ২০১৪ আর ২০১৮ বিশ্বকাপেও যথাক্রমে আর্জেন্টিনা এবং স্পেনের মত দলের সঙ্গে জোরদার লড়াই করেছিল তারা, হেরেছিল ১-০ গোলে। সুতরাং এবার দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছলে তা হবে দীর্ঘ পরিশ্রমের ফল।

ইতালিয়া ৯০-এর ক্যামেরুন থেকে শুরু হয়েছিল আফ্রিকার দলগুলোর বিশ্বকাপ মাতিয়ে দেওয়া খেলা। কোনোবার নাইজেরিয়া, কোনোবার সেনেগাল চমকে দিয়েছে। ২০১০ বিশ্বকাপে শেষ মুহূর্তে লুই সুয়ারেজ হাত দিয়ে গোল আটকে না দিলে হয়ত প্রথম আফ্রিকান দল হিসাবে ঘানা সেমিফাইনালেও পৌঁছে যেত। সেই আফ্রিকা এবারে এখনো নিষ্প্রভ, বরং এশিয়া চমকে দিচ্ছে।

এমনিতে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপে এশিয়ার সবচেয়ে ধারাবাহিক দল। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, স্পেন আর জার্মানি ছাড়া তারাই একমাত্র দল যারা গত দশটা বিশ্বকাপেই খেলেছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। একমাত্র ২০০২ সালে ঘরের মাঠে সেমিফাইনালে পৌঁছনো ছাড়া তাদের বলার মত কোনো সাফল্য নেই। এবারে যথেষ্ট শক্তিশালী উরুগুয়ের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র দিয়ে শুরু করা আশাব্যঞ্জক। যদিও গ্রুপ এইচ বেশ কঠিন।

কোচ হার্ভে রেনার্ড ছাড়া সৌদি আরব আর সকলকেই চমকে দিয়েছে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে। চমক আরও বাকি আছে কিনা সময় বলবে, তবে সৌদির সাফল্যে তাদের কোচের অবদান কিন্তু অনেকখানি। রেনার্ড কোনো কুলীন ইউরোপিয় ক্লাবের কোচ ছিলেন না কখনো, কিন্তু আফ্রিকা, এশিয়ার খেলোয়াড়দের মনমেজাজ, শক্তি-দুর্বলতা তাঁর নখদর্পনে। জাম্বিয়া আর আইভরি কোস্টকে আফ্রিকা কাপ অফ নেশনস খেতাব জিতিয়েছিলেন। সে কারণেই তৈল ধনে ধনী সৌদি কর্তারা তাঁকে জাতীয় দলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

জাপানের চমক কিন্তু এক ম্যাচে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ তাদের এই সাফল্যের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে তৎকালীন লিগের খোলনলচে বদলে ফেলে জে-লিগ চালু করার মাধ্যমে। বয়স্ক বাঙালি ফুটবলপ্রেমীদের বিলক্ষণ মনে আছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ব্রাজিলিয় ট্র‍্যাজিক নায়ক জিকোর জাপানের লিগে খেলতে আসার কথা। আরও বহু ফুটবলোন্নত দেশের তারকাই সেসময় জাপানে খেলতে আসেন। তবু জাপান এশিয় ফুটবলে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠলেও বিশ্ব স্তরে তেমন ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেনি তখনই। আজকের অবস্থায় পৌঁছতে সময় লেগেছে।

আইএসএলের কথা ভেবে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করছে? জাপান কিন্তু স্রেফ জে-লিগ চালু করে ক্ষান্ত হয়নি। গোড়া কেটে আগায় জল দেওয়া তাদের স্বভাব নয়। জাপানে স্কুল ফুটবলকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিশু বয়স থেকে শুরু হয় স্কাউটিং। ‘নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ কাগজের এক প্রতিবেদন বলছে, জাপানি শিশুদের মধ্যে ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ ৩৫ বছর ধরে করে চলেছেন টম বায়ার বলে এক আমেরিকান। আটের দশকে অবসর নেওয়ার পর তিনি জাপানেরই বাসিন্দা হয়ে যান। ছোটদের জন্য একগুচ্ছ ফুটবল স্কুল খোলেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। আরও মজার কথা, সে যুগে ছোটদের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় কমিক্সে ‘কোরোকোরো কোমিক্কু’-তে ফুটবল শেখার কায়দাকানুন শিশুপাঠ্য করে লিখতে থাকেন। সেদিন জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে দিল যে জাপান দল, তাদের তিনজন ফুটবলার – মিনামিনো, দোয়ান আর এন্দো – বায়ারের সেই স্কুলগুলোর ছাত্র ছিলেন।

আরও পড়ুন জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত

এত কাঠখড় পুড়িয়ে জাপানি ফুটবল এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে বিশ্বকাপের ২৬ জনের দলের সাতজন খেলেন বুন্দেশলিগায় আর একজন জার্মানির দ্বিতীয় ধাপের লিগে। এঁদের মধ্যে জার্মান লিগে সবচেয়ে বেশি সমীহ করা হয় মাঝমাঠের খেলোয়াড় দাইচি কামাদাকে। তিনি খেলেন এইন্ট্রাখট ফ্র‍্যাঙ্কফুর্টে। জার্মানির বিখ্যাত ক্লাব ভিএফবি স্টুটগার্টের স্কাউটরা কদিন আগেই জাপানের শোশি হাইস্কুলের ছাত্র আনরি চেইসুকে সই করিয়েছে। সে ইতিমধ্যেই জাপানের অনূর্ধ্ব-১৭ ও ২৩ দলে খেলে ফেলেছে।

অর্থাৎ জাপান ফুটবলে সূর্যোদয় সবে শুরু হয়েছে। চলতি বিশ্বকাপেই তারা সাফল্যে দক্ষিণ কোরিয়াকে টপকে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবার বাকি তিনটে ম্যাচে তেমন কিছু করতে না পারলেও আগামীদিনে বিশ্ব ফুটবলে সমীহ করার মত এশিয় শক্তি হয়ে ওঠার পথে তারাই সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

জাতীয় সঙ্গীত এবং নেশন: ইরান যা ভাবায়

নেশন যে একটা বানিয়ে তোলা ধারণা – রবীন্দ্রনাথের এই মতের চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলা হলে। একই কবির একই ভাষায় লেখা দুটো গান গায় দুই আলাদা নেশনের মানুষ।

জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়ার কী কী ফল হতে পারে? ইসলামিক আইনে চালিত, এই মুহূর্তে গনগনে বিদ্রোহের আগুনে ঝলসাতে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানে কী হতে পারে জানি না, তবে সাংবিধানিকভাবে এখনো ধর্মনিরপেক্ষ এবং তথাকথিত আধুনিক আইনকানুন মেনে চলা দেশ ভারতে কী হতে পারে তার বেশকিছু দৃষ্টান্ত আছে।

২০১৮ সালের দুর্গাপুজোর সপ্তমীর দিন নিজেদের দেশের সবচেয়ে সংস্কৃতিবান এবং প্রগতিশীল জনগোষ্ঠী বলে দাবি করা কলকাতার বাসিন্দারা স্টার থিয়েটারে ন জন দর্শকের দিকে তেড়ে যান সিনেমা শুরু হওয়ার আগে ‘জনগণমন’ চলার সময়ে উঠে দাঁড়িয়ে গান না করার অপরাধে। অথচ সে বছরের জানুয়ারিতেই সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টেরই জারি করা সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র বাজানো বাধ্যতামূলক করার আদেশ বাতিল করে দিয়ে বলেছিল, “The interim order passed on November 30, 2016 is modified that playing of national anthem prior to screening of a film is not mandatory or directory”। কিন্তু দেশের অবস্থা তখনই এমন, যে ওই আদেশ পুরোপুরি বাতিল করার সাহস সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদেরও হয়নি। বর্তমান প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় সে সময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বটে “should we wear our patriotism on our sleeves”? কিন্তু আদালত এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্কোয়্যার পাস দিয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে।

সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ের পর ৯ জানুয়ারি দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া কলকাতার বিভিন্ন সিনেমা হলের মালিকদের মতামত প্রকাশ করেছিল এক প্রতিবেদনে। সেই প্রতিবেদন পড়লে বোঝা যায়, ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাতিরাষ্ট্র এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যে মনোভাবই থেকে থাকুক, কলকাতার হলমালিকরা ব্যবসার মত জাতীয়তাবাদের প্রতিযোগিতাতেও হারতে রাজি নন।

প্রিয়া সিনেমার মালিক অরিজিৎ দত্ত বলেছিলেন “সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশে আমার এখানে কোনো তফাত হবে না। আমি জাতীয় সঙ্গীতের বদলে বন্দে মাতরম বাজাব। আশা করব দর্শকরা উঠে দাঁড়াবেন। তবে আমি কাউকে জোর করব না।” মিনার, বিজলী, ছবিঘরের মালিক সুরঞ্জন পাল বলেছিলেন “সুপ্রিম কোর্টের নতুন অর্ডার জাতীয় স্তোত্র বাজানো বাধ্যতামূলক নয় বললেও আমি বাজাতেই থাকব। আমি এ-ও আশা করব যে গান চলার সময়ে দর্শকরা উঠে দাঁড়াবেন।” নবীনার মালিক নবীন চৌখানি আবার একটা নতুন কথা বলেছিলেন। “আগের অর্ডারটা বৈষম্যমূলক ছিল। কেবল সিনেমা হলগুলোকে জাতীয় স্তোত্র বাজানোর জন্যে বেছে নেওয়া হল কেন? রেস্তোরাঁ, খেলার মাঠ – এসব জায়গায় তো বাজাতে বলা হয়নি।”

অর্থাৎ দিনের যে কোনো সময়ে যে কোনো উদ্দেশ্যে আপনি যেখানেই যান না কেন, রাষ্ট্রের ইচ্ছা হলেই আপনাকে সাবধান পজিশনে দাঁড় করিয়ে জাতীয় স্তোত্র বাজিয়ে দেওয়া হবে আর আপনাকেও সুবোধ বালক/বালিকা হয়ে গাইতে হবে। এই ব্যবস্থায় বিশেষ কারোর আপত্তি নেই। শুধু তাই নয়, কেউ ভিন্নমত হলে তাকেও মেরে ধরে দাঁড় করিয়ে গাওয়ানোর উদ্যোগ নেবে লোকে।

চেন্নাই, বেঙ্গালুরুতেও সেসময় সিনেমা হলে এ নিয়ে বিস্তর গোলমাল, হাতাহাতি হয়েছিল, গৌহাটিতে হুইলচেয়ারে বসা এক শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষকেও জাতীয়তাবাদী দর্শকরা উঠে না দাঁড়ানোর জন্য গালাগালি করেছিলেন। উল্লেখ্য, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার অবমাননা আইনত অপরাধ বলে গণ্য হলেও আইনে কোথাও বলা নেই উঠে না দাঁড়ানো মানে অবমাননা করা। যা-ই হোক, আজও রমরমিয়ে সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র বেজে চলেছে, অধিকাংশ নাগরিক উঠে দাঁড়িয়ে গান গেয়েও থাকেন। ইদানীং অবশ্য যারা উঠে দাঁড়ায় না তাদের দিকে তেড়ে যাওয়ার ঘটনা তত শোনা যায় না। অনেকে ওসব ঝামেলা এড়াতে গান বেজে যাওয়ার পরে হলে ঢোকেন। তার মানে ঝামেলা যে হতে পারে সে আতঙ্ক সফলভাবে সকলের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে। সিনেমা হলে জাতীয়তাবাদ প্রদর্শন কর্তব্য বলে স্বীকৃত হয়েছে। সে কর্তব্য পালন না করলে গারদে পুরে দেওয়ার আইন এখনো পাস হয়নি বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কদিন আগে বলে দিয়েছেন, শুধু বন্দুকধারী নয়, কলমধারী নকশালদেরও সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। তেমন কিছুদিন পরে বলতেই পারেন, শুধু রাজনীতি করা অ্যান্টি-ন্যাশনাল নয়, জাতীয় স্তোত্র না গাওয়া অ্যান্টি-ন্যাশনালদেরও গ্রেপ্তার করতে হবে। কে না জানে, প্রধানমন্ত্রী যে সে লোক নন? তিনি বিষ্ণুর একাদশ অবতার। অতএব তাঁর কথাই আইন। তিনি বললেই জাতীয় স্তোত্র গাইতে যারা উঠে দাঁড়ায় না তাদের হাজতবাস করানোর জন্য সিনেমা হলে কাতারে কাতারে পুলিস মোতায়েন হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

তবু না মেনে উপায় নেই, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আয়াতোল্লা খোমেইনি হয়ে উঠতে বাকি আছে। অনুসিদ্ধান্ত – ভারতের ইরান হয়ে উঠতে বাকি আছে। তাই ভাবছিলাম, ভারতেই যদি সাধারণ নাগরিক সিনেমা হলে জাতীয় স্তোত্র না গাইলে এত কাণ্ড হতে পারে, তাহলে কাতারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে ইরানের যে ফুটবলাররা জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন না, তাঁদের কী অবস্থা হবে। ম্যাচের পর সাংবাদিক সম্মেলনে ইরান অধিনায়ক এহসান হজসফি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন কেন তাঁরা জাতীয় সঙ্গীত গাননি। জানিয়েছেন দেশে যা চলছে তা যে ভাল হচ্ছে না তা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই এবং তাঁর দল দেশের মানুষের পাশেই আছে। তাদের জন্যেই ভাল খেলার চেষ্টা, গোল করার চেষ্টা।

⚡️ BREAKING: #IRAN FOOTBALL TEAM CAPTAIN DEFIES REGIME, BACKS PROTESTS: “WE HAVE TO ACCEPT THAT CONDITIONS IN OUR COUNTRY ARE NOT RIGHT & OUR PEOPLE ARE NOT HAPPY. THEY SHOULD KNOW THAT WE ARE WITH THEM. AND WE SUPPORT THEM. AND WE SYMPATHIZE WITH THEM REGARDING THE CONDITIONS.” PIC.TWITTER.COM/SX4KENXITZ— Hillel Neuer (@HillelNeuer) November 21, 2022

কী চলছে তাঁর দেশে? কারোর জানতে বাকি নেই। ১৬ সেপ্টেম্বর মাহসা আমীনী রাষ্ট্রের হাতে খুন হওয়ার পর থেকে ইরানের মহিলাদের হিজাববিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। তাঁরা প্রকাশ্যে আসছেন ইসলামিক রাষ্ট্রের হিজাব, বোরখা পরার আইন অমান্য করে। পুড়িয়ে দিচ্ছেন সেসব, চুল কেটে ফেলছেন। মিছিলে মিছিলে ছয়লাপ গোটা দেশ। পাল্লা দিয়ে চলছে সরকারি দমননীতি – মারধোর, হত্যা, পুলিসি হেফাজতে যৌন নির্যাতন। ইরানের পুরুষদের একটা বড় অংশ যে এই আন্দোলনের পাশে এসে গেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল বিশ্বকাপের মঞ্চে ফুটবল দলের প্রতিবাদে।

পৃথিবীর কোথাও কোনো নারী আন্দোলনের পাশে এভাবে পুরুষদের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা দাঁড়িয়েছেন কিনা জানি না, নারীবাদ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা বলতে পারবেন। কিন্তু হজসফি ও তাঁর দল একইসঙ্গে অন্য একটা প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন যা আজকের পৃথিবীতে, ভারতে তো বটেই, প্রাসঙ্গিক। ভারতের জাতীয় স্তোত্রের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ নেশন (বাংলাতেও এই শব্দই লিখেছেন) ব্যাপারটাকেই ভাল চোখে দেখতেন না। স্বাধীন দেশে কী করলে নেশনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয় তার কিছু মানদণ্ড আমরা ঠিক করেছি, সব দেশই করে থাকে। তার অন্যতম জাতীয় সঙ্গীত। ইরানের ফুটবলাররা জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন না, বললেন দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ দেশ মানে মানুষ, কতকগুলো প্রতীক নয়। তাহলে কি প্রতীকের প্রয়োজন শুধু দেশের উপর নেশনের আধিপত্য বজায় রাখতে?

১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে রবীন্দ্রনাথ ইরানে যান শাসক রেজা শাহ পহলভির আমন্ত্রণে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক হজসফিদের জানার কথা নয়। তবু তাঁদের আচরণে যেন উঠে এসেছে নেশন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথেরই অনাস্থা।

আরও পড়ুন ‘ন্যাশনাল আর্কাইভের অবলুপ্তি দেশটাকে শপিং মল বানানোর চক্রান্ত’

১৯১৬ সালের মে মাস থেকে ১৯১৭ সালের এপ্রিল – এই সময়ের মধ্যে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দেন। যেসব কথাবার্তা তিনি বলেন তা জাতীয়তাবাদীদের (বা নেশনবাদীদের) সেদিনও পছন্দ হয়নি, আজও হয় না। যেমন জাপান সম্পর্কে তিনি বলেন “জাপানে দেখেছি গোটা দেশের মানুষ স্বেচ্ছায় নিজেদের মস্তিষ্ক এবং স্বাধীনতা সরকারের হাতে খর্ব হতে দিয়েছে। আর সরকার নানারকম শিক্ষার ব্যবস্থার দ্বারা মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের অনুভূতি নির্মাণ করছে, মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিলে সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে নজরদারি চালাচ্ছে। এক সংকীর্ণ পথ দিয়ে সত্যের দিকে নয়, মানুষকে সেই দিকে চালিত করছে যেদিকে নিয়ে গেলে মানুষকে একেবারে ভেঙে গড়ে নিজের ইচ্ছানুযায়ী এক সমসত্ত্ব জড়পিণ্ডে পরিণত করা যাবে। মানুষ এই সর্বগ্রাসী মানসিক দাসত্ব সানন্দে এবং সগর্বে মেনে নেয় কারণ তাদের মধ্যে নেশন নামক ক্ষমতার যন্ত্রে পরিণত হওয়ার উত্তেজক অভিলাষ কাজ করে…”। [ভাষান্তর আমার]

(I have seen in Japan the voluntary submission of the whole people to the trimming of their minds and clipping of their freedom by their government, which through various educational agencies regulates their thoughts, manufactures their feelings, becomes suspiciously watchful when they show signs of inclining toward the spiritual, leading them through a narrow path not toward what is true but what is necessary for the complete welding of them into one unform mass according to its own recipe. The people accept this all-pervading mental slavery with cheerfulness and pride because of their nervous desire to turn themselves into a machine of power, called the Nation…)

পড়লে মনে হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়েই রবীন্দ্রনাথ ইসলামিক বিপ্লব পরবর্তী ইরানের মত নেশন বা একবিংশ শতাব্দীর বিরাট ডিসটোপিয়াসুলভ নেশনগুলোর চেহারা দেখতে পাচ্ছিলেন, যা তাঁর অন্তত দেড় দশক পরে ইউরোপের টোটালিটেরিয়ান রাষ্ট্রগুলোকে দেখে কল্পনা করবেন অলডাস হাক্সলি (Brave New World; প্রকাশকাল ১৯৩২), তিন দশক পরে জর্জ অরওয়েল (1984; প্রকাশকাল ১৯৪৯)।

নেশন যে একটা বানিয়ে তোলা ধারণা – রবীন্দ্রনাথের এই মতের চমৎকার প্রমাণ পাওয়া যায় ভারত বনাম বাংলাদেশ খেলা হলে। একই কবির একই ভাষায় লেখা দুটো গান গায় দুই আলাদা নেশনের মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে এ জিনিস দেখতে হয়নি। ১৯১৬-১৭ সালের সেই বক্তৃতামালায় ভারত সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন “যদিও শৈশবকাল থেকে আমাকে শেখানো হয়েছিল যে নেশনকে পুজো করা প্রায় ঈশ্বরকে এবং মানবতাকে শ্রদ্ধা করার চেয়েও ভাল, আমার মনে হয় আমি সেই শিক্ষার প্রভাব কাটিয়ে উঠেছি। আমার বিশ্বাস আমার দেশের মানুষ তাঁদের সত্যিকারের ভারত লাভ করতে পারবেন সেই শিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করলে, যা শেখায় একটা দেশ মানবতার আদর্শের চেয়ে বড়।”

(Even though from childhood I had been taught that idolatry of the Nation is almost better than reverence for God and humanity, I believe I have outgrown that teaching, and it is my conviction that my countrymen will truly gain their India by fighting against the education which teaches them that a country is greater than the ideals of humanity.) [ভাষান্তর আমার]

রবীন্দ্রনাথ যে লড়াই করতে বলেছিলেন আমরা তাতে ব্যর্থ হওয়ার ফলেই দেশভাগ হয়, উপরন্তু খণ্ডিত ভারতবর্ষ আজও ভাগ হয়ে চলেছে। ইরানের ফুটবল দল নেশন নির্ধারিত প্রতীককে অস্বীকার করে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন, ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা যত দিন যাচ্ছে তত নেশনের বশংবদ হয়ে পড়ছেন। আগে সাতে পাঁচে থাকতেন না, ইদানীং সবার আগে রাষ্ট্রের পক্ষ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সোশাল মিডিয়ায়। এসব বললেই একটা কথা বলা হয় – আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের থেকে ওসব আশা করা উচিত নয়, কারণ আমাদের সমাজ ইউরোপ বা আমেরিকার মত গণতান্ত্রিক নয়। আমাদের খেলোয়াড়রা রাজনৈতিক প্রতিবাদ করলে নাকি নানাবিধ চাপের মুখে পড়বেন। ইরানের ফুটবলারদের দেখার পর এ কথায় আর কান দেওয়ার প্রয়োজন নেই বোধহয়। কারণ আমরা তো ইরানের চেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক দেশ বলেই নিজেদের দাবি করে থাকি। তাহলে তাদের ফুটবলাররা এবং তাঁদের পরিজন যে সংকটের কল্পনায় ম্রিয়মান না হয়ে এমন প্রতিবাদ করেছেন তার চেয়ে বড় কোন বিপদে আমাদের খেলোয়াড়রা পড়তে পারেন স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে?

পুনশ্চ: বিশ্বকাপ জ্বরে আমাদের অনেকেরই হয়ত চোখ এড়িয়ে গেছে একটা খবর। বিজেপির আইনজীবী নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায় দিল্লি হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা করে দাবি করেছেন ‘জনগণমন’ আর ‘বন্দে মাতরম’-কে সমান মর্যাদা দিতে হবে। তার উত্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, দুটো গান একই স্তরের এবং দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দুটোকেই সমান শ্রদ্ধা জানানো উচিত। উপাধ্যায় নিজের পিটিশনে দাবি জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলোকে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুটো গানই প্রত্যেক কাজের দিনে বাজানো নিশ্চিত করতে হবে।

দেশ যত দুর্বল হয় নেশনকে তত শক্তিশালী করার দরকার হয়। যে গানে নেশন কম জনগণমন বেশি, সে গান ঠেকায় পড়ে সহ্য করে নিতে হয়। কিন্তু আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের কাছে অবশ্যই সেই গান বেশি শ্রেয়, যেখানে মাতৃমূর্তির সাহায্যে জনমনে অভিন্ন নেশন প্রতিভাত হয়। 

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

কাতারে বিশ্বকাপ: নিরোর অতিথি আমরা সবাই

এমন নয় যে কেবল একখানা জমকালো বিশ্বকাপ আয়োজন করতে হবে বলেই তারা হঠাৎ শ্রমিকদের এভাবে নিংড়ে নেওয়া শুরু করেছে। দুনিয়াসুদ্ধ লোকের জানা ছিল কাতারে নিয়মকানুন সর্বনেশে।

রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন – এ কথা খুবই প্রচলিত। উইলিয়ম শেক্সপিয়র অবশ্য অন্য আরেকটা বাজনার কথা লিখেছেন। কিন্তু সে বিতর্ক থাক। কথা হল, বাজনদার হওয়া ছাড়াও নিরোর নানারকম গুণ ছিল। যেমন তিনি নিজের বাগানে অতিথিদের জন্যে এলাহি নৈশ পার্টির আয়োজন করতেন। সে পার্টির আলোর ব্যবস্থা করা হত অভিনব কায়দায়। কিছু অসহায় লোককে আলকাতরায় চুবিয়ে কাঠের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হত, তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হত। জ্যান্ত মানুষগুলো পুড়ত আর আলোয় আলো হয়ে উঠত নিরোর বাগান। সেসব কয়েক হাজার বছর আগেকার কথা। তখনকার মানুষ এখনকার তুলনায় অসভ্য ছিল – এই বলে নিরোর অতিথিদের মাফ করে দেওয়া যেতে পারে হয়ত। কিন্তু আমাদের মাফ করা হবে কোন অজুহাতে? আমাদের যুগেও তো আনন্দের আয়োজনগুলো, বিশেষ করে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ আখ্যা দেওয়া হয় যে মোচ্ছবগুলোকে, সেগুলো নিরোর পার্টির মতই বহু মানুষের জীবন, জীবিকা, স্বাধীনতার বিনিময়ে আয়োজিত হচ্ছে। কলকাতায় অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপ হলে বস্তি উচ্ছেদ হয়, আমেদাবাদে ডোনাল্ড ট্রাম্প এলে গরীব মানুষগুলোকে লুকিয়ে ফেলতে উঁচু পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়। কাতারে আজ থেকে যে বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে তার আয়োজন করতে যা যা করা হয়েছে সেসবও তো গোপন নেই। তবু তো আমরা মেতে উঠব, তাই না?

কী হয়েছে জানেন না বলছেন? তা না জানতেও পারেন। কারণ এ যুগের নিরোরা সভ্য মানুষ। তাঁরা অমন বুক ফুলিয়ে অতিথিদের দেখিয়ে দেখিয়ে ওসব করেন না। অতিথিদের নজর যাতে কেবল ভাল ভাল জিনিসে পড়ে তার বন্দোবস্ত করার জন্য গাদাগুচ্ছের সংবাদমাধ্যমও আছে। তারা আর কতটুকু জানতে দেয় এসব? তবে বিদেশি সংবাদমাধ্যম এসে পড়লে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যায় অনেক সময়। তাই একবার বলে দিই যতটুকু জানা গেছে।

কাতারের রাজপরিবার এবং ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলেছেন ২০১০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত নির্মাণকাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন মোটে তিনজন শ্রমিক। কিন্তু ফেয়ার স্কোয়ার নামের মানবাধিকার সংগঠন বলেছে ওই সংখ্যাটা নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাদের সুপ্রিম কমিটির বক্তব্য, আরও ৩৬ জন বিভিন্ন নির্মাণস্থলে দিনের কাজ শেষ করার খানিকক্ষণ পরেই মারা গেছেন। কিন্তু কাতার সরকার এবং ফিফা তাঁদের হিসাবের মধ্যে রাখেনি, বলে দিয়েছে ওগুলো “প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু”। অবশ্য এ-ও হিমশৈলের চূড়া। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামে যে বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংস্থা আছে, তাদের বিশ্বাস করলে বলতে হয় আসলে কয়েক হাজার শ্রমিক মারা গেছেন গত ১২ বছরে।

বিশ্বকাপ আরম্ভের দিন সকালে মেসি, নেইমার, রোনাল্ডো, এমবাপে, লেওয়ানডস্কিদের নিয়ে সুস্বাদু লেখা উপহার দেওয়ার বদলে তেতো সত্যের ঝাঁপি খুলে বসার জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। মৃত শ্রমিকদের কথা না তুলে পারলাম না। তার কারণ ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ান কাগজের তদন্তমূলক প্রতিবেদনে বছর খানেক আগেই উঠে এসেছে এই তথ্য, যে স্রেফ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কারই ৬,৫০০ প্রবাসী শ্রমিক মারা গেছেন কাতারের আনন্দযজ্ঞে। সবে বছর দুয়েক হল, নিজের দেশের রাজপথ দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের হাজার হাজার মাইল হেঁটে যেতে দেখেছি নিরম্বু উপবাসে। হাঁটতে হাঁটতে মরে যেতে দেখেছি, ক্লান্ত হয়ে রেললাইনের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ট্রেনের চাকায় পিষে যেতে দেখেছি। সে স্মৃতি টাটকা থাকতেও বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার উত্তেজনায় প্রবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থা কী করে ভুলে যাই বলুন?

তবে হ্যাঁ, যত শ্রমিকেরই মৃত্যু হয়ে থাক আর যত শ্রমিকই কাতারের অতি দুর্বল শ্রম আইনের সুযোগে চরম শোষিত হয়ে থাকুন (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে সংখ্যাটা এক লক্ষের বেশি), দেখার মত একটা জিনিস যে দেখা যাবে আগামী একমাস, তাতে সন্দেহ নেই। অনেক শ্রমিক বলেছেন তাঁদের দিয়ে দিনে ১৪-১৮ ঘন্টা কাজ করানো হয়েছে। এত পরিশ্রম কি আর বৃথা যাবে? শুধু কাতারকে দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই। এমন নয় যে কেবল একখানা জমকালো বিশ্বকাপ আয়োজন করতে হবে বলেই তারা হঠাৎ শ্রমিকদের এভাবে নিংড়ে নেওয়া শুরু করেছে। দুনিয়াসুদ্ধ লোকের জানা ছিল কাতারে নিয়মকানুন সর্বনেশে। ফিফার সদস্যরা সব জেনেশুনেই তাদের বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। কিসের বিনিময়ে তাঁদের এহেন বদান্যতা সে আবার আরেক কাহিনি।

আপনি বলতেই পারেন, এসব রাজনীতির কথা, ফুটবল কোথায়? কিন্তু মনে রাখবেন, এবারের বিশ্বকাপ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে ইউক্রেন আক্রমণ করার জন্যে। সুতরাং আর ফুটবল অরাজনৈতিক, বিশ্বকাপ অরাজনৈতিক – এসব বলার অধিকার ফিফা বা কাতারের নেই। ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন নতুন কাতারে নতুন শ্রম আইন বলবৎ করা এবং মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স সেন্টার তৈরি করানোর জন্য ফিফাকে চাপ দেবে বলে ঘোষণা করেছে। আটটা দলের অধিনায়ক মাঠে নামবেন সমপ্রেমী, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি বিবিধ লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের সমর্থনে রামধনু রংয়ের ‘ওয়ানলাভ’ আর্মব্যান্ড পরে। বেশকিছু দল কাতারের সমপ্রেমবিরোধী দমনমূলক আইনের প্রতিবাদে ফ্যান জোন করবে না ঠিক করেছে। এছাড়াও বেশ কয়েকজন ফুটবলার ও কোচ বলেছেন কাতারে বিশ্বকাপের আয়োজন করাই উচিত হয়নি। সুতরাং অন্তত এবারের বিশ্বকাপের আর অরাজনৈতিক হয়ে থাকার উপায় নেই। সেকথা বুঝেই বোধহয় ইনফান্তিনো হঠাৎ দারুণ কাতারি, আরব, আফ্রিকান, সমপ্রেমী, প্রতিবন্ধী, প্রবাসী শ্রমিক হয়ে উঠেছেন। এমনকি বলেছেন কাতারের নিন্দে করার আগে ইউরোপের নিজেদের তিন হাজার বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। আহা, এমন ভাল ভাল কথা যদি সারা বছর বিশ্বের বড় বড় পুঁজির অধিকারীরা ভাবতেন!

তবে একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে যে এই প্রথম এত বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এতখানি রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একনায়কতান্ত্রিক যে কোনো সরকার চিরকাল এরকম প্রতিযোগিতাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের কাজে লাগায়। রুশ একনায়ক ভ্লাদিমির পুতিন ২০১৮ বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছিলেন, আর্জেন্টিনার একনায়ক হর্হে রাফালে ভিদেলা একইভাবে ব্যবহার করেছিলেন ১৯৭৮ বিশ্বকাপকে, বেনিতো মুসোলিনি ১৯৩৪ বিশ্বকাপকে। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে আর্য রক্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে অ্যাডলফ হিটলারকে যেভাবে ল্যাজে গোবরে হতে হয়েছিল জেসি ওয়েন্সের দাপটে, সে ইতিহাস মনে রাখেন না। রাখার দরকার নেই। কারণ মুসোলিনি আর ভিদেলার আমলে যথাক্রমে ইতালি আর আর্জেন্টিনায় ঠিক কী কী ঘটেছিল ইতিহাসে তা স্পষ্ট লেখা থাকলেও ওই দুই বিশ্বকাপে যে ফুটবলাররা খেলেছিলেন, তাঁরা সকলেই যে অংশগ্রহণের জন্য লজ্জিত বা তাঁদের জয় রক্তলাঞ্ছিত মনে করেন তা কিন্তু নয়। কারোর মতে তাঁরা খেলেছিলেন দেশের মানুষের জন্য, দেশের শাসকের জন্য তো নয়। কেউ আবার বলেন মাঠের বাইরে কী ঘটছে সে সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা ছিল না। কিছু ফুটবলার সৎভাবে স্বীকার করেন সবকিছুই জানা ছিল, কিন্তু তাঁরা কী-ই বা করতে পারতেন? এই তিন দলের কেউই যে সম্পূর্ণ ভুল তা বলা চলে না। কারণ খেলোয়াড়দের ক্ষমতার সীমা আছে। বল পায়ে অতিমানবিক দেখতে লাগে বলেই তাঁরা কেউ সত্যি সত্যি অতিমানব নন।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

সত্যি কথা বলতে মুসোলিনি আর ভিদেলা আয়োজিত বিশ্বকাপে যা যা ঘটেছিল, তার তুলনায় কাতারে যা হতে চলেছে সেটা বড়জোর নোংরামি। কাতারে অন্তত কোনো স্টেডিয়াম থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে ডিটেনশন ক্যাম্প নেই, আর্জেন্টিনায় কিন্তু ছিল। উপরন্তু মুসোলিনি যেভাবে ফাইনালের রেফারিকে পর্যন্ত চোখ রাঙিয়ে ইতালির বিশ্বকাপ জয় নিশ্চিত করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে, কাতারের রাজার পক্ষে তা করা প্রায় অসম্ভব। কাতার যদি গ্রুপ এ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছয় তাহলেই যথেষ্ট। কারণ তাদের গ্রুপে আছে নেদারল্যান্ডস আর আফ্রিকান সিংহ সেনেগাল। সাদিও মানে শেষ মুহূর্তে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেও তারা যথেষ্ট শক্তিশালী দল।

গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ডের পক্ষে গ্রুপ বি মোটেই কঠিন হওয়ার কথা নয়। হ্যারি কেন ও তাঁর দলবল ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা দলগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে, কারণ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে (২০১৮) পৌঁছবার পরের ইউরোতেই (২০২০) ফাইনাল খেলার বিরল কৃতিত্ব এই দল অর্জন করেছে। তবে ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড দলের বিশ্বজয়ের কৃতিত্ব এখনো অধরা। এফ এ-র সঙ্গে সাউথগেটের চুক্তির মেয়াদ ২০২৪ পর্যন্ত। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, যে জানা আছে এবার ট্রফি জিততে না পারলে ওই চুক্তি কাজে আসবে না। গত কয়েক বছরে ক্রমাগত উন্নতি করে চলা এই দলটা কেনই বা গ্যারেথ বেলের ওয়েলস, নড়বড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইরানকে নিয়ে চিন্তিত হতে যাবে?

একই কথা প্রযোজ্য গ্রুপ সি-র আর্জেন্টিনার জন্য। এমনকি দিয়েগো মারাদোনার খেলোয়াড় জীবনেও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযান শুরু হত অস্থিরভাবে। এই প্রথম ওই বিরল প্রতিভার মানুষটি না থাকবেন ড্রেসিংরুমে, না থাকবেন শিশুসুলভ উদ্দীপনা নিয়ে সমর্থক হিসাবে গ্যালারিতে। অনেকদিন পরে এবার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ খেলতে নামছে ফেভারিটদের মধ্যেও ফেভারিট হিসাবে, যদিও লায়োনেল মেসি সেকথা মানতে চাইছেন না এখনো। কদিন আগেই তিনি দাবি করেছেন আর্জেন্টিনা মোটেই ফেভারিট নয়। কথাটা নিঃসন্দেহে দলের উপর চাপ তৈরি হতে না দেওয়ার জন্য বলা। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত একটা দল যদি ফেভারিট না হয় তাহলে শব্দটার মানে কী? এবারের বিশ্বকাপ মেসির জন্যে শেষ সুযোগ। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে যতরকম খেতাব জেতা সম্ভব প্রায় সবই জিতে ফেলেছেন একাধিকবার, বিশ্বের সর্বকালের সেরাদের মধ্যেও তাঁর নাম লিখে ফেলেছেন অগণিত মানুষ। তবুও মারাদোনা নামক একটা দেওয়ালের সামনে এসে বারবার থমকে দাঁড়াতে হয়েছে মেসিকে। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা এবং সারা পৃথিবীর সমালোচকরা বারবার বলে এসেছেন, বার্সেলোনার মেসি আর আর্জেন্টিনার মেসি এক নয়। তিনি নীল-সাদা জার্সিতে তো কিছুই জেতেননি। মারাদোনা প্রয়াত হলেন ২০২০ সালে, আর পরের বছরই মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা জিতে ফেললেন। এবার তাঁর সামনে মারাদোনার ১৯৮৬ সালের কীর্তি ছুঁয়ে ফেলার সুযোগ। মারাদোনা অবশ্য প্রায় একা হাতে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ভরা যৌবনে, মেসি এখনই ৩৫। ইতিমধ্যেই বার্সেলোনা ছেড়ে তাঁকে প্যারিস সাঁ জা-য় সরে যেতে হয়েছে, ২০২৬ সালে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-মেক্সিকোর বিশ্বকাপে মেসি মাঠে নামার অবস্থায় থাকেন, তাহলেও বিশ্বকাপ জেতার অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাছাড়া এত শক্তিশালী দলই বা প্রতি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা পাবে কোথায়? সাধারণত আর্জেন্টিনা গোল করেও নিশ্চিন্ত হতে পারে না। কিন্তু এবার লায়োনেল স্ক্যালোনির দলে অন্তত একজন ক্রিস্টিয়ান রোমেরো আছেন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায়।

গ্রুপ ডি-র প্রথম স্থানের লড়াইটা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স আর বিপজ্জনক ডেনমার্কের মধ্যেই থাকার কথা, যদি না অস্ট্রেলিয়া কোনো চমক দেয়। এই নিয়ে পরপর পাঁচটা বিশ্বকাপ খেলবে তারা, কিন্তু এবারের বিশ্বকাপটা আরেকটু হলেই ফসকে যাচ্ছিল। শেষমেশ আন্তঃমহাদেশিয় প্লে অফে পেরুকে হারিয়ে কাতারে পৌঁছতে হয়েছে। ইউরো ২০২০-তে ডেনমার্ক সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল। সেইসময় মাঠেই অসুস্থ হয়ে পড়া ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন নিজের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন, সম্প্রতি ফ্রান্সকে ডেনমার্ক দুবার হারিয়েছেও বটে। তবু দিদিয়ের দেশঁর ছেলেরা বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দল। পল পোগবা আর এনগোলো কান্তে অবশ্য মাঝমাঠে থাকছেন না, কিন্তু গত বিশ্বকাপের বিস্ময়বালক কিলিয়ান এমবাপে এখন ২৩ বছরের ভয়ঙ্কর গোলশিকারী। সঙ্গে থাকার কথা ছিল করিম বেনজেমার। কিন্তু তিনি আবার উরুর চোটে ছিটকে গেলেন গতকাল। ফ্রান্সের গোলে অবশ্য নির্ভরযোগ্য উগো লরিস থাকছেন।

গ্রুপ ই থেকে যে দুই দলের দ্বিতীয় রাউন্ডে না ওঠাই অঘটন হবে, সেই স্পেন আর জার্মানির বেশ মিল আছে। দুটো দলই প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, কিন্তু বেশ কিছুদিন কোনো ট্রফি জিততে পারেনি। জার্মান ফুটবল ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ সময় গত চারটে বছর। রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপ থেকেই তাদের বিদায় সকলকে চমকে দিয়েছিল। তারপর ইউরো ২০২০-তেও তারা দ্বিতীয় রাউন্ডের গন্ডি টপকাতে পারেনি। কিন্তু হান্সি ফ্লিকের দলে আবার একগুচ্ছ পৃথিবীর প্রথম সারির ফুটবলার এসে গেছেন। গোল করার জন্য সার্জিও ন্যাব্রি, লেরয় সেন, কাই হ্যাভের্তজ, টিমো ওয়ার্নারের পরেও আছেন ৩৩ বছরের থমাস মুলার। পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। ম্যানুয়েল নয়ারকেও ভুলে গেলে চলবে না, তিনি তো শুধুই গোলরক্ষক নন।

লুই এনরিকের স্পেনেও প্রতিভাবান আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের ছড়াছড়ি। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকা এই মুহূর্তে পেদ্রি, যাঁর বয়স মাত্র ১৯, বিশ্বকাপ চলাকালীন কুড়িতে পা দেবেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই বার্সেলোনার জার্সি গায়ে প্রায় ১০০ ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে। বার্সেলোনার আরেক তরুণ আনসু ফাতিকে নিয়েও অনেকের বিরাট আশা। ফিট থাকলে তিনি একাই বিশ্বকাপ মাতিয়ে দিতে পারেন বলে কারো কারো ধারণা। ইউরো ২০২০-তে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া স্পেন বিশ্বকাপের যোগ্যতার্জন পর্ব পেরিয়ে এসেছে বেশ অনায়াসেই। তবে পেদ্রি, ফাতিদের করা গোল এনরিকের রক্ষণ ধরে রাখতে পারবে কিনা সেটাই বড় কথা। বটবৃক্ষের মত সার্জিও বুস্কেৎস অবশ্য থাকবেন ওই তরুণদের পিছনে।

গত বিশ্বকাপের রানার্স আপ ক্রোয়েশিয়ার জন্য গ্রুপ এফ সহজ হওয়ার কথা। কারণ এই গ্রুপে তাদের চ্যালেঞ্জ করার মত দল একমাত্র বেলজিয়াম, যাদের কেবলই শক্তিক্ষয় হয়েছে গত চার বছরে। অন্যদিকে জ্লাটকো ডেলিচের অধীন ক্রোয়েশিয়ার ক্রমোন্নতি হয়েছে। ২০১৮ বিশ্বকাপের বেলজিয়াম দলকে বলা হয়েছিল সোনালি প্রজন্ম। সেই প্রজন্ম প্রায় শেষ। ভিনসেন্ট কম্পানি অবসর নিয়েছেন, রোমেলু লুকাকু আগের মত বিপজ্জনক নেই আর ইডেন হ্যাজার্ডের চোটে জর্জরিত সময় কেটেছে রিয়াল মাদ্রিদে। এখনো প্রথম দলে নিয়মিত নন। একমাত্র কেভিন ডি ব্রুইন আর গোলরক্ষক থিবাউ কুতোয়া আগের বিশ্বকাপের ফর্মেই আছেন বলা যায়।

গ্রুপ জি-র ক্যামেরুন উচ্চাকাঙ্ক্ষী দল। রিগোবার্ট সংয়ের ছেলেরা যখন মার্চ মাসে আলজেরিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ছাড়পত্র আদায় করলেন, তখন ক্যামেরুনের কিংবদন্তি প্রাক্তন ফুটবলার স্যামুয়েল এটোয়ো দলকে বলেছিলেন “আমরা কাতারে যাব বিশ্বকাপ জিততে।” স্বপ্ন সবসময় বড় করে দেখাই ভাল। কিন্তু এটোয়োর স্বপ্ন সফল করতে ক্যামেরুনকে প্রথম রাউন্ডেই সার্বিয়া আর সুইটজারল্যান্ডের মত শক্ত বাধা ডিঙোতে হবে। দ্রাগান স্তোইকোভিচের অধীনে সার্বিয়া শুধু জিততে চায় না, অনেক গোল করতে চায়। তাদের হারানো মোটেই সহজ নয়। কিন্তু দল হিসাবে আরও জমাট মুরাত ইয়াকিনের সুইটজারল্যান্ড, যাদের প্রাণভোমরা গ্রানিৎ ঝাকা। এই দল ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সকে ১-৩ পিছিয়ে পড়েও শুটআউটে হারিয়েছিল, কোয়ার্টার ফাইনালেও স্পেনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পেনাল্টি শুটআউট অব্দি।

এমন একটা গ্রুপ হয়ত তিতের ব্রাজিলের পক্ষেও নেহাত সহজ হবে না, যদিও পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এই গ্রুপ থেকে প্রথম হয়ে উঠবে বলেই সকলে আশা করবে। মেসির মত নেইমারও এবার যে দলে খেলবেন তাঁর খেলোয়াড় জীবনে সেটাই সম্ভবত ব্রাজিলের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। রাফিনিয়া, রিচার্লিসন, লুকাস পাকেতা – নেইমার ছাড়াও তিতের হাতে গোল করার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এতজন হাজির। তার উপর মাঝমাঠে আছেন ক্যাসেমিরো আর রক্ষণভাগে বর্ষীয়ান থিয়াগো সিলভা। কার তাতে কী, তিতে যদি ষষ্ঠ খেতাবের স্বপ্ন দেখেন?

ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোরও এটাই শেষ বিশ্বকাপ। পিয়ার্স মর্গানের সঙ্গে যে সাক্ষাৎকারের জন্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাঁকে ক্লাব থেকে তাড়াতে চলেছে বলে খবর, সেখানেই তিনি জানিয়েছেন আর ২-৩ বছর খেলে চল্লিশে অবসর নিতে চান। সেক্ষেত্রে বিশ্বকাপের মুখে অমন একখানা সাক্ষাৎকার কেন দিতে গেলেন তা বিস্ময়কর। এমনিতেই পর্তুগাল পড়েছে শক্ত গ্রুপে। গ্রুপ এইচে তাদের প্রতিপক্ষ ঘানা, উরুগুয়ে আর দক্ষিণ কোরিয়া। ঘানা অবশ্য শেষ ১২ ম্যাচের মাত্র দুটো জিতেছে, কিন্তু হেড কোচ ওটো অ্যাডো যথার্থই বলেছেন, ঘানা হল বড় প্রতিযোগিতার দল। তারা ২০১০ সালে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের স্বাদ পেয়ে গেছে। ফলে তাদের হালকাভাবে নেওয়া যায় না। আবার উরুগুয়ে শুধু যে দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (যদিও বহুকাল আগে – ১৯৩০, ১৯৫০) তা নয়, এবারে তাদের দল যথেষ্ট শক্তিশালী। লুই সুয়ারেজ আর এডিনসন কাভানি তো আছেন বটেই, আছেন দিয়েগো গোদিন। এঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে থাকবে রিয়াল মাদ্রিদের ফেদেরিকো ভ্যালভের্দের তারুণ্যের দীপ্তি। কোচ দিয়েগো আলোনসোর বিশ্বাস এই দল তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিততে পারে। সে বিশ্বাসের শক্ত পরীক্ষা গ্রুপেই হয়ে যাবে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত এই গ্রুপে আছে দক্ষিণ কোরিয়া – এশিয়ার সবচেয়ে ধারাবাহিক দল। এমনকি ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনা আর স্পেনকে বাদ দিলে একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়াই টানা দশটা বিশ্বকাপ খেলতে চলেছে। তাদেরও বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। টটেনহ্যামের সন হিউং-মিন সুস্থ থাকলে এবং ফিট থাকলে কোরিয়াও বেগ দিতে পারে।

এমতাবস্থায় রোনাল্ডো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ফর্ম হারিয়ে বসলেন, একটা ম্যাচের মধ্যেই মাঠ ছেড়ে চলে গেলেন, বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে বললেন ইউনাইটেড ম্যানেজার এরিক টেন হ্যাগকে মোটেই শ্রদ্ধা করেন না। ওই ক্লাব এবং ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ফুটবলার ওয়েন রুনিকে অকারণেই ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলেন। পর্তুগালের আর যে ফুটবলার যেমনই খেলুন না কেন, বলাই বাহুল্য রোনাল্ডো স্বমহিমায় না থাকলে ২০১৬ ইউরো জয় আর ২০১৯ উয়েফা নেশনস লিগ জয় সম্ভব হত না।

পাঠক, আপনি যদি পর্তুগালের ভক্ত হন, তাহলে রোনাল্ডোর জন্য প্রার্থনা করুন। যদি অন্য কোনো দলের সমর্থক হন তাহলে তাদের জন্য প্রার্থনা করুন। কিন্তু বিনীত অনুরোধ, সঙ্গে কাতারের মৃত এবং অত্যাচারিত মানুষের জন্যও প্রার্থনা করুন। প্রার্থনায় কিছু হয় না, কিন্তু এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারবেন? আমরা সকলেই তো নিরোর অতিথি হয়ে গেছি, কেউ বাদ নেই। কারণ আজ বিশ্বজুড়ে অনেক নিরো।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

World Cup: We are all Nero’s guests

Authoritarian rulers never seem to learn from Adolf Hitler’s Berlin Olympics experience, when his bid to showcase Aryan supremacy boomeranged as Jesse Owens reigned supreme.

It is said that in ancient Rome, Emperor Nero used to hold extravagant garden parties. Poor people were smeared in tar and bound to wooden stakes. Then they were set alight to illuminate the garden. With all that is happening around us, it would not be insane to ask if we are all becoming Nero’s guests. Because all the greatest shows on earth are unearthing some kind of cruelty or the other. Nero’s guests could be excused for being ancient, therefore backward, but what is our excuse for keeping eyes wide shut to the cruelties done in Qatar for the World Cup commencing on Sunday?

While authorities in Qatar and FIFA president Gianni Infantino insist only three workers have died in the last 12 years during preparation work for the World Cup, human rights organisations like Fair Square say that number is a “willful attempt to mislead”. Their Supreme Committee claims 36 more from construction sites have died after a day’s work, but those deaths were not counted, blaming “natural causes”. If Human Rights Watch is to be believed, the number actually runs into thousands.

Forgive me, dear reader, if you are feeling cheated by the first couple of paras of this curtain raiser. You were expecting mouth-watering dishes made of Messi, Neymar, Mbappe, Lewandowski et al but the starter tasted like bitter gourd.I could not help bringing up the dead workers as England’s The Guardian newspaper’s investigation says 6,500 migrant workers from India, Pakistan, Bangladesh and Sri Lanka have died in Qatar since 2010. Coming just a couple ofyears after we saw migrant workers walking thousands of miles through our own country and dying on the road, it is impossible to ignore these facts in the excitement of a sporting spectacle.

Spectacle it shall be, no matter how many workers (Amnesty International says more than100,000) have been exploited and abused by lax labour laws of Qatar. Many have reportedly worked 14-18 working hours a day. To be fair, Qatar did not change their laws overnight to get the World Cup job done cheaply. Entire world knew how things were in that country and members of FIFA still voted for their bid. What role cash and kinds played is another story.

One can justifiably argue that this is all politics, not football. But having excluded Russia from this World Cup for attacking Ukraine, it would be rich of FIFA to dismiss the above criticism as just politics. The English FA has vowed to push for new labour laws and Migrant Workers’ Centre in Qatar. As many as eight captains are planning to wear rainbow-coloured ‘One Love’ armbands in support of LGBTQIA+ community during the matches, many teams have cancelled fan zones protesting the oppressive laws about homosexuality in Qatar. Also, many footballers and coaches are on record saying the World Cup should not have been held in that country. World Cup 2022, therefore, cannot escape politics.

However, this is not the first world event to be underscored by politics. Dictators have always exploited sporting events to prove their supremacy. Vladimir Putin did that with the 2018 World Cup, Argentine dictator Jorge Rafale Videla with the1978 edition and Benito Mussolini with the 1934 edition. Authoritarian rulers never seem to learn from Adolf Hitler’s Berlin Olympics experience, when his bid to showcase Aryan supremacy boomeranged as Jesse Owens reigned supreme. They have good reason not to. Those who played in Italy (1934) and Argentina (1978) remain divided in their opinion about the glory. Some believe they played and won for the people of their country, not the ruler. Some feign ignorance about what was happening at that point in time while others declare helplessness. None of them is fully wrong.

Considering what was going on in Mussolini and Videla’s regime, Qatar would just be dirty. Hopefully, there is no detention camp within walking distance of one of the stadiums, as was the case in Argentina. Moreover, Qatar cannot possibly lift the trophy on December 18, thereby further glorifying the monarchy. In fact, it would be an achievement if they progress from Group A, which has the always fascinating Netherlands and African giants Senegal.

Read Falling from the sky: The insignificance of being human

Gareth Southgate’s ever-improving England should find it easy in Group B. Harry Kane& Co. have already made it to a World Cup semifinal and a Euro final, surpassing all the English sides of the past but one. Southgate has already said he knows the contract till 2024 cannot protect him if he fails to lift this trophy. Why should such a team be worried about Wales, United States and Iran?

Same for Argentina in Group C. An Argentine World Cup campaign, even during the days of Diego Maradona, used to be tumultuous. This is the first time the genius would neither be in the dressing room, nor in the stands looking like a child desperate to see his favourite side win. This is also the first time Argentina are coming into the tournament as firm favourites even though Messi refuses to acknowledge it. That is a good way to deflect pressure because who can be a favourite if a team that has not lost 35 games on the trot isn’t? Messi, for all his exploits in European club football, has always hit a wall called Maradona. Fans back home and critics world over always pointed out Messi has not won anything for Argentina. Maradona passed away in 2020 and Argentina won Copa America next year. That monkey is off Messi’s back now. It is highly unlikely that he will get another opportunity to emulate Maradona’s 1986. There could not be a better opportunity, too, as Lionel Scaloni’s team is the best Argentine side in a longtime. When was the last time they had a defender of Cristian Romero’s calibre?

The fight for top spot in Group D would be a competition between defending champions France and dangerous Denmark, unless Australia, struggling in the qualifiers, spring a surprise. Didier Deschamps’s side is a good unit even without Paul Pogbaand N’Golo Kante in the midfield. A mature Kylian Mbappe and in-form Karim Benzema could be nightmarish for any defence and the reliable Hugo Lloris is still in goal.

Luis Enrique’s Spain and Hansi Flick’s Spain in Group E are rich in history and have been poor in recent past. Germany, perhaps, have never been poorer in big tournaments. Their group stage exit from the last World Cup was followed by a second-round loss to England in Euro 2020. But this German side is again overflowing with top performers. If the striking power of Serge Gnabry, Leroy Sane, Kai Havertz, Timo Werner is not enough, there is still the old fox –Thomas Mueller. And Manuel Neuer remains one of the best to guard the goal.

Likewise Spain have talented attackers and young ones at that. Pedri, perhaps their biggest star at the moment, will turn only 20 during the World Cup. But he has already played almost 100 matches for Barcelona. Ansu Fati, another young Barcelona recruit, could light up the World Cup if he is fit enough. They would have the calmness of elder statesman Sergio Busquets behind them.

Group F should be a cakewalk for last World Cup’s runners up Croatia, with deteriorating Belgium as the only challenge for the top spot. While Croatia havegrown in the last four years and look a set team under Zlatko Dalic, Belgium’s golden generation seems to be over. Roberto Martinez does not have the services of a stalwart like Vincent Kompany anymore, Romelu Lukaku has lost some edge and Eden Hazard has been plagued by injuries, not being a regular for Real Madrid. Only Kevin de Bruyne and Thibaus Courtois remain the same force.

Cameroon have high hopes in Group G. When Rigobert Song’s boys beat Algeria in March to ensure qualification, legend Samuel Eto’o, now the head of Cameroonian Football Federation, told the team “We go to Qatar to win the World Cup.” Dreams are good but Cameroon will have to get past decent European teams Serbia and Switzerland first, assuming Tite’s Brazil will not have problems topping that group. Neymar, like Messi, never had a better team with him. Raphinha, Richarlison, Lucas Paqueta – coach Tite is spoilt for choice as far as attackers are concerned. Then there is Casemiro in the midfield and Thiago Silva at the back. Dreaming of the sixth title is not outrageous.

Cristiano Ronaldo, in his last World Cup, has landed in a tough group with his side. The other teams in Group H are Ghana, Uruguay and South Korea. Ghana played a World Cup quarterfinal in 2010, Uruguay are two-time champions and South Korea, apart from being the most regular Asian team in the quadrennial show, have been in the semi-final. In fact, it is Portugal whose best World Cup performance came way back in 1966, when they finished third. But Ronaldo has taken them through their best ever period, winning Euro 2016 and the inaugural UEFA Nations League in 2019.

However, Ronaldo’s form and fitness have become a concern now. For the last few days, he has been in the news for all the wrong reasons. Ronaldo claims he has not been given enough respect at Old Trafford either by Manchester United manager Erik ten Hag or the management. He has also spoken ill of Wayne Rooney unprovoked. Did Ronaldo need this distraction to charge himself up before the big event or will it further dent his team’s chances? Whatever it is, the campaign will be doubly difficult for Portugal if CR7 is not at his best.

Pray for him if you are a Portugal fan, pray for whichever team you support. But do keep the dead and the persecuted of Qatar in your prayers. We can do only that much because we cannot help becoming Nero’s guests. Today’s world does not have one Nero.

Originally published in The Meghalayan

জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত

মুখবন্ধে সম্পাদক জয়দীপ বসু ও তাঁর সহকারী সায়ন মুখার্জি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, স্রেফ প্রচ্ছদ দেখলেও টের পাওয়া যাচ্ছে যে এ বই ততটা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস নয়, যতটা ভারতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস।

ভারতের ফুটবল এখন কোথায় দাঁড়িয়ে তা সংক্ষেপে বোঝাতে হলে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের দলগুলো ঝাঁ চকচকে হোটেলে সর্বোচ্চ মানের সুযোগসুবিধা নিয়ে থাকে, বিমানে যাতায়াত করে; জাতীয় গেমসে সোনার পদক জয়ী বাংলা দলের ফুটবলাররা বাড়ি ফেরেন দু রাত ট্রেনে কাটিয়ে। ট্রেনে চড়ায় কোনো অন্যায় নেই, অপমানও নেই। কিন্তু দু ধরনের ফুটবলের দুস্তর ব্যবধান এতে স্পষ্ট হয়। ভারতীয় ফুটবল অবশ্য এভাবেই চলে। রাজ্য দল দূরের কথা, জাতীয় দলও ক্লাব দলগুলোর মত সুযোগসুবিধা ভোগ করে না। ভারতের জাতীয় দলের পরিচর্যায় ইদানীং বিপুল উন্নতি হয়ে থাকলেও দীর্ঘকাল জাতীয় দলে খেলা সম্মানের, সেখানে দেশপ্রেম জড়িত – এই আবেগের শাক দিয়ে পারিশ্রমিকের মাছ ঢেকে রেখেছিলেন ফুটবল কর্তারা। তখন থেকেই ভারত আন্তর্জাতিক ফুটবলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ফুটবলোন্নত দেশেই ক্লাব ফুটবল বেশি অর্থকরী, তার গ্ল্যামারও বেশি। তা বলে জাতীয় দল হেলা শ্রদ্ধার পাত্র নয়। সুনীল ছেত্রী ব্যক্তিগত দক্ষতায় লায়োনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর পাশে জায়গা করে নিলেও আন্তর্জাতিক ফুটবল মানচিত্রে কিন্তু ভারতীয় দল কোথাও নেই। অথচ ফুটবলে যখন বিশ্বকাপ নয়, অলিম্পিককেই মনে করা হত সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতার মঞ্চ, তখন এই ভারতই ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে চতুর্থ হয়েছিল। এই অবনমনের ইতিহাস ধরা পড়েছে ভারতীয় ফুটবল দলের ৭৫ বছরের ইতিহাস নিয়ে লেখা বক্স টু বক্স বইতে।

মুখবন্ধে সম্পাদক জয়দীপ বসু ও তাঁর সহকারী সায়ন মুখার্জি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, স্রেফ প্রচ্ছদ দেখলেও টের পাওয়া যাচ্ছে যে এ বই ততটা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস নয়, যতটা ভারতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস। তরুণ ফুটবলপ্রেমীদের প্রায়শই হা হুতাশ করতে দেখা যায় ভারত বিশ্বকাপ ফুটবলের ত্রিসীমানায় পৌঁছতে পারে না বলে। অথচ তাঁদের ধ্যান জ্ঞান ক্লাব ফুটবল। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল আইএসএল খেলতে পারল কি না পারল তা নিয়ে যত আগ্রহ তার ছিটেফোঁটাও জাতীয় ফুটবল দল নিয়ে দেখা যায় না। সুনীল ছেত্রী যদি বর্তমান প্রজন্মের খেলোয়াড় না হয়ে প্রাক্তন হতেন তাহলে তাঁর কীর্তি নিয়ে কার কতটা আগ্রহ থাকত যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সন্দেহ নেই এর জন্যে অনেকখানি দায়ী ভারতীয় ফুটবল দলের সাফল্যের অভাব। ১৯৭০ সালের এশিয়ান গেমস আর মারডেকা কাপে ব্রোঞ্জ মেডেলের পর বলার মত সাফল্য আর কোথায়? সাফ কাপ বা এশিয়ান চ্যালেঞ্জ কাপের খেতাব যে খুব বড় কোনো সাফল্য নয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় এশিয়ান কাপের মূলপর্ব বা বিশ্বকাপের যোগ্যতামান পর্বের খেলা এসে পড়লেই। কিন্তু ব্যর্থতার ইতিহাসও তো জানা জরুরি। সম্ভবত সাফল্যের ইতিহাস জানার চেয়েও বেশি জরুরি, কারণ ব্যর্থতার সত্যনিষ্ঠ ইতিহাসই সাফল্যের ইমারত গড়ার মশলা। আইএসএলে মত্ত ফুটবলপ্রেমীদের সামনে সেই ইতিহাস তুলে ধরার কাজ করেছে বক্স টু বক্স। ফুটবলপ্রেমীদের প্রেম কতটা এ বইয়ের কপালে জুটবে তা বলা শক্ত, কিন্তু নথি হিসাবে এ বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।

তথ্য সংকলন করা পরিশ্রমসাধ্য হতে পারে, অসম্ভব নয়। কিন্তু কেবল তথ্য ইতিহাস হয়ে ওঠে না। পাহাড়প্রমাণ তথ্য ঘেঁটে একজন বা দুজন যদি ভারতীয় ফুটবল দলের ইতিহাস লিখতেন তাহলে গভীরতায় ঘাটতি থাকতে পারত, একপেশে ইতিহাস তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই বইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ হল দুই সম্পাদক এবং পরিসংখ্যানবিদ গৌতম রায় ছাড়া আরও ১৪ জন ফুটবল সাংবাদিকের বয়ানে ইতিহাসকে তুলে ধরা। বাকি পৃথিবীর সাংবাদিকতায় ‘সুপার স্পেশালাইজেশন’-ই দস্তুর। কিন্তু ভারতে তা নানা কারণে অসম্ভব। অতিমারীর আগে পর্যন্ত তবু ফুটবল সাংবাদিক, ক্রিকেট সাংবাদিক, টেনিস সাংবাদিক – কাজের এরকম বিভাজন অন্তত বড় সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেখা যেত। করোনার ধাক্কা থেকে নিজেদের লাভের কড়ি বাঁচাতে গিয়ে মালিকরা ওটুকুও লাটে তুলে দিয়েছেন। এমন আবহে এই বইয়ে হায়দরাবাদের ফুটবল নিয়ে লিখেছেন সেখানকার সাংবাদিক (এন গণেশন ও জি রাজারমণ), বাংলার ফুটবল নিয়ে কলকাতার সাংবাদিক (পুলকেশ মুখোপাধ্যায়), কেরালা (লেসলি জেভিয়ার), গোয়া (মার্কাস মারগুলহাও), মুম্বাই (মারিও রডরিগেজ) সম্বন্ধে লিখছেন সেখানকার অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা; পাঞ্জাব (এস এস শ্রীকুমার) ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল (বৈভব রঘুনন্দন) নিয়ে বিশেষজ্ঞরা – এই ব্যবস্থার জন্য সম্পাদকদের আলাদা প্রশংসা প্রাপ্য। ভারতীয় ফুটবল দলের সাফল্য-ব্যর্থতার ইতিহাস নথিবদ্ধ করতে হলে যে এইসব এলাকার ফুটবল নিয়ে স্বতন্ত্র আলোচনা দরকার, এই ভাবনাও প্রশংসার যোগ্য।

এত বড় দেশের খেলা নিয়ে আলোচনা বিকেন্দ্রীভূত হলে তবেই যে গভীর হয় তার বড় প্রমাণ পুলকেশবাবুর প্রবন্ধ ‘Royal or Not, Bengal’। পিকে ব্যানার্জি, অমল দত্ত বা বাঘা সোমের কোচিংয়ের খ্যাতি তো দেশজোড়া। কিন্তু কজন জানেন হুগলী-ব্যান্ডেল এলাকার অশ্বিনী বরাটের কথা? পুলকেশবাবু লিখেছেন, সুরজিৎ সেনগুপ্তের বাঁ পা প্রথম দিকে তেমন সচল ছিল না। অশ্বিনী (নিজের অঞ্চলে ভোলাদা নামে খ্যাত) বেশ কিছুদিন প্র্যাকটিসের প্রথম আধ ঘন্টা সুরজিৎকে ডান পায়ে বল ছুঁতে বারণ করে দিয়েছিলেন। তার ফলে ১৯৭৩ সালের রোভার্স কাপের প্রথম প্র্যাকটিস সেশনের পরেই সুরজিতের ক্লাব কোচ পিকে স্ত্রীকে চিঠিতে লেখেন তাঁর নতুন ছাত্রটির মধ্যে এক বিরল গুণ দেখা যাচ্ছে। তার দুটো পা-ই সমান সচল।

এমন মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে রাজ্যভিত্তিক প্রবন্ধগুলোর সবকটাতেই। তবে ভারতীয় দলের সর্বকালের সেরা কোচ সৈয়দ আব্দুল রহিমের শহর এবং মহম্মদ হাবিব, আকবর, সাবির আলির মত ফুটবলারের জায়গা হায়দরাবাদ নিয়ে প্রবন্ধটি অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের এই শতকের গোড়ায় দশ বছর সাসপেন্ড থাকার অনুল্লেখে। ভারতীয় ফুটবলে হায়দরাবাদের যে স্থান ছিল সেখান থেকে আজ স্রেফ এক আইএসএল ফ্র্যাঞ্চাইজে পরিণত হওয়ার ঘটনাক্রমে দেশের ফুটবল মানচিত্রে ওই দীর্ঘ অনুপস্থিতি অবশ্যই বড় কারণ।

ভারতীয় ফুটবল দল কীভাবে অলিম্পিক আবির্ভাবেই ইউরোপকে চমকে দিয়েছিল, এক অজ্ঞাতনামা ব্রিটিশ সাংবাদিকের কলমে সেই বয়ান দিয়ে আরম্ভ হয়েছে বক্স টু বক্স, আর বইয়ের দ্বিতীয় অংশ শুরু হয়েছে জয়দীপবাবুর লেখা ‘Doomsday: Cash vs Country’ দিয়ে। জাতীয় দলের পাতাল প্রবেশের সেই শুরু। এ লেখার শুরুতেই দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে যেমন তেমনভাবে ফুটবলারদের জাতীয় দলের খেলিয়ে নেওয়ার যে প্রচেষ্টার কথা লিখেছি, তার সূচনাবিন্দু রয়েছে জয়দীপবাবুর ওই প্রবন্ধে।

১৯৮২ এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি হিসাবে ১৯৮১ থেকেই লম্বা শিবির এবং মারডেকা কাপে অংশগ্রহণ ছাড়াও জাতীয় দলের জন্য একাধিক টুরের বন্দোবস্ত করেছিল সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ)। কিন্তু ফুটবলারদের জন্য যথাযোগ্য পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করা হয়নি। ১৯৮১ সালের গোড়ায় সল্টলেক স্টেডিয়ামে জাতীয় দলের শিবির বসে। খেলোয়াড়দের রাখা হয়েছিল নির্মীয়মান স্টেডিয়ামে মশামাছিতে ভর্তি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। তার উপর তাঁদের ১৯৮১-৮২ মরসুমে ক্লাবের হয়ে খেলার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছিল না। বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন খেলোয়াড়রাও নাছোড়বান্দা। ফুটবল ফেডারেশন তখন তাঁদের লিখিত বিবৃতি দিতে বলে, যে তাঁরা ক্যাম্প ছেড়ে ক্লাবের হয়ে খেলতে যেতে চান এবং জাতীয় দলের টুর্নামেন্টের আগে আবার ফেরত আসবেন। জয়দীপবাবু লিখেছেন, ওই মর্মে দেওয়া বিবৃতিতে সই করে বেরিয়ে যাওয়া খেলোয়াড়দের ‘রেবেলস’, ‘ডেজার্টার্স’, ‘অ্যান্টি-ন্যাশনালস’ আখ্যা দেয় সংবাদমাধ্যমগুলো। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার এবং জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই ফুটবলারদের কড়া নিন্দা করে। জ্যোতিবাবু স্বয়ং বিধানসভায় মুলতুবি প্রস্তাবের জবাবে এঁদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন। এসবের জেরে ভাস্কর গাঙ্গুলি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রসূন ব্যানার্জি, প্রশান্ত ব্যানার্জির মত ফুটবলাররা প্রায় একমাস বাড়ি থেকে বেরোতে পারেননি বলে উল্লেখ করেছেন জয়দীপবাবু। কলকাতার তিন প্রধান, যারা ওই খেলোয়াড়দের উস্কেছিল, তারাও পাশে দাঁড়ায়নি। শেষমেশ খেলোয়াড়দের বাবা-মায়েরা ফেডারেশন সেক্রেটারি অশোক ঘোষের কাছে ক্ষমা চান, কিন্তু ফেডারেশন অনমনীয় মনোভাব বজায় রাখে। নিয়ম করা হয়, জাতীয় শিবিরে সুযোগ পেলে মেডিকাল কারণ না থাকলে বা বাদ না পড়লে শিবির ছেড়ে যাওয়া চলবে না।

তখনো ভারতীয় ফুটবলে পেশাদারি কাঠামো তৈরি হয়নি। কিন্তু খেলোয়াড়রা অনেকেই যে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেন এবং ক্লাবগুলোর কাছ থেকে যথেষ্ট ভাল পারিশ্রমিক পান তা গোপন ছিল না। ফেডারেশন সেই ব্যবস্থাকে আইনি কাঠামোয় নিয়ে এসে কোনো বিকল্পের কথা ভাবতে পারত। তা না করে গা জোয়ারি ব্যবস্থা করা হয়। শেষপর্যন্ত অধুনালুপ্ত ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিলের কর্তা প্রয়াত ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশর মধ্যস্থতায় দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া ফুটবলাররা সে মরসুমে ক্লাবের হয়ে খেলার অনুমতি পান এবং মরসুমের পর থেকে এশিয়ান গেমসের শিবিরে থাকবেন বলে ঠিক হয়। জাতীয় শিবিরে থাকলে মাসে ২,০০০ টাকা করে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে বলেও সিদ্ধান্ত হয়। জয়দীপবাবু যথার্থই লিখেছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা হলেও সম্মানহানি আটকানো গেল না। জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার সম্মান, ফুটবলারদের সম্মান।

অবশ্য জাতীয় দলের খেলার গুরুত্ব লঘু করে দেওয়ার সর্বনাশা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল আগেই। তা নিয়ে বিশেষ কাউকে লেখালিখি করতে দেখা যায় না। জয়দীপবাবু এই একই প্রবন্ধে সবিস্তারে সে সম্পর্কে লিখেছেন। বস্তুত প্রবন্ধটি শুরুই হয় ১ জুন, ১৯৭৩ তারিখের ঘটনা দিয়ে। সেদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সশরীরে দিল্লি গিয়ে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী (খেলাধুলো তখন ওই মন্ত্রকের অধীনে) নুরুল হাসানকে জানিয়ে আসেন, কলকাতার তিন প্রধানের পক্ষে মারডেকা কাপের জন্য জাতীয় শিবিরে খেলোয়াড় পাঠানো সম্ভব নয়। কারণ তখন কলকাতা ফুটবল লিগ পুরোদমে চলবে। সে বছর মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান স্পোর্টিংয়ের খেলোয়াড়দের ছাড়াই ভারত মারডেকা কাপে যায় এবং ষষ্ঠ স্থানে শেষ করে। জয়দীপবাবুর মতে, নকশাল আন্দোলন পরবর্তী বাংলার যুবসমাজকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সিদ্ধার্থশঙ্কর কলকাতার ফুটবলকে ব্যবহার করেন। আদতে ক্ষতি হয় ভারতীয় ফুটবলের। ক্লাবের স্বার্থে জাতীয় দলের স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া চলে – এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পায় একজন মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে। এসব পড়তে পড়তে তির্যক হাসি না হেসে পারা যায় না। কারণ যে কলকাতা লিগের খেলার জন্য জাতীয় দলের খেলাকে তুচ্ছ করা হয়েছিল, সেই কলকাতা লিগ আজ ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। মোহনবাগান সগর্বে বলে দিতে পারছে তারা লিগে খেলবে না। সেকালের কর্মকর্তারা মনে করতেন কলকাতা লিগ খেতাবের চেয়ে বড় পুরস্কার ফুটবল বিশ্বে নেই, আজকের কর্তারা মনে করেন আইএসএল খেললেই মোক্ষলাভ, কলকাতা লিগ ফালতু। মাঝখান থেকে ভারতীয় ফুটবল গোলকধাঁধায় ঘুরে মরছে, এগোতে পারছে না।

ঠিক সে কথাই লিখেছেন ধীমান সরকার। তাঁর প্রবন্ধের নাম ‘Going Around In Circles’। তিনি শুরুতেই অপ্রিয় সত্যটা বলে দিয়েছেন। ১৯৯৮ থেকে ২০২২ – এই আড়াই দশকে শুটিং, বক্সিং, ভারোত্তোলন, ব্যাডমিন্টন, কুস্তির মত যেসব খেলায় ভারত অলিম্পিকে যেত স্রেফ অংশগ্রহণ করতে; সেসবে পদক জিতে ফেলেছে, বিশ্বনাথন আনন্দ প্রথম ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার হিসাবে শুরু করে পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছেন। অথচ ভারতীয় ফুটবল দল লুই ক্যারলের থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস গল্পের অ্যালিসের মত প্রাণপণ দৌড়েও সেই দক্ষিণ এশিয়ার এক শক্তিশালী দলই হয়ে রয়েছে। আই লিগকে দুয়োরানিতে পরিণত করা আইএসএল যে ভারতীয় ফুটবলে কোনো যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারেনি, বরং ভারতের ক্লাব ব্যবস্থার আরও ক্ষতিই করেছে তা ধীমানবাবুর লেখায় স্পষ্ট। এমতাবস্থায় জাতীয় দলের উন্নতির আশাও যে দুরাশা তা উচ্চারণ করতে তিনি কসুর করেননি।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

বক্স টু বক্স এভাবে ইতিহাস আলোচনার মধ্যে দিয়ে বর্তমান বিশ্লেষণ ছাড়া আরও একটা জরুরি কাজ করেছে, তা হল ভারতীয় দলের হয়ে অবিস্মরণীয় খেলা দেখানো যে কিংবদন্তীরা আজকের প্রজন্মের অচেনা, তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ডাঃ টি আওকে নিয়ে লিখেছেন শারদা উগ্রা, তুলসীদাস বলরামকে নিয়ে সিদ্ধার্থ সাক্সেনা, রহিম সাহেবকে নিয়ে জয়দীপবাবু। অত্যন্ত মূল্যবান অরুণ সেনগুপ্তের নেওয়া সুধীর কর্মকারের সাক্ষাৎকারও। নিজের খেলা, নিজের প্রজন্মের খেলা এবং বর্তমান প্রজন্মের খেলার মান সম্পর্কে এত নির্মোহ মূল্যায়ন করতে আজকাল কোনো খেলার প্রাক্তনদেরই দেখা যায় না।

দু মলাটের মধ্যে শ আড়াই পাতায় ভারতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের নানা দিক জানতে চাইলে, বর্তমানকে ভাল করে বুঝতে চাইলে বক্স টু বক্স চমৎকার। ভুয়ো খবরের যুগে ভারতীয় ফুটবল দলের ১৯৫০ বিশ্বকাপে না খেলা নিয়ে নিয়মিত ব্যবধানে যে গুজবটা ছড়ানো হয়ে থাকে সোশাল মিডিয়ায়, তা খণ্ডন করতেও সাহায্য করবে কাশীনাথ ভট্টাচার্য এবং জয়দীপবাবুর লেখা দুটো প্রবন্ধ। তবে কিছু অসঙ্গতি এড়ানো গেলে ভাল হত। যেমন সায়নবাবুর ‘Golden Quarter’ বলছে ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের পর ইউরোপ টুরে একটা ম্যাচে আজাক্স আমস্টারডামকে ভারতীয় দল হারিয়েছিল ৫-১ ব্যবধানে। কিন্তু শারদা উগ্রার লেখায় ব্যবধানটা হয়ে গেছে ২-১। প্রথম তথ্যটাই সঠিক, কিন্তু এই অসঙ্গতি পাঠককে দিগভ্রান্ত করবে। যে বইতে যত্ন করে ভারতীয় দলের ৭৫ বছরের গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান পর্যন্ত সৃজন করা হয়েছে, ছাপা হয়েছে একগুচ্ছ মূল্যবান ছবি, সে বইতে এ ধরনের ভুল কাম্য নয়।

বক্স টু বক্স
সম্পাদনা: জয়দীপ বসু
প্রকাশক: আইএমএইচ
দাম: ৬৫০ টাকা

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত

%d bloggers like this: