ভারতমাতার লাঞ্ছনা ড্যাবডেবিয়ে দেখতে শিখেছি আমরা

২০১৪ সালের পর থেকে যতবার ভারতমাতা শব্দটা আমাদের শুনতে হয়েছে রাজনৈতিক আলোচনায়, ততবার প্রাক-স্বাধীনতা যুগে বা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই জন্মানো ব্যক্তিরাও বোধহয় সারাজীবনে শোনেননি। যে দেশে জন্মেছি সে দেশকে মা বলে কল্পনা করায় এমনিতে কোনো অন্যায় নেই। কেবল উগ্র জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থীরা নয়, আদৌ নেশন ব্যাপারটাতেই বিশ্বাস ছিল না যে রবীন্দ্রনাথের, তিনিও জন্মভূমির উদ্দেশে লিখেছেন “সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে।” কিন্তু নিজের দেশকে আরও অনেককিছু হিসাবেই কল্পনা করে থাকে অনেকে। সাহেবরা মাদারল্যান্ড, ফাদারল্যান্ড দুটোই বলে থাকে। শিল্পী মানুষদের তো কথাই নেই। যুক্তি, তক্কো আর গপ্পো ছবিতে নীলকণ্ঠ বাগচীর ভূমিকায় ঋত্বিক ঘটক চোখ বড় বড় করে বললেন “প্রেমে পড়ে গেলাম”। তারপর সোজা তাঁর ক্যামেরা দেখাতে শুরু করে বাংলার প্রকৃতি। চুম্বন এড়িয়ে (নাকি চুম্বনের পর?) দৌড়ে হাত ছাড়িয়ে চলে যাওয়া প্রেমিকা দুর্গাকে পর্দায় দেখা যায় পরে এবং ক্ষণেকের জন্য। বাজতে শুরু করে “আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি” এবং ক্যামেরা ঘুরে বেড়ায় জলে জঙ্গলে পাহাড়ে আকাশে। গোটা গানেই প্রেমে বিহ্বল তৃপ্তি মিত্রের চেয়ে বেশি করে দেখা যায় জন্মভূমিকে।

কিন্তু দেশকে নিয়ে এইসব নানারকম ভাবনা এ দেশের ঠারেঠোরে বারণ হয়ে গেছে ২০১৪ সাল থেকে। দেশকে মা বলেই ভাবতে হবে, বন্দে মাতরম গাইতে হবে। যারা গাইতে আপত্তি করবে তারা সব দেশদ্রোহী। এমনকি রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় স্তোত্রটিও গাইতে হবে খেলার আগে, সিনেমা দেখার আগে একেবারে সাবধান পোজিশনে দাঁড়িয়ে। বসে থাকা মহাপাপ। হুইলচেয়ারে বসে থাকলেও ভারতমাতার অপমান এবং তার শাস্তি ‘পাকিস্তানি’ বলে গালমন্দ করা। তা এমন একনিষ্ঠ মাতৃভক্তদের দেশে নিশ্চয়ই আশা করা অন্যায় নয় যে নারীর সম্মান একেবারে শিখরে পৌঁছবে। অন্য সব দেশ আমাদের দেখে শিখবে কেমন করে মেয়েদের সম্মান করতে হয়। ট্রেনে বাসে কোনো পুরুষ চোরাগোপ্তা মেয়েদের জামার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেবে না, কনুই দিয়ে গুঁতো মারবে না বুকে, বাস ব্রেক কষার অজুহাতে এসে পড়বে না গায়ে। পড়লেও মেয়েরা টুঁ শব্দটি করার অপেক্ষা। তৎক্ষণাৎ উপস্থিত মাতৃভক্তরা তার সে অবস্থাই করবে কীচকের যে অবস্থা করেছিলেন ভীম। পুরাণই তো আমাদের ইতিহাস আর আমরা এত সভ্য জাতি, ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেব না? এও নিশ্চয়ই আশা করা চলে যে অফিস কাছারিতে যৌন হয়রানি বলে কিছু থাকবে না, কারণ সেসব করলেই মাতৃভক্ত রাষ্ট্র তার লম্বা হাত বাড়িয়ে চাকরিসুদ্ধ বধ করবে দুঃশাসনটিকে। ধর্ষণ শব্দটার তো কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, কারণ সেই কবে রামভক্ত, সীতা মাইয়ার ভক্ত লালকৃষ্ণ আদবানি বলেছিলেন, ধর্ষণের শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড। তিনি যখন মার্গদর্শকমণ্ডলীর সদস্য, তখন দেশের সরকার কি আর ওই মার্গে না গিয়ে পারে?

কিমাশ্চর্যম তৎপরম! ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলার এবং ঘাড় ধরে বলানোর ধুম বেড়েই চলেছে, অথচ আট থেকে আশির ভারতীয় মহিলারা ধর্ষিত হচ্ছেন, খুন হচ্ছেন। কখনো কাঠুয়ার মত শিশুকে দিনের পর দিন মন্দিরে গুম করে রেখে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলা হচ্ছে, কখনো হাথরাসের মত প্রমাণ লোপাট করতে খোদ পুলিস এসে বুক ফুলিয়ে টিভি ক্যামেরার তোয়াক্কা না করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে ধর্ষিতার দেহ। উন্নাওয়ের মত ধর্ষিতার বাবা খুনও হয়ে যাচ্ছেন অনেকসময়। আরও আশ্চর্য, ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল বেরোচ্ছে। সে মিছিলের নেতৃত্বে থাকছেন ভারতমাতার সবচেয়ে বড় ভক্তদের দলের নেতা, মন্ত্রীরা। ধর্ষিতার হয়ে মামলা লড়ছেন যে মহিলা আইনজীবী তাঁকে হুমকি দিচ্ছেন বার অ্যাসোসিয়েশনের লোকেরাই। তিনি আশঙ্কা করছেন ধর্ষিত হতে পারেন, খুনও হতে পারেন।

এখানেই শেষ নয়। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ধর্ষক বলে প্রমাণিত এবং সাজা পাওয়া অপরাধীরাও ভারতমাতার পরম ভক্ত সরকারের সিদ্ধান্তে সদাচরণের জন্য মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। জেল থেকে বেরোলে তাদের মালা পরিয়ে বীরের সম্মানও দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ভারতমাতার পুজো হচ্ছে আর তাঁর কন্যাসন্তানদের গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো হচ্ছে। ধর্ষণ যে কোনো গুরুতর অপরাধই নয় তা দেশসুদ্ধ লোককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। উন্নাওয়ের প্রাক্তন বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার, যিনি ধর্ষিতার বাবাকে খুন করার অপরাধে হাইকোর্টের আদেশে দশ বছর জেল খাটছেন, তিনি এ বছর জানুয়ারি মাসে মেয়ের বিয়ের জন্য হপ্তা দুয়েক অন্তর্বর্তী জামিন পেয়েছিলেন। গতকাল হরিয়ানার ভারতমাতার পরমভক্তদের সরকার ৩০ দিনের প্যারোলে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছে গুরমীত রাম রহিমকে, যিনি একাধিক ধর্ষণ ও খুনের মামলায় ইতিমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ২০২৩ সালের সাত মাসে দুবার বাইরে আসা হয়ে গেল তাঁর। বলা যায়, মাঝেমধ্যে ছুটি কাটাতে জেলে যান।

এইসব ধর্ষকদের ঘটনায় মিল একটাই। এঁরা বর্ণহিন্দু, অত্যাচারিত মহিলারা হয় মুসলমান, নয় দলিত। কে জানে! হয়ত কাঠুয়ার আসিফা, গুজরাটের বিলকিস বানো বা হাথরাসের দলিত মেয়েটি ভারতমাতার প্রতিভূ নয়। কে ভারতমাতার সন্তান আর কে দেশদ্রোহী তা তো আর ভারতমাতা ঠিক করেন না, ঠিক করেন তাঁর দায়িত্বপ্রাপ্ত সন্তানরা। তাঁরা হয়ত ঠিক করেছেন ওদের ভালমন্দে ভারতমাতার কিছু এসে যায় না। কিন্তু দস্তুরমত হিন্দু আন্তর্জাতিক পদকজয়ী কুস্তিগীররাও ভারতমাতার প্রতিভূ নন? ভিনেশ ফোগত, সঙ্গীতা ফোগত, সাক্ষী মালিকরা দিনের পর দিন রাস্তায় বসে রইলেন; পুলিস তাঁদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল। তবু ব্রিজভূষণ শরণ সিং কিন্তু গ্রেফতার হলেন না। উল্টে গতকাল গ্রেফতার না হয়েই জামিন পেয়ে গেলেন

এমন দেশে মণিপুরের মত একটা ছোট্ট রাজ্যে কয়েকজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাকে উলঙ্গ করে পথে পথে ঘোরানো হবে, যে পুরুষের যেমন ইচ্ছা স্পর্শসুখ অনুভব করবে, দল বেঁধে ধর্ষণ করবে – এ আর এমন কী ব্যাপার? ভারতমাতার সবচেয়ে বড় ভক্ত, বেচারা স্বঘোষিত প্রধান সেবক উপরে বর্ণিত কোনো ঘটনাই জানতেন না। হঠাৎ কাল মণিপুরের ঘটনাটা জানতে পেরে বেজায় ব্যথা পেয়েছেন, রেগেও গেছেন। এরকম বেদনা শেষ দেখা গিয়েছিল বিবেক ওবেরয়ের মধ্যে। যখন তিনি নরেন্দ্র মোদীর চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে জ্বলন্ত গুজরাট দেখে বলেছিলেন “মেরা গুজরাট জ্বল রহা হ্যায়!” এই বেদনায়, এই রাগে কার যে কী এসে গেল তা বোঝা মুশকিল। প্রধানমন্ত্রী মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংকে সরানোর ব্যবস্থাও করেননি, নিজে গিয়ে দাঁড়াবেন আগুন নেভাতে – এমন কথাও বলেননি। বরং বীরেন সগর্বে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এমন তো শয়ে শয়ে ঘটনা ঘটেছে, সেইজন্যেই তো ইন্টারনেট বন্ধ করা ছিল। এমন মাতৃভক্তির কোনো তুলনা হয়? এমন শয়ে শয়ে ঘটনা আটকাতে পারেননি বলে কোনো আফসোস নেই। কিন্তু এতে ভারতমাতার ভাবমূর্তি যেন খারাপ না হয় সেদিকে তিনি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। তাই তো এসব ঘটনা প্রকাশ পায়নি এতদিন। অতএব যত দোষ সোশাল মিডিয়ার

অবশ্য খামোকা উত্তেজিত হচ্ছি। ঠিকই তো বলেছেন বীরেন সিং। ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের লজ্জা তো সমাজের নয়; সরকারেরও নয়। যত লজ্জা সবটাই তো যে মহিলা লাঞ্ছিত তাঁর। এটাই তো সনাতন ভারতীয় মূল্যবোধ। আমরাও তো সেই মূল্যবোধ নিয়েই চলি। তাই আমাদের বাড়ির মেয়েরা অনেক লাঞ্ছনার ঘটনা স্রেফ চেপে যায়। বহু ধর্ষণে আজও পুলিসে ডায়রিই হয় না, কারণ আমার বাড়ির মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে এ আমার লজ্জা। বাড়ির সমস্ত পুরুষ (এবং মহিলার) লজ্জা। এই আমরাই তো ভোট দিয়ে ভারতমাতার এই সন্তানদের হাতে দেশের দায়িত্ব তুলে দিয়েছি। এঁরা তো আর তালিবানদের মত একে ৪৭ হাতে জোর করে ঢুকে পড়েননি সংসদে, বিধানসভাগুলোতে। ফলে ওই কুকি মহিলাদের জামাকাপড় খুলে নিয়েছি তো আমরা সবাই। উলঙ্গ করে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়েছি আমরাই। আমরা, যারা কোথাও না কোথাও সংখ্যাগুরু। এখনো আমাদেরই কতজন বনলতা সেনগিরি করে যাচ্ছে সোশাল মিডিয়ায় – কবে কোথায় কোন সরকারের আমলে কোন মহিলার সঙ্গে কী করা হয়েছিল। গুজরাটের ধর্ষিত মহিলাদের কথা উঠলেই আমরা টেনে আনি ধর্ষিত কাশ্মীরি পণ্ডিত মহিলাদের কথা অথবা নোয়াখালিতে ধর্ষিত মহিলাদের কথা। মেইতেইরাও অনেকেই সেই রাস্তা ধরে নিয়েছে। তাদের কোনো কোনো সংগঠন আবার দাবি করেছে, উলঙ্গ করে হাঁটানো হয়েছে বটে, কিন্তু ধর্ষণ করা হয়নি।

আরও পড়ুন কতটা পথ পেরোলে পরে ভারত পাওয়া যায়?

আমরা দেখছি, জনগণমনয়ধিনায়করাও দেখছেন। ড্যাবডেবিয়ে দেখছেন। নিজের মাকে নগ্ন দেখার পাপে সোফোক্লিসের ট্র্যাজেডির রাজা অয়দিপাউসকে অন্ধ হয়ে যেতে হয়েছিল। নিজেই নিজের চোখ উপড়ে নিয়েছিল সে। তবু তো অয়দিপাউস পাপটা করেছিল নিজের অজ্ঞাতে। আমরা সজ্ঞানে এই যে পাপ করে চলেছি এর শাস্তি কী?

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

কী ঢাকছে সরকারি চোলি? কেনই বা ঢাকছে?

আজ বিবিসির তথ্যচিত্র মুছে দেওয়া হচ্ছে, কাল ২০০২ সালে গুজরাটে আদৌ কোনো দাঙ্গা হয়েছিল বলে পোস্ট করলেই তা মুছে দেওয়া হবে। আহসান জাফরি খুন হননি – ওটি ভুয়ো খবর। বিলকিস ধর্ষিত হননি – ওটিও ভুয়ো খবর।

চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়
চোলি কে পিছে?
চুনরী কে নীচে কেয়া হ্যায়
চুনরী কে নীচে?

আমাদের তখন সবে গোঁফের রেখা উঠছে। সন্ধেবেলা দূরদর্শনের ‘সুপারহিট মুকাবলা’ অনুষ্ঠানে খলনায়ক ছবির এই গান পরপর কয়েক সপ্তাহ বেজেছিল এবং আমাদের উদ্বেল করেছিল। তখনো বাঙালি ছেলেমেয়েরা ভূমিষ্ঠ হয়েই হিন্দিতে পণ্ডিত হয়ে যেত না, ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়েরাও দলে দলে হিন্দিকে তাদের দ্বিতীয় ভাষা করে তুলতে উদগ্রীব হতেন না। ফলে চোলি আর চুনরী শব্দদুটির অর্থ জানতে আমাদের কিঞ্চিৎ সময় লেগেছিল। জানার পর আমাদের রোমাঞ্চ কোন মাত্রায় পৌঁছেছিল তা আজকের স্মার্টফোন প্রজন্ম কল্পনা করতে পারবে না। কিছুদিন পরে সে রোমাঞ্চে জল ঢেলে দিতে কেউ বা কারা আদালতে মামলা ঠুকে দিল। গানটি শ্লীল না অশ্লীল তা নিয়ে প্রবল তর্কাতর্কি লেগে গেল, কিছুদিন পরে দেখা গেল জনপ্রিয়তায় একসময় এক নম্বরে উঠে যাওয়া ওই গান আর ‘সুপারহিট মুকাবলা’ অনুষ্ঠানে বাজানো হচ্ছে না। ইলা অরুণের গাওয়া ওই চারটি লাইন মোটেই অশালীন নয় – এই যুক্তির পক্ষে যারা, তাদের হাতিয়ার ছিল অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া পরের কয়েক লাইন

চোলি মে দিল হ্যায় মেরা
চুনরী মে দিল হ্যায় মেরা
ইয়ে দিল ম্যায় দুঙ্গি মেরে ইয়ার কো, পেয়ার কো।

অকাট্য যুক্তি। ছবিতে দেখা যেত এক নাচাগানার আসরে নীনা গুপ্তা গানের প্রথম চার লাইনের প্রশ্নটি তুলছেন, আর লাস্যময়ী মাধুরী দীক্ষিত স্পষ্ট উত্তর দিয়ে দিচ্ছেন। অতএব অন্য কিছু ভাবার তো কোনো কারণ নেই। যতদূর মনে পড়ে আদালতে গানটির অশ্লীলতা প্রমাণ হয়নি, তাই প্রায় একই যুগের খুদ্দার ছবির অন্য একটি গান ‘সেক্সি সেক্সি সেক্সি মুঝে লোগ বোলে’-র মত আদালতের নির্দেশে গানের কথা বদল করে নতুন করে প্রকাশ করতে হয়নি। কিন্তু ঘটনা হল, চোলির পিছনে আর চুনরীর নিচে যা আছে তা নিয়ে আমাদের রোমাঞ্চে জল ঢালা সম্ভব হয়নি। আমরা যে যার মত করে বুঝে নিয়েছিলাম কী আছে – দিল না অন্য কিছু।

২০০২ সালে গুজরাটে গোধরায় ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের পর কী ঘটেছিল, তাতে নরেন্দ্র মোদীর কতখানি দায় ছিল, আদৌ ছিল কি ছিল না – এ প্রশ্ন উঠলেই আমার ওই গানটির কথাই মনে পড়ে। হৃদয় তো অনেক গভীরে গেলে পাওয়া যায়। বয়ঃসন্ধির ছেলেপুলেদের অতদূর যাওয়ার ধৈর্য থাকে না। আমরা, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্কিন ডিপ’, ওই গানের সে অর্থটুকু ভেবেই আহ্লাদিত হতাম। দূরবর্তী কোনো মাইক থেকে গানটি ভেসে এলে বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে চোখ মারামারি চলত, ঠোঁটে থাকত দুষ্টু হাসি। তা বলে কি আমাদের মধ্যে একটিও সুবোধ বালক ছিল না? তারা আমাদের অসভ্য উল্লাস দেখে যারপরনাই বিরক্ত হত। দু-একজন খাঁটি সাত্ত্বিক মানসিকতায় আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করত, আমরা গানটির একেবারে ভুল অর্থ ভেবে নিচ্ছি। একই গানের কথার যে একাধিক অর্থ হওয়া সম্ভব সে শিক্ষা আমরা তখনই পাই – রবীন্দ্রসঙ্গীতের গভীরতা বা ভারতচন্দ্রের ব্যাজস্তুতিকে স্পর্শ করার আগেই।

বিলিতি কবিতার রোম্যান্টিক যুগের কবিরা মনে করতেন মানুষ অমৃতের সন্তান। জন্মের পরেও বেশ কিছুদিন সে নিষ্পাপ থাকে, তারপর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তার মধ্যে পাপ প্রবেশ করে, পবিত্রতা বিদায় নেয়। কবি উইলিয়াম ব্লেক Songs of Innocence আর Songs of Experience নামে দুটি পরিপূরক কবিতার বই লিখে ফেলেছিলেন, আর উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ লিখেছিলেন এ জগৎ হল কারাগার। একটি ছেলে যত বড় হয় তত তার চতুর্দিকে ঘনিয়ে আসে সে কারাগারের গরাদ (“Shades of the prison-house begin to close/Upon the growing Boy”)। ২০০২ সালের মত ঘটনা যখন ঘটে তখন মানুষ অমৃতের সন্তান না মৃত্যুর সওদাগর তা নিয়ে ঘোর সন্দেহ দেখা দেয়। তবে এখন পিছন ফিরে মনে হয় মাধুরীর চোলি যেমন আমাদের নিষ্পাপ নাবালকত্ব থেকে অভিজ্ঞ সাবালকত্বে পৌঁছে দিয়েছিল, তেমনই গুজরাট ২০০২ ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে রাম জন্মভূমি নিয়ে গণহিস্টিরিয়া তৈরি করা আর মসজিদ ভাঙার রাজনীতির নাবালকত্ব থেকে শাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণের সাবালকত্বে পৌঁছে দিয়েছিল।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত একাধিক মামলায় রায় দিয়েছে – কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু, ধর্ষণ, বাস্তুচ্যুতির পিছনে কোনো বৃহত্তর অপরাধমূলক চক্রান্ত ছিল না। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদীরও কোনো প্রত্যক্ষ দায় ছিল না। এর উপরে আর কথা কী? কে না জানে, ভারতের বিচারব্যবস্থার মত নিখুঁত ও নিরপেক্ষ ব্যবস্থা পৃথিবীর কোথাও নেই? সেই কারণেই তো বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থাকে বাতিল করার দাবিতে উঠেপড়ে লেগেছে মোদী সরকার। তাদের অভিযোগ – ব্যবস্থাটি অগণতান্ত্রিক। আইনমন্ত্রী কিরেন রিজিজু আর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় প্রায় বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছেন প্রতিদিন। কী কাণ্ড! যে ব্যবস্থা মোদীর বিরুদ্ধে যাবতীয় রাজনৈতিক চক্রান্ত নস্যাৎ করে তাঁকে পদ্মফুলের মত নিষ্পাপ প্রমাণ করেছে, সেই ব্যবস্থাকে কিনা তাঁর সরকারই মনে করে অগণতান্ত্রিক!

এমন সময়, হাঁউ মাউ খাঁউ, গণহত্যার গন্ধ পাঁউ বলে এসে পড়ল বিবিসির তথ্যচিত্র ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চেন। নতুন করে উঠে পড়ল চোলির পিছনে কী আছে সেই প্রশ্ন। এইবেলা পরিষ্কার করে দেওয়া যাক, উদাহরণ হিসাবে শুধুমাত্র বিপরীতকামী পুরুষদের মধ্যে চালু থাকা নারীদেহ সম্পর্কে একটি রগরগে আলোচনাকে কেন টেনে এনেছি। কারণটি খুব সোজা। ওই যে বললাম, আমরা যে যার মত করে বুঝে নিয়েছিলাম? লক্ষ করলে দেখা যাবে, গুজরাটে ঠিক কী হয়েছিল বিজেপির ভোটাররাও ঠিক একইভাবে যে যার মত করে বুঝে নিয়েছে। ওই যে বললাম, গানটি ভেসে এলেই আমাদের মধ্যে চোখ মারামারি চলত? ঠিক একই ব্যাপার বিজেপি ও তার ভোটারদের মধ্যে চলে। বিবিসির তথ্যচিত্রে যা যা দেখানো হয়েছে তার কিছুই কিন্তু নতুন নয়। নতুন খবর বলতে এটুকুই, যে ব্রিটিশ সরকার এক নিজস্ব তদন্ত চালিয়েছিল, যার সিদ্ধান্ত হল মোদী স্বয়ং দায়ী। যে সমস্ত প্রমাণ, যেসব সাক্ষীকে এই তথ্যচিত্রের দর্শকরা দেখছেন তাঁদের কথা ভারতের বহু ছোটবড় সংবাদমাধ্যমে গত দুই দশকে প্রকাশিত হয়েছে। রাকেশ শর্মার তথ্যচিত্র ফাইনাল সলিউশন দেখলে বিবিসির তথ্যচিত্রের চেয়েও বেশি ঠান্ডা স্রোত নামবে শিরদাঁড়া বেয়ে। সেই তথ্যচিত্রটি যখন ইউটিউবে প্রথম আপলোড করা হয়, তখন সরকারের হাতে তা ব্লক করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু দলে দলে লোক বারবার রিপোর্ট করে ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’-কে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে সাময়িকভাবে ব্লক করিয়ে দিয়েছিল।

ফলে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। উঠলেই প্রত্যেকবার বিজেপি নেতা ও সমর্থকদের থেকে দুরকম উত্তর পাওয়া যায়। এক দল বলে, সব বানানো গল্প। সুপ্রিম কোর্ট ক্লিনচিট দিয়েছে। আরেক দল বলে, যা করেছে বেশ করেছে। মুসলমানদের বেশি বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। অমিত শাহ স্বয়ং যেমন সংবাদসংস্থা এএনআইকে বলেছিলেন, মোদীজির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত অভিযোগ করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর সেই অভিযোগকারীদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আবার সম্প্রতি হিমাচল প্রদেশে নির্বাচনী প্রচারে বলেছেন, ২০০২ সালে মোদীজি যারা হিংসা ছড়ায় তাদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন। ফলে গুজরাটে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার যা পছন্দ সে তাই বুঝে নেবে।

আমরাও ঠিক এমনই করতাম। এক দল মাধুরীর হৃদয় নিয়ে ভাবত, আরেক দল মাংসপিণ্ড নিয়ে। এমন চোলিকেন্দ্রিক পৌরুষই যে গুজরাট ২০০২-এর অভিজ্ঞান তা আর কেউ না জানলেও বিলকিস বানো বিলক্ষণ জানেন।

ভারত সরকার ইউটিউবে বিবিসির তথ্যচিত্রের যত লিঙ্ক আছে সব ব্লক করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। বিবিসির তথ্যচিত্রের লিঙ্ক শেয়ার করায় বেশকিছু টুইটও মুছে দিতে বলেছে। যদি বলি এই সাবালক জীবনের চেয়ে সেই নাবালক জীবন ভাল ছিল, তাহলে স্রেফ স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়ছি বলা যাবে কি? তখন ভারত রাষ্ট্র স্রেফ যৌনতাকেই অশ্লীল বলে বিবেচনা করত, ঢেকেঢুকে রেখে, গানের কথা বদলে দিয়ে বা কোনো ফিল্মের গোটা দু-চার চুম্বন দৃশ্য বাদ দিয়েই নিজের ক্ষমতা জানান দিত। তাও কেউ আদালতে দৌড়লে তবে। এখন তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন করে নিজের অপছন্দের কিছু দেখলেই তাকে অসত্য বলে দেগে দিয়ে ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ঠিক সেই কাজটিই করা হয়েছে এক্ষেত্রে। কদিন আগেই, গত মঙ্গলবার, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে আপলোড হওয়া সংশোধনীর এক খসড়ায় দেখা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো যে খবরকে ভুয়ো খবর বলে ঘোষণা করবে সে খবর কোনো সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করা যাবে না। শেয়ার হলে তার দায়িত্ব বর্তাবে সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটির উপর।

অর্থাৎ আজ বিবিসির তথ্যচিত্র মুছে দেওয়া হচ্ছে, কাল ২০০২ সালে গুজরাটে আদৌ কোনো দাঙ্গা হয়েছিল বলে পোস্ট করলেই তা মুছে দেওয়া হবে। আহসান জাফরি খুন হননি – ওটি ভুয়ো খবর। বিলকিস ধর্ষিত হননি – ওটিও ভুয়ো খবর। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো হয়ত এমনই বলবে। তা সরকার বা সরকারি সংস্থাগুলি বলতেই পারে। কিন্তু যত বলবে ততই চোলির পিছনে কী আছে সে প্রশ্ন জোরালো হবে। সরকারের এখনো চোলি কেন প্রয়োজন – সে প্রশ্নও উঠবে নির্ঘাত। কারণ গুজরাট দাঙ্গায় অভিযুক্ত, এমনকি শাস্তিপ্রাপ্তরাও তো এখন মুক্ত। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কাব্যের সত্যতা প্রমাণ করে গারদ ঘনিয়ে এসেছে কেবল উমর খালিদ, শার্জিল ইমামদের মত নাবালকদের উপর – যারা গালভর্তি দাড়ি গজিয়ে যাওয়ার পরেও মানুষকে মৃত্যুর সওদাগর ভাবার সাবালকত্বে উত্তীর্ণ হতে পারেনি।

আরও পড়ুন অসংসদীয় শব্দ: মুখ বুজে বাঁচা অভ্যাস করতে হবে

সামান্য আশাবাদী অবশ্য হওয়া যায় একথা ভেবে, যে সরকারের এখনো খানিক লজ্জাশরম আছে বলেই চোলির প্রয়োজন পড়ছে। তবে ইন্টারনেটের যুগে চোলি যথাস্থানে রাখা লৌহকঠিন সরকারের পক্ষেও কষ্টসাধ্য। শীত বড়জোর আর এক মাস। তারপর বসন্ত সমীরণে ভোরের দিকে হাওড়ার ফেরিঘাট থেকে যদি বাগবাজার অভিমুখে নৌকাবিহারে বেরিয়ে পড়েন, তাহলে দেখতে পাবেন ভাগীরথীর পাড়ে প্রাতঃকৃত্য করতে বসেছেন অনেকে। তাঁরা বসেন নদীর দিকে পিছন ফিরে। তাতে সুবিধা হল, আপনি তাঁদের উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে পেলেও তাঁরা আপনাকে দেখতে পান না। ফলে ভেবে নেওয়া সহজ হয় যে আপনিও তাঁদের দেখতে পাচ্ছেন না। ইন্টারনেটে একটি দেশের মধ্যে তথ্য ও তথ্যচিত্র ব্লক করা এমনই ব্যাপার। অবশ্য আত্মপ্রতারণা ছাড়া একনায়কত্ব বাঁচে কেমন করে?

পুনশ্চ: বিবিসির তথ্যচিত্রের নামে পার্ট ওয়ান কথাটি রয়েছে। কঙ্গনা রানাওয়াতের হিট ছবির সংলাপের ভাষায় “অভি তো হমে ঔর জলীল হোনা হ্যায়।”

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: