দলে দলে দলবদলের খেলায় বাঙালি এখন দিব্যি দড়

পেপ বার্সেলোনার একগুচ্ছ খেলোয়াড়কে বায়ার্ন মিউনিখ বা ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে আনতে পারেননি। মুকুল দলে দলে বিজেপি নেতা, কর্মীকে তৃণমূলে আনছেন। আস্ত জেলা কমিটি তুলে আনছেন।

টিভিতে ইউরো দেখছেন? হিংসা হচ্ছে না? প্রায় সব মাঠেই দর্শক আছে। অথচ এ দেশে আমরা ভয়ে ভয়ে বাজার যাচ্ছি, ট্রেন চলছে না বলে বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে কাজে যেতে হচ্ছে, তিতিবিরক্ত মানুষ স্পেশাল ট্রেন আটকে দিচ্ছেন, ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজ যাওয়া ভুলে গেছে, বড় বড় পরীক্ষা বাতিল, খেলাধুলোর তো প্রশ্নই নেই। ফাঁকা মাঠে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ আর অর্ধেক ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ছাড়া ভারতে দেখার মত খেলা হয়নি সেই গত বছরের মার্চ থেকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের খেলাপাগল লোকেদের খেলা দেখার তেষ্টা যে কমেনি, বরং বেড়েছে — সেকথা রাজ্যের নেতৃবৃন্দ বিলক্ষণ জানেন। অতএব নির্বাচনে স্লোগান হল “খেলা হবে”। ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে শ্রবণেন সোয়া ভোজনম তো বটে। সোয়াই বা কেন? এক জনসভায় তো মুখ্যমন্ত্রী হুইল চেয়ার থেকে দর্শকদের দিকে একটা সত্যিকারের ফুটবলই ছুঁড়লেন। হাড্ডাহাড্ডি খেলার মাঠে দর্শকদের প্রাণ যাওয়ার ইতিহাস সারা পৃথিবীতেই আছে। ইডেনে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ দেখতে গিয়ে ১৬ জনের মৃত্যুর কথা এ রাজ্যের কে না জানে? এবারের নির্বাচনও ছিল মরণপণ লড়াই, অতএব বেশকিছু প্রাণ গেল।

তবে মাঠের খেলার সাথে রাজনীতির খেলার বড় তফাত হল মাঠের খেলার শুরু আছে, শেষ আছে। শেষ হলে জয়ী দলের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন পরাজিত অধিনায়ক বিরাট কোহলির কাঁধে মাথা রাখতে পারেন, কোহলি ঠেলে সরিয়ে দেন না। আইসিসির কাছে অকারণ নালিশ ঠুকে ট্রফি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করেন না। কিন্তু রাজনীতির খেলার সূচনা, উপসংহারের ঠিক নেই। অনেকে ভাবেন কেবল নির্বাচনটুকু খেলা। “খেলা হবে” স্লোগান যাঁর মাথা থেকে বেরিয়েছিল, তিনিও হয়ত তাই ভেবেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফল বেরোনো মাত্রই পরাজিত বিজেপি বুঝিয়ে দিল, বিধানসভা নির্বাচনটা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের মত ‘ওয়ান-অফ’ খেলা নয়, লম্বা সিরিজ।

খেলা হবে আর আনুষঙ্গিক উত্তেজনাগুলো থাকবে না তা কি হয়? সৌরভোত্তর বাঙালি না হয় ক্রিকেটের দিকে বেশি ঝুঁকেছে, কিন্তু তার সেরা খেলা এখনও ফুটবল। নইলে ইস্টবেঙ্গলকে আই এস এল খেলানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রী মাঠে নামেন? ফুটবলের অন্যতম আকর্ষণ হল ‘ট্রান্সফার মার্কেট’। এই বিলিতি কথাটা হালের আমদানি। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশক অব্দি যখন টিভির চ্যানেল ঘোরালেই ইউরোপের লিগ দেখা যেত না; সেইসময় আমরা বলতাম ‘দলবদল’। দিবারাত্র খবরের চ্যানেল ছিল না, ডিজিটাল মাধ্যম ছিল না, কিন্তু সকালের কাগজ তেতে থাকত দলবদলের খবরে। আজ পড়লাম কৃশানু-বিকাশ মোহনবাগানে যাচ্ছেন, কালই ছবি বেরোল “ইস্টবেঙ্গলের গোপন আস্তানায় আড্ডার আসরে অভিন্ন জুটি”। সঙ্গে হয়ত পল্টু দাসের উক্তি “ওরা ঘরের ছেলে, আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবে?” মহমেডান ছাড়ছেন চিমা? সুদীপ চ্যাটার্জি কি দল বদলাবেন? কার অফার নিয়ে ভাবছেন শিশির ঘোষ? বিজয়ন-সত্যেন কি সত্যিই কেরালা পুলিস ছেড়ে মোহনবাগানে আসছেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মাঠে বল পড়ার আগেই ফুটবল মরসুম শুরু হয়ে যেত। একসময় রীতিমত অপহরণের অভিযোগে জেরবার হয়ে আই এফ এ চালু করল টোকেন ব্যবস্থা। টোকেন যার, ফুটবলার তার। তখন আবার এক ক্লাবকে টোকেন দিয়ে ফেলে পুলিসে ডায়রি করা শুরু হল টোকেন হারিয়ে গেছে বা কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে।

আই এস এল যুগের তরুণ বাঙালির কাছে এসব গল্পকথা মনে হবে। কলকাতা লিগকে দুয়োরানি করে দিয়েছিল যে আই-লিগ, তাও তো এখন সবার পিছে সবার নীচে। কিন্তু মাঝবয়সী বা বার্ধক্যে উপনীত ফুটবলপ্রেমীরা নিশ্চয়ই গত কয়েক মাস স্মৃতিমেদুরতায় ভুগছেন। ভোটের মরসুমে ফিরে এসেছে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের উত্তেজনা। প্রত্যেকবার অমিত শাহ উড়ে আসার কয়েকদিন আগে থেকে চ্যানেলে, কাগজে, ফেসবুকে আলোচনা চলেছে কোন কোন তৃণমূল নেতা বিজেপিতে যাচ্ছেন, কোন কোন সাংসদ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন, কোন সিপিএম কাউন্সিলর কোন দিনের সভায় বিজেপিতে যোগ দেবেন। সন্দেহ নেই বিজেপির রিক্রুটারদের কাছে সে আমলের টুটু বসু, পল্টু দাস, মহম্মদ ওমররা নস্যি। তৃণমূল মন্ত্রিসভার সদস্য শুভেন্দু অধিকারী থেকে প্রবীণ সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যের ডান হাত শঙ্কর ঘোষ পর্যন্ত কাকে না বঁড়শিতে গেঁথেছেন? তৃণমূলও হাত গুটিয়ে বসে ছিল না, তবে দলে টানা লোকেদের ধারে এবং ভারে তারা পিছিয়ে ছিল। সৌমিত্র খাঁয়ের ঘর ভাঙা ছাড়া আর তেমন সাফল্য কোথায়? তাছাড়া কৃশানু এক দলে, বিকাশ অন্য দলে থাকলে লাভ কী?

ফুটবলের দলবদল শেষ হয়ে যেত মরসুম শুরু হওয়ার আগেই। ‘মিড-সিজন ট্রান্সফার উইন্ডো’ ব্যাপারটা ইউরোপ থেকে শেখা হল অনেক পরে। কিন্তু সে তো উইন্ডো, মানে জানলা। নির্বাচনের পরে যা খুলে গেছে তা সিংহদুয়ার। ধীরেন দে, জ্যোতিষ গুহ পর্যন্ত ফেল পড়ে যাবেন মুকুল রায়ের সামনে। বাংলা সংবাদমাধ্যমে তাঁকে চাণক্য বলা হচ্ছে ইদানীং, অচিরেই মোরিনহো বা গুয়ার্দিওলার সাথে তুলনা করতে হবে। যদিও তাঁদেরও এমন চৌম্বকশক্তি নেই। পেপ বার্সেলোনার একগুচ্ছ খেলোয়াড়কে বায়ার্ন মিউনিখ বা ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে আনতে পারেননি। মুকুল দলে দলে বিজেপি নেতা, কর্মীকে তৃণমূলে আনছেন। আস্ত জেলা কমিটি তুলে আনছেন। খেলার আরও রোমহর্ষক হয়ে উঠছে। মুকুলবাবু বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হতে চলেছেন। বিরোধীরা আপত্তি করেছিলেন, ও পদটায় বিরোধী দলের বিধায়ককে বসানোই তো দস্তুর। কারণ শাসক দলে থাকা বিধায়ক সরকারি হিসাবপত্র পরীক্ষা করলে যে গলতি মাপ করে দেবেন না, তার নিশ্চয়তা নেই। জবাবে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন মুকুলবাবু তো বিজেপিরই বিধায়ক, তৃণমূল তাঁকে সমর্থন করবে কেবল।

পিকে ব্যানার্জি আর অমল দত্ত যখন যথাক্রমে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের কোচ ছিলেন, তখন উত্তেজনার পারদ চড়েই থাকত। ডায়মন্ড ম্যাচের আগে সে কি প্রবল বাদানুবাদ! একবার ভাবুন তো, যদি পিকে একইসঙ্গে দুই দলেরই কোচ হতেন? সাইডলাইনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়ে বেড়াতেন, বাইচুংকে নির্দেশ দিতেন “অপেক্ষা করলে হবে না, বল কাড়তে হবে।” তারপর বাইচুং গোল করতেই বাসুদেব মণ্ডলকে বকতেন “হচ্ছেটা কী? তুই থাকতে বাইচুং সাপ্লাই পাচ্ছে কেন?” মুকুল রায় খেলাটাকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করেছিলেন, বাঙালি মুকুলবাবুর বিশ্বরূপ দেখছে। এদিকেও তিনি, ওদিকেও তিনি।

আরও পড়ুন রাহুলে না, বাবুলে হ্যাঁ: তৃণমূলের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

যে সময়ের কথা বলে লেখা শুরু করেছিলাম, সে সময় বাঙালির গুমোর ছিল, আর যা-ই হোক, ফুটবলে আমরা ভারতসেরা, কলকাতা হল ভারতীয় ফুটবলের মক্কা। সে গর্ব গোয়ায় গুঁড়িয়ে গেছে অনেককাল আগে। আরেক অহঙ্কার ছিল বাংলার রাজনীতি। এখানে মারামারি, খুনোখুনি হয়। কিন্তু আয়ারাম গয়ারাম সংস্কৃতি নেই, ওসব গোবলয়ের ব্যাপার। আজকের ট্রান্সফার মার্কেটে সে গর্বও ধূলিসাৎ।

অবশ্য রাজনীতি খেলা হয়ে দাঁড়ালে এসব হবেই। যে কোন ঘটনাই প্রথমবার ঘটলে চোখ কপালে ওঠে, দ্বিতীয়বার আর কেউ উচ্চবাচ্য করে না। ফলে খেলা যত এগোবে, নেতাদের যাওয়া আসা বাঙালিরও গা-সওয়া হয়ে যাবে। রবি শাস্ত্রী ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় উত্তেজক ম্যাচের শেষে বলতেন, আসলে জয়ী হল খেলাটা। এ ক্ষেত্রেও যে খেলাটাই জিতবে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ হারবে, হারছে সাধারণ নাগরিক।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: