বঙ্গবিভূষণ পুরস্কার কি এমনি এমনি খায়?

পুরস্কার

পুরস্কার কেন মূল্যবান? সকলে পায় না বলে। সারা পৃথিবীতে এত বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে, এত সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, এত সমাজসেবা হচ্ছে রোজ, অথচ ছশো কোটি মানুষের মধ্যে সবমিলিয়ে জনা দশেক প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার পান। তাই ওই পুরস্কার প্রাপকদের সব দেশেই আলাদা সম্মান। একসময় পাড়ার পুজোর ধুনুচি নৃত্য প্রতিযোগিতায় ছোটদের উৎসাহিত করার জন্য সব অংশগ্রহণকারীকেই সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে থালা, বাটি, চামচ ইত্যাদি দেওয়া হত। তাছাড়া আর কোনো পুরস্কারই রাম শ্যাম যদু মধু – সকলকেই দেওয়ার নজির নেই। আদৌ পুরস্কার বলে কিছু থাকা উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। কোনো দেশের বা রাজ্যের সরকারের আদৌ কাউকে পুরস্কার দেওয়া উচিত কিনা তা নিয়েও বিলক্ষণ তর্ক হতে পারে। ভারতের সংবিধান বলে আইনের চোখে, রাষ্ট্রের চোখে সব নাগরিকই সমান। সেক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ বিশেষ নাগরিককে পুরস্কার দেওয়া উচিত কিনা তা-ও তর্কাতীত নয়।

এতৎসত্ত্বেও আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই নানারকম সরকারি পুরস্কার চালু আছে। প্রায় প্রতি বছরই প্রাপকদের তালিকা কোনো না কোনো দিক থেকে সমালোচিত হয় এটা যেমন সত্য, তেমনি প্রাপকদের সামাজিক সম্মান যে বৃদ্ধি পায় তা-ও অস্বীকার করার উপায় নেই। মুশকিল হল সাম্প্রতিককালে পুরস্কারগুলো যেন বড় বেশি সহজলভ্য হয়ে গেছে, ফলে মূল্য হারাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ ইত্যাদি দিয়ে থাকেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর গরীব পশ্চিমবঙ্গ সরকার চালু করেছিলেন বঙ্গবিভূষণ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, মহাশ্বেতা দেবীর মত প্রবাদপ্রতিম মানুষ তা পেয়েছেন। এ বছর হঠাৎ ব্যক্তির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানকেও পুরস্কৃত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কোন প্রতিষ্ঠান? না কলকাতার তিন ঐতিহ্যশালী ফুটবল ক্লাব – মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল আর মহমেডান স্পোর্টিং

আরও পড়ুন আকাদেমি সমাচার: সাহিত্য পুরস্কার যার যার, তিরস্কার সবার

এমনিতে ভাল কাজের জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করায় দোষ নেই। কিন্তু যে পুরস্কার নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন (তিনি অবশ্য নেবেন না জানিয়েছেন) আর অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া হচ্ছে, সে জিনিস যে কোন যুক্তিতে তিনটি ফুটবল ক্লাবকে দেওয়া যেতে পারে তা দুর্বোধ্য। অর্থনীতিতে অমর্ত্য আর অভিজিৎ বিনায়কের কাজ গোটা বিশ্বে আলোচিত। অন্যদিকে কলকাতার তিন ক্লাবের কর্মকর্তারা নিজেদের অবিমৃশ্যকারিতায়, অপদার্থতায় একসময় যে শহরকে ভারতীয় ফুটবলের মক্কা বলা হত তাকে প্রায় ধাপার মাঠে পরিণত করেছেন। অমর্ত্য, অভিজিৎ আর তাঁদের অবদান যদি একই পুরস্কারের যোগ্য হয়, তাহলে সে পুরস্কারের আর মূল্য থাকল কী? শতাব্দী-প্রাচীন মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল আর এককালে ভারত দাপিয়ে বেড়ানো মহমেডান স্পোর্টিংকে এই পুরস্কার প্রদান যদি তাদের অতীত গৌরবের কথা ভেবে দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্য নস্ট্যালজিয়া-কাতর বাঙালির যোগ্য কাজই হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, এদের অবদান বুঝতে রাজ্য সরকারের এত সময় লাগল কেন? মোহনবাগানের এটিকের মুখাপেক্ষী হওয়া আর ইস্টবেঙ্গলের এই আছি এই নেই অবস্থা না হলে কি তাদের অবদান ঠাওর হচ্ছিল না?

অবশ্য যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীকে পুরস্কৃত করার জন্যে রাতারাতি নতুন সাহিত্য পুরস্কার চালু হয়ে যায়, সেখানে প্রদানের অর্থ, গুরুত্ব – এসব নিয়ে আলোচনা করা বাতুলতা।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার।

Leave a Reply

%d bloggers like this: