আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে মরে প্রমাণ করতে হবে সে মরেনি

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে মরে প্রমাণ করতে হবে

যদি ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় মহেন্দ্র সিং ধোনি ২০১৫ বিশ্বকাপের বছর খানেক আগে ঘোষণা করতেন তিনি আর একদিনের ক্রিকেট খেলবেন না, কেমন হত ব্যাপারটা? তখন ধোনির বয়স সবে ৩৩ বছর। চোট আঘাতে বেশ কিছুদিন মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছিল এমন নয়, উইকেটরক্ষায় শিথিলতা দেখা যাচ্ছিল বা ব্যাটে রান ছিল না তা-ও নয়। সে অবস্থায় ক্রিকেটের অন্যতম বক্স অফিস ধোনি একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিলে অবশ্যই হইচই পড়ে যেত। কিন্তু এমন কিছু তখন ঘটেনি। সাদা বলের ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাদের একজন ধোনি শুধু ২০১৫ বিশ্বকাপ নয়, ২০১৯ সালের বিশ্বকাপও খেলেছেন। কিন্তু ধোনি তখন ৫০ ওভারের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে ফেললে যতটা অবাক কাণ্ড হত, অতি সম্প্রতি তার চেয়েও অবাক কাণ্ড ঘটে গেছে। যে কোনো ধরনের ক্রিকেটে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অলরাউন্ডারদের একজন এবং ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় বেন স্টোকস একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। ১৯ জুলাই (মঙ্গলবার) দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিকই ছিল তাঁর খেলোয়াড় জীবনের শেষ একদিনের ম্যাচ।

ধোনি অবসর নিলে যা হত, স্টোকসের অবসর তার চেয়েও বেশি আশ্চর্যের কারণ স্টোকসের বয়স এখন ৩১। ব্যাটিংয়ের ক্ষেত্রে বলা হয়, এই বয়সে এসে একজন ব্যাটার আরও পরিণত হয়ে ওঠেন। আর স্টোকস তাঁর বোলিং বাদ দিয়ে শুধু ব্যাটার হিসাবেই ইংল্যান্ড দলে জায়গা পেতে পারেন তিন ধরনের ক্রিকেটেই। অতীতে বয়স বাড়লে, শরীরের ধকল নেওয়ার ক্ষমতা কমে গেলে অনেক অলরাউন্ডারই বোলিং করা ছেড়ে দিয়েছেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে স্টিভ ওয় ব্যাট হাতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তাঁর অপরাজিত ১২০ রান ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার শেষ অব্দি ফাইনালে পৌঁছত না। টাই হয়ে যাওয়া সেমিফাইনালেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতরান করেছিলেন। স্টোকসও যে আগামী বছর ভারতীয় উপমহাদেশের বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে পার্থক্য গড়ে দিতে পারতেন না তা বলা যায় না। কিন্তু তিনি সে বিকল্পের দিকে গেলেন না। এমন একজন ক্রিকেটার, যিনি নিঃসন্দেহে একদিনের ক্রিকেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় এবং যাঁর খেলা সারা বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদের বিলক্ষণ আনন্দ দেয়, তিনি কেন এত তাড়াতাড়ি অবসর নিয়ে নিলেন?

ভবিষ্যতে যখন ক্রিকেটের ইতিহাস লেখা হবে, তখন ২০২২ সালের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নিয়ে একটা আলাদা অধ্যায় লিখতে হবে। এই এক সপ্তাহে এমন তিনটে ঘটনা ঘটে গেছে যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যুগ বদলে যাওয়ার সূচক। একটা অবশ্যই স্টোকসের মত একজন সক্রিয়, জনপ্রিয় এবং অল্পবয়সী ক্রিকেটারের একদিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া। কিন্তু ক্রিকেট দলগত খেলা। সেদিক থেকে আরও বড় ঘটনা স্টোকসের অবসরের ঠিক পাঁচদিন আগে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ডের একটা সিদ্ধান্ত। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার একটা একদিনের ম্যাচের সিরিজ খেলার কথা ছিল। কিন্তু ১৩ জুলাই ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে জানায় যে তারা ওই সিরিজ খেলতে অপারগ, কারণ ওই সময়ে তারা নিজেদের দেশে যে নতুন টি টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ চালু করছে তার খেলা চলবে। সেই লিগ সামলে জাতীয় দলকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো সম্ভব নয়। আর বাকি বছরের ব্যস্ত ক্রীড়াসূচি থেকে আর কোনো সময় বার করাও সম্ভব নয়।

টি টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগের গুরুত্ব কতটা বেড়ে গেছে আর একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের গুরুত্ব কতটা কমে গেছে তা এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার এই সিদ্ধান্তে তাদের আগামী বছরের বিশ্বকাপ খেলার উপরে প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের নিয়মানুযায়ী, এখন একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ সুপার লিগের অংশ। ঠিক যেমন টেস্ট ম্যাচগুলো বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ। তফাত বলতে সুপার লিগের পয়েন্ট দিয়ে একদিনের ক্রিকেটের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হয় না, ঠিক হয় কোন কোন দল সরাসরি বিশ্বকাপে খেলবে। ওই পয়েন্ট টেবিলের প্রথম আটটা দল (ভারত বাদে সাতটা, কারণ ভারত আয়োজক দেশ) ২০২৩ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে, বাকিদের পাঁচটা অ্যাসোশিয়েট দেশের সঙ্গে যোগ্যতা অর্জনকারী প্রতিযোগিতায় খেলতে হবে। সেখান থেকে মাত্র দুটো দেশ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করবে। ওই পয়েন্ট টেবিলে দক্ষিণ আফ্রিকা এই মুহূর্তে এগারো নম্বরে আছে। জানুয়ারি মাসের অস্ট্রেলিয়া সিরিজ বাদ যাওয়ায় মে মাসে ওই টেবিল চূড়ান্ত হওয়ার আগে দক্ষিণ আফ্রিকা আর মাত্র দুটো সিরিজ খেলার সুযোগ পাবে – ইংল্যান্ড আর ভারতের বিরুদ্ধে। সেই দুটো সিরিজ জিতে প্রথম পাঁচে উঠে আসা মোটেই সহজ নয়। যোগ্যতা অর্জনকারী প্রতিযোগিতাও নেহাত সহজ হবে না, কারণ সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে থাকতে পারে শ্রীলঙ্কা, আয়ারল্যান্ডের মত দলগুলো। এককথায়, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ খেলার সুযোগও ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে গেল ফ্র্যাঞ্চাইজ টি টোয়েন্টি লিগ আয়োজন করার জন্য।

আইসিসির পূর্ণ সদস্য কোনো দেশের ক্রিকেট বোর্ডের এই মনোভাব ইঙ্গিত দিচ্ছে, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট হল অতীত। কুড়ি ওভারের ক্রিকেটই ভবিষ্যৎ। যুগপৎ এই ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে, যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্তত একটা ক্রিকেট বোর্ড সেরকমই মনে করছে। ১৩ তারিখ ক্রিকেট সাউথ আফ্রিকা এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পরে ঘটেছে তৃতীয় ঘটনা। দক্ষিণ আফ্রিকার বোর্ড যে টি টোয়েন্টি লিগের জন্য অস্ট্রেলিয়া সফর বাতিল করেছে, সেই লিগের ফ্র্যাঞ্চাইজগুলোর নিলাম ছিল ২০ তারিখ। সেখানে ছটা ফ্র্যাঞ্চাইজের সবকটাই কিনে নিয়েছেন আইপিএলের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিকরা। মুম্বাই ইন্ডিয়ানস, চেন্নাই সুপার কিংস, দিল্লি ক্যাপিটালস, লখনৌ সুপার জায়ান্টস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ এবং রাজস্থান রয়্যালসের মালিকরাই এখন দক্ষিণ আফ্রিকার ওই লিগের ভাগ্যনিয়ন্তা। বহুদিন আগে থেকেই ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ এবং আমেরিকার লিগে দল আছে কলকাতা নাইট রাইডার্সের মালিকদের, মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের মালিকরা সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর লিখে একটা দলের মালিক। ক্যারিবিয়ান লিগে পাঞ্জাব কিংস আর রাজস্থান রয়্যালসের মালিকদেরও দল রয়েছে। কিন্তু এর আগে কোনো লিগের সম্পূর্ণ দখল আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজের মালিকদের হাতে আসেনি। তাদের ইচ্ছাতেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এ পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগে ভারতীয় ক্রিকেটারদের খেলার অনুমতি দেয়নি। এখন কথা হল, অন্য দেশের লিগের দলগুলোও যখন আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজ মালিকদেরই দখলে, তখন তাঁরা বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, ঋষভ পন্থ, হার্দিক পাণ্ড্যার মত জনপ্রিয় ক্রিকেটারদের চাইবেন না কেন? চাইলে ভারতীয় বোর্ড কতদিন না বলতে পারবে? যদি না পারে, তখন ক্রিকেটাররা আর কত ক্রিকেট খেলবেন?

ক্রিকেটের মরসুম বলে আর কিছু নেই বহুকাল হল। বিশেষ করে ভারত, ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া যে পরিমাণ ক্রিকেটে খেলে তাতে ক্রিকেটারদের চোট, আঘাত লেগেই আছে। জেমস অ্যান্ডারসন, স্টুয়ার্ট ব্রড, চেতেশ্বর পুজারার মত যাঁরা শুধু টেস্ট খেলেন একমাত্র তাঁদেরই দেখা যায় চোট আঘাত কম। বিশেষ করে জোরে বোলাররা দুটো সিরিজ খেলেন তো চারটে সিরিজ মাঠের বাইরে থাকেন। ভারতীয় ক্রিকেটারদের চোট, আঘাত এবং ক্লান্তি তো এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে চলতি বছরের সাত মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই সাতজন ভারত অধিনায়ক (বিরাট, রোহিত, কে এল রাহুল, হার্দিক, ঋষভ পন্থ, যশপ্রীত বুমরা, শিখর ধাওয়ান) দেখে ফেলব আমরা। স্টোকসও কিন্তু ক্রীড়াসূচিকে দোষ দিয়েছেন। তিনি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, তিন ধরনের ক্রিকেটেই দলকে একশো শতাংশ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেট থেকে অবসর নিচ্ছেন।

ঘটনা হল, এভাবে চললে আরও অনেককেই তিরিশের আশেপাশে অবসর নিয়ে ফেলতে দেখা যাবে। একেকজন একেক ধরনের ক্রিকেট ছেড়ে দেবেন, কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কেউই টি টোয়েন্টি ক্রিকেট ছাড়বেন না। দেশের হয়ে না খেললেও ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট খেলবেনই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত যেসব দেশে ক্রিকেটের অবস্থা সঙ্গীন, ক্রিকেট বোর্ড তেমন টাকাপয়সা দিতে পারে না, সেখানকার ক্রিকেটাররা গত এক দশক ধরেই দেশের হয়ে খেলার তোয়াক্কা না করে সারা পৃথিবীর ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ খেলে বেড়িয়েছেন। কারণ ওখানে অনেক টাকা রোজগার করার সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগ আরও বাড়ছে এবং বাড়বে। দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন লিগে উৎসাহের কারণও আর্থিক। তাদের ক্রিকেটও ধুঁকছে। কিন্তু শুধু ওই একটা লিগ চালু হচ্ছে তা তো নয়, এ বছর থেকে আইপিএল আট দলের বদলে দশ দলের লিগ হয়ে গেছে। সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রি করে যে বিপুল পরিমাণ টাকা ভারতীয় বোর্ড আয় করছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে আরও দল যোগ করে আইপিএলকে আরও লম্বা করতে চাইলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এদিকে আইসিসির কেন্দ্রীয় ক্রীড়াসূচি, যার পোশাকি নাম ফিউচার টুরস প্রোগ্রাম, তাতে আইপিএলের জন্য আলাদা করে আড়াই মাস সময় ছেড়ে রাখা হবে বলে একরকম সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ লিগ এবং ইংল্যান্ডের একশো বলের লিগ দ্য হান্ড্রেড – সেসবের জন্যেও আলাদা করে সময় ধার্য করা হবে। শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটাররা এত লিগ ক্রিকেট খেলে আর দেশের হয়ে খেলবেন কখন? কেনই বা খেলবেন? ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মত যেসব দেশের বোর্ড সফল ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগের রোজগার থেকে জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের ভাল পারিশ্রমিক দিতে পারবে, তারা না হয় তবু পারবে। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড – এরা কী করবে? এমনকি অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডও খাবি খেতে পারে। এই সাইটেই আগে লিখেছি, এক অস্ট্রেলিয় সাংবাদিক আগামী মরসুমে আইপিএলে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক এমন জায়গায় পৌঁছতে পারে যা ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক প্যাট কামিন্সকে যা পারিশ্রমিক দেয় তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি।

কিন্তু ক্রিকেটাররা নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিপদে ফেলছে বোর্ডগুলো এবং আইসিসির লোভ। এই শতাব্দীর প্রথম দশকেও পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে বেশ জনপ্রিয় ছিল ত্রিদেশীয়, চতুর্দেশীয় প্রতিযোগিতা; যদিও তার টান ক্রমশ কমে আসছিল। টি টোয়েন্টি যুগে আইসিসি ওই ধরনের প্রতিযোগিতা একেবারেই বন্ধ করে দিল, যাতে শুধুমাত্র আইসিসি আয়োজিত প্রতিযোগিতাগুলোই বহুদলীয় হয়। কেন? সম্প্রচারের লাভের গুড় যাতে কম না পড়ে। অথচ আইসিসি কিন্তু একই যুক্তিতে ওয়ার্ল্ড টি টোয়েন্টি ছাড়া কোনো বহুদলীয় টি টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা হবে না বলেনি। একের পর এক ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ চালু হয়েছে। আসলে আইসিসির বলার উপায় ছিল না। কারণ সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য ভারতই সবচেয়ে বড় লিগটা চালায়।

সুতরাং কুড়ি ওভারের ক্রিকেট তথা ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়তে থাকল। ২০১১ বিশ্বকাপের পর পঞ্চাশ ওভারের খেলায় নতুন নিয়ম হল, দুই প্রান্ত থেকে দুটো বলে খেলা হবে। টি টোয়েন্টির মতই ছোট করে আনা হল বাউন্ডারি, তার উপর সারাক্ষণই পাওয়ার প্লে। ফলে পঞ্চাশ ওভারের খেলার নাটকীয়তার বারোটা বাজল। রিভার্স সুইং বন্ধ, স্পিনারদের ভূমিকা নগণ্য। কারণ বল পুরনো হয় না বলে ঘুরতে চায় না, ইনিংসের শেষ প্রান্তে বল নরম হয়ে গিয়ে আর মারা শক্ত হয় না। ফলে খেলাটা হয়ে দাঁড়াল টি টোয়েন্টিরই বড় সংস্করণ। সে জিনিস আলাদা করে দেখতে কার ভাল লাগে? এ নিয়ে শচীন তেন্ডুলকরের মত লোক আপত্তি করেছেন, আইসিসি কান দেয়নি। এখন একদিনের ক্রিকেট ভালবাসেন এমন অনেকে চাইছেন আইসিসি খেলাটাকে বাঁচানোর উদ্যোগ নিক। স্বয়ং ভারত অধিনায়ক রোহিত কদিন আগে মনে করিয়ে দিয়েছেন ত্রিদেশীয় সিরিজগুলোর কথা, বলেছেন ওগুলো আবার চালু করলে হয়ত খেলার সংখ্যা কমানো যাবে, ক্রিকেটারদের চাপ কমবে।

কিন্তু ক্রিকেটারদের চাপ কমাতে চাইছে কে? কেরি প্যাকারও ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি যখন ওয়ার্ল্ড সিরিজ চালু করে রঙিন জামা, সাদা বলের ক্রিকেটের রাস্তায় হাঁটেন, স্বার্থটা একেবারেই ব্যবসায়িক ছিল। কিন্তু তিনি ক্রিকেটকে ব্যবহার করে টাকা রোজগার করতে চেয়েছিলেন, আজকের ক্রিকেটকর্তারা টাকা রোজগার করার জন্যে ক্রিকেটকে ব্যবহার করতে চান। কথায় বলে, মানুষের প্রয়োজনের শেষ আছে, লোভের শেষ নেই। মুনাফার লোভ তো অসীম। একবিংশ শতকে যে কোনো বড় ব্যবসার আর্থিক বছরের লক্ষ্য ঠিক হয় আগের বছরের মুনাফা অনুসারে। এ বছর আরও বেশি মুনাফাই লক্ষ্য। অতএব ক্রিকেটের ব্যবসায় ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগগুলোকে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বাড়িয়ে চলাই লক্ষ্য। তাতে শুধু একদিনের ক্রিকেট নয়, সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই গোল্লায় গেলে ক্ষতি নেই। বরং গোল্লায় না পাঠালেই নয়।

আরও পড়ুন IPL auction: Where privilege holds court

তার জন্য জনমত তৈরি করার কাজ আরম্ভ হয়ে গেছে পুরোদমে। ভারতীয় দলের কোচ হিসাবে সাফল্যের মুখ দেখে ক্রিকেটজগতে বিলক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন রবি শাস্ত্রী। তিনি সম্প্রতি এজবাস্টন টেস্ট চলাকালীন সম্প্রচার সংস্থার স্টুডিওতে বসে বলেছিলেন, ক্রিকেটের ফুটবলের মতই ক্লাবভিত্তিক হয়ে ওঠা উচিত। ইংল্যান্ডের দ্য টেলিগ্রাফ কাগজের পডকাস্টে বুধবার ফের একথা বলেছেন। যোগ করেছেন, বিশেষ করে টি টোয়েন্টিতে দ্বিপাক্ষিক ক্রিকেট কমিয়ে ফেলা উচিত। শুধু বিশ্বকাপের সময়ে, আইসিসি টুর্নামেন্টগুলোর সময়ে জাতীয় দলগুলোর মধ্যে ক্রিকেট হওয়া উচিত। বাকি সময়টা দেশে দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট চলুক। তারপর, যেন টেস্ট ক্রিকেট বলে একটা বস্তু আছে সেকথা মনে পড়ায়, বলেছেন এমনটা করলে উপরের ছটা দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক টেস্ট খেলার জন্যে বেশি সময় পাওয়া যাবে। টেস্ট ক্রিকেটকে দুটো স্তরে ভাগ করে দেওয়া দরকার। নইলে দশ বছর পরে টেস্ট ক্রিকেট বাঁচবে না। গোটা পডকাস্টের মধ্যে থেকে এই যে এক মিনিট তুলে টুইট করা হয়েছে, তাতেই কতগুলো চমকপ্রদ কথা!

পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে আপেলের সঙ্গে কমলালেবুর তুলনা করার সাহস বোধহয় একমাত্র শাস্ত্রীরই আছে। তিনি এমন একটা খেলার সঙ্গে ক্রিকেটের তুলনা করেছেন যে খেলার একটাই ফরম্যাট – নব্বই মিনিট। সেই খেলার পথে হেঁটে নাকি টি টোয়েন্টি, টেস্ট, একদিনের ক্রিকেট – সবই বাঁচবে। উপরন্তু তিনি বলছেন দেশে দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগগুলোকে উৎসাহ দেওয়া উচিত, তাহলে নাকি টেস্ট খেলার সময় পাওয়া যাবে। বছরে মাসের সংখ্যা না বাড়ালে যে দুটো একইসঙ্গে কী করে সম্ভব তা তিনিই জানেন। সব দেশে সফল ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ নেই। পাকিস্তানের মত দেশে থাকলেও রাজনৈতিক কারণে ক্রিকেট বিশ্বে পাকিস্তান পিছিয়ে, তাই পাকিস্তান সুপার লিগের অদূর ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে আইপিএল বা বিগ ব্যাশের সমকক্ষ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম। তাহলে ওই দেশগুলোতে ক্রিকেট বাঁচবে কী করে? ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের দয়ায়? সে দয়ার বহর তো যথেষ্ট দেখা গেছে। আইসিসির রাজস্বের বেশিরভাগটা তাদেরই দিতে হবে, কারণ তারাই সবচেয়ে বেশি টাকা এনে দেয় – এই যুক্তিতেই তো তারা চলে। নিজেদের মধ্যে ছাড়া অন্য দেশগুলোর সাথে এক সিরিজে দুটোর বেশি টেস্টও তারা খেলতে চায় না।

আসলে শাস্ত্রী যা বলেছেন তা আইসিসি তথা বিসিসিআই কর্তাদের মনের কথা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যে ভবিষ্যৎ তিনি নির্দেশ করেছেন তা আরও সংকীর্ণ। ফলে মুনাফার ভাগীদার আরও কম, মুনাফার ভাগ বেশি। মুশকিল হল, ফুটবল খেলা হয় পৃথিবীর প্রায় সব দেশে, ক্লাবও অসংখ্য। ক্রিকেট এখনো গোটা পনেরো দেশের খেলা। কর্তারা যে পথে যেতে চাইছেন তাতে ওই পনেরোও কমতে কমতে পাঁচে এসে ঠেকতে পারে। আরও ভাল করে ভেবে দেখলে বোঝা যায়, যে দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি, সেই ভারতেও আসলে খেলাটা নয়, খেলোয়াড়রা জনপ্রিয়। মাঠে, টিভির সামনে এবং মোবাইলের পর্দায় ভিড় হয় আন্তর্জাতিক তারকাদের টানে। আইপিএলের রমরমাও তাঁদের তারকাচূর্ণেই। ওটা বাদ গেলে কী হয়? ঘরোয়া ফুটবলের অবহেলিত প্রতিযোগিতা সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে মাঠ ভরে যায়, অনলাইন স্ট্রিমিং দ্যাখে কয়েক লক্ষ লোক। কিন্তু রঞ্জি ট্রফি ফাইনালের স্কোরের খবরও রাখে না বিশেষ কেউ। সুতরাং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দুয়োরানী হয়ে গেলে ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ নিয়ে মাতামাতি থিতিয়ে যেতে বেশি সময় না-ও লাগতে পারে।

তবে ভবিষ্যৎ চিন্তা করার বদভ্যাস ক্রিকেটকর্তাদের নেই। শোনা যাচ্ছে অন্য দেশের লিগে দল কিনেছেন যাঁরা, তাঁদের চাপে আসন্ন সাধারণ সভায় বিসিসিআই নাকি ভারতীয় ক্রিকেটারদের বিদেশের লিগে খেলার অনুমতি দিয়ে দিতে পারে। হয়ত এখনই শীর্ষস্থানীয়দের ছাড়া হবে না, সরাসরি বোর্ডের সাথে চুক্তিবদ্ধ নন এমন ক্রিকেটারদের ছাড়া হবে। তা যদি ঘটে তাহলে ইতিমধ্যেই অবহেলিত ঘরোয়া ক্রিকেট আরও রক্তশূন্য হয়ে যাবে। বিপুল অর্থের হাতছানি উপেক্ষা করে কে পড়ে থাকবে জনশূন্য স্টেডিয়ামে চারদিন, পাঁচদিনের ক্রিকেট খেলার জন্য? তারপর শাস্ত্রীদের ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগের বাড়বাড়ন্তে টেস্ট ক্রিকেট তথা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের দীর্ঘজীবন প্রাপ্তির ফ্যান্টাসি কী করে পূরণ হবে কে জানে!

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার।

One thought on “আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে মরে প্রমাণ করতে হবে সে মরেনি”

Leave a Reply

%d bloggers like this: