“সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে” — উদয়পুরের ছাপোষা দর্জি কানহাইয়া লালের নারকীয় হত্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আজকের ভারত সম্পর্কে এর চেয়ে সত্যি কথা আর কিছু নেই। স্বাধীনতা লাভ তথা দেশভাগের প্রাক্কালে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার মধ্যে দাঁড়িয়ে ওই লাইন লিখেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। আজ আবার আমাদের মধ্যে বিভাজনরেখা স্পষ্ট। এমন নয় যে কানহাইয়া লালের মৃত্যু কোনো শীর্ষবিন্দু বা সূচনাবিন্দু। যেভাবে আমরা সবাই অপরকে ঘৃণা করছি এবং আড়চোখে দেখছি, তাতে স্পষ্ট আমাদের সকলের জামার নীচেই লুকনো আছে অস্ত্রশস্ত্র। কখন কোন প্ররোচনায় বেরিয়ে আসবে আর আমরা কাউকে কনিষ্ঠের মত জেনেও হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে ফেলব – তা কেউ বলতে পারে না। এমনটা শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হল, এবং অতি বড় আশাবাদীও সত্বর থামবে বলে ভরসা করতে পারবেন না।
আসলে স্বীকার করে নেওয়া ভাল, শুধু অপরে অবিশ্বাস নয়, অপরকে সংগঠিতভাবে কথায় এবং কাজে আক্রমণ করার যে প্রকল্প তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এ দেশে চলছে – তার ফল ফলতে শুরু করেছে। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দেশজুড়ে যে দাঙ্গা হয়েছিল, তখনো উদয়পুরের মত ঘটনার কথা জানা যায়নি। মহম্মদ সম্পর্কে যে কটূক্তি করেছে তার পোস্ট শেয়ার করা মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য অপরাধ বলে মনে করেছেন দুজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অথচ সেইসময় খোদ ধর্মস্থান ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরেও কোনো মুসলমান এমন ঘটনা ঘটাননি। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বব্যাপী আল কায়দা, আইসিসের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন দাপিয়ে বেড়ানোর সময়েও ভারতে যে কটা সন্ত্রাসবাদী হানা হয়েছে তাতে ভারতীয় মুসলমানদের যোগদান প্রায় শূন্য। ভারতকে অশান্ত করতে বরাবরই এই সংগঠনগুলোকে পাকিস্তানের নাগরিকদের সাহায্য নিতে হয়েছে। কিন্তু তাতে ভারতীয় মুসলমানদের দিকে আড়চোখে তাকানো আটকানো যায়নি।
আরও যা মারাত্মক, তা হল একমাত্র ইসলামিক সন্ত্রাসবাদই বিপজ্জনক – এই ভয়ংকর মত শুধু সামাজিক নয়, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। সাধ্বী প্রজ্ঞার মত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্তও আইনসভার সদস্য হয়ে গেছেন। আল কায়দা, আইসিসের মতই হিন্দু উগ্রবাদী সংগঠনগুলোও শিশুদের অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। সাধুসন্তরা বক্তৃতায় হিন্দুদের অস্ত্র তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নির্বাচনী জনসভায় জনতাকে গুলি করতে উৎসাহ দিয়েছেন। রাষ্ট্র এসব কড়া হাতে দমন করেনি, বরং হিংসার বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছে তাদেরই দাঙ্গা লাগানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। হেট স্পীচ প্রকাশ করে দেওয়ায় নিযুক্ত মহম্মদ জুবেরের মত সাংবাদিকদের টুইটার ট্রোলদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুরনো হিন্দি ছবির দৃশ্যের স্ক্রিনশট টুইট করার জন্যে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া হয়েছে বলে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ওদিকে রোজ প্রাইম টাইমে দুই ধর্মের উগ্রবাদীদের নিয়ে আসর বসিয়ে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম।
আরও পড়ুন বিজেপি মুখপাত্র বিতাড়ন: হিন্দুত্বের টাইম আউট, খেলা শেষ নয়
অর্থাৎ ভারতে মানুষের ভাবাবেগ, মানুষের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি দাম হয়েছে ঠাকুর, দেবতা, পয়গম্বরদের। গোমাংস খাওয়ার, বিক্রি করার অপরাধে মুসলমান খুন হচ্ছেন। পয়গম্বরকে অপমান করার অপরাধে হিন্দু খুন হচ্ছেন। ভারতের বারোটা বাজাতে আর পাকিস্তান বা চীনের প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেরাই সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি। কবে স্নিগ্ধতা হৃদয়ে জাগবে, সে অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর গতি নেই।
উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত