বিরাট অপসারণ: দুই পুরনো বন্ধুর অস্ট্রেলিয় সিদ্ধান্ত

রবি শাস্ত্রী আর বিরাট একদিনের ক্রিকেটের দলের জন্য এত বছরেও একজন চার নম্বর খুঁজে পাননি; কুলদীপ যাদব, যজুবেন্দ্র চহলকে তাঁদের আজ মনে হয়েছে দারুণ প্রতিভা, কাল ভেবেছেন আবর্জনা।

বিরাট

এই মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে। ভারত আপাতত টেস্টে এক নম্বর দল, টি টোয়েন্টিতে দু নম্বর। একমাত্র একদিনের ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া তিন, ভারত চার। এবারের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার ঝুলিতে তেমন বড় সাফল্য নেই অনেকদিন হল। নিজের দেশে পরপর দুবার ভারতের কাছে টেস্ট সিরিজ হেরেছে। বল ট্যাম্পারিং, অশ্লীল এস এম এসে জর্জরিত। সুতরাং বলাই যায়, অস্ট্রেলিয়ার সে রাম নেই। কিন্তু সে অযোধ্যাও নেই বললে ভুল হবে। ব্যক্তির চেয়ে দল বড় — তাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি বদলায়নি। ওটাই দীর্ঘমেয়াদি দলগত সাফল্যের চাবিকাঠি। ওভাবেই পরপর তিনটে বিশ্বকাপ জেতা দল গড়ে ওঠে।

ভারতীয় ক্রিকেটে এ সংস্কৃতি কোনোদিন ছিল না। এখানে শচীন তেন্ডুলকরের অবসর বর্ণময় করে তুলতে আলাদা সিরিজের আয়োজন হয়। এই তারকাকেন্দ্রিক সংস্কৃতিকে জোর ধাক্কা দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয় গ্রেগ চ্যাপেল। যে দুজন ঘটনার কেন্দ্রে ছিলেন, তাঁদের একজন এখন ভারতীয় দলের কোচ। অন্যজন বোর্ড সভাপতি। সেই রাহুল দ্রাবিড় আর সৌরভ গাঙ্গুলির যুগলবন্দিতে বিরাট কোহলির দুটো মুকুট গেছে, পড়ে আছে একটা

মনে রাখা ভাল, সৌরভ অধিনায়ক হওয়ার আগে টিম ইন্ডিয়া কথাটার প্রচলন হয়নি। সবাই জানত দিল্লি লবি, মুম্বাই লবি ইত্যাদির কথা। প্রতিভাবান ক্রিকেটাররা ‘টিম’ হয়ে উঠতেন না, যা বিদেশে মুখ থুবড়ে পড়ার বড় কারণ ছিল। সে ঐতিহ্য ভেঙে নতুন উত্তরাধিকার তৈরি করেছিলেন সৌরভই। ফলে সে কালের বঙ্গ মিডিয়া সৌরভের অধিনায়কত্ব চলে যাওয়ায় রাহুলকে যতই মিচকে শয়তান বা বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন করে থাক, সৌরভ বিলক্ষণ বুঝতেন দলের স্বার্থ সবার উপরে। আর সে স্বার্থ রাহুলের হাতে নিরাপদ। না বুঝলে ওই ঘটনার পরেও এত বছর দুজনের বন্ধুত্ব অম্লান থাকত না। বোর্ড সভাপতি হয়ে সৌরভ রাহুলকে প্রথমে ‘এ’ দলের দায়িত্বে, পরে সিনিয়র দলের দায়িত্বে আনতেন না।

র‍্যাঙ্কিং যা-ই বলুক, সাদা বলের ক্রিকেটে একগুচ্ছ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিতে একের পর এক আইসিসি প্রতিযোগিতায় যে দল ব্যর্থ, সে দলের নেতৃত্ব বদলের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সৌরভ, রাহুলদের সময় হলে হয়ত সেমিফাইনাল, ফাইনালে উঠলেই প্রশংসা করা যেত। গত এক দশকে সাফল্যের যে খতিয়ান মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট, রোহিত নিজেরাই তৈরি করেছেন — তাতে এখন আর সেমিফাইনালে উঠলেই হাততালি দাবি করা চলে না।

রবি শাস্ত্রী আর বিরাট একদিনের ক্রিকেটের দলের জন্য এত বছরেও একজন চার নম্বর খুঁজে পাননি; কুলদীপ যাদব, যজুবেন্দ্র চহলকে তাঁদের আজ মনে হয়েছে দারুণ প্রতিভা, কাল ভেবেছেন আবর্জনা। এরকম অনেক উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা যায়, কেন সাদা বলের ক্রিকেটে তাঁদের উত্তরাধিকার বলতে পড়ে থাকবে অশ্বডিম্ব। সে আলোচনা বড় পরিসরের জন্য তোলা থাক।

আপাতত যা বলার, তা হল সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়ক স্টিভ ওয়কেও অস্ট্রেলিয়া ২০০৩ বিশ্বকাপের দলে রাখেনি। কারণ তিনি মন্থর হয়ে যাচ্ছিলেন, ব্যাটে রান ছিল না। আমাদের বিরাট আন্তর্জাতিক ম্যাচে শেষ শতরান করেছেন ২৩ নভেম্বর ২০১৯,  কলকাতায়। একদিনের ক্রিকেটে শেষ শতরান ১৪ আগস্ট ২০১৯, পোর্ট অফ স্পেনে। তাঁর সামগ্রিক গড় যেখানে প্রায় ষাট, সেখানে ওই শতরানের পর থেকে গড় ৪৩.২৬। অধিনায়কত্ব থাক, উনি বরং ব্যাটিংয়ে মন দিয়ে শচীনের শতরানের রেকর্ড ভাঙুন। মাত্র সাত পা দূরে আছেন।

আরও পড়ুন বিরাট, রোহিত, রাহুলদের সত্য রচনা চলছে চলবে

বিরাটভক্তদের অভিমান হচ্ছে, এই কড়া সিদ্ধান্তটা নিদেন পক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করা হল না বলে। অন্যায় অভিমান নয়, তবে কিনা বিরাট নিজেও সাংবাদিক সম্মেলনের বিশেষ ভক্ত নন। অপ্রিয় প্রশ্ন এলে কেমন রেগে যান, ইন্টারনেট ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন। তাঁকে সরানোর সিদ্ধান্ত সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করলে অপ্রিয় প্রশ্নই বেশি আসত নির্ঘাত। প্রধান নির্বাচক চেতন শর্মার বয়স হয়েছে। তাঁর সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করার ঝুঁকি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হওয়া বোর্ড সভাপতি না নিয়ে ভালই করেছেন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading