তখনো সৌরভ গাঙ্গুলি লর্ডসে লাটসাহেবি করেননি। অস্ট্রেলিয়া সফরে মাত্র একটা খেলায় সুযোগ পেয়ে গোড়াতেই এল বি ডব্লিউ হয়ে মাথা নীচু করে ঘরে ফিরে এসেছেন। “বাঙালি ক্রিকেট খেলতে পারে না” এটাকে স্বতঃসিদ্ধ করে নিয়েছে গোটা ভারত। তখন সদ্য পাড়ার মাঠে বড়দের সঙ্গে ক্যাম্বিস বলে খেলার লাইসেন্স পেয়েছি। বড়রা কেউ কেউ কলার তুলে আজহারকে নকল করে। আমার চেয়ে সামান্য ছোট একটি ছেলে, গোলগাল চেহারা, বয়সের তুলনায় একটু বেশিই ভাল ব্যাট করে। বড় ছেলেরাও আউট করতে ঘেমে ওঠে। তাকে “শচীন” বলে ডাকা শুরু হয়ে গেছে। বাড়ির উল্টোদিকে লাইব্রেরি। লাইব্রেরির গায়েই আমাদের খেলার মাঠ। আমাদের শচীন চার, ছয় মারলে বারবার সেই লাইব্রেরিতে বল ঢুকে যায়। লাইব্রেরিয়ান পিসির বকা কানে না তুলে আমরা চুপচাপ বল নিয়ে আসি। ঐ লাইব্রেরি থেকেই নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলি মতী নন্দীর ‘ননীদা নট আউট’। শান্তিপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্রিকেট শেখার বই পড়ে ওখানে যেমন ছবি আঁকা আছে তেমন করে ধরার চেষ্টা করি ব্যাটটা। রঞ্জি সিং এর মত গ্লান্স করার চেষ্টা করি, কিছুতেই ব্যাটে বলে হয় না। কিন্তু মনের উড়ান ঠেকাবে কে? আমাকে উড়ি। যে দুজনের ডানায় ভর দিয়ে সবচেয়ে বেশি উড়ি তাঁদের একজন ধীমান দত্ত, অন্যজন গোপাল বসু।
নির্মেদ গদ্যে জিওফ্রে বয়কট থেকে সাগরময় সেনশর্মা — সকলকে ঘরের লোক করে তোলেন ঐ দুজন, আজকালের খেলার পাতায় আর ‘খেলা’ নামের খেলাধুলোর পত্রিকায়৷ প্রতিদিন বিকেলে নিজের খেলা শেষ হওয়ার পরেও ওঁদের টানে ততক্ষণ কাটাই লাইব্রেরির রিডিং রুমে, যতক্ষণ না বাড়ির জানলা থেকে কড়া গলায় মায়ের ডাক আসে।
অনেকদিন পর্যন্ত জানতামই না গোপাল বসু একজন প্রাক্তন ক্রিকেটার, এবং নেহাত হেলাফেলা করার মত খেলোয়াড় ছিলেন না। খুঁটিনাটি বিশ্লেষণে এবং কেউই সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন (সৌরভ ছাড়া) — এই প্রত্যয়ে ততদিনে গোপাল বসু আমার চোখে ক্রিকেট লেখক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।
বহু বছর পরে খবরের কাগজের খেলার পাতায় যখন কাজ করতে এসেছি, তখন অগ্রজ ক্রিকেট সাংবাদিকদের মুখে তাঁর খেলোয়াড় জীবনের গল্প শুনেছি। তিনি কতবড় ক্রিকেটার ছিলেন না ছিলেন তার নৈর্ব্যক্তিক বিচার করা হয়ত সম্ভব নয়, কারণ তিনি সারা বছর টিভিতে নানা স্তরের ক্রিকেট লাইভ দেখানো যখন শুরু হয় তার অনেক আগের যুগের লোক। পরিসংখ্যান আছে কিন্তু নেভিল কার্ডাস তো কবেই লিখে গেছেন “স্কোরবোর্ড একটা গাধা” (এই উক্তিটাও গোপাল বসুর লেখাতেই প্রথম পড়েছিলাম)। অতটা চরমপন্থী না হলেও স্কোরবোর্ড যে সবটা বলে না সেটা অস্বীকার করা যুক্তিযুক্ত নয়। অতএব সেকথা থাক। গোপাল বসু ক্রিকেট লেখক হিসাবে যা, আমার কাছে সেই যথেষ্ট।
এই তারকাবন্দনার যুগে গোপাল বসুদের অভাব বোধ করি। এখন তো আর কেউ সেঞ্চুরি করে আউট হওয়া ব্যাটসম্যান সম্পর্কে লিখবে না “গ্রেটদের মধ্যে জায়গা পেতে গেলে ম্যাচ শেষ করে আসতে হয়।”
ক্রিকেট লেখক
এখন তো আর কেউ সেঞ্চুরি করে আউট হওয়া ব্যাটসম্যান সম্পর্কে লিখবে না “গ্রেটদের মধ্যে জায়গা পেতে গেলে ম্যাচ শেষ করে আসতে হয়”