একমাস হতে চলল বিছানায় পড়ে আছি — এক সপ্তাহ নার্সিংহোমে, তারপর থেকে বাড়িতে। সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা, ধুম জ্বর — এসব নিয়ে নার্সিংহোমের দিনগুলো শোচনীয়ভাবে কেটেছে প্রথমদিকে। তারপর আস্তে আস্তে একটু সুস্থ হলাম। হয়ে দেখলাম আমার চেয়েও খারাপ অবস্থা ডাক্তারদের। মুখে বলছেন ডেঙ্গু কিন্তু লিখতে হচ্ছে “এন এস ১ বাহিত ভাইরাল জ্বর” কারণ স্নেহময়ী দিদির রাজ্যে শুধু যে সাংবাদিক কী লিখবেন সেটা দিদি এবং তাঁর ভাইদের চোখরাঙানিতে ঠিক হয় তা নয়, ডাক্তার প্রেসক্রিপশনে কী লিখবেন সেটাও নবান্নে ঠিক হয়। ডাক্তারের দুর্গতিটা ভাবুন — পুজোমন্ডপে অসুরও হতে হবে আবার প্রেসক্রিপশনও লিখতে হবে হুজুরের হুকুমমত, নইলেই টানাটানি। এক ডাক্তার তো বেচারাথেরিয়ামের মত মুখ করে বলেই দিলেন “মাঝেমাঝে মনে হয় প্র্যাকটিস করা ছেড়ে দিই।”
এসব দেখে মনে পড়ে গেল ডাক্তার গড়াইয়ের কথা। ডাক্তার এস পি গড়াই, যিনি বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অফ নিউরোলজির কর্তা ছিলেন এবং মিডিয়াবাহিনী নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দেশোদ্ধারে আপত্তি জানিয়ে, অপারেশন ফেলে মহাকরণে জো হুজুরি করতে পারবেন না বলার জন্যে সেই ২০১১র মে মাসে সাসপেন্ড হয়েছিলেন। সেইসময় অনেকেরই খুব আহ্লাদ হয়েছিল কারণ “সি পি এম আমলের আবর্জনা সরানো হল।” কোন কোন ডাক্তারেরও যে এমন উল্লাস হয়নি তা বলা যাবে না। ডাক্তারবাবুরা সংগঠিতভাবে কোন প্রতিবাদ করেছিলেন কি? মনে করার খুব চেষ্টা করছি, মনে পড়ছে না।
আমার বাবার জন্যে কয়েকবার এবং একবার আমার নিজের জন্যেও মমতা ক্ষমতায় আসার আগে বাঙ্গুরের ঐ হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। তখন দেখেছি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদির দিক থেকে সরকারী হাসপাতাল বললেই যে ভয়াবহ ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, বাঙ্গুর ঠিক তেমনটা ছিল না। নিশ্চয়ই তার কৃতিত্ব ডাক্তার গড়াইয়ের মত লোকেদেরই। কিন্তু পরিবর্তন সেসবের ধার ধারেনি।
আরেকজন ডাক্তারের কথাও মনে পড়ল — ডাক্তার অরুণ সিং। শেঠ সুখলাল কারনানি মেমোরিয়াল হাসপাতালের এই ডাক্তারকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। এনার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলাম। ওরকম ব্যস্ত হাসপাতালে নিও ন্যাটালজির মত একটা সুপার স্পেশালাইজড বিভাগ বানিয়ে ফেলেছিলেন ভদ্রলোক। সেই বিভাগে যেতে হয়েছিল আমাকে। গিয়ে দেখি কি আশ্চর্য মেশিনের মত কাজ হয় সেখানে, হাজারটা অপ্রাপ্তির মধ্যেও! একজন নার্স ডাক্তার সিংকে উদ্ধৃত করে যেরকম স্বরে কথা বললেন আমার আর আমার স্ত্রীর সাথে, অতখানি শ্রদ্ধা নিয়ে কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান সম্পর্কে অন্য কর্মীদের কথা বলতে শেষ শুনেছিলাম যখন আমার স্কুলের মাস্টারমশাইরা আমাদের হেডস্যার সম্পর্কে কথা বলতেন। ডাক্তার সিংকে যেদিন সামনাসামনি দেখলাম, দেখে মনে হল কোন ধ্যানমগ্ন ঋষিকে দেখছি। এমন একটা লোক যাকে এককথায় পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছা করে। আমার সামান্য দেখায় ভুল থাকতে পারে কিন্তু তথ্য বলছে এস এস কে এমের পেডিয়াট্রিকস এবং নিও ন্যাটালজি বিভাগকে দেশের অন্যতম সেরা করে তোলায় ডাক্তার সিং অনস্বীকার্য অবদান। সেই লোকটিকেও কি এক অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই এমন এক হাসপাতালে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল যেখানে তাঁর গবেষণার কোন দাম নেই। ডাক্তারবাবুরা কতটা প্রতিবাদ করেছিলেন? মনে করতে পারছি না।
হ্যাঁ, প্রতিবাদ একটা হয়েছিল, একেবারে রাস্তায় নেমে। যখন মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারী হাসপাতালের জোরজুলুম, দু নম্বরীর একটা হিসাবকিতাব করলেন প্রকাশ্যে, তারপর যখন হাসপাতালগুলোয় পেশিশক্তির আস্ফালন চলল একের পর এক। তখন ডাক্তাররা রাস্তায় নেমেছিলেন বটে।
তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ কী বুঝব? সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের পাশে বেসরকারীর ডাক্তারবাবুরা নেই নাকি বেসরকারীর ডাক্তারবাবুদের পাশে সরকারীর ডাক্তারবাবুরা নেই? আমাদের অভিজ্ঞতা তো বলে ঘুরেফিরে একই ডাক্তারদের সরকারী, বেসরকারী দুরকম জায়গাতেই দেখা যায়। তাহলে প্রতিবাদের এহেন তারতম্য হয় কেন? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, এই তারতম্য সরকারকে এবং আমাদের মত রুগীদের, তাদের বাড়ির লোকেদের কী বার্তা দিচ্ছে? শুধু সরকারী হাসপাতালের যাঁরা ডাক্তারি করেন তাঁদের যোগ্যতা কম নাকি কম রোজগার করেন বলে গুরুত্ব কম? এই বার্তা গেলে কোন রুগী কোন ডাক্তারকেই শ্রদ্ধা করবে কি? নাকি সরকার কোন ডাক্তারকে গুরুত্ব দেবে? দিচ্ছে না যে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। নইলে ডাক্তার রোগনির্ণয় করে কী লিখবেন তা মুখ্যমন্ত্রী ঠিক করেন কোন অধিকারে? তিনি পাশ করা উকিল, ডক্টরেট, কবি, চিত্রশিল্পী — এসব জানতাম। তিনি ডাক্তারও হয়ে উঠলেন নাকি? ইন্ডিয়ান মেডিকাল এসোসিয়েশন বলে কিছু এরাজ্যে আছে?
বেচারাথেরিয়াম ডাক্তার
এই তারতম্য সরকারকে এবং আমাদের মত রুগীদের, তাদের বাড়ির লোকেদের কী বার্তা দিচ্ছে? শুধু সরকারী হাসপাতালের যাঁরা ডাক্তারি করেন তাঁদের যোগ্যতা কম নাকি কম রোজগার করেন বলে গুরুত্ব কম? এই বার্তা গেলে কোন রুগী কোন ডাক্তারকেই শ্রদ্ধা করবে কি? নাকি সরকার কোন ডাক্তারকে গুরুত্ব দেবে?