নির্বোধ আর বুদ্ধিমান

এই যারা হাসাহাসি করছে তাদের নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির উপরে আস্থা দেখে যে আমার হাসি পাচ্ছে। এরা অনেকেই তো কদিন আগে নিজেরাও বিশ্বাস করেছিল যে দু হাজার টাকার নোটের মধ্যে জিপিএস চিপ বসানো আছে, তাই মাটির নীচে পুঁতে রাখলেও আয়কর দপ্তর জানতে পারবে কোথায় আছে। এরাই তো গলা ফাটিয়ে বলে বেড়াচ্ছিল বিমুদ্রাকরণের ফলে নাকি আইএস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরাই তো হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ডকে বেদবাক্য বলে মনে করে

রাজধানী কলকাতার অধিবাসীদের চেয়ে এ রাজ্যের গ্রাম বা মফঃস্বলের বাসিন্দারা যে নিকৃষ্টতর জীব, এ রকম একটা ধারণা অনেকদিন ধরে চালু আছে। বহুকাল শুনে এসেছি মাধ্যমিকে জেলার ছাত্রছাত্রীরা স্ট্যান্ড করে না, করিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ এমন হতেই পারে না যে জেলার ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় কলকাতার বাসিন্দাদের চেয়ে ভাল ফল করবে। ইদানীং কলকাতার অধিকাংশ ছেলেমেয়ে আইসিএসই বা সিবিএসই স্কুলে চলে গেছে বলেই বোধহয় এই অভিযোগটা আর তত শোনা যায় না।
বামফ্রন্ট যখন একের পর এক নির্বাচনে জিতত, যখন সেই জয়গুলোকে রিগিং এর ফল বলে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়ার জায়গাটা তৈরি হয়নি, তখনো দেখতাম শহুরে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তরা বলতেন “ও তো গ্রামের ভোটে জেতে।” মানে গ্রামের ভোটগুলো ফাউ। শহরের একেকটা ভোটের মূল্য গ্রামের ভোটের থেকে বেশি হওয়া উচিৎ ছিল, তাহলে এই অনর্থ ঘটতে পারত না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয় নিয়েও দেখেছি একই কথা বলা হয়। অথচ কলকাতা কর্পোরেশন, বিধাননগর পুরসভা তৃণমূলের দখলে; কলকাতার অধিকাংশ বিধায়ক মমতার পার্টির।
মজা হচ্ছে, কলকাতার লোকেদের মনেই থাকে না যে বাঙালি যাঁদের নিয়ে গর্ব করে, রামমোহন রায় থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত, তাঁদের অনেকেরই জন্ম, বেড়ে ওঠা কলকাতার বাইরে।
যাক গে। যেজন্যে এত কথা বলছি এবারে সেটা বলি। ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড বসানোর বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন চলছে। গত কয়েকদিনে যা জানা গেছে তাতে এটা স্পষ্ট যে এলাকার মানুষের ক্ষোভ আসলে পাওয়ার গ্রিড নিয়ে ততটা নয় যতটা বলপূর্বক বা ঠকিয়ে জমি দখল করা নিয়ে। এই আন্দোলনের পেছনে নকশাল বা অন্য বিরোধীদের প্রেরণা (বা প্ররোচনা) থাকুক আর না-ই থাকুক, দিদির ভাইয়েরা যে শুধু আইনকানুন মেনেই জমি নিয়েছেন ওখানে তা নয় — এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। পাওয়ার গ্রিড ওখানে বসলে ঐ এলাকার মানুষের কী সুবিধা হবে, আদৌ কোন সুবিধা হবে কিনা এসব বোঝানোর জন্য সরকার সময় ব্যয় করেননি। অতএব এটা গা জোয়ারি, যেমন গা জোয়ারি সিঙ্গুরে করা হয়েছিল, নন্দীগ্রামে করা শুরু হয়েছিল। কিন্তু মুশকিল হল, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী, সহকর্মী অনেকের কাছেই দেখছি ভাঙড় নিয়ে আলোচনায় মুখ্য বিষয় এগুলো নয়। মুখ্য হল এক স্থানীয় মহিলার বাইট, যেখানে তিনি বলেছেন ওখানে পাওয়ার গ্রিড হলে “আমাদের আর বাচ্চা হবে না।”
গ্রামের মানুষরা কত অজ্ঞ, কত অশিক্ষিত তা নিয়েই হাসাহাসি, রসালো আলোচনা ইত্যাদি চলছে। বিজ্ঞানে আমি বরাবরই অজ্ঞান। ইলেকট্রিক আর ইলেকট্রনিকের পার্থক্য বুঝিয়ে দেওয়ার যোগ্যতাও আমার নেই সুতরাং ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড মানুষের শরীরে কী প্রভাব ফ্যালে বা আদৌ ফ্যালে কিনা তা নিয়ে আমার কোন ধারণা নেই। আমার পদার্থবিদ বন্ধুদের অনুরোধ করব আলোকপাত করতে।
কিন্তু এই যারা হাসাহাসি করছে তাদের নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির উপরে আস্থা দেখে যে আমার হাসি পাচ্ছে। এরা অনেকেই তো কদিন আগে নিজেরাও বিশ্বাস করেছিল যে দু হাজার টাকার নোটের মধ্যে জিপিএস চিপ বসানো আছে, তাই মাটির নীচে পুঁতে রাখলেও আয়কর দপ্তর জানতে পারবে কোথায় আছে। এরাই তো গলা ফাটিয়ে বলে বেড়াচ্ছিল বিমুদ্রাকরণের ফলে নাকি আইএস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরাই তো হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ডকে বেদবাক্য বলে মনে করে। ঐ গ্রাম্য মহিলা, যিনি হয়ত শুধু নিজের নামটুকু সই করতে পারেন, তার সাথে এই ইংরিজি জানা, স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারা লোকেদের পার্থক্য কোথায়? শহরে বাস করে, ডিগ্রিধারী হয়ে কী তফাত হল? এবার থেকে শঙখ ঘোষকে মনে রাখবেন:

‘হাওড়া ব্রিজের চূড়োয় উঠুন,
নীচে তাকান, ঊর্ধ্বে চান —
দুটোই মাত্র সম্প্রদায়
নির্বোধ আর বুদ্ধিমান।’