বয়সটা যে চল্লিশের দিকে এগোচ্ছে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম গত পরশু বিকেলে । অফিস যাওয়ার পথে কলেজ স্ট্রিট গেছি গোটাদুয়েক বইয়ের খোঁজে । যেতে হবে ন্যাশনাল বুক এজেন্সিতে । আমার পরিষ্কার মনে পড়ল ওটা সূর্য সেন স্ট্রিটে । বীরবিক্রমে পুঁটিরাম পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন প্রায় রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছে গেছি তখন মনে হল এবার স্মৃতি ব্যর্থ হয়েছে এটা মেনে নেওয়া উচিৎ । নিজের স্মৃতির উপর গর্বটাকে লক্ষ্মী ছেলের মত পিঠের ব্যাগে লুকিয়ে ফেলে এক প্রবীণার কাছে পথনির্দেশ চাইলাম । তিনি জানালেন দোকানটা কফি হাউসের আশেপাশে । প্যারামাউন্টের সামনে দিয়ে যাচ্ছি, তখনও দোকানটার চেহারা কিছুতেই মনে পড়ছে না । অগত্যা একজন নবীন দোকানকর্মীর সাহায্য চাইলাম । তিনি একেবারে কোন্ বাড়িটা তা-ও বলে দিলেন ।
আমি যখন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলের সামনে তখন ঝুপ করে নেমে পড়ল বৃষ্টি । ব্যাগ থেকে লটঘটে ছাতাটা বার করে খুলতে খুলতেই একটু ভিজে গেলাম ।
এন বি এ তে ঢুকতে গিয়ে দেখি তার সামনে একগাদা তরুণ তরুণী ভিড় জমিয়েছে । আমার মত তাদের অফিস যাওয়ার তাড়া নেই । তাই বৃষ্টি থেকে বাঁচবার তাগিদও তাদের যৎসামান্য । কোন একটা ছাউনির নীচে দাঁড়ানো যতটা না প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি ঘন হয়ে বৃষ্টি উপভোগ করতে করতে আড্ডা দেওয়ার জন্যে । ঐ ভাবনাহীন প্রাণগুলোকে এড়িয়ে ঢুকে পড়লাম দোকানে । সেখানে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন আগলে বসে আছেন কয়েকজন প্রায় বৃদ্ধ ভদ্রলোক যাঁদের চোখ ঢেকে ফেলেছে সিঁড়িতে দাঁড়ানো ছেলেমেয়েগুলো । বৃষ্টি দেখার আর উপায় নেই । আমার প্রবেশে ওঁরা একটু নড়েচড়ে বসেছিলেন কিন্তু আমি এমন একটা বই চেয়ে বসলাম যে হতাশ গলায় ওঁদের একজনকে বলতে হল “ও বই আর পাওয়া যায় না । অনেকদিন হল ।”
যা-ই হোক এক বন্ধুর জন্যে উপহার কেনার ছিল । সে বইটা শেলফের উপরেই রাখা ছিল । সেইটে কিনে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি আরো বেড়েছে, সেইসঙ্গে ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও । ভাবছি অনুজ অনির্বাণকে কফি হাউসে আসতে বলি, বহুবার প্রতিশ্রুত আড্ডাটা মারা যাবে । তারপর ভাবলাম এত বৃষ্টিতে আসবেই বা কী করে ? ভাবতে ভাবতে কফি হাউসের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি । বাইরের চেহারাটা দেখেই বুঝতে পারছি ভেতরে আমাকে আরো বেমানান, এমনকি হাস্যকর, দেখাবে । তাই বাইরেই কোনমতে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
বৃষ্টি কমার নাম নেই । রাস্তা দিয়ে বহু ছেলেমেয়ে ছাতা ছাড়াই দিব্য হেঁটে যাচ্ছে আমার কেজো জীবনকে মুখ ভেঙচিয়ে । কেউ কেউ ভিজতে ভিজতে হঠাৎ বৃষ্টি থেকে বাঁচার ভান করে ফুটপাথে এসে উঠছে । তাদের জায়গা ছাড়তে ছাড়তে আমি ক্রমশ কোণঠাসা । এমন সময়ে দেখি কফি হাউস থেকে একলাফে রাস্তায় নেমে পড়ে একটি মেয়ে তার প্রেমিকটিকে ভিজতে ডাকছে । ছোঁড়া এমন আহাম্মক (অথবা সাইনাসের রুগী) যে হাতের ছাতাখানা দেখিয়ে বলছে “তোর ছাতাটা বার কর না ।” দেখেই আমার মনে হল এ শালা শঙ্খবেলা দ্যাখেনি । শেষ অব্দি অবশ্য মেয়েটিরই জিৎ । সে বিজয়গর্বে গদগদ হয়ে প্রেমিককে বগলদাবা করে সংস্কৃত কলেজ পেরিয়ে উধাও হল ।
এইসব দেখতে দেখতে কখন এক ফুটপাথস্থ বই বিক্রেতার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি ! তিনি ঝাঁজিয়ে উঠলেন । আমি দেখলাম এখানে আমার না দাঁড়ানোই শ্রেয় । ময়ূরদের পাড়ায় দাঁড়কাকের দাঁড়িয়ে থাকা সত্যিই অন্যায় । অতএব ঐ বৃষ্টিতেই রাস্তায় নেমে পড়লাম ।
জায়গা খুঁজতে খুঁজতে মনে হল হিন্দু স্কুলের সামনের পাঠ্য বইয়ের দোকানগুলো, যেগুলোকে বরাবর বইপাড়ার সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় দোকান বলে মনে হয় আমার, সেগুলোর ছাউনিই আমার উপযুক্ত আশ্রয় । কারণ সেখানে দেখি পড়াশোনা ছাড়া কিচ্ছু জানে না এমন ছেলেমেয়ে আর তাদের বাবা-মায়েদের ভিড় । আমার মত বা আরেকটু বড় মাপের ভুঁড়ি নিয়ে অনেকেই সেখানে আছে ।
সবে ওখানে দাঁড়িয়ে ছাতাটা বন্ধ করেছি, কোথা থেকে বেগুনী আর নীল শাড়ি পরা দুটো মেয়ে একটা ছাতায় আধাআধি ভিজতে ভিজতে এসে হাজির । একজন আরেকজনকে প্রচন্ড বকছে “তোকে বললাম শাড়ির ঝামেলা করিস না । এখন কী হবে ? হাঁটাও যাচ্ছে না ঠিক করে । কী ভারী হয়েছে শাড়িটা !”
অন্য বেচারির উত্তর “আমি কী করে জানব এরকম বৃষ্টি হবে ? সকাল থেকে রোদই ছিল ।”
এদের ঝগড়া উপভোগ করতে করতেই ভাবছি এত বৃষ্টিতে জল ঠেঙিয়ে অফিস যাব কী করে । হোয়াটস্যাপ গ্রুপে সেই দুশ্চিন্তার কথা লিখেও ফেলেছি । ইতিমধ্যে এক মনোযোগী ছাত্রী হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ পা পিছলে রাস্তার হাঁটুজলে ঝপাং । হাতের খাতা “ভেসে যায় অলকানন্দা জলে”। সে প্রথমে লজ্জিত পরে হর্ষিত । তারস্বরে সঙ্গী ছেলেটাকে ডাকছে ” অ্যাই, কোথায় গেলি ? শিগগির আয় ।” ছেলে অমনি দৌড়ে এসে হাত ধরে তুলতে গেছে । কিন্তু মেয়ের চিৎকৃত নির্দেশ “আগে খাতা আগে খাতা ।” রোগা প্যাংলাটি দেখলাম কোন শালপ্রাংশু মহাভুজ বলীর চেয়ে কোন অংশে কম নয় । একহাতে পৃথুলা সঙ্গিনী আর অন্য হাতে তার হৃদি, থুড়ি খাতা, সে দিব্যি তুলে নিল ।
ততক্ষণে আমার নিজেকে আবার পাতিকাক মনে হচ্ছে । দুঃখে কা কা করে ডেকে উঠতে যাব, অমনি ফোনটা বেজে উঠল । সহকর্মী অর্ণবের ফোন “তুমি আমহার্স্ট স্ট্রিট ক্রসিং এ চলে আসতে পারবে ? আমি ওলাতে আছি । তোমায় তুলে নেব তাহলে ।” আমাকে তখন হেঁটে আন্দামান যেতে বললেও চলে যেতাম, আমহার্স্ট স্ট্রিট তো কোন্ ছার । Damsel না হলেও আমি তখন প্রবল distressed । সহকর্মীটি shining ওলায় আমাকে উদ্ধার করল ।
বয়স হচ্ছে
ইতিমধ্যে এক মনোযোগী ছাত্রী হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ পা পিছলে রাস্তার হাঁটুজলে ঝপাং । হাতের খাতা “ভেসে যায় অলকানন্দা জলে”। সে প্রথমে লজ্জিত পরে হর্ষিত । তারস্বরে সঙ্গী ছেলেটাকে ডাকছে ” অ্যাই, কোথায় গেলি ? শিগগির আয় ।” ছেলে অমনি দৌড়ে এসে হাত ধরে তুলতে গেছে । কিন্তু মেয়ের চিৎকৃত নির্দেশ “আগে খাতা আগে খাতা ।” রোগা প্যাংলাটি দেখলাম কোন শালপ্রাংশু মহাভুজ বলীর চেয়ে কোন অংশে কম নয় । একহাতে পৃথুলা সঙ্গিনী আর অন্য হাতে তার হৃদি, থুড়ি খাতা, সে দিব্যি তুলে নিল