একজন সাব এডিটর

যদি ধরে নিই আমাদের ভাস্করদার, মানে ভাস্করনারায়ণ গুপ্তের, মৃত্যুটাও আমাদের সংবাদজগতে কোথাও রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না, তাহলে একদমই ভুল হবে না

রোজ সকালে যে কাগজটা পড়েন সেটার মধ্যে ছাপাখানার শ্রমিকদের কায়িক শ্রমের পাশাপাশি অনেক মানুষের মানসিক শ্রম মিশে থাকে। তার মধ্যে যারা নিজেদের ভাল কাজের জন্যে প্রায় কখনোই পুরস্কৃত হয় না, কিন্তু ভুল হলে প্রচণ্ড তিরস্কৃত হয়, তাদের নাম সাব এডিটর। ভাল খবর বেরোলে সম্পাদকের পিঠ চাপড়ানি এবং পাঠকের কাছে নাম — দুইই হয় রিপোর্টারের। বস্তুত পাঠকের কাছে সাব এডিটর বলে কোনকিছুর অস্তিত্বই নেই প্রায়। সাব এডিটর যখনই কোথাও সাংবাদিক হিসাবে নিজের পরিচয় দেন তখনই শুনতে হয় “ও, আপনি রিপোর্টার?” সাংবাদিকতার ইতিহাস, সব দেশে সব যুগেই, রিপোর্ট তথা রিপোর্টারদের ইতিহাস। কাগজের চমকে দেওয়া হেডিং, ছবির স্মরণীয় ক্যাপশন পাঠক ভোলেন না। কিন্তু যিনি ওগুলো দিয়েছেন তাঁর নাম কাগজে ছাপা হয় না বলে পাঠক জানতেও পারেন না। প্রতিভাবান সাংবাদিকরা যখন আত্মজীবনী বা কাল্পনিক কাহিনী লেখেন তখনো সাব এডিটরদের কথা বড় একটা আসে না। বিখ্যাত রিপোর্টার বা কাগজের সম্পাদক মারা গেলে তাঁর কাগজে (তেমন বিখ্যাত হলে অন্য কাগজেও) খবরটা ছাপা হয়। সাব এডিটর, সে তিনি যত উচ্চপদস্থই হোন না কেন, মারা গেলে সাধারণত তা হয় না। অন্য চাকরিতে কর্মরত কেউ মারা গেলে অফিসে একটা স্মরণসভা হয়, খবরের কাগজের অফিসে দৈনন্দিন কাজের এমন চাপ যে সে ফুরসতও নেই।
অতএব যদি ধরে নিই আমাদের ভাস্করদার, মানে ভাস্করনারায়ণ গুপ্তের, মৃত্যুটাও আমাদের সংবাদজগতে কোথাও রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না, তাহলে একদমই ভুল হবে না। বিশেষ করে যখন মৃত্যুর বেশ আগে থেকেই ভাস্করদার সাব এডিটরবৃত্তি ঘুচে গিয়েছিল।
এক অর্থে খবরের কাগজে সাব এডিটরদের জীবন মৃত্যুর এই যে অকিঞ্চিৎকর অবস্থান, এটাই সবচেয়ে বাস্তবানুগ। যে কোন পেশার মানুষের জীবন মৃত্যুই তো, খুব বড় কিছু না করে থাকলে, এই বিরাট পৃথিবীতে এরকমই অকিঞ্চিৎকর। তবু, সবচেয়ে নগণ্য লোকটা যখন মারা যায় তখনো তার চেনা জানা মানুষরা, কাছের মানুষরা, অন্তত কয়েকটা দিন শোক পালন করে। কবি নাজিম হিকমত লিখেছিলেন বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড় জোর এক বছর। একবিংশ শতাব্দীতে নিশ্চয়ই আরো কম। তাই ভাবলাম এই বেলা স্মৃতিচারণটা সেরে ফেলা যাক। কদিন পরে আমারই লোকটাকে মনে থাকবে কিনা সে কি হলফ করে বলা যায়?
ভাস্করদার সাথে আমার শেষ দেখা ২০০৭ এ, যেদিন স্টেটসম্যান থেকে তার পাওনা টাকা পয়সার তাগাদা দিতে সে অফিসে এসেছিল। তারপর বার দুয়েক ফোনে কথা হয়েছে। শেষ কথা হয় ২০০৯ এ। আমার বিয়ের নেমন্তন্ন করবার জন্যে ফোন করেছিলাম। ভাস্করদা আসবে বলে কথা দিয়েও আসতে পারেনি। সাব এডিটরদের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। ভাস্করদা তদ্দিনে হিন্দুস্তান টাইমসের অধুনালুপ্ত সংস্করণের উচ্চপদস্থ সাব এডিটর। উচ্চপদস্থ, কিন্তু সাব এডিটর তো। তারপর থেকে ভাস্করদার সাথে যোগাযোগ আছে যে বন্ধুদের, তাদের কাছ থেকে তার খোঁজখবর নিয়েছি। কারণ ভাস্করদার জীবনে শোনার মত কিছুই ঘটছে না এরকম প্রায় হত না। এক আধবার ইচ্ছে হয়েছে দেখা করার উদযোগ আয়োজন করি, কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ আলস্যে সে আর করা হয়ে ওঠেনি। তাহলে এখন লোকটার স্মৃতিচারণ করতে বসলাম কেন? এ কি আদিখ্যেতা নয়? নয়। তার কারণ আমি লিখছি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্যে। কিসের কৃতজ্ঞতা? সেই কথাই বলি।
আমি যখন শিক্ষানবিশ সাংবাদিক হিসাবে ২০০৫ এর জুন মাসে দ্য স্টেটসম্যান কাগজে যোগ দিই তখন বহিরঙ্গ আর অন্তরঙ্গ — দুদিক থেকেই কাগজটার অবস্থা জলসাঘর ছবির জমিদারবাড়িটার মত। কাজ শেখার পক্ষে অবশ্য জায়গাটা তখনো চমৎকার ছিল। কিন্তু সেটা বুঝতে তো সময় লাগে। কী শিখতে হবে, কোনটা আগে শিখতে হবে কোনটা পরে — সেসব বুঝতেও সময় লাগে। আর সেসব বুঝে ওঠার জন্যে মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যের দরকার হয়। সেই স্বাচ্ছন্দ্য যুগিয়ে দেওয়ায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল আমার তৎকালীন বস, ক্রীড়া সম্পাদিকা ইলোরা সেনের। ব্যাপারটা আরো একটু সহজ হয়েছিল ক্রীড়া বিভাগে আমার সহকর্মীদের মধ্যে আমার দুই সহপাঠী সুদীপ্ত আর অরিজিৎ থাকায়। কিন্তু সাংবাদিক মাত্রেই জানেন, আমাদের পেশায় এক কঠিন ঠাঁই আছে যেখানে নবীন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা, এবং যেখানে কেউ কোন সাহায্য করতে পারে না। সে ঠাঁইয়ের নাম নাইট ডিউটি। যখন সেই ডিউটিতে থাকতাম, তখন গোড়ার দিকে বাড়ি যাওয়ার সময় ইলোরাদি বলে দিয়ে যেতেন “ভাস্কর, মনো (মনোজিৎ দাশগুপ্ত), ও রইল। প্রথম প্রথম নাইট করছে তো। একটু দেখো।” ঐ দুজনের ব্যবহারে আমরা (শিক্ষানবিশরা) কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে গেলাম, ভুল হলেও ভয় নেই। শুধরে দেওয়ার জন্যে ভাস্করদা, মনোদা আছে। আমার কাছে সেদিনের ঐ ভরসাটুকুর দাম, যত বয়স হচ্ছে তত বেড়ে যাচ্ছে।
আমি মফঃস্বলের ছেলে, চোদ্দ পুরুষে কেউ কখনো সাংবাদিক ছিল না। তার উপর স্টেটসম্যান এমন একটা কাগজ যা পড়ে বাবা ইংরিজি শিখতে বলত ছোটবেলায়। ফলে বেশি রাতে অফিস ফাঁকা হয়ে গেলে অন্য ডেস্কের কার সাথে কতটা কথা বলব, কার সাথে হাসিঠাট্টা করা চলে, কার ঠাট্টায় হাসা চলে আর কার ঠাট্টায় হাসলে তিনি রেগে যাবেন — এসব নিয়ে প্রাথমিক দ্বিধা ছিলই। সেই দ্বিধা কাটাতে যে লোকটা সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল, সেও ভাস্করদাই। ফলে কিছুদিন পরেই দেখা গেল তার ভাষায় আমি হয়ে গেছি “কোন্নগরের সিপিএম।” ভাস্করদার কিন্তু সিপিএমকে ঘোর অপছন্দ। অথচ আমার বাবা সিপিএম করে বলে ঐ নামকরণটা করলেও আমাকে বেশ পছন্দ বলেই মনে হয়।
সেইসময় নাইট ডিউটি শেষ হওয়ামাত্রই বাড়ি আসার জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা ছিল না। আমাকে অফিসেই অপেক্ষা করতে হত ভোর চারটে অব্দি। তারপর অফিসের গাড়ি আমায় নামিয়ে দিত শেষ রাতের হাওড়া স্টেশনে। দিনের প্রথম ট্রেন ধরে আমি বাড়ি ফিরতাম। রাত দেড়টা দুটো নাগাদ কাজ শেষ হওয়ার পর ঐ যে দুটো ঘন্টা, তা আমার দেখতে দেখতে কেটে যেত ভাস্করদার জন্যেই। হুল্লোড়ে লোকের নিঃসঙ্গতা, বিষণ্ণতা অত কাছ থেকে দেখার সুযোগ জীবনে আর হয়নি। সেই মধ্যরাতের আড্ডাগুলোতেই ভাস্করদাকে ভাল করে দেখার আমার সুযোগ হল। এবং যত দেখলাম, তত অবাক হলাম।
দেখলাম লোকটা যেমন ঝড়ের বেগে টাইপ করে সন্ধ্যেবেলা, তেমনি দুপুর রাতে গড়গড়িয়ে জয় গোস্বামীর কবিতা বলে। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময়ে পাঞ্জাবী বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার গল্প বলতে বলতে খালিস্তানপন্থী আন্দোলন কী এবং কেন, ভিন্দ্রানওয়ালে ইন্দিরা গান্ধীর ফ্র‍্যাঙ্কেনস্টাইন কিনা সেই আলোচনায় ঢুকে পড়ে অনায়াসে। আদবানির প্রশংসা করতে করতে দুম করে ঋত্বিক ঘটকের ‘যুক্তি, তক্কো আর গপ্প’ শট ধরে ধরে বিশ্লেষণ করতে আরম্ভ করে।
বেশ কয়েকবার এমন হয়েছে, অফিস থেকে বেরনোর সময়ে দেখা গেছে ভাস্করদা, মনোদাকে পৌঁছতে যাবে আবার আমাকেও হাওড়ায় ছাড়তে যাবে, অত গাড়ি মজুত নেই। ওরা তখন আমায় নামিয়ে দিয়ে বাড়ি গেছে।
স্বভাবতই আমার মত নবীনদের অনেকেরই ভাস্করদাকে তখন দারুণ পছন্দ। দেখা গেল অফিসের সমস্যা নিয়ে ভাস্করদার পরামর্শ তো চাইছিই, উপরন্তু কোন সুন্দরীকে মনে ধরেছে কিন্তু বলে উঠতে পারছি না — সে সমস্যার সমাধানও ভাস্করদার কাছেই দাবী করছি। ভাস্করদা হয়ত বলছে “ওরে ****, এর চেয়ে আমিই বলে আসি নাহয়।”
ভাস্করদার সাথে আমার সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত এক নবমীর রাত। জীবনে প্রথম নবমীর দিন নাইট ডিউটি করছি। ব্যাজার মুখে। কাজ শেষ হওয়ার পর ভাস্করদা টানতে টানতে নিয়ে গেল প্রতিদিন অফিসের সামনে। নিজেরা চা খাচ্ছে, আমাকেও খেতেই হবে। যতই বলি আমি চা খাই না, ভাস্করদা বলে “আমি বলছি, তোকে খেতে হবে **।” খাওয়া হল, তারপর বলল “আচ্ছা, এটা আমার ইচ্ছায় খেলি, এবার তোর কী খাওয়ার ইচ্ছে বল। যা বলবি তাই খাওয়াব।” সেটা সুইগি, জোম্যাটোর যুগ নয়। ক্ষিদেও পেয়েছে তেড়ে। কিন্তু কিছু বলতে পারছি না সঙ্কোচে। শেষ অব্দি ভাস্করদাই “আচ্ছা, তুই ডিম ভালবাসিস তো?” বলে রাস্তার ধারের দোকান থেকে ডবল ডিমের ভুর্জি কিনে দিল। নিউজরুমে ফিরে সামনে বসিয়ে সমস্তটা খাওয়াল। রাত আড়াইটেয় খাওয়া সেই ডিমের ভুর্জির স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে।
ওরকম একজন সাব এডিটর হয়ে উঠতে আমরা কেউ পারলাম না। সব বিষয়ে অত আগ্রহ, অত পড়ার শক্তি আমাদের নেই। ওরকম একজন সিনিয়র হয়ে উঠতেও পারিনি। অত মমতাও আমাদের নেই।

ছবি: ভাস্করদার ফেসবুক পেজ থেকে