বর্ষার শব্দ

শিরীষ কাগজের চালাকি ভেদ করতে বর্ষার একটা গোটা মরসুমও লাগেনি। ভিতরে ঢুকতে পেয়ে তার সুরও গেল বদলে।

বর্ষার শব্দ আছে। বৃষ্টির শব্দ নয়, যে শব্দের কথা বলছি তা অন্য কোনো শব্দের সাথে মেলে না।

আমাদের বাড়িটা মজবুত এবং পাকা। কিন্তু বাবা-জ্যাঠাদের মধ্যে ঠাকুর্দার তৈরি বাড়ি ভাগাভাগি হওয়ার সময় বারান্দাটা আমাদের ভাগে পড়েনি। অথচ রোজ প্রচুর মানুষ আসেন বাবার কাছে নানা প্রয়োজনে, তাঁদের বসার জায়গা দেওয়া যায় না। তাই বারান্দার দরকার পড়ল। শিক্ষক বাবার মাইনে তখন হাজার দশেক। মাকে জিজ্ঞেস করলেন “লোন নিয়ে বারান্দাটা করে না ফেললে আগামী বর্ষায় খুব মুশকিলে পড়ব। কটা বছর ডাল, আলুসেদ্ধ খেয়ে থাকতে হবে কিন্তু। পারবে তো?” সে যুগের মধ্যবিত্ত গৃহিণীরা পারতেন না এমন কৃচ্ছ্রসাধন আজও আবিষ্কার হয়নি। সেই আমাদের বারান্দা হল, কিন্তু বাবা যা ঋণ পেলেন তাতে বারান্দার দেওয়াল প্লাস্টার হল না। মেঝে হল না, মাটি ফেলে সমান করে একটু কম দামের ইট পেতে দেওয়া হল তার উপর। নড়বড় করত, মায়ের শরীর বেশ ভারী বলে চলতে অসুবিধা হত প্রথম প্রথম। বাবা বলতেন “ও কিছু না, চলতে চলতে ওগুলো মাটিতে বসে যাবে। তখন আর অসুবিধা হবে না।” পাকা ছাদও হল না, কারণ ছাদ ঢালাইয়ের অনেক খরচ। কোথা থেকে বেশকিছু ফুটোওলা টিন জোগাড় হল, শিরীষ কাগজ দিয়ে ফুটো বোজানো হল, আমাদের পাকাবাড়ির বারান্দা পেল টিনের চাল। বর্ষা এসে পড়ল, সশব্দে। প্রথম দিন বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময় অনেক রাত। আমরা তিনজনেই এমন বোকা, ভেবেছিলাম কেউ টিনের চালের উপর উঠে লাফাচ্ছে। ক্রমশ সে শব্দের সাথে ভাব হয়ে গেল।

শিরীষ কাগজের চালাকি ভেদ করতে বর্ষার একটা গোটা মরসুমও লাগেনি। ভিতরে ঢুকতে পেয়ে তার সুরও গেল বদলে। আস্ত চাল আর ফুটো চালে শব্দের তফাত অভ্যস্ত কান ছাড়া ধরা পড়ে না চট করে। ফুটো দিয়ে ইটের উপর পড়ার শব্দ আরেকরকম। জল পেয়ে ইটগুলোর চেহারা বদলে গেল, চটি ছাড়া বারান্দায় হাঁটা বারণ হল। সাপ, ব্যাঙ দুয়েরই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একমাত্র আমাদের বারান্দার ইটের মেঝেতেই দেখেছি। সাপগুলোর বাহারি চেহারা দেখে বহুবার ভেবেছি বিষাক্ত, কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে ওগুলো হেলে। ইটের উপর জল পড়ার শব্দ একরকম, সেই জলে কাদায় হাঁটার শব্দ আরেকরকম। সব মিলিয়ে বর্ষার শব্দ।

সশব্দ বর্ষায় বিদ্যুৎ চালু থাকবে এমন প্রত্যাশা আমাদের ছিল না। বৃষ্টি থামলেই আসবে কিনা তা নিয়েই বরং বড়রা আলোচনা করতেন। বর্ষার শব্দের মধ্যে সন্ধেবেলায় লণ্ঠন বা ল্যাম্পের আলোয় পড়তে বসলে চেঁচিয়ে পড়ার দরকার হত। মনে মনে পড়লে বা লিখতে গেলে ধীরে ধীরে বুজে আসত চোখের পাতা — এমন সুরেলা, এমন ছান্দিক ছিল বর্ষার শব্দ। সাধারণত বাবা বাড়ি ফিরতেন রাত করে। বরাবরই মনে হত বাবা বাড়ির বাইরে থাকলে বর্ষার শব্দ একরকম, ফিরে এলে অন্যরকম।

তখন পাড়ায় টিভি বিরল। আমাদের পাশের বাড়িতেই ছিল একখানা। দৈবাৎ বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও লোডশেডিং হত না। তখন টিভি থেকে ভেসে আসা সিনেমার গান আর সংলাপে বর্ষার শব্দের রূপ খুলে যেত। বৃষ্টি, লোডশেডিং, পড়াশোনা শেষ, বাবা ফিরছেন না, ফিরলে খেতে বসব। ততক্ষণ কী হবে? মা গান গাইবেন। বর্ষার শব্দে যোগ হল মায়ের খালি গলার গান, বাড়িতে হারমোনিয়ামের প্রয়োজন বোধ হয়নি তখনো। মোমবাতির আলোয় তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে মা কতদূর ধেয়ে যেতেন তা বোঝার বয়স হওয়ার আগে থেকেই এই রুটিন। বোধহয় তাই এখনো বর্ষার শব্দ পেলেই কানের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতে থাকে। তার সবগুলোই প্রকৃতি পর্যায়ের গান নয়, বর্ষার গানও নয়। বোঝার বয়স কি আজও হয়েছে? কে জানে! বয়স আর বোঝার বয়স বোধহয় আলাদা। তাছাড়া সবটা কি কখনো বোঝা হবে? প্রথম যেদিন মাকে “সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি” গাইতে শুনেছিলাম আর চোখে দেখেছিলাম জল, সেদিন সে জলের কারণ বুঝিনি, আজও তো বুঝি না।

খালি গলায় গাইতে বাবাও ভালবাসতেন, অপেশাদার যাত্রা/নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন বলে কণ্ঠস্বরও ছিল চমৎকার। কখনো কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানি না, কিন্তু বহু কবিতা মুখস্থ ছিল। সেসব আবৃত্তি করার ইচ্ছে কেন জানি না বৃষ্টি এলেই সবচেয়ে প্রবল হত। বোধহয় বাবার মধ্যে রোম্যান্টিকতার ঘাটতি ছিল। কারণ এক্ষুণি চোখ বুজলে বর্ষার শব্দের সাথে বাবার গলায় শোনা যেসব কবিতা আজ মিশে যাচ্ছে, সেগুলো একটাও প্রেমের কবিতা নয় — কাজি নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ৎ’, ‘কামাল পাশা’, রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেটা’। আর আশ্চর্য সব গল্পের আবহসঙ্গীত হয়ে আছে বর্ষার শব্দ। ঠাকুর্দার একখানা রেকর্ড প্লেয়ার আমাদের ভাগে পড়েছিল। কিছু ধার করা আর কিছু কেনা লং প্লেয়িং রেকর্ড চালাতাম তাতে। একটা রেকর্ডে বাজত ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। একটা ছুটির দিনে শুনতে শুনতে লোডশেডিং। বাবার মুখে সেই প্রথম শুনলাম ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর গল্প। কোনো এক বর্ষার দিনে শুনেছিলাম রুশ বিপ্লবের গল্প। আমি জানি বাবা কোনোদিন সের্গেই আইজেনস্টাইনের কোনো ছবি দেখেননি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নন্দনে প্রথমবার ব্যাটলশিপ পোটেমকিন দেখে মনে হয়েছিল এসব দৃশ্য বাবার চোখেই প্রথম দেখেছি। ফিদেল কাস্ত্রো, চে গেভারার গল্পও প্রথম শুনিয়েছিলেন কোন বৃষ্টিদিনে।

আমাদের জীবনে অনেকগুলো স্মরণীয় পরিবর্তন আসে ১৯৯০ সালে। সেই বসন্তে প্রথম মাকে ছেড়ে বেশ কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল। বৈশাখ মাসের পাঁচ তারিখ হাসপাতালে মা আমার বোনকে জন্ম দিলেন। সে বছরই কোনো সরকারি সিদ্ধান্তে বাবার মাইনে বাড়ল অনেকখানি। একদিন আমাকে আর মাস ছয়েকের বোনকে বড় জেঠিমার কাছে রেখে বাবা-মা খানিকক্ষণের জন্য বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন একটা আশ্চর্য জিনিস নিয়ে। আপট্রনের পোর্টেবল টিভি। ততদিনে পাড়ায় প্রায় সব বাড়িতে টিভি এসে গেছে, কলকাতাবাসী আত্মীয়দের বাড়িতে এবং পাড়ার এক ধনী বন্ধুর বাড়িতে মনোরম রঙিন টিভিও দেখে ফেলেছি। সাদাকালো টিভি দেখে সামান্য মনখারাপ হয়েছিল, প্রকাশ করিনি। দোকান থেকে যিনি এসে টিভি চালানো, বন্ধ করা, চ্যানেল বদলানো, ছবির ঔজ্জ্বল্য বাড়ানো কমানো শেখাতে এসেছিলেন তিনি বললেন “কোম্পানি এই মডেলটা রঙিন টিভি হিসাবেই বানিয়েছিল। খরচে পোষাবে না বলে লাস্ট মোমেন্টে সাদাকালো করেছে।” এ কি কম সান্ত্বনা! পরদিন খেলার মাঠে ধনী বন্ধুটিকে সগর্বে জানিয়েছিলাম এই তথ্য। তখন ভুয়ো খবর আমাদের কল্পনাতেই ছিল না। এতকিছু বদলাল, বর্ষার শব্দ কিন্তু বদলায়নি। যতটুকু মাইনে বেড়েছিল তাতে দেওয়াল প্লাস্টার করা যায় না, বারান্দার মেঝে হয় না, পাকা ছাদ হয় না।

তা বলে কেউ গোমড়া মুখে থাকে না। আমার সাথে আমার বোনও বর্ষার শব্দ উপভোগ করতে শিখে গেল দ্রুত। বছর তিনেক পরে আমাদের বাড়িতে এল আরেকটা আশ্চর্যন্ত্র। ফিলিপসের টু ইন ওয়ান। একই যন্ত্রে ক্যাসেট চলে আবার এফ এম রেডিও চলে! দাদুর রেকর্ড প্লেয়ার বোনের জন্মের আগেই গত হয়েছেন। মাঝের কয়েকটা বছর বাড়িতে গান বজায় রেখেছিলেন বাবা-মা নিজেরাই। সামর্থ সীমিত, তাই বাবা বললেন যে মাসে টেপ রেকর্ডার কেনা হল, সে মাসে ক্যাসেট কেনা হবে না। মাসে মাসে একটা-দুটো করে ক্যাসেটে বাড়িতে এলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা, সলিল চৌধুরী, এ আর রহমান এবং অবশ্যই থরে থরে রবীন্দ্রনাথ। তখন আর বৃষ্টি হলেই লোডশেডিং হয় না আমাদের পাড়ায়। এক বর্ষার সকালে বাবার ইচ্ছে হল আবৃত্তি রেকর্ড করে রাখবে। যে গলা যাত্রার মাঠে শেষ সারির দর্শকের কাছেও পৌঁছে যেত অনায়াসে, সেই গলা তখন আর নেই। সেরিবেলা ডিজেনারেশনের অসুখে বাবার হাত কাঁপত আজন্ম দেখেছি, ততদিনে গলাও কাঁপতে শুরু করেছে। সেদিনের বর্ষার শব্দে মিশল কাঁপা গলায় ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’। সেখানেই শেষ নয়, রান্নাবান্নার মধ্যে থেকে টেনে এনে মাকে দিয়েও আবৃত্তি করানো হল মায়ের প্রিয় কবিতা ‘অভিসার’।

এখন চাকরি চলে যাওয়ার যুগ, মাইনে কমে যাওয়ার যুগ। তাই হয়ত বললে গল্পের মত শোনায়, কিন্তু সে সময় সত্যিই বাবার চাকরি যেতে পারে বা মাইনে কমে যেতে পারে আমরা জানতাম না। জানতাম মাইনে কেবল বাড়ে। কারোর বাবার মাইনে ঝটপট বাড়ে, আমাদের বাবার ধীরে ধীরে বাড়ে। ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে আমার যখন গোঁফ দাড়ি বেরোতে শুরু করেছে, তখন বর্ষার শব্দ বদলে গেল। কারণ ব্যাঙ্কের চোখে বাবার ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা বেড়েছে। অতএব বারান্দার পুরনো বাসিন্দা সাপ, ব্যাঙেদের কপাল পুড়ল। শান বাঁধানো মেঝে হল, দেওয়ালে প্লাস্টার হল। ফুটো টিনের চালের দিন ফুরোল। বারান্দা যে কেবল পাকা ছাদ পেল তা নয়, ছাদের উপর নতুন ঘরও হল। তারপর এল বর্ষা। আমরা চারজন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে প্রবল ব্যথায় আবিষ্কার করলাম, আমাদের বর্ষার শব্দ দূরে সরে গেছে। সেবার বর্ষাটা মনখারাপে কেটেছে। কী যেন অমূল্য ধন আমাদের ছিল, আর নেই।

বর্ষা কিন্তু নির্দয় নয়। টিনের চাল না পেলে চুপ করে যাব, এমন জেদ নেই তার। আমাদের বাড়ির সামনেই খোলা মাঠ, সেখানে বিকেলে ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছি কিন্তু সকালে গরু চরিয়েছে নাটুকাকু। এরপর থেকে আমাদের বর্ষার শব্দ ভরে রেখেছে সেই গরুদের ডাক, কাদা মাঠে বলে শট নেওয়ার ভোঁতা শব্দ আর গোলের তীক্ষ্ণ উল্লাস। ছাদের রেনওয়াটার পাইপ থেকে জল পড়ার শব্দ থেকেও বঞ্চিত হইনি। কলকাতার অনতিদূরে আমাদের মফস্বলে গত সাড়ে তিন দশকে শব্দদূষণ যত বেড়েছে, বর্ষা তত বোবা হয়েছে। গাছপালা, পশুপাখিও নিঃশব্দে উল্লাস করা শিখে গেছে। পাছে শব্দ করলে মানুষের চোখে পড়ে ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম উঠে যায়!

আমরা কিন্তু বহাল তবিয়তে আছি। শুধু বৃষ্টি এলে মনে হয় কোনও একটা তার ছিঁড়ে গেছে কবে। সুর হারায়ে গেল।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে