স্বপ্নসুন্দর

শেলী পড়েছি অনেক অনেক পরে। কিন্তু মহম্মদ রফির গান শুনতে শুনতেই বুঝেছি, যে গানগুলো সবচেয়ে বেশিদিন মনে থাকে, হৃদপিন্ডে জড়িয়ে থাকে শিরা, ধমনীর মত — সেগুলো বিষাদের গান, বিরহের গান

23sld12112934720.jpg

আমাদের বাড়িতে মামার দেওয়া একটা রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। আমার স্কুলমাস্টার বাবার রোজগারে রেকর্ড কেনা বড় সহজ ছিল না। একমাত্র পুজোর মাসে নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে একটা দুটো লং প্লেয়িং রেকর্ড কেনা যেত। কিন্তু গান শোনা থেমে থাকত না তা বলে। পরিচিত বা প্রতিবেশীদের থেকে রেকর্ড চেয়ে এনেও গান শুনতাম সেইসময়।
একদিন একটা রেকর্ড চেয়ে আনল বাবা, খাপটার উপরে দেখি একটা হাসিমুখ, টাকমাথা লোকের ছবি। সেই রেকর্ডটা চালিয়ে একটা গানের আগে বাবা বলল “এই ছবিটা জানিস, আমি বাবার সাথে হলে গিয়ে দেখেছিলাম। একটা বিরাট পাথরের মূর্তি। তার সামনে বসে একটা লোক আকুল হয়ে গানটা গাইছে। গান শুনে পাথরের মূর্তিটার চোখ দিয়ে জল পড়ে। ওদিকে পাথরের মূর্তি কাঁদছে, এদিকে আমরা কাঁদছি।”
জানি না গল্পটার প্রভাবে নাকি গায়কের গুণে, গানটা শুনতে শুনতে আমারও চোখে জল এসে গেল। বাবার দিকে তাকিয়ে দেখি বাবারও চোখে জল। সেটা গান শুনে নাকি নিজের শৈশবস্মৃতি মনে করে, নাকি ঐ গানটা আর বাবার স্মৃতি অবিচ্ছেদ্য হয়ে গিয়েছিল — সে বিচার করার মত বড় তখন আমি ছিলাম না। কিন্তু বেশ কয়েকবার শুনে আমার এত ভাল লেগে গেল গানটা যে প্রচন্ড বেসুরো গলায় গাইতে চেষ্টা করতে লাগলাম “ও দুনিয়া কে রখওয়ালে, সুন দর্দ ভরে মেরে নালে।”
তখন আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আসতেন হিন্দমোটর কারখানার হিন্দিভাষী শ্রমিকরা। আমার বাংলা শিক্ষা তখনো হাসিখুশি দ্বিতীয় ভাগে না পৌঁছলেও তাঁদের সাথে বাবার কথোপকথন শুনে শুনে হিন্দি আমি বেশ বুঝতে পারি। ঐ রেকর্ডটাতেই আরেকটা গান ছিল যেটা আমার খুব পছন্দ হল। “কেয়া হুয়া তেরা ওয়াদা? ওয়ো কসম ওয়ো ইরাদা?” যতই হিন্দি বুঝি না কেন, প্রেম এবং তার প্রত্যাখ্যান বোঝার শক্তি তখন আমার মোটেও ছিল না। আসলে গায়কের গলার আওয়াজটাই বড্ড ভাল লেগে গেল। সেই ভাল লাগা নিয়ে মহম্মদ রফির সঙ্গে এতটা পথ।
শেলী পড়েছি অনেক অনেক পরে। কিন্তু মহম্মদ রফির গান শুনতে শুনতেই বুঝেছি, যে গানগুলো সবচেয়ে বেশিদিন মনে থাকে, হৃদপিন্ডে জড়িয়ে থাকে শিরা, ধমনীর মত — সেগুলো বিষাদের গান, বিরহের গান। চাপা কান্নায় বা উদগত অশ্রুতে রফির জুড়ি পাইনি।
স্মরণীয় গানে নিশ্চয়ই অনেকটা অবদান থাকে গীতিকার আর সুরকারের। কিন্তু আমার মত সঙ্গীতবোধহীন শ্রোতার মন জুড়ে থাকে শুধু মুখচোরা শিল্পীর মনোহরণ গলাটা। অল্প বয়সে প্রেমে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে তাই বারবার শুনতাম “এহসান তেরা হোগা মুঝ পর / দিল চাহতা হ্যায় ওয়ো কহনে দো”। সায়রা বানুর মুখে তখন দিব্য বসে যেত সেই মেয়েটির মুখ, কিন্তু স্বপ্নেও কন্ঠস্বরটা আমার হত না, মহম্মদ রফিরই থাকত।
ইদানীং বয়স দ্রুত বাড়ছে বুঝতে পারি। যদিও সন্ধের দিকে মেঘ করে এলে এখনো “দিওয়ানা হুয়া বাদল” মনে পড়ে অনিবার্যভাবে, আগেকার মত বাসে বোরখা পরা কোন সুন্দরীকে দেখলে চট করে “মেরে মেহবুব তুঝে মেরি মহব্বত কি কসম” মনে পড়ে না। তবে অবাক লাগে এই ভেবে যে দিনে পাঁচবার নমাজ পড়া এক মুসলমান কী করে পাথরের বিগ্রহ আর সেইসঙ্গে লক্ষ লক্ষ মূর্তিপুজোয় বিশ্বাসী শ্রোতাকে কাঁদাতে পারেন শুধু তাঁর কণ্ঠস্বর দিয়ে! এসব কি সত্যি ঘটেছিল, নাকি কোন চৈতালী রাতের স্বপ্নে আমাদের বাপ-ঠাকুর্দারা এসব দেখেছিলেন?