সভ্যতার ফাঁদ

যতই পাহাড় কমে আসুক, সেইসঙ্গে জঙ্গল, তৎসহ শ্বাস নেওয়ার মত বিশুদ্ধ বাতাস। হোটেল হোক, রিসর্ট হোক, হাইওয়ে হোক, পেট্রল পাম্প হোক। এগুলোই তো সভ্যতার লক্ষণ

কদিনের জন্যে পালিয়ে গেছিলাম। শিক্ষক গ্রেপ্তার, বিরোধী হত্যা, নির্লজ্জ মিথ্যাভাষণ, দ্রব্যমূল্যের অনর্গল বৃদ্ধি, উপনির্বাচন, পেইড নিউজ — এসব ভুলে। পাহাড়ে। মধ্যে মধ্যে পালাতে ইচ্ছে বোধহয় সবারই করে। তবে পালাতে চাইলেই তো আর পালানো যায় না। আমরা সাধারণ মানুষ, মুকেশ আম্বানি তো নই। তাঁর জীবনযাত্রা চলে তাঁর নিয়মে, আমাদের চলতে হয় সমাজ, সংসারের নিয়মে। তবে যা দেখে এলাম, পালানোর জায়গা সকলেরই কমে আসছে।
গেছিলাম গৌহাটি হয়ে শিলং, সেখান থেকে হপ্তাখানেক ধরে এদিকওদিক চেরাপুঞ্জি, ডাউকি, লাইথলুম ইত্যাদি। সাড়ে আট বছর আগেও একবার শিলং গেছি। এবারে একই রাস্তায় যাওয়ার সময়ে সবচেয়ে বড় যে তফাতটা চোখে পড়ল সেটা হল তখন পাহাড় কেটে যে জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ হচ্ছিল তা এবারে সম্পূর্ণ। তা ভাল, তবে মুশকিল হল রাস্তা বানানো হয়ে গিয়ে থাকলেও পাহাড় ফাটানো আর শেষ হচ্ছে না। গৌহাটি থেকে শিলঙের পথে এবং শিলং থেকে চেরাপুঞ্জির পথে বিপুল উদ্যমে পাহাড় ভাঙা চলছে, ভাঙা জায়গাগুলো দগদগে ঘায়ের মত হয়ে আছে বাঁকে বাঁকে। পাহাড়ের গা থেকে রক্ত পড়ে না বলেই বোধহয় কেউ প্রশ্ন তোলে না “এত রক্ত কেন?” এত পাহাড় ফাটানো কেন তার উত্তর খুব শক্ত নয় অবশ্য। অনেক জায়গাতে ইতিমধ্যেই সাইনবোর্ড লেগে গেছে — অমুক হোটেল আর তমুক রিসর্ট। অনেক জায়গাতেই অবশ্য নির্মাণ সম্পূর্ণ। কিসের বলুন তো? পেট্রল পাম্পের। পাহাড়ে নির্মল বাতাস আর নীল আকাশের আশে বেড়াতে গিয়ে যতগুলো পেট্রল পাম্প দেখলাম তত সারাজীবনে দেখেছি কিনা সন্দেহ। টুরিস্ট বাড়ছে, গাড়ি বাড়ছে, সরকারের করপ্রাপ্তি বাড়ছে, পেট্রল পাম্প বাড়লেই বা ক্ষতি কী? আপনি বলবেন, তা ওসব তো করতেই হবে। পাহাড় বেচে তো আর পয়সা হয় না।” আরে আরে! বলেন কী! কে বলেছে পাহাড় বেচে পয়সা হয় না? আলবাত হয়। বেধড়ক পাহাড় ভেঙে ফেলা দেখে আমার গিন্নীর সাথে একটু হা হুতাশ করছিলাম “এইভাবে পাহাড় কাটছে! কী পায় এমন করে?” শুনে আমাদের ভাড়া গাড়ির চালক শর্মাজি বললেন “পত্থর বিকতা হ্যায় না! কাফি আচ্ছা দাম মিলতা হ্যায়।” কপালে ছিল বলে স্বচক্ষে দেখাও হয়ে গেল এক জায়গায়। পাহাড় ভাঙা হচ্ছে আর লরিতে চেপে টুকরো টুকরো পাহাড় চলেছে কিছু দূরে নির্মীয়মাণ রিসর্টের শোভাবর্ধনে। যারা পাথর ভাঙছে তারা খুশি কারণ দিব্য দু পয়সা হচ্ছে। যারা পাথর কিনছে তারা খুশি কারণ তাদের রিসর্ট মজবুত এবং মনোরম হচ্ছে। আমাদের মত টুরিস্টরা খুশি কারণ দুর্গম পাহাড় সুগম হচ্ছে, আমাদের থাকার জায়গা বাড়ছে। সরকার খুশি কারণ যত টুরিস্ট, যত রিসর্ট, তত কর। হিসাব বহির্ভূত আয়ব্যয়গুলোর কথা বাদই দিলাম। তাছাড়া মেঘালয় পিছিয়ে থাকবে কেন? পশ্চিমবঙ্গে হাতিদের যাওয়া আসার পথে হোটেল, রিসর্ট বানানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, উত্তরাখণ্ডে জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে দিয়ে হাইওয়ে হচ্ছে। মেঘালয় ছোট রাজ্য বলে কি মানুষ না? সে যতই পাহাড় কমে আসুক, সেইসঙ্গে জঙ্গল, তৎসহ শ্বাস নেওয়ার মত বিশুদ্ধ বাতাস। হোটেল হোক, রিসর্ট হোক, হাইওয়ে হোক, পেট্রল পাম্প হোক। এগুলোই তো সভ্যতার লক্ষণ।
পাহাড়ের শোক ত্যাগ করে অন্য কথা বলি। প্রকৃতিপ্রেমী বাঙালিদের জলে ফেলা প্লাস্টিক সত্ত্বেও মানতেই হবে ডাউকি ভ্রমণ মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে আমার মত কাঠবাঙালের পক্ষে, যার কয়েক ফুট দূরেই বাংলাদেশের জল, মাটি দেখে বারবার ‘কোমল গান্ধার’ মনে পড়ে যাচ্ছিল। বেসুরো গলায় গেয়েও ফেললাম সেই বিয়ের গান, যা ঋত্বিক দুই বাংলার বিয়ের গান হিসাবে ভেবেছিলেন “আমতলায় ঝামুরঝুমুর / কলাতলায় বিয়া / আইলেন গো সুন্দরী জামাই / মুটুক মাথায় দিয়া।”
সেই স্বপ্নসফর শেষ করে শর্মাজি নিয়ে গেলেন এক প্রত্যন্ত গ্রামে, নাম তার মউলিননং। কেন যাওয়া সেখানে? না সেটা এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম। গ্রামে অনেক সাইনবোর্ড। অনেক খুঁজলাম এই সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রামের তকমাটা কে দিয়েছে কোথাও লেখা আছে কিনা। পেলাম না। আপনারা কোথাও পেলে জানাবেন। অবশ্য গ্রামটা নিঃসন্দেহে খুব পরিচ্ছন্ন। হবে না-ই বা কেন? গ্রামে কোন কাঁচা রাস্তা নেই, কাদা হবে কোত্থেকে? সব বাড়িতে পাকা শৌচাগার, পুরো গ্রামে পাকা নর্দমা। গ্রামটা খাসিদের, যাঁদের জীবিকা মূলত পর্যটনই, ফলে প্রায় সবকটা বাড়িই দোকান হয়ে উঠেছে। ফলক দেখে জানতে পারলাম গ্রামের রাস্তা পাকা হয়েছে মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিমে (MGNREGS)। এত পাকা শৌচাগার বানানোও গ্রামের লোকের সাধ্যে কুলিয়েছে বলে মনে হয় না, হয়ত সরকারী সাহায্য ছিল। থাকাই উচিৎ। সব গ্রামেই এরকম সাহায্য দিয়ে গ্রামগুলোকে পরিচ্ছন্ন করে না তুলে একটা গ্রামকে পরিচ্ছন্নতম করে তোলা কেন রাষ্ট্রের (সরকারের) উদ্দেশ্য হবে — প্রশ্ন সেটাই। অর্থনৈতিক সঙ্গতির সাথে পরিচ্ছন্নতার যে আবশ্যিক সম্পর্ক সেটা অস্বীকার করতে গিয়ে আরো প্রকট হয়ে পড়েছে এখানে। কী গর্বের দেশ আমাদের! স্বাধীনতার একাত্তর বছর পরে যত্ন করে একটা গ্রামকে পরিষ্কার করেছি আমরা যাতে দেশবিদেশের টুরিস্ট এসে দেখে চোখ কপালে তুলে বলে “ওমা! কি পরিষ্কার! একদম বিদেশের মত।”
ঠিক আগেরদিন লাইথলুম নামে আরেকটা গ্রামের প্রান্তে একটা জায়গায় গিয়েছিলাম। সেখানে উঁচুনিচু ঘাসজমি হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে উল্টোদিকের পাহাড়ের সৌন্দর্যে চমকে উঠে। আর আকাশ অমনি নেমে এসে ঠোঁটে আঙুল রেখে বলেছে “কোলাহল তো বারণ হল। এবার কথা কানে কানে।”
সেদিন আমাদের চালক ত্রিপুরার বাঙালি। অগাধ জ্ঞান ভদ্রলোকের (তাঁর কথায় পরে আসছি)। জানালেন এই রূপকথার মত জায়গাটায় রক অন ২ ছবিটার শুটিং হয়েছিল। তাতে জায়গাটায় লোকের আনাগোনা অনেক বেড়েছে কিন্তু গ্রামের রাস্তা সরকারী আশীর্বাদধন্য হয়নি। টুরিস্টদের জন্যে শৌচাগারটার অবস্থা দেখে বোঝা যায় গ্রামটাও পরিচ্ছন্নতম হয়ে ওঠার অদৃশ্য পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনি। যাক সে কথা। কবি তো কবেই প্রশ্ন করেছেন “চেরাপুঞ্জির থেকে, একফোঁটা মেঘ ধার দিতে পারো গোবি সাহারার বুকে?” সেই চেরাপুঞ্জির অদূরে এমন অসাম্য তো থাকবেই।
সেদিনের চালক নাথবাবুর কথা দিয়ে আমার প্যানপ্যানানি শেষ করি।
ভদ্রলোক চোস্ত হিন্দিতে কথা বলছিলেন বলে ভেবেছিলাম উনি অবাঙালি নাথ। মাঝে একটা ফোন এল, তাতে বাঙাল ভাষায় কথা বলতে শুনে ভুল ভাঙল। জানা গেল উনি বঙ্গসন্তান ঠিক নন, ত্রিপুরাসন্তান। অযাচিতভাবে জীবন, দাম্পত্য, অপত্যস্নেহ প্রভৃতি ভারী ভারী বিষয়ে অনেক জ্ঞান বিতরণ করলেন, তবে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান যেটা দিলেন সেটা ময়ূরের জনন প্রক্রিয়া সম্পর্কে। নইলে আমার এই ভ্রমণকাহিনীতে তাঁর জায়গা হত না। গভীর প্রত্যয় থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন “বলুন তো, ময়ূর ডিম দেয় না বাচ্চা দেয়? আগে দাদা বলুন, তারপরে বৌদি বলবেন।”
আমি মূঢ়, অল্প বিজ্ঞানশিক্ষিত সাংবাদিক, বলে ফেলেছি “ডিম দেয়। সেটা ফুটে বাচ্চা হয়।” ভদ্রলোক সজোরে ব্রেক কষে পেছন ঘুরে এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যে নিজেকে নিরক্ষর মনে হল। আমার স্ত্রী, স্কুলে বিজ্ঞান পড়ানোই যার পেশা, তার কাছে উনি অন্যরকম কিছু আশা করেছিলেন। অথচ সে বলল “হ্যাঁ, পাখিমাত্রেরই ডিম থেকে বাচ্চা হয়।” তড়িদাহত নাথবাবু আমার দিকে ফিরে বললেন “এই প্রশ্নটা বৌদিরে করা যায় না। আপনারে করি। এই যে কইতাছেন ময়ূরে ডিম দেয়, ডিম দিতে গ্যালে তো করতে অইব। আপনে কখনো ময়ূর-ময়ূরীরে করতে দ্যাখছেন?” আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে ময়ূর কুকুর বেড়ালের মত আমাদের চারপাশে প্রচুর পরিমাণে ঘুরে বেড়ায় না। ফলে তাদের “করতে” না দেখা না “করার” প্রমাণ হিসাবে দাঁড়ায় না। তিনি আমাকে উড়িয়ে দিয়ে বললেন “আরে আপনি দ্যাখেন নাই শুদু না, কোন মানুষই দ্যাখে নাই। কারণ ওরা করে না। ময়ূর গিয়া ময়ূরীর কাছে কান্দে। সেই অশ্রু পান কইরাই ময়ূরীর বাচ্চা হয়।” আমার জীবন বিজ্ঞানের মাস্টারমশাই, যুক্তিবিদ্যার মাস্টারমশাই — সকলের প্রতি মনে মনে “অপরাধ নেবেন না স্যার” বলে চুপ মেরে রইলাম। ঐ পাহাড়ি রাস্তায় বউ, বাচ্চাসমেত নাথবাবু আমাদের অনাথ করে দিলে তো স্যারেরা বাঁচাতে পারবেন না। একটা প্রশ্ন অবশ্য না করে থাকতে পারলাম না। “এখানেই সপরিবারে থাকেন না ত্রিপুরায় কেউ আছে এখনো?” উত্তর এল “না না, ফেমিলি আছে ওখানে। বাবা-মা আছেন না?”
বোঝা গেল বিপ্লব দেবরা এখন অনেকদিন ক্ষমতায় থাকবেন।
ভেবেছিলাম পালাতে পেরেছি কয়েকদিনের জন্যে। উপলব্ধি হল “বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছ। কেমনে দিই ফাঁকি?”