আমাদের স্কুলজীবনের গোড়ার দিকে অফসেট প্রিন্টিং সুলভ ছিল না। সরকারের দেওয়া পাঠ্যবইগুলো ছিল ব্লক প্রিন্টিং, সে বইতে ফটোগ্রাফ থাকত না, থাকত স্কেচ। সম্ভবত ক্লাস ফাইভের ইতিহাস বইতে একটা ছবি ছিল — একটা গর্ত থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। ক্যাপশন ছিল এরকম কিছু: “পরমাণু বিস্ফোরণের পরে হিরোশিমা”। স্কেচ হওয়াতে বীভৎসতা ভাল করে বোঝা যেত না। আমাদের অনেকেরই পরমাণু আর হিরোশিমা শব্দদুটোর সাথে সেই প্রথম পরিচয়। অবশ্য রাজনীতিবিদ বাবার সন্তান আর রাজনীতিবিদ মামাদের ভাগ্নে হওয়ার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিটলার, মুসোলিনি, স্তালিন, রুজভেল্ট, ঠান্ডাযুদ্ধ আমার তখনই পরিচিত। হিরোশিমার সঙ্গে আমার পরিচয় এসব চেনারও আগে। বাড়ির রেকর্ড প্লেয়ারে হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং তাঁর দলবলের একটা রেকর্ড খুব বাজত। তাতে শঙ্খচিল বলে একটা গান ছিল। প্রশান্তের বুকে হিরোশিমা দ্বীপে বাস করা এক শঙ্খচিলের গল্প ছিল সেই গানে, যে ভালবাসত সাগরিকাকে। তার চোখে হিরোশিমার ধ্বংস কেমন লেগেছিল সেই গল্প। তখন থেকেই হিরোশিমাকে চিনি, নাগাসাকিকেও।
যে ফটোগ্রাফটার অনুকরণে পাঠ্যবইয়ের স্কেচটা আঁকা হয়েছিল সেটা দেখি অনেক বড় হয়ে। কিন্তু প্রতিবছর আজকের দিনে আমার স্কুলের প্রার্থনাসভায় (ভগবানের নাম করার অনুষ্ঠান নয়। আমার স্কুলে ঐ জিনিসটা কী অপূর্ব ছিল তা নিয়ে পরে কখনো পোস্ট করব) মাস্টারমশাইরা, বিশেষত ইতিহাসের স্যার শঙ্খবাবু, হিরোশিমা আর নাগাসাকির বীভৎসতা বোঝাতে আর সেইসঙ্গে যুদ্ধ আর ভবিষ্যতে পারমাণবিক যুদ্ধ হলে তা কত ভয়ঙ্কর হবে তা বোঝাতে অনেকখানি সময় ব্যয় করতেন।
বড় হওয়ার পথে যখন ক্রমশ রাজনৈতিক হচ্ছি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রও হয়েছি সেইসময় এই উপমহাদেশে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হল। কোন একটা কাগজ তো মহা উৎসাহে হেডিং দিয়েছিল “ভারত ৫ : পাকিস্তান ৫”। তখনই প্রথম আঁচ পেলাম যে আমাদের চারপাশে অনেকেরই ধারণা পরমাণু বোমা বড়সড় পেটো ছাড়া কিছুই নয়। শত্রুপক্ষের দশটা আছে, মারতে পারে। কুছ পরোয়া নেহি। আমাদের বারোটা আছে। আমরাও মারব। এইরকম আর কি। অতঃপর কারগিল, পাকিস্তান, রক্তলোলুপতা, মারো শালাদের। তখন আবাসিক কলেজে পড়ি। বিজ্ঞানের ছাত্রদের অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা অত কাছ থেকে দেখার সুযোগ কমই পেয়েছি। কলেজ পত্রিকায় পদার্থবিদ্যার বিভাগীয় প্রধান দীপক ঘোষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরমাণু বোমার ধ্বংসক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে লিখেছিলেন। কে শোনে কার কথা! আজ যাদের ভক্ত বলি, তাদের ভক্তির ট্রেলার সেইসময় দেখেছি।
মোটামুটি ঐ সময়েই ‘নির্বাপিত সূর্যের সাধনা’ গ্রন্থের লেখক জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায়, আমার ছোটমামা, বইটার একটা পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। পুরনোটা বাড়ির বইয়ের তাকে অনেকদিন পড়েছিল, আমার পড়া হয়নি। চারিদিকের যুদ্ধবাদী কোলাহল শেষ অব্দি আমাকে দিয়ে নতুন সংস্করণটা পড়িয়ে নেয়। ১৯৪০ এর দশকে যে বোমার ভূগর্ভে বিস্ফোরণ দেখে সংস্কৃতে পণ্ডিত রবার্ট ওপেনহাইমারের মনে পড়েছিল গীতায় বর্ণিত সহস্র সূর্যের বিস্ফোরণের কথা, তার শক্তি ১৯৯৯-২০০০ এ কোথায় এসে ঠেকে থাকতে পারে ভেবে স্তম্ভিত হয়ে যাই।
এরপর ২০০৪। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে এম এ পড়তে ঢুকেছি এবং বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা চলছে দারুণভাবে। সহপাঠী সুদীপ্ত, যাকে তখন কমরেড বলে সম্বোধন করি, হঠাৎ টানতে টানতে নিয়ে গেল ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের রাজ্য কমিটির দপ্তরে। আলাপ করাল এক পাঞ্জাবি পাজামা পরা জাপানি ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম তার জুনিচি কোদামা। জাপান থেকে এসেছে সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘আকাহাতা’ র হয়ে আমাদের লোকসভা নির্বাচন রিপোর্ট করতে। জুনিচি ভাঙা ভাঙা ইংরিজি বলতে পারে, হিন্দী বা বাংলা একদমই না। সুদীপ্ত ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের অনুমতিক্রমে আমাকে জুতে দিল তার সাথে, সহকারী হিসাবে। পথ চিনিয়ে নিয়ে যাব আর স্থানীয় লোকেদের সাথে কথোপকথনে সাহায্য করব।
পরের বছর জুনিচি আবার কলকাতায় এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ষাট বছর পূর্তিতে কলকাতায় কী হচ্ছে তার প্রতিবেদন লিখবে বলে। এবারে সঙ্গে এল ওর স্ত্রী রিয়েকো আসাতো। রিয়েকো পেশায় দোভাষী। দিব্যি হিন্দি বলতে পারে, চেষ্টা করলে বাংলাও শিখে নিতে পারে ঝটপট। তবু নাকি জুনিচির আমাকেই দরকার। অতএব ওদের সাথে পয়লা সেপ্টেম্বর টো টো করে কলকাতা ঘুরলাম। ওরা অবাক — বিশ্বযুদ্ধ থেকে এতদূরে থাকা একটা দেশে মানুষ সেই যুদ্ধ সম্পর্কে এত জানে! এত লোক সেজন্য মিছিলে হাঁটে! স্কটিশচার্চ স্কুলের মাস্টারমশাইরা ছেলেদের লাইন দিয়ে দাঁড় করাচ্ছেন, তাদের হাতে যুদ্ধবিরোধী প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন। জুনিচির ধারণা হল ছাত্ররা কী নিয়ে এই কান্ড সেসব জানে না, শুধু আদেশ পালন করছে। আমি, শঙখবাবুর ছাত্র আমি, এই অভিযোগ মানব কেন? জনে জনে ছাত্রকে ধরে ধরে প্রশ্ন করতে লাগলাম। তাদের উত্তরগুলো আমার, আমার দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে লাগল। জুনিচিও আপ্লুত। রিয়েকো হঠাৎ আমায় জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা, এরা হিরোশিমা, নাগাসাকির কথা জানে?”
“আলবাৎ জানে।”
“দেখি, জিজ্ঞেস কর।”
ছাত্ররা ‘লিটল বয়’, ‘ফ্যাটম্যান’ পর্যন্ত যথাযথ বলে দিল।
সেবার ফেরত যাওয়ার আগে ওরা দুজনে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। সেদিন জানতে পারলাম রিয়েকোর বাবা-মা হিবাকুশা। ১৯৪৫ এর ৬ই আগস্ট হিরোশিমায় ছিলেন। রিয়েকো জাপানে যুদ্ধবিরোধী, পরমাণু অস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। যাওয়ার আগে আমাকে ওদের আন্দোলনের স্মারক একখানা লকেট উপহার দিয়ে গিয়েছিল।
নব্বইয়ের দশকে তবু আমরা পরমাণু বোমাকে বড়সড় পেটো ভাবতাম। আজকাল যখন দেখি চকলেট বোমা ভাবা হচ্ছে, “লাহোরে একটা ফেলে দিলেই হয়” বলা হচ্ছে মুহুর্মুহু, যে বলছে সে বোঝেই না যে লাহোরে বোমা পড়লে তেজষ্ক্রিয়তায় আমাদের পাঞ্জাবের দেশপ্রেমিক মানুষও বাঁচবে না, তখন বেশ কষ্ট হয়। নিজের জন্যে নয়, শঙ্খবাবু, ডিজির মত মাস্টারমশাইদের জন্যে; রিয়েকোর জন্যে, তার বাবা-মায়ের জন্যে।
এসব বললে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব, অনেক নিকটাত্মীয় সামনে বা পেছনে বলে “নিজেকে কী মনে করে ও? সব ব্যাপারে অন্যরকম কথা বলে নিজেকে এক্সেপশনাল প্রমাণ করতে চায়?”
কী করে বোঝাই বলুন? যারা এসব বলে তারাও কেউ কেউ স্যারেদের ক্লাসগুলো করেছে বটে, রিয়েকোর ছলছলে চোখদুটো তো দ্যাখেনি। ভাল করে তাকালে যেখান দিয়ে আজও সেই দৃশ্যটা দেখা যায় — বিরাট গর্ত, ধোঁয়ার কুণ্ডলী। অফসেট প্রিন্টের চেয়েও পরিষ্কার ছবিটা।
ছবিটা
বাড়ির রেকর্ড প্লেয়ারে হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং তাঁর দলবলের একটা রেকর্ড খুব বাজত। তাতে শঙ্খচিল বলে একটা গান ছিল। প্রশান্তের বুকে হিরোশিমা দ্বীপে বাস করা এক শঙ্খচিলের গল্প ছিল সেই গানে, যে ভালবাসত সাগরিকাকে। তার চোখে হিরোশিমার ধ্বংস কেমন লেগেছিল সেই গল্প। তখন থেকেই হিরোশিমাকে চিনি, নাগাসাকিকেও