ফাদার স্ট্যান স্বামী: একটি শোকহীন মৃত্যু

স্ট্যান স্বামীর জামিনের আবেদন করার লোক কম ছিল না। বারবার আবেদন করা হয়েছে, বারবার শুনানি হয়েছে আর রাষ্ট্র আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তিনি যেন জামিন না পান।

৬ জুলাই ছিল দলাই লামার ৮৬তম জন্মদিন। সেই উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই তিব্বতি ধর্মগুরুকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মোদী যা করেন, সবই ইতিহাসে প্রথমবার ঘটে। দলাই লামাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর ব্যাপারেও নাকি তিনিই প্রথম। সে প্রথম বা চতুর্দশ যা-ই হোন, ব্যাপারটা আপত্তিকর নয়। ভারতবর্ষ সাধুসন্তদের দেশ, ধর্মভীরু মানুষের দেশ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ধর্মগুরুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবেন — এ আর বেশি কথা কী? তাছাড়া দলাই লামা কেবল ধর্মগুরু নন, বহু বছর ধরে ভারতেরই বাসিন্দা এবং চীনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিব্বতি জনগণের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের নেতা। ভারতের মত গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী তো তাঁর পাশেই থাকবেন। অধিকার রক্ষার লড়াই পৃথিবীর সর্বত্র, সব সরকারের আমলেই কেউ না কেউ করে চলে। তেমনই আরেকটা লড়াইয়ের সৈনিক ছিলেন স্ট্যান স্বামী — আরেকজন ধর্মযাজক। দলাই লামার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট এই মানুষটা দলাইয়ের জন্মদিনের আগের দিনই মারা গেলেন। ধর্মভীরু এবং মানুষের অধিকারের লড়াইয়ে সহমর্মী প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশ করে টুইট করেননি।

যে মানুষটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত; এমনকি সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নভলাখা, ভারভারা রাও, সোমা সেন, জি এন সাইবাবা, আনন্দ তেলতুম্বড়ে, হ্যানি বাবুদের সাথে মিলে নাকি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ছক কষছিলেন, তাঁর মৃত্যুতে সেই প্রধানমন্ত্রীই শোক প্রকাশ করবেন! অন্যায় আবদার, তাই না? কিন্তু স্ট্যান স্বামীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ রয়েছে, দলাই লামার বিরুদ্ধে চীনা সরকারের অভিযোগ যে তার চেয়েও সাংঘাতিক। তিনি কেবল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তা নয়, রীতিমত নেতা। সেই কারণেই ১৯৫৯ সালে চীনা বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর তাঁকে ছদ্মবেশ ধারণ করে ভারতে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তখনকার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে মোদীর পূর্বসুরী মনমোহন সিং পর্যন্ত সব দলের সব প্রধানমন্ত্রী দলাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন। বিরোধী দলগুলোও এ নিয়ে কখনো সরকারকে আক্রমণ করেনি। এতে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষতি হলেও নীতি বদলানো হয়নি, কারণ ভারত সরকার তিব্বতের মানুষের অধিকারকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছে। ভাবা যেত মোদী সেই ধারাই অনুসরণ করছেন, যদি নিজের দেশের আন্দোলনকারীদের প্রতি তাঁর সরকার সংবেদনশীল হত। অন্য অনেককিছুর মত বিচারাধীন অবস্থায় বৃদ্ধ ধর্মযাজকের মৃত্যুও বোধহয় মোদীর আমলেই প্রথম হল।

এমনিতে ভারতে বিনা বিচারে পুলিশ বা বিচারবিভাগীয় হেফাজতে বছরের পর বছর আটকে থাকা নতুন কিছু নয়। নানা সমীক্ষায় দেখা যায় দলিত, আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের কপালে এই দুর্ভোগ সহজেই জোটে। ট্যাঁকের জোর না থাকলে বা লোকলস্কর না থাকলে মাত্র কয়েকশো টাকা চুরি করা বাচ্চা ছেলেকেও বিনা বিচারে বহু বছর কারাবাস করতে হয়। মৃত্যুও অস্বাভাবিক নয়। এমনই এক মৃত্যুর ঘটনায় মঙ্গলবার সারাদিন উত্তপ্ত ছিল বর্ধমান জেলার বরাকর। কিন্তু স্ট্যান স্বামীর জামিনের আবেদন করার লোক কম ছিল না। বারবার আবেদন করা হয়েছে, বারবার শুনানি হয়েছে আর রাষ্ট্র আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তিনি যেন জামিন না পান। কেবল জামিন নয়, পার্কিনসন্স অসুখে ভোগা এই মানুষটা যাতে জল খাওয়ার জন্য একটা স্ট্র পর্যন্ত না পান তার জন্য প্রাণপণ আইনি লড়াই করেছে মোদী সরকার। দেশদ্রোহীদের এমনটাই হওয়া উচিত — এই মত অনেকেরই। মুশকিল হল, ফাদারের দেশদ্রোহের এক বিন্দু প্রমাণ দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। দিল্লি দাঙ্গার জন্য এই একই আইনে অভিযুক্ত উমর খালিদের মত স্ট্যান, ভারভারা, গৌতম, সুধা, সোমাদের বিরুদ্ধেও এখন পর্যন্ত কোন প্রমাণ নেই। প্রমাণ বলতে যা জমা দেওয়া হয়েছে, তা বড়জোর কিছু বইপত্র বা লিফলেট।

ফাদার স্ট্যান সম্বন্ধে যা জানা যায়নি, তা বাদ দিয়ে যা জানা আছে সেগুলো আলোচনা করে দেখা যাক তিনি কেমন ভয়ঙ্কর লোক ছিলেন। তিনি এমন ঘোর সন্ত্রাসবাদী যে মাওবাদী সন্দেহে গ্রেপ্তার হওয়া আদিবাসীদের পরিবার পরিজনের হাতে অস্ত্র তুলে না দিয়ে ন্যায়বিচারের দাবিতে জনস্বার্থ মামলা করতেন। সংবিধানের পঞ্চম তফসিল অনুযায়ী কেন আদিবাসী এলাকায় ট্রাইব অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল গড়া হয়নি, সে প্রশ্ন তুলতেন। খনিজ পদার্থের জন্য বা শিল্প গড়তে আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমির অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে বোমা, বন্দুক, গুলিবিহীন আন্দোলন করতেন।

আরও পড়ুন বাধ্যতামূলক মহানতার একাকিত্বে ইমাম রশিদি

আসলে প্রমাণের দরকার নেই, আটক করে রাখার ইচ্ছাই যথেষ্ট। Unlawful Activities (Prevention) Act বা ইউএপিএ এমন এক আইন, যে আইনে জামিন হল ব্যতিক্রম, অভিযুক্তকে আটক করে রাখাই নিয়ম। অন্য সব আইনের সাথে এই আইনের এখানেই তফাত। মনে রাখা ভাল, ১৯৬৭ সালে চালু হওয়া এই আইনকে ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার সংশোধনী এনে আরো কঠোর করে তোলে। বিপুল অপব্যবহারের অভিযোগে Prevention of Terrorism Act বা পোটা বাতিল করতে হওয়ায়, সেই আইনের বহু আপত্তিকর ধারা এই সংশোধনীর মাধ্যমে ইউএপিএ-তে ঢুকিয়ে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। কোন দল প্রতিবাদে মুখর হয়নি। চার্জশিট ছাড়াই গ্রেপ্তারির ব্যবস্থা, জামিন পাওয়ার বিষয়ে নানা শর্ত আরোপ করা এবং “সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ”-এর অস্পষ্ট সংজ্ঞার আওতা বৃদ্ধি — সবই ইউপিএ আমলেই করা হয়েছিল, ২০০৮ ও ২০১২ সালে আরো দুটো সংশোধনীর মাধ্যমে। বিজেপি সরকার ২০১৯ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে দেগে দেওয়ার ব্যবস্থা করে, আগে কেবল কোনো সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী গণ্য করা যেত। রাজ্যসভায় বাম দলগুলো, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, এমডিএমকে, আরজেডি এবং এআইএমআইএমের মত কয়েকটা ছোট পার্টি ছাড়া সেই সংশোধনীর বিরুদ্ধে কেউ ভোট দেয়নি। লোকসভায় এআইএমআইএম, বিএসপি, আইইউএমএল, ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং এইউডিএফ দলের মোট আটজন সাংসদ সংশোধনীর বিরুদ্ধে ভোট দেন। কংগ্রেস ভোটাভুটির সময় ওয়াক আউট করলেও রাজ্যসভায় পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

বরাবরই ইউএপিএ-কে আরো শক্তিশালী করার পক্ষে সন্ত্রাসবাদের জুজু দেখানো হয়েছে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে সরকারবিরোধী মানুষের উপর। পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে এই আইনে রাজনৈতিক কর্মী, সমাজকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তৃণমূল সরকারের আমলেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। তবে যেহেতু এ দেশে বিজেপি বিরোধী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তাই এই আইনে গ্রেপ্তার হওয়া মানুষের সংখ্যা এখন কয়েকশোতে পৌঁছেছে।

আসলে ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু আমাদের সকলকেই আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নয়, আমরা সাধারণ নাগরিকরাও সন্ত্রাসবাদের নাম করলেই যে কোন সরকারি দমনপীড়নকে বৈধ বলে মেনে নিয়ে থাকি। তাই এমন সব একুশে আইন দেখে ক্ষেপে ওঠার বদলে খুশি হই। আমাদের মধ্যে অনেকে নিশ্চয়ই স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতেও “বেশ হয়েছে” মনে করছে। কারণ আমাদের সাধু সন্তদের প্রতি ভক্তির সীমা বাবা রামদেব অব্দি। কোন ফাদারের কাজকর্মের কারণে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি। এক্ষেত্রে কিন্তু মানুষটাকে শ্রদ্ধা করার প্রয়োজন নেই। এটুকু বোঝা দরকার যে কোন কারণে সরকারের (এমনকি স্রেফ পুলিশের) চক্ষুশূল হলেই বিনা প্রমাণে এইভাবে আমাকে, আপনাকেও দিনের পর দিন কারাগারে ফেলে রাখা সম্ভব। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এমনকি জল খাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে তিলে তিলে মেরে ফেলা সম্ভব। আইন মেনেই।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত