আকাদেমি সমাচার: সাহিত্য পুরস্কার যার যার, তিরস্কার সবার

সাহেবরা বলে থাকে রোম একদিনে তৈরি হয়নি। মমতা ব্যানার্জিকে নিরলস সাহিত্যচর্চার জন্য পুরস্কার দিয়ে মানুষকে হাসির খোরাক জোগানোও একদিনে হয়নি। একে সাহিত্যের অপমান বা সাহিত্যিকদের অপমান – যা-ই বলুন, ঘটনাটি কিন্তু ধারাবাহিকতা মেনে ঘটানো হয়েছে। ২০১৮ সালকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষ প্রায়শই ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ ওই বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসক দলের প্রার্থীরা নির্বাচিত হন। যেভাবে এই কাণ্ড ঘটানো হয় তাতে পশ্চিমবঙ্গে আর গণতন্ত্র অবশিষ্ট ছিল না বলে বিরোধীরা অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু রাজ্যের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যাঁদের আগ্রহ আছে তাঁদের একইসঙ্গে খেয়াল থাকা উচিত, মনোনয়ন পর্বের হিংসা নিয়ে শঙ্খ ঘোষের কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পরে তৃণমূলের বীরভূম জেলার নেতা অনুব্রত মণ্ডল কবিকে কোন ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন।

“বড় বড় কথা বলছেন কবি? এ কোন কবি? আমরা তো কবি বলতে জানতাম রবীন্দ্রনাথ, নজরুল। এ কোন নতুন কবি উঠে এসেছেন, যে আমার উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছেন। কবির নাম শঙ্খ রাখা ঠিক হয়নি, শঙ্খ নামের অপমান করেছেন উনি। এখনও বলছি, রাস্তায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে।”

আনন্দবাজার পত্রিকার ১০ মে ২০১৮ তারিখের সংস্করণে এই প্রতিবেদনের সঙ্গেই ছিল আরেকটি প্রতিবেদন, যেখানে অনুব্রতর আক্রমণ সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টজনদের মতামত প্রকাশিত হয়েছিল। যাঁরা মত দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির দুই বর্তমান সদস্য – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও জয় গোস্বামী। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কথা যদি সত্যি হয় (মিথ্যে বলে মনে করার কোনো কারণ ঘটেনি, যেহেতু সে কথার কোনো প্রতিবাদ হয়নি এখনো), তাহলে মমতা ব্যানার্জিকে আকাদেমির সর্বপ্রথম রিট্রিভারশিপ (নাকি সাবভার্সিভ? বলতে গিয়ে ভুল হয়েছে?) পুরস্কার দেওয়ার সিদ্ধান্তে এঁদেরও সম্মতি ছিল। কী বলেছিলেন সেদিন ওই দুজন? শীর্ষেন্দুর বক্তব্য ছিল “এটা রাজনৈতিক চাপানউতোর। আমি যেহেতু রাজনীতি করিনা, তাই এ নিয়ে মন্তব্য করতে পারছি না।” আর জয় বলেছিলেন “পঞ্চাশের দশক থেকে অপ্রতিহত গতিতে কবিতা লিখছেন শঙ্খ ঘোষ। তিনি আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। জ্ঞানপীঠ পেয়েছেন। এ রকম একজন সম্পর্কে যদি কেউ এ কথা বলেন, তবে কবিতা সম্পর্কে তাঁর কোনও বক্তব্যে মাথা না ঘামানোই ভাল। তাঁর কোনও কথাকে গুরুত্ব দেওয়াই উচিত নয়।”

অর্থাৎ বাংলার শ্রেষ্ঠ জীবিত কবিকে শাসক দলের একজন পদাধিকারী গুন্ডা ব্যক্তিগত আক্রমণ করলে সেটা শীর্ষেন্দুর কাছে রাজনৈতিক চাপান উতোর। যেন শঙ্খ ঘোষ বিরোধী দলের একজন নেতা, সাহিত্য জগতের কেউ নন। অতএব প্রবীণ সাহিত্যিক শীর্ষেন্দুর এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার দায় নেই। আনন্দবাজার পত্রিকার একটি প্রিয় শব্দ আছে – দলদাস। শব্দটি কোনো অজ্ঞাত কারণে শুধুমাত্র বাম দলের সাথে যুক্ত মানুষজনের জন্যই ব্যবহার করা হয়। নইলে দলদাসত্বের এমন চমৎকার উদাহরণ চোখ এড়াত না। পুরোদস্তুর রাজনৈতিক অবস্থান নিলাম, অথচ বললাম আমি রাজনীতি করি না। ভাষার এমন চাতুর্য একমাত্র শীর্ষেন্দুর মত উচ্চাঙ্গের কথাশিল্পীর পক্ষেই সম্ভব।

জয়ের মন্তব্যটিও অতুলনীয়। শঙ্খ ঘোষের মহানতা কোথায়? প্রথমত, অর্ধ শতকের বেশি কবিতা লেখায়। দ্বিতীয়ত, দুটি বড় বড় পুরস্কার পাওয়ায়। অর্থাৎ যদি পনেরো-বিশ বছর কবিতা লিখছেন, কোনো পুরস্কার পাননি – এমন কবি সম্পর্কে অনুব্রত কথাগুলি বলতেন তাহলে তেমন দোষ হত না। তাছাড়া দোষ হয়েছে বলেও জয় মনে করছিলেন কিনা বোঝার উপায় নেই, কারণ তিনি বলছেন যে লোক কবিতা বোঝে না তার কথায় গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না। অর্থাৎ কথাগুলি কে বলছে তার কোনো গুরুত্ব নেই। জয় এমন এক স্বপ্নলোকে বিচরণ করেন যেখানে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতার বিন্যাস নেই। কেবল দু দল মানুষ আছে – এক দল কবিতা বোঝে, আরেক দল কবিতা বোঝে না। যারা বোঝে না তাদের মধ্যে কে কী বলল তা নিয়ে না ভাবলেই মিটে গেল। অর্থাৎ সেদিন পশ্চিমবঙ্গের গদ্য আর পদ্য সাহিত্যের দুই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী শিল্পী অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছিলেন। সাহিত্য যে অতি খেলো ব্যাপার – এ কথা পশ্চিমবঙ্গে সেদিনই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর একটি গল্পে ভজহরি নামে এক চাকরের কথা আছে। একদিন বাড়িতে চোর এল, ভজহরি ঠিক করল ব্যাটাকে ধরতে হবে। সে মাথায় শিং বেঁধে, লেজ পরে উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল। তার ধারণা চোর তাকে ছাগল মনে করে চুরি করতে আসবে, অমনি সে চোরকে জড়িয়ে ধরবে। চোর এল, ঘরে ঢুকল, ভজহরি নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু বলল “ম্যা-আ-আ-আ”। চোর সব জিনিসপত্র বার করে এনে নিশ্চিন্তে পুঁটুলি বাঁধল, ভজহরি কেবল আওয়াজ করল “ম্যা-আ-আ-আ”। চোর চুরির মাল নিয়ে আস্তাকুঁড় পেরিয়ে ছুটে পালাল, ভজহরি হেসে খুন। বলল “ব্যাটা কি বোকা, আস্তাকুঁড় মাড়িয়ে গেল, এখন বাড়ি গিয়ে স্নান করতে হবে!” নিজেদের বুদ্ধি সম্পর্কে ভজহরিসুলভ মুগ্ধতায় আকাদেমির সম্মানীয় সদস্যরা নিজেদের, বাংলা আকাদেমির এবং বাংলা সাহিত্যের বিশ্বাসযোগ্যতার বারোটা বাজালেন।

এমনিতে বাঙালি চিরকাল গুণ এবং গুণীর দারুণ কদর করে এসেছে বললে ডাহা মিথ্যা বলা হবে। বাঙালি বরাবরই স্বীকৃতির কাঙাল এবং হুজুগে মাততে পছন্দ করে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন বিশ্বভারতী গড়ে তুলতে বাঙালিরা তাঁকে একটি পয়সা দিয়ে সাহায্য করেনি, শুধু মোহিত সেন নামে এক অধ্যাপক এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। অথচ মৃত্যুর পর স্যুভেনির হিসাবে সেই লোকের দাড়ি ছিঁড়ে নিতে হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল। পথের পাঁচালী বিদেশে সম্মানিত না হলে সত্যজিৎ রায়কে নিয়েও আমরা গদগদ হতাম কিনা সন্দেহ। এ বিষয়ে সেরা উদাহরণ অবশ্য মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অবিস্মরণীয় রিপোর্টাজে লিখেছেন, মাণিক যখন মারা যাচ্ছিলেন তখন কেউ তাঁর খবর নেয়নি। অথচ মারা যাওয়ার পর ফুলে ফুলে ঢেকে যাওয়ার জোগাড়। সে দৃশ্য নিজে চোখে দেখেছিলেন বলেই বোধহয় সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ফুল জমে জমে পাথর হয়। এতকিছু সত্ত্বেও বাঙালি গুণীদের মধ্যে ক্ষমতার প্রসাদ পাওয়ার জন্য এ হেন কাতরতা, যা-ই ঘটুক তা মুখ বুজে মেনে নেওয়ার এমন ব্যগ্রতা নিঃসন্দেহে অভিনব। সুভাষ নিজে বামপন্থী হয়েও বামফ্রন্ট সরকারের পেয়ারের লোক ছিলেন না। মৃত্যুর পর বরং মমতা ব্যানার্জি তাঁকে নিজেদের লোক বলে দাবি করেছিলেন। শঙ্খ ঘোষ কংগ্রেস আমলে তাদের বিরুদ্ধে লিখেছেন, বাম আমলে সিপিএম নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক সত্ত্বেও নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পর মিছিলে হেঁটেছিলেন। তফাতের মধ্যে তাঁকে দলে টানতে বিমান বসু তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন, ব্যর্থ হওয়ার পরেও “এ কোন কবি” বলেননি।

অল্পবয়সী, কম বিখ্যাতদের স্বীকৃতির লোভ তবু বোঝা যায়। সারাজীবন পাঠক, সমালোচকদের কাছ থেকে সম্মান পাওয়া এবং গত এক দশকে ফণিভূষণ, মণিভূষণ, বিধুভূষণে ভূষিত কৃতীরা কিসের অনুপ্রেরণায় নিজের সাধনার চরম অসম্মানেও রা কাড়েন না – সে এক রহস্য। কিন্তু সে রহস্য বাদ দিয়েও পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্য কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং কোন পথে চলেছে তা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আলোচনা করার পরিস্থিতি তৈরি করে দিল মুখ্যমন্ত্রীকে পুরস্কার প্রদান। নিজেদের অজান্তে এই কাজটি করার জন্য হয়ত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিকে ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ বাংলার লেখক, প্রকাশক, পাঠক গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে বিলক্ষণ ভালবাসেন। নিজেদের দোষত্রুটি নিয়ে ভাবতে কেউ রাজি নন। বাংলা সাহিত্য একদিনে এতটা খেলো হয়নি। এই সুযোগে এ বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

রত্না রশিদ বলে এক সাহিত্যিক মুখ্যমন্ত্রীকে পুরস্কার দেওয়ার প্রতিবাদে নিজের পুরস্কার ফিরিয়ে দেবেন বলেছেন। তাতে তৃণমূল কংগ্রেস মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়ার কাটাছেঁড়া করলেই অনেকগুলি দিক বেরিয়ে আসবে। রত্নাকে ফালতু প্রমাণ করতে দেবাংশুর প্রথম যুক্তি, মমতা ব্যানার্জির বই বেস্টসেলার আর রত্নার বন্ধুবৃত্তেরও নব্বই শতাংশ লোকই তাঁর বইয়ের নাম বলতে পারবে না।

প্রথমত, বাংলার প্রকাশনা জগতের সার্বিক অডিট কে করে? একটি বই কত কপি বিক্রি হলে বেস্টসেলার হয়? আরও বড় প্রশ্ন – বেস্টসেলার মানেই ভাল সাহিত্য, এমনটা কে ঠিক করল? রত্নার বইয়ের নাম কজন জানেন তা দিয়ে কেন ঠিক হবে তিনি কেমন লেখেন? দেবাংশু মমতা ব্যানার্জির দলের লোক, তাই এই পুরস্কার প্রদানের পক্ষ নিয়ে যা পেরেছেন বলেছেন – এই যুক্তিতে তাঁর কথাগুলি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ বেস্টসেলার মানেই ভাল – এ ধারণায় আজকাল বেশিরভাগ পাঠক ভোগেন। প্রকাশকদের মধ্যেও বেস্টসেলার প্রকাশ করার হুড়োহুড়ি। বিপ্লব করে ফেলার প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাজারে নামা অনেক ছোট প্রকাশকও চটজলদি রোজগার এবং প্রকাশনা জগতে নাম করার তাগিদে জনপ্রিয় ফেসবুকারদের প্রচুর লাইক পাওয়া পোস্ট একত্র করে বই প্রকাশ করছেন। বেস্টসেলার বই করার তাগিদে কবিরা নিভৃতে সারস্বত সাধনা করার বদলে ফেসবুকেই পরের পর কবিতা প্রকাশ করছেন। এমনকি সাংবাদিকদের মত ঘটনাভিত্তিক কবিতা লিখছেন। বিখ্যাত মানুষদের জন্মদিনে, মৃত্যুদিনে কবিতা; কেউ মারা গিয়ে শ্মশানে পৌঁছবার আগেই কবিতা। সম্পাদনা রুগ্ন শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা লেখা হয় সবই প্রকাশযোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। ভুল, ঠিক বলে আর কিছু নেই। বিশিষ্ট লেখকদের পুরনো বইয়ের যেসব নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে দীর্ঘদিনের প্রকাশনা সংস্থা থেকে, সেগুলিতে নতুন নতুন বানান ভুল, যতিচিহ্নের যথেচ্ছ অন্তর্ধান এবং আবির্ভাব দেখা যাচ্ছে।

এর বিপরীতে ‘যাহা বেস্টসেলার, তাহাই বর্জনীয়’ ব্রিগেডও আছে। কোনো লেখকের বই ভাল বিক্রি হচ্ছে জানলেই তাঁরা নিশ্চিত হয়ে যান ওটি আদৌ সাহিত্য নয়। বেস্টসেলার আর লিটারেচার দুটি পৃথক বস্তু – এমন অভূতপূর্ব তত্ত্বও উঠে আসছে। শতাধিক বছরের শেক্সপিয়র চর্চা এই ফল দিচ্ছে জানলে গিরীশ ঘোষ, উৎপল দত্তরা কী করতেন কে জানে! অর্থাৎ প্রকারান্তরে বেস্টসেলার বিরোধীরাও বেস্টসেলার হওয়া বা না হওয়াকেই উৎকর্ষের মাপকাঠি বলে ধরছেন। এভাবে যে ভাষার সাহিত্য চলে, সেখানে আকাদেমি, পুরস্কার – এসব নিয়ে তো ভূতে ফুটবল খেলবেই।

দেবাংশু তাঁর পোস্টে এরপর যা লিখেছেন তা আরও গুরুতর। তিনি লিখেছেন ২০২১ সালে মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় না ফিরলে বাংলায় এন আর সি হত, রত্না রশিদকেও ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হত ইত্যাদি। অর্থাৎ মমতা বিজেপির ক্ষমতায় আসা আটকেছেন, তাই তাঁর সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্য। মানে সাহিত্য এমন একটি বিষয়, যার পুরস্কার আদৌ সাহিত্যচর্চা না করেও পাওয়া যেতে পারে। কোনো পুলিসকর্মী হয়ত ভাল গুন্ডা দমন করেন, তার পুরস্কার হিসাবেও সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে। এই যে সাহিত্যকে একটি বিশেষ কাজ, বিশেষ শৃঙ্খলা হিসাবে না ভাবা – এটিও কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখন দারুণ ‘কুল’। ২০১৪ সালে যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে হোক কলরব আন্দোলন চলছিল, তখন বাংলার সাংবাদিক কুলচূড়ামণি সুমন চট্টোপাধ্যায় ফেসবুকে লিখেছিলেন যাদবপুর এমন একটি জায়গা, যেখানে তুলনামূলক সাহিত্যের মত অর্থহীন বিষয় পড়ানো হয়। তিনি তবু সাহিত্যের বাইরের লোক, ইদানীং কবিরাও “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি” বললে রেগে যান। চিরকাল গরীব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ নিজেদের মত করে গান বাঁধেন, ছড়া কাটেন, শিল্প সৃষ্টি করেন – এই যুক্তিতে যে কেউ কবি হতে পারে এই যুক্তি দেওয়া হয়। যেন গরীব, খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে যাঁরা এসব করেন তাঁদের সৃজনে কোনো অধ্যবসায় নেই, কোনো শৃঙ্খলা নেই। যাঁরা ছৌ নাচেন তাঁদের যেন নাচ শিখতে হয় না, যেমন তেমন লম্ফঝম্প করলেই চলে। যাঁরা পটশিল্পী তাঁদের গল্পটি সযত্নে গড়ে তুলতে হয় না, ছবিগুলি ভেবেচিন্তে আঁকতে হয় না।

স্বতঃস্ফূর্ততা বলে এক আজব ধারণা তৈরি করা হয়েছে, যা কেবল কবিরা নয়, যাঁরা গল্প, উপন্যাস লেখেন তাঁরাও একমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিস বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। মনে যা এল তা-ই ঝটপট লিখে ফেলা যদি কবিতা বা সাহিত্য হয়, তাহলে সত্যিই মমতার “এপাং ওপাং ঝপাং”-কে কবিতা বলে স্বীকার করতে আপত্তি করা চলে না। অন্নদাশংকর রায়ের সৃষ্টি ছড়া আর মমতা ব্যানার্জির লেখা ছড়া নয়, তার সবচেয়ে বড় কারণ (আর কোনো কারণ দর্শানোর আদৌ প্রয়োজন নেই) যে প্রথমটিতে ছন্দ আছে, দ্বিতীয়টিতে ছন্দের হদ্দমুদ্দ হয়েছে – এ কথাও বলা উচিত নয়। কারণ ছন্দ তো স্বতঃস্ফূর্ত নয়, রীতিমত মাত্রা হিসাব করে অঙ্ক কষে মেলাতে হয়। ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর যখন থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কাব্যপ্রতিভা প্রকাশ পেয়েছে, তখন থেকে তাঁর লেখা এবং তদনুরূপ লেখা কবিতা হচ্ছে না বললে বা ব্যঙ্গ করলেই বলা শুরু হয়েছে, কবিতা লেখা কি ভদ্রলোকদের মনোপলি নাকি? সবার অধিকার আছে কবিতা লেখার। অর্থাৎ কবিতাকে ভদ্রলোক বনাম সাবল্টার্নের রণভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। রাজধানী নিবাসী, বরাবর ক্ষমতার বৃত্তে থাকা ব্রাহ্মণকন্যা কী করে সাবল্টার্ন হন সে প্রশ্ন থাক। কিন্তু সাবল্টার্ন হলেই যে যা-ই লিখুক তাকেই কবিতা বলতে হবে, এমনটা কি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক লিখেছেন? স্বীকার্য যে কবিতার কোনো সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। এমনকি অ্যান্টি-পোয়েট্রি বলেও একটি জিনিসের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু ব্যাকরণ ভাঙতে গেলে আগে তো ব্যাকরণ শিখতে হয়, সে ব্যাকরণ ভদ্রলোকদের তৈরি হলেও।

এসব বললে রে রে করে তেড়ে আসার মত লোক এখন পশ্চিমবঙ্গে কম নেই। এই ক্ষতির তুলনায় মুখ্যমন্ত্রীর হাতে সাহিত্য পুরস্কার তুলে দেওয়া সামান্য ক্ষতি। বস্তুত, ওই ক্ষতিগুলো আটকানো গেলে হয়ত এই ক্ষতি দেখতে হত না।

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত

আরও পড়ুন

পূজার ছলে তোমায় ভুলে