বেদি আর ববিকে ভোলা বিবেকের কাছে অপরাধ

ভারতীয় জোরে বোলারদের মধ্যে কপিলদেব নয়, যশপ্রীত বুমরাই গোট – একথাও এখনই বলা শুরু হয়ে গেছে। স্পিনারদের মধ্যে অশ্বিন গোট। ফলে বিষাণ সিং বেদিকে আর কে মনে রাখবে?

বিরাট কোহলি একটা করে শতরান করেন আর নতুন করে তর্ক শুরু হয় – সর্বকালের সেরা কে? কোহলি নাকি শচীন তেন্ডুলকর? চলতি বিশ্বকাপে বিরাট ইতিমধ্যেই একটা শতরান করে ফেলায় এবং আরেকটা শতরানেরও খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ায় সোশাল মিডিয়ায় দুজনের ভক্তরা এ নিয়ে ধুন্ধুমার চালিয়ে যাচ্ছেন। দুপক্ষই প্রধানত পরিসংখ্যানকেন্দ্রিক। ক্রিকেট খেলার পরিসংখ্যান আজকাল মোবাইল ফোনের কল্যাণে সকলের আঙুলের ডগায়। তার উপর ক্রিকেট যত বাড়ছে, পরিসংখ্যানগুলো তত ফুলে ফেঁপে উঠছে। ফলে ও নিয়ে তর্ক করাই সুবিধাজনক। যে কোনো খেলাই খেলে মানুষ। ফলে খেলার পরিবেশ, পরিস্থিতি, একজন খেলোয়াড়ের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা এবং অবস্থানের মত বিষয় যে পরিসংখ্যানের সমান, বা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়েও বেশি, গুরুত্বপূর্ণ তা বেশিরভাগ আলোচনাতেই উঠে আসে না। কেবল সাধারণ ভক্তরা নন, বিশেষজ্ঞরাও আজকাল এই দোষে দুষ্ট। ফলে যা সাম্প্রতিক তা-ই সবচেয়ে ভাল – এই অলিখিত বাক্যটা প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। GOAT (গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম) বলে একটা আশ্চর্য শব্দ দিনরাত ছোড়াছুড়ি হয় আজকাল। হয় কোহলি নয় তেন্ডুলকর গোট। ভারতীয় ক্রিকেটের বহু যুদ্ধের একক নায়ক সুনীল গাভস্করের নামও ক্রিকেটভক্তদের আলোচনায় ধারাভাষ্য বাদে আসে না আর। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেছে, তাই ভিভিয়ান রিচার্ডসের মত ব্যাটারও আলোচনার বাইরে। ভারতীয় জোরে বোলারদের মধ্যে কপিলদেব নয়, যশপ্রীত বুমরাই গোট – একথাও এখনই বলা শুরু হয়ে গেছে। স্পিনারদের মধ্যে অশ্বিন গোট। ফলে বিষাণ সিং বেদিকে আর কে মনে রাখবে?

ভারতের বিখ্যাত স্পিন চতুষ্টয়ের অন্যতম এবং প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক, জাতীয় দলের প্রাক্তন কোচ বেদি ক্রিকেট বিশ্বকাপের মধ্যে মারা গেলেন। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচের আগে এক মিনিট নীরবতা পালন হয়নি, কোনো দলের ক্রিকেটার কালো আর্মব্যান্ড পরে মাঠে নামেননি। হয়ত আগামী রবিবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে রোহিত শর্মারা সে কাজটা করবেন। কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিত ভারতীয় বোর্ড চাইলে অন্য দলগুলোও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে দ্বিধা করত না। কেনই বা করবে? ক্রিকেটের সমঝদারদের কাছে বেদির এখনো যথেষ্ট দাম আছে। ইয়ান চ্যাপেল, জিওফ্রে বয়কটরা এখনো বোঝেন বেদির ২৬৬টা টেস্ট উইকেটের মূল্য। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর ঝুলিতে ১,৫৬০টা উইকেট। অথচ নিজের দেশের ক্রিকেটভক্তরাই বেদিকে ভুলে বসে আছেন।

সেদিক থেকে ববি চার্লটন ভাগ্যবান। ইংল্যান্ডের একমাত্র বিশ্ব ফুটবল খেতাব জয়ের অন্যতম স্থপতির নামও যে ইদানীংকালের ইংল্যান্ড সমর্থক বা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের তরুণ ভক্তরা দিনরাত আলোচনা করেন তা নয়। কিন্তু ও দেশের খেলাধুলোর সংস্কৃতি আলাদা। এখানকার মত রাজনৈতিক নেতাদের নামে স্টেডিয়াম হয় না চট করে, স্টেডিয়ামের বাইরে মূর্তি বসানো হয় প্রবাদপ্রতিম খেলোয়াড়দের। তাই ববির মৃত্যুর পর তাঁর ক্লাব ইউনাইটেড চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচের সাংবাদিক সম্মেলনের আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছে। আরও নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা রয়েছে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ফুটবলপ্রেমীরা লাইন দিয়ে ফুলের তোড়া হাতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন। এক ভক্ত তো তাঁর মূর্তি বেয়ে উঠে গলায় পর্যন্ত শ্রদ্ধাজ্ঞাপনকারী স্কার্ফ জড়িয়ে দিয়েছেন।

ববি বা বেদি এক অন্য জগতের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁরা সারাজীবনে শুধু খেলোয়াড় হিসাবে যা আয় করেছেন, আজকের লায়োনেল মেসি বা কোহলি সম্ভবত এক দিনে তা আয় করেন। কিন্তু তাঁরা কিছু আদর্শ নিয়ে চলতেন। বেদি যেমন শুধু স্পিনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন বলেই স্মরণীয় নন। ১৯৭৬ সালে কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে অধিনায়ক বেদি মাত্র ৩০৬ রানে ছয় উইকেট পড়ার পরেই ইনিংসের সমাপ্তি ঘোষণা করে দেন। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা ভারতীয় ব্যাটারদের আউট করতে নয়, আহত করতে নেমেছিলেন। যা বিশ্বাস করেন তা নিয়ে অকপট থাকা ববিরও অভিজ্ঞান। নিজের যোগ্যতা নিঃসংশয়ে প্রমাণ করার পরেও তিনি বলতেন, ১৯৫৮ সালের মিউনিখ বিমান দুর্ঘটনায় ম্যাট বাজবির সোনার ছেলেরা মারা না গেলে তিনি বড় ফুটবলার হয়ে উঠতেন না।

আরও পড়ুন বেলা ফুরোতে আর বসে রইলেন না শেন ওয়ার্ন

আজকাল অনেক প্রিয় খেলোয়াড়ের মাঠের বাইরের আচরণ আমাদের আহত করে। কারণ দেখা যায়, মাঠে দারুণ লড়াকু আমাদের নায়ক মাঠের বাইরে ক্ষমতার সামনে একেবারে নতজানু। এঁরা কিন্তু কাঁড়ি কাঁড়ি উইকেট নিলে বা ঝুড়ি ঝুড়ি রান করলেও শিরদাঁড়ার দিক থেকে বেদির ধারেকাছে আসতে পারবেন না। আজীবন দিল্লিতে ক্রিকেট খেলা, দিল্লির হয়ে দুবার রঞ্জি ট্রফি খেতাব জেতা বেদির নামে ফিরোজ শাহ কোটলার একটা স্ট্যান্ডের নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু কর্মকর্তারা যেই স্টেডিয়ামের নাম বদলে অরুণ জেটলি স্টেডিয়াম করে দিলেন, আর কেউ কোনো প্রতিবাদ না করলেও বেদি কর্তাদের চিঠি দিয়ে জানান তাঁর নামাঙ্কিত স্ট্যান্ডটার নাম যেন বদলে দেওয়া হয়। দিল্লির ক্রিকেট সংস্থার সদস্যপদও তাঁর আর দরকার নেই। ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজনকে কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমী যেন স্মরণে রাখেন, তার জন্যে যে বোর্ডের দিক থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেই তার কিন্তু এটাও অন্যতম কারণ। বেদিকে মনে থাকলেই তো এসবও মনে থাকবে ভক্তদের।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: