শুধু কুস্তির পদক নয়, দেবতার গ্রাসে আজ সবার সন্তান

যেমন সৌরভ গাঙ্গুলি, তেমন এম সি মেরি কম আর পিটি ঊষা। তাঁরা নিজেদের পদক জেতার কষ্ট বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সহখেলোয়াড়দের কষ্ট যে বোঝেন না তা তো দেখাই যাচ্ছে।

অলিম্পিক নয়, এশিয়ান গেমস নয়, কমনওয়েলথ গেমস নয়, এমনকি সাফ গেমসও নয়। স্রেফ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে জেতা একখানা পদকের পিছনেও কত বছরের পরিশ্রম, কত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ত্যাগস্বীকার থাকে তা যে কোনো ক্রীড়াবিদকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। আরও বেশি করে টের পাওয়া যায় একটুর জন্য পদক জিততে পারেননি যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে কথা বললে। প্রয়াত মিলখা সিং জানতেন, কলকাতার ছেলে জয়দীপ কর্মকার জানেন, আগরতলার মেয়ে দীপা কর্মকারও জানেন সারাজীবনের পরিশ্রমের পর তীরে এসে তরী ডুবলে কেমন লাগে। অথচ গোটা দুনিয়ায় চতুর্থ হওয়াও সারাজীবনের সাধনা ছাড়া সম্ভব নয়।

সেই ১৮৯৬ সালে শুরু হয়েছিল আধুনিক অলিম্পিক। সোয়াশো বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। অথচ হকি দলের পদকগুলো বাদ দিলে কতজন ভারতীয় অলিম্পিক পদক জিতেছেন তা আজও এক হাতের কড়ে গুনে ফেলা যায়। এ দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয় যে ১৪ বছরের বাচ্চা মেয়ে শ্যানন মিলার একটা অলিম্পিক থেকেই পাঁচটা পদক জিতে নেবেন বা একা মাইকেল ফেল্পসের আলমারিতেই থাকবে প্রায় আড়াই ডজন অলিম্পিক পদক। দেশটা চীনও নয় যে ছোটবেলা থেকে পদকজয়ী অলিম্পিয়ান তৈরি করতে যত্ন নেবে দেশের সরকার। এমন দেশের ক্রীড়াবিদরা যখন ঠিক করেন আন্তর্জাতিক স্তরে জেতা পদক জলে ফেলে দেবেন, তখন বুঝতে হবে পৃথিবীর সব রং মুছে গেছে তাঁদের চোখের সামনে থেকে। সূর্য নিভে গেছে।

‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় যে মা রাগের মাথায় সন্তানকে বলে ফেলেছিলেন “চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে”, নিজের কথা কানে যেতে যে অনুতাপবাণে তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠেছিল, একজন পদকজয়ী ক্রীড়াবিদের “মেডেল গঙ্গায় ফেলে দেব” বলার সময়ে তার চেয়ে কম যন্ত্রণা হয় না। কারণ একটা পদক জিততে হলে সন্তান পেটে ধরার মতই দীর্ঘ শারীরিক ও মানসিক বেদনা সহ্য করতে হয়। ভারতের কুস্তিগীররা, বিশেষ করে মহিলা কুস্তিগীররা, আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তা বুঝতে চাইলে আগে এই কথাটা স্পষ্ট বোঝা দরকার।

ক্রীড়াবিদরা সফল হওয়ার পরে সমস্ত আলো তাঁদের উপর এসে পড়ে। সাফল্যের পথটার উপরে আলো ফেলা হয় না সচরাচর। ফলে স্বীকার্য যে পদক জয়ের সলতে পাকানোর পর্ব খুব বেশি মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু যাঁরা মতি নন্দীর কাহিনি অবলম্বনে সরোজ দে পরিচালিত কোনি বা শিমিত আমীন পরিচালিত চক দে ইন্ডিয়া দেখেছেন, তাঁদের বলে দিতে হবে না যে স্রেফ প্রতিভায় চিঁড়ে ভেজে না। পেশাদার খেলোয়াড়ের জীবন বস্তুত ব্যথার পূজা। এমন ভয়ঙ্কর ব্যথা, যে খেলার জগতের বাস্তবতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকা কিছু ফিল্ম সমালোচকের মনে হয়েছিল, গীতা ও ববিতা ফোগত এবং তাঁদের বাবা মহাবীর ফোগতের জীবন নিয়ে তৈরি দঙ্গল ছবিতে নারীত্বের অবমাননা দেখানো হয়েছে। মহাবীর মেয়েদের উপরে নিজের মতামত চাপিয়ে দিয়েছেন, সেখানে ‘ফিমেল এজেন্সি’-র অভাব ইত্যাদি। এঁরা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁশ নিয়ে তাড়া করার দৃশ্য সম্পর্কে কী ভাবেন কে জানে! যা-ই ভাবুন, পৃথিবীর সমস্ত ক্রীড়াবিদের সাফল্য ওই পথেই এসেছে। নির্মম মমতা ছাড়া সফল ক্রীড়াবিদ হওয়া যায় না।

তাহলে ভাবুন, পছন্দের খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে, নিজের বয়সী আর পাঁচটা ছেলেমেয়ের মত আনন্দ ফুর্তি বাদ দিয়ে, কোচের চোখরাঙানি হজম করে, খাটতে খাটতে আধমরা হয়ে গিয়ে যে পদক জেতেন একজন ক্রীড়াবিদ – সেই পদক বিসর্জন দিতে চান কোন অসহায়তায়।

ভিনেশ ফোগত, সঙ্গীতা ফোগত, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়ারা সেই অসহায়তায় পৌঁছেছেন। আপাতত হরিয়ানার কৃষক নেতাদের অনুরোধে গঙ্গায় পদক বিসর্জন দেওয়ার পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু কী হবে পাঁচদিন পরে?

হবে অশ্বডিম্ব – এই মনোভাব নিয়েই এই ইস্যুতে এখন পর্যন্ত চলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। তাই এই চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয়েছে আমাদের কুস্তিগীরদের। সাধারণভাবে একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশের ক্রীড়াবিদদের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, ভারতের ক্রীড়াবিদদের ঘাড়ে সেসব তো আছেই। আছে একগাদা উপরি পাওনাও। বরাবরই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদদের মেজাজ মর্জি অনুযায়ী চলতে হয় তাঁদের। দেশের আর সবকিছুর মত খেলার জন্য বরাদ্দ টাকাও চলে যায় কর্মকর্তাদের পকেটে। আর কিছু মনে না থাকলেও কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি আর সুরেশ কালমাদির কথা কার না মনে আছে? ফলে অনেকেরই ধারণা ছিল, প্রাক্তন খেলোয়াড়দের খেলা চালানোর দায়িত্ব দিলে সব ম্যাজিকের মত বদলে যাবে। ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি, ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের দুর্নীতি – সবই আদালত পর্যন্ত গড়ানোর ফলে এসে পড়েছিল সেই সুযোগ। কিন্তু মোদী সরকারের আমলে দেখা গেল, রাজনীতিবিদদের বশংবদ প্রাক্তন খেলোয়াড়রা কিছু কম যান না। যেমন সৌরভ গাঙ্গুলি, তেমন এম সি মেরি কম আর পিটি ঊষা। তাঁরা নিজেদের পদক জেতার কষ্ট বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, কিন্তু সহখেলোয়াড়দের কষ্ট যে বোঝেন না তা তো দেখাই যাচ্ছে।

ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে প্রথম যখন লাগাতার যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন ভিনেশ, সাক্ষীরা – তখন একটা ওভারসাইট কমিটি গড়ে দেওয়া হয়েছিল, যার কর্ণধার ছিলেন মেরি কম এবং আরেক অলিম্পিক পদকজয়ী কুস্তিগীর যোগেশ্বর দত্ত। সেই কমিটি অশ্বডিম্বই প্রসব করেছিল। নইলে যন্তর মন্তরে ধরনায় বসতেই হত না সাক্ষীদের।

মেরি কম, ঊষারা একে খেলোয়াড় তায় মহিলা। তবু তাঁরা যৌন হয়রানির অভিযোগকে পাত্তা দিচ্ছেন না, ভিনেশদের চোখের জলের দাম তাঁদের কাছে মিনারেল ওয়াটারের চেয়ে বেশি নয়। হয়ত ব্রিজভূষণের মত তাঁরাও মনে করেন ওসব পদকের দাম ১৫ টাকা। নতুন সংসদ ভবনের বর্ণাঢ্য উদ্বোধন নির্বিঘ্ন করতে কুস্তিগীরদের উপর পুলিসি আক্রমণ সম্পর্কে তাঁদের নীরবতা, ব্রিজভূষণের প্রতি মৌন সমর্থন প্রমাণ করে ক্ষমতার মদের নেশা অন্য সব নেশার চেয়ে কড়া। হাজার হোক, মেরি কম মণিপুরের নির্বাচনে বিজেপির তারকা প্রচারক ছিলেন। যোগেশ্বর তো রীতিমত বিজেপি দলের সদস্য। অর্থাৎ ভারতের ক্রীড়াপ্রেমীদের অরাজনীতির সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল।

কুস্তিগীরদের প্রতি সহানুভূতিশীল অনেকেরও রাজনীতি ব্যাপারটা প্রবল অপছন্দ। তাঁরা কোমলমতি। শাসক দলের সাংসদ যৌন হয়রানির একাধিক অভিযোগ সত্ত্বেও গ্রেফতার হন না, সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ না করলে, অলিম্পিক পদকজয়ীরা ধরনায় না বসলে এফআইআর পর্যন্ত দায়ের হয় না। তবু বিরোধী দলের নেতারা কুস্তিগীরদের পাশে দাঁড়ালে কোমলমতি ক্রীড়াপ্রেমীরা নাক কোঁচকান। তাঁদের জন্য উল্লেখ থাক, আজকের অপমানিত কুস্তিগীররা কিন্তু কখনো অরাজনৈতিক ছিলেন না। ২০১৪ সালের পর থেকে চালু হওয়া ধারা অনুযায়ী তাঁরা সোশাল মিডিয়ায় মোদী সম্পর্কে এবং তাঁর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ছিলেন দীর্ঘকাল। হিন্দুত্বের রাজনীতিও তাঁদের অনেকেরই পছন্দের। মে মাসের গোড়ার দিকেও বজরং ইনস্টাগ্রামে বজরং দলকে সমর্থন করে পোস্ট করেছিলেন, পরে মুছে দেন।

তা বলে বজরংদের এই আন্দোলনকে বাঁকা চোখে দেখার কোনো কারণ নেই। হরিয়ানার রক্ষণশীল, খাপ পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রিত সমাজ থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের ফ্যাসিবাদের ক্রীড়নক হয়ে যাওয়া খুব আশ্চর্যের নয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের জাতিভুক্ত এবং সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনী সৌরভেরই যদি অমিত শাহের অনুগ্রহে আপত্তি না থাকে তো বজরংদের দোষ কী? কে লড়ছেন তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন দাবিতে লড়ছেন। যে দেশের মেয়েদের ছোট থেকে নিকটাত্মীয়ের হাতে যৌন হয়রানি অভ্যাস করে নিতে হয়, ধর্ষক বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর অত্যাচারিত মেয়েটির পরিবার লোকলজ্জায় মুখ লুকোয় – সে দেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মহিলা ক্রীড়াবিদরা তাঁদের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছেন; পাশে রয়েছেন পুরুষ ক্রীড়াবিদরা – একে ঐতিহাসিক বলে মানতেই হবে। কর্পোরেট পেশাদার মহিলারাও জানেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগুলো বহু জায়গাতেই এখনো দায়সারা। এই আন্দোলন তেমন অনেক কর্তৃপক্ষকেই তটস্থ করে তুলছে। ইতিমধ্যেই এসে পড়েছে কুস্তির আন্তর্জাতিক নিয়ামক সংস্থার হুঁশিয়ারি।

আরও পড়ুন কুস্তিগীরদের আন্দোলন: মহাতারকাদের মহাকাপুরুষতা

বিজেপির রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির চেয়ে এসব অনেক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। যদিও রাকেশ ও মহেশ টিকায়েতের মত খাপ পঞ্চায়েতের নেতার উপস্থিতি, বরাবরের বিজেপি সমর্থক ফোগত পরিবারের প্রধান মহাবীরের বিবৃতি এবং হরিয়ানার বিজেপি নেতাদের উল্টো গাওয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এ ব্যাপারে রাজনৈতিকভাবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে। মোদীর দেবতাপ্রতিম ভাবমূর্তি বিশেষ কাজে আসছে না।

অনির্বাচিত মনুবাদী সাধুসন্তরা ঢুকে পড়েছেন ভারতের সংসদে, অযোধ্যার মহন্তরা অপ্রাপ্তবয়স্কদের যৌন আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে যে আইন (Protection of Children from Sexual Offences Act, 2012) আছে তা বদলানোর দাবিতে সভা করতে চলেছেন ব্রিজভূষণের সমর্থনে। বলা বাহুল্য, তাঁদের কথার ওজন আজকের ভারত সরকারের কাছে অসীম। ফলে সরকার যে তাঁদের প্রণাম জানিয়ে অর্ডিন্যান্স এনে আইন বদলে ফেলবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা ঘটলে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পারবে আমাদের সকলের সন্তানের ধর্ষকরা। সুতরাং ভিনেশ, সাক্ষী, বজরংদের লড়াই এখন শুধু পদকজয়ী ক্রীড়াবিদদের লড়াই নয়, সমস্ত ভারতীয়ের লড়াই। সব মেয়েকে, সব শিশুকে দেবতার গ্রাস থেকে বাঁচানোর লড়াই।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: