ইতিহাসের হদ্দমুদ্দ ও আধসেদ্ধ মার্কসবাদে চিঁড়েচ্যাপটা ব্যোমকেশ

ইদানীং পশ্চিমবাংলার সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে প্রবল ইতিহাসপ্রীতি তৈরি হয়েছে। ফলে ইতিহাসাশ্রিত গল্প, উপন্যাস, ছায়াছবি, ওয়েব সিরিজের আধিক্য। ইতিহাসের প্রেমে গুণী বাঙালিরা এতই ডগমগ যে গোয়েন্দা কাহিনি নিয়ে ছবিও তৈরি করা হচ্ছে পিরিয়ড পিস হিসাবে। সেই কাহিনিগুলির মধ্যে আবার পরিচালকদের বিশেষ পছন্দ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা ব্যোমকেশ বক্সীকে। ইতিহাস শরদিন্দুর অতি প্রিয় লেখার বিষয়। একাধিক ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন, ঐতিহাসিক গল্পও লিখেছেন অনেকগুলি। ব্যোমকেশের গল্প, উপন্যাসেও ইতিহাস টেনে এনেছেন অনেক জায়গাতেই। তেমনই একটি উপন্যাস দুর্গরহস্য। টালিগঞ্জ পাড়ার রাঘব বোয়ালদের ইতিহাসপ্রীতি ও গোয়েন্দাপ্রীতির ঠ্যালায় একই বছরে সেই দুর্গরহস্য নিয়ে দু-দুটো ছবি (একটি বড় পর্দার জন্যে, অন্যটি ওয়েব সিরিজ হিসাবে) তৈরি হয়ে গেল। ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে বাংলা ছবির যা অবস্থা তাতে দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী (২০১৫) ছবির মত নিখুঁত সেট তৈরি করে যে সময়কাল দেখানো হচ্ছে তখনকার কলকাতা শহর বানিয়ে ফেলা অসম্ভব। কারণ অত রেস্ত নেই। তা সত্ত্বেও টালিগঞ্জের অকুতোভয় পরিচালকরা পিরিয়ড পিস বানিয়ে চলেছেন। ব্যাপারটি খুবই প্রশংসাযোগ্য হতে পারত, যদি ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে গেলে ইতিহাস যে মন দিয়ে পড়তেও হয় – একথা তাঁরা মাথায় রাখতেন। সচরাচর রাখেন না, হইচই অ্যাপে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত দুর্গ রহস্য (উপন্যাসের নামটিকে দুই শব্দে ভাঙার নিশ্চয়ই কোনো গূঢ় তাৎপর্য আছে যা প্রাজ্ঞ দর্শক ধরে ফেলবেন) ওয়েব সিরিজের পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ও রাখেননি।

শিল্পীর স্বাধীনতা প্রয়োগ করে উপন্যাসের ঘটনাবলীকে তিনি বিশ শতকের প্রথমার্ধের বদলে ছয়ের দশকে স্থাপন করেছেন, যখন পশ্চিমবঙ্গ তথা সাঁওতাল পরগণায় নকশালবাড়ি আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। এতে অসুবিধা ছিল না, গোলমাল বেধেছে যেখানে উপন্যাসের অনুসরণেই সিপাহী বিদ্রোহ দেখানো হয়। সেই অংশে দুর্গ দখল করে নেওয়া সিপাহীদের দলের নেতা এক বাঙালি। ইতিহাস বলছে ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডের হাত দিয়ে শুরু হয়ে থাকলেও বাংলায় সিপাহী বিদ্রোহ বিশেষ প্রভাব ফেলেনি। তবু শিল্পীর স্বাধীনতার খাতিরে বাঙালি নেতাকে না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু সেই নেতা ১৮৫৭ সালে বসে “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” বলেন কী করে? একথা সর্বজনবিদিত যে ওই স্লোগানটির উৎস ফরাসী বিপ্লবের ‘ভিভা লা রেভল্যুসিওন’। ওই স্লোগান ভারতে এসে হসরত মোহানির কল্যাণে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’-এ পরিণত হয় বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ভারতীয় বামপন্থীদের লব্জে। আর সব স্লোগানের মতই ওই স্লোগানকে জনপ্রিয় করে তোলায় অনেকের ভূমিকা আছে, যাঁদের মধ্যে ভগৎ সিংও একজন। বাংলা ভাষায় ওই স্লোগান নিজস্ব চেহারা পেয়েছে হয় একই সময়ে অথবা আরও পরে। সিপাহী বিদ্রোহ তো এসবের ৭০-৮০ বছর আগেকার কথা। সেই বিদ্রোহের নেতার মুখে “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” স্লোগান মেনে নেওয়া যায় বামপন্থীদের ব্যঙ্গ করে তৈরি কোনো ওয়েব সিরিজে, পিরিয়ড পিসে নয়।

পরিচালক শুধু ইতিহাসের হদ্দমুদ্দ করলেও কথা ছিল, এই স্লোগানটি ব্যবহার করে তিনি রাজনীতিরও সাড়ে বারোটা বাজিয়েছেন। কারণ কোনো মতের ঐতিহাসিকই সিপাহী বিদ্রোহের কোনো বিপ্লবী উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করেননি। জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন “এই সিদ্ধান্ত এড়ানো শক্ত যে তথাকথিত প্রথম জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ না প্রথম, না জাতীয়, না স্বাধীনতার যুদ্ধ।” [ভাষান্তর আমার] রমেশচন্দ্রের ইতিহাস পাঠ অবশ্য মার্কসবাদীদের সঙ্গে মেলে না, আর সৃজিত এই ছবিতে প্রবল মার্কসবাদী (হয়ত মৃণাল সেনের বায়োপিক তৈরির মহড়া হিসাবে)। কিন্তু মার্কসবাদী হলে তো ‘বিদ্রোহ’ আর ‘বিপ্লব’ শব্দদুটির অর্থগত ফারাক বোঝা উচিত। বিশেষত মার্কসবাদীরা বিপ্লব বলতে যা বোঝেন তার সঙ্গে সিপাহী বিদ্রোহের লক্ষ্য যে একেবারেই মেলে না, সেকথা বোঝাও খুব শক্ত নয়। সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ ছিলেন লর্ড ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির ফলে শাসনক্ষমতা হারানো বা কোণঠাসা হয়ে যাওয়া রাজন্যবর্গ। ওই বিদ্রোহের অন্যতম ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। স্কুলপাঠ্য ইতিহাস বইয়ের এই তথ্যগুলি জানলেও বোধহয় নকশাল আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল পরিচালক ওই স্লোগান সিপাহীদের মুখে বসাতেন না। পড়াশোনা করার সময় না থাকলে সত্যজিৎ রায়ের শতরঞ্জ কে খিলাড়ি (১৯৭৭) ছবিটা দেখে নিলেও চলত। সত্যজিৎ অ্যানিমেশন ব্যবহার করে প্রায় শিশুদের বোঝার যোগ্য করে ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতি এবং তার ফলাফল বুঝিয়েছেন। কোথায় ইংরেজদের তাড়িয়ে দেশিয় রাজন্যবর্গের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার বিদ্রোহ আর কোথায় জোতদার জমিদার উচ্ছেদ করতে, ভারতে সমাজবিপ্লব আনতে নকশালবাড়ি আন্দোলন!

অবশ্য এই ওয়েব সিরিজের পরিচালক সত্যজিতের ছবি দেখতে যাবেন কোন দুঃখে? তিনি তো গোড়াতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তিনি সত্যজিতের প্রতিস্পর্ধী। তাঁর ব্যোমকেশও (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) স্বয়ং উত্তমকুমারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ তার গিন্নী সত্যবতী (সোহিনী সরকার) আর বন্ধু অজিতকে নিয়ে চিড়িয়াখানা (১৯৬৭) ছবিটি দেখতে গেছে। তারপর অজিত (রাহুল অরুণোদয় ব্যানার্জি) বেরিয়ে এসেই রেগেমেগে ঘোষণা করে দেয় যে সে আর কোনোদিন সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ – কাউকেই ব্যোমকেশ নিয়ে ছবি করতে দেবে না। কারণ সত্যজিৎ ব্যোমকেশকে চশমা পরিয়েছেন। এতদ্বারা সৃজিত আগের সবকটি সিজনের চশমা পরা ব্যোমকেশ অনির্বাণের চশমা হরণের একটি যুক্তি খাড়া করলেন (এত বকবকানির পরেও একটি বাহারি রোদচশমা কিন্তু পরানো হয়েছে)। এই কর্মটি ছাড়া, আর অনির্বাণকে উত্তমকুমারের সঙ্গে এক ফ্রেমে দাঁড় করিয়ে বাঙালির নস্ট্যালজিয়ায় সুড়সুড়ি দেওয়া ছাড়া, ওই দৃশ্যের আর যে কী সার্থকতা তা ছটি পর্বের আগাপাশতলা দেখেও বোঝা গেল না। পরিচালকের কেন যে মনে হল বাংলা ছবির প্রবাদপ্রতিম পরিচালকদের একালের লোকেদের মত গোয়েন্দা গল্প নিয়ে ছবি করার উৎসাহ ছিল – তাও বোঝা শক্ত। ইতিহাস তো বলছে সত্যজিৎ চিড়িয়াখানা ছবিটিও বানিয়েছিলেন তাঁর ইউনিটের দীর্ঘকালীন সহকর্মীরা বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন বলে। এমনকি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে বলতে শুনেছি, জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯) ছবিটিও সত্যজিৎ করেছিলেন বিশেষ প্রয়োজনে। একমাত্র সোনার কেল্লা (১৯৭৪)-ই ভালবেসে তৈরি করা। ইতিহাসের কথা আর না বাড়ানোই ভাল, কারণ ওটি কোনোকালেই সৃজিতের জোরের জায়গা নয়। অনতি অতীতে দার্জিলিং দেখাতে গিয়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের ভুল পতাকা দেখিয়ে ফেলেছিলেন, আটের দশকের কলকাতা বিমানবন্দরে ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার পোস্টার দেখিয়েছিলেন। গুমনামী নামের আস্ত ছবিটিই তো অনুজ ধর নামক এক ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিককে ঐতিহাসিক বানিয়ে করা। পরে সত্যিকারের ঐতিহাসিক সুগত বসুর মুখোমুখি হয়ে ছবির ইতিহাসের দিকটি সম্পর্কে উত্তর দিতে গিয়ে সৃজিত বিস্তর খাবি খেয়েছিলেন। অতএব এই ওয়েব সিরিজের অন্য দিকগুলি নিয়ে কথা বলা যাক।

সত্যতা থাকুক আর না থাকুক, তেলেভাজার দোকান সম্পর্কে একটি কথা খুব চালু। দোকানিরা নাকি একই তেলে দিনের পর দিন চপ, বেগুনি ইত্যাদি বানিয়ে যায়। সৃজিতের বরাবরের মুনশিয়ানা এই কাজটিতে। তিনি বিদেশি ছবির, জনপ্রিয় পুরনো বাংলা ছবির, অধুনা নিজের ছবিরও রিমেক, সিকুয়েল, প্রিকুয়েল ইত্যাদি বানাতে ওস্তাদ। তিনি পুরনো তেলেই ঈষৎ পরিবর্তিত রন্ধন প্রণালীতে তেলেভাজা বানান মাত্র কয়েক মাসে আর দর্শক তা লাইন দিয়ে খায় – এই হল তাঁর সাফল্যের ইতিহাস। তা দুর্গ রহস্যে কী কী পরিবর্তন এল? প্রথমত, সত্যবতীকে দিয়ে বেশকিছু নারীবাদী সংলাপ বলানো হল। অগাস্ট মাসে মুক্তি পাওয়া বিরসা দাশগুপ্তের ব্যোমকেশ ও দুর্গরহস্য ছবির মতই এখানেও সত্যবতী শরদিন্দুর অভিপ্রায় অনুযায়ী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় দাদা সুকুমারের জিম্মায় না থেকে, ব্যোমকেশ আর অজিতের সঙ্গে রহস্যের অকুস্থলে গেছে। শুধু তাই নয়, বিরসা গর্ভবতী সত্যবতীকে দুর্গে পাঠিয়েছিলেন একেবারে শেষে। সৃজিতের সত্যবতী আরও তেজিয়ান, তার ব্যোমকেশের প্রতি প্রেম আরও প্রবল। তাই সে গর্ভাবস্থাতেও দুর্গে পৌঁছে যায়। বিরসা একটি অহেতুক রবীন্দ্রসঙ্গীত ঢুকিয়েছিলেন ব্যোমকেশ-সত্যবতীর প্রেম বোঝাতে, সৃজিত সঙ্গীতের সঙ্গে লাজুক যৌনতাও এনেছেন। স্বদেশ মিশ্র রচিত, তমালিকা গোলদার সুরারোপিত গানের মধ্যে দিয়ে সেসব এমনি এমনি এসেছে। সবই ঠিক ছিল, কেবল প্রসববেদনা ওঠার পরে নারীবাদী সত্যবতী কেন দুম করে সেকালের রাজপুত মহিলাদের মত “আগে ধর্ম, তারপর সহধর্মিণী। আগে সত্য, তারপর সত্যবতী” বাণী দিয়ে দিল তা দুর্বোধ্য। এই ওয়েব সিরিজের পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা সৃজিত একজন পুরুষ। ফলত প্রসববেদনা অনুভব করা তাঁর পক্ষে যে সম্ভব নয় তা জানা কথা। কিন্তু সংবেদনশীলতা বলে একটি জিনিস আছে, যা যে কোনো মাধ্যমের শিল্পী হওয়ার প্রাথমিক শর্ত। সেটুকু থাকলেই বোঝা যায়, গর্ভধারণের শেষ পর্যায়ে যখন ব্যথার চোটে ঘাম দিচ্ছে, তখন একজন গর্ভবতীর পক্ষে দার্শনিক হয়ে ওঠা অসম্ভব। তবে রদ্দি হিন্দি ছবির নায়ক-নায়িকাদের বেদনা সহ্য করার ক্ষমতা অন্য স্তরের। সেই কবে আমরা অমিতাভ বচ্চনকে দেখেছি, অমৃতা সিং অনবরত চাবুক মেরে যাচ্ছেন, ক্ষতে নুন ছড়িয়ে মারছেন, তবুও অমিতাভ অনড়। অমৃতা রাগে গরগর করতে করতে জিজ্ঞেস করলেন, কী হল? ব্যথা লাগছে না? অমিতাভ উত্তর দিলেন “মর্দ কো দর্দ নহি হোতা।” সৃজিত যদি সত্যবতীর চরিত্রটি সেই আদর্শে লিখে থাকেন, তাহলে অবশ্য কিছু বলার নেই। তবে কিনা ওইরকম অতিনাটকীয় সংলাপ হিন্দি ছবিতেও লেখা হয় না আজ বিশ বছর।

হিন্দি ওয়েব সিরিজে আজকাল নায়িকা হয় মারকুটে পুলিস অফিসার (দহাড় সিরিজে সোনাক্ষী সিনহা)। সে বিয়ে করতে চায় না, কিন্তু প্রেমিকের সঙ্গে নিয়মিত যৌনতা নিয়ে অপরাধবোধ নেই। গর্ভসঞ্চার আটকাতে গর্ভনিরোধক পিল খেয়ে নেয়। প্রেমিক অন্য শহরে চলে গেলে সেই সম্পর্ক যে রাখা সম্ভব হবে না তা মুখোমুখি বলে দিতেও সংকোচ বোধ করে না। মেয়ে গোয়েন্দা (চার্লি চোপড়া অ্যান্ড দ্য মিস্ট্রি অফ সোলাং ভ্যালি ওয়েব সিরিজে ওয়ামিকা গাব্বি) প্রেমিকের সঙ্গে যৌনতার ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেলে প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে দেয়, অপমানে কান্নাকাটি করে। কিন্তু কয়েকদিন পরেই ফের সেই খুনের তদন্তে নেমে পড়ে, যাতে প্রেমিকটি বিনা দোষে অভিযুক্ত। কারণ কেসের নিষ্পত্তি না করে সে ছাড়বে না। এইসব করতে এই চরিত্রগুলিকে নারীবাদী বুলি আওড়াতে হয় না। তবে পুরনো তেলে চপ ভেজে গেলে অমন চরিত্র তৈরি করা সম্ভব হয় না।

শরদিন্দুর কাহিনিতে আরও একটি স্বকীয় মোচড় একেবারে শেষে দিয়েছেন সৃজিত, তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্পয়লার দেওয়া হয়ে যাবে। শুধু এটুকু বলা যাক, যে ও জিনিসও একমাত্র রদ্দি বলিউডি ছবিতেই সম্ভব। বিরসা আর সৃজিত – দুজনের কেউই নিজস্ব মোচড় দিয়ে শরদিন্দুর চেয়ে উন্নত ক্লাইম্যাক্স তৈরি করতে পারেননি। কেবল পরিবর্তনের স্বার্থে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। শরদিন্দুর খলনায়কদের যে মেধা, যে কুটিলতা থাকে, সৃজিতের খলনায়কে তাও ফোটেনি। চিত্রনাট্যে সে সুযোগই রাখা হয়নি। এত দ্রুত ভাজতে হলে হয়ত তেলেভাজার স্বাদে অত সূক্ষ্মতা আনাও যায় না। মা দুর্গার মত দশখানা হাত না থাকা সত্ত্বেও এক পুজোয় সৃজিত দুখানা ছবি বাজারে নামিয়ে দিলেন (বড় পর্দায় দশম অবতার, ওটিটিতে আলোচ্য ওয়েব সিরিজটি) – এতেই বোধহয় আমাদের কৃতার্থ থাকা উচিত। মণিলাল চরিত্রের অভিনেতা দেবরাজ ভট্টাচার্যের বেশভূষা অবিকল বল্লভপুরের রূপকথা ছবিতে তাঁর চরিত্রটির মত হয়ে যাওয়া মেনে নেওয়া উচিত। ব্যস্ত পরিচালক সবেতে বদল ঘটানোর সময় পাবেন কখন? দেবরাজকে যেভাবে মেগা সিরিয়ালের গৃহবধূদের মত সকালে, বিকেলে, মাঝরাতে ফুলহাতা শার্ট আর গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাও নিশ্চয়ই পরিচালকের ব্যস্ততার পরিণাম।

সঞ্জীব
বল্লভপুরের রূপকথা চবিতে সঞ্জীবের চরিত্রে দেবরাজ ভট্টাচার্য
ব্যোমকেশ
দুর্গ রহস্য ওয়েব সিরিজে মণিলালের চরিত্রে দেবরাজ ভট্টাচার্য

প্রথম পর্বে ব্যোমকেশকে সত্যজিতের চশমা পরানো নিয়ে অজিত যেখানে চটে ওঠে, সেখানে মূল কাহিনিতে পরিবর্তন আনার সপক্ষে ব্যোমকেশকে দিয়ে সৃজিত এমন সংলাপ বলিয়েছেন যাতে বোঝা যায়, তিনি ‘ওয়ার্ল্ড সিনেমা’ দেখেন এবং বোঝেন। যে দর্শকরা দেখে না তাদের শিক্ষিত করার প্রয়াস ধরা পড়েছে ওই সংলাপে। পরিচালকের এই আত্মরতি মেনে নেওয়া যেত যদি তিনি মাস্টারপিস না হলেও, অন্তত যত্নে নির্মিত একটি সিরিজ উপহার দিতেন। এত অযত্নে নির্মিত শিল্পকর্মের স্রষ্টার এহেন রেলা হজম করা শক্ত। বস্তুত, কাহিনির পরিবর্তনগুলি কাহিনিতে নতুন মাত্রা যোগ করলে দর্শকদেরও বেমানান মনে হয় না, পরিচালককেও তার পিছনে যুক্তি তৈরি করে ছবির মধ্যে ঢোকাতে হয় না। হইচই প্ল্যাটফর্মের জন্যই এর আগে সৃজন নির্দেশক (creative director) অনির্বাণ আর পরিচালক সুদীপ্ত রায় ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল বানিয়েছেন। সেখানে কাহিনির অনেক বেশি পরিবর্তন করা হয়েছিল। সৃজিতের সিরিজে ব্যোমকেশের কেবল চশমা নেই, সেখানে ছিল আরও বড় পরিবর্তন। ব্যোমকেশ চিরাচরিত ধুতি পাঞ্জাবির বদলে আগাগোড়া শার্ট, প্যান্ট পরেছিল। কেবল একেবারে শেষে ভোটদানের সময়ে তাকে ধুতি পাঞ্জাবি পরে দেখা যায়। এসবের যুক্তি দেওয়ার জন্যে আলাদা দৃশ্যনির্মাণের প্রয়োজন হয়নি, একটিও সংলাপ খরচ হয়নি। ওয়ার্ল্ড সিনেমায় পণ্ডিত সৃজিতবাবু এইটুকু আত্মবিশ্বাস দেখাতে পারলেন না কেন কে জানে। বেদেদের দিয়ে মঙ্গলকাব্য উচ্চারণ করানোর কাজটা তো বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই করেছেন।

এত গোলমাল এবং মন্থর চিত্রনাট্য সত্ত্বেও সিরিজটি যে একটিবার দেখা যায় তার কারণ অভিনেতারা। বংশীধর, মুরলীধর, হরিপ্রিয়া, গদাধর, তুলসীর মত চরিত্রগুলির পর্দায় উপস্থিতি সামান্য। অন্য সব অভিনেতাই নিজের সামর্থ্যের সদ্ব্যবহার করেছেন।

বিরসার ব্যোমকেশরূপী দেব গোয়েন্দাগিরি কম করেছিলেন, সুপার হিরোগিরি বেশি। সৃজিতের ব্যোমকেশরূপী অনির্বাণকে একাধারে উত্তমকুমার, প্রেমিক স্বামী, গোয়েন্দা, সাপুড়ে – সবই হতে হয়েছে। অথচ সে চিড়িয়াখানা দেখে বেরিয়ে বেশ রং নিয়ে বলেছিল, উত্তমকুমারের মত সাপ ধরতে যাবে না। কারণ “আমি সাপুড়ে নই”। সেকথা কি পরিচালক সাপ ধরার দৃশ্য রচনা করার সময়ে ভুলে গিয়েছিলেন? নাকি বিরসার ব্যোমকেশ সাপ ধরেছে বলে সৃজিতের ব্যোমকেশকেও সাপ ধরতেই হত?। যা-ই হোক, এত ভার বইতে হওয়ায় অনির্বাণকে কখনো কখনো ক্লান্ত দেখিয়েছে। গোয়েন্দা হিসাবে নয়, বেশি বিশ্বাসযোগ্য লেগেছে রোম্যান্টিক নায়ক হিসাবেই। সোহিনী সরকারের সঙ্গে তাঁর চোখের ভাষা যতখানি মিলেছে তা আগের কোনো সিজনে রিধিমা ঘোষের সঙ্গে দরজা বন্ধ করে প্রেম করার দৃশ্যগুলোতেও মেলেনি।

আরও পড়ুন দেব দেবী মহাদেব আছেন, সত্যান্বেষী নিরুদ্দেশ

এর কৃতিত্ব অবশ্য অনেকখানি সোহিনীরও। সেকেলে বউদের অতিপরিচিত সুরে কথা বলাই হোক আর উঁচু হয়ে থাকা পেট নিয়ে অস্বস্তি সামলে হাঁটাচলা করার অভিনয়ই হোক – কে বলবে তিনি সত্যি সত্যি সত্যবতী নন? গর্ভবতীর অভিনয় মানে যে কেবল পা ফাঁক করে হাঁটা নয়, তা যাঁদের প্রয়োজন তাঁরা এই অভিনয় দেখে শিখতে পারেন। কেবল অনির্বাণের সঙ্গে নয়, অজিতরূপী রাহুলের সঙ্গেও সোহিনী চমৎকার রসায়ন তৈরি করেছেন। চটে যাওয়া দেওরকে “ও-ও ঠাকুরপো” বলে ডেকে মান ভাঙানো দেখলে অনেক দর্শকেরই প্রয়াত জেঠিমা, মাসিমা, ঠাকুমা, দিদিমাদের মনে পড়বে।

প্রথমবার অজিতের চরিত্রে অভিনয় করা রাহুল একটি জিনিস ঘটিয়েছেন যা অতীতের কোনো অজিতরূপী অভিনেতাই সম্ভবত পারেননি। তিনি ব্যোমকেশ আর সত্যবতী, দুজনের সঙ্গেই দারুণ রসায়ন তৈরি করেছেন। ফলে স্রেফ ব্যোমকেশের উপগ্রহ হয়ে থাকেননি, সত্যিই শরদিন্দুর বর্ণনামাফিক বক্সী পরিবারের একজন অপরিহার্য সদস্য হয়ে উঠেছেন। ব্যোমকেশকে বাদ দিলেও অজিতের সঙ্গে যে সত্যবতীর একটি মিষ্টিমধুর সম্পর্ক আছে – এই একান্ত বাঙালিয়ানা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন রাহুল। উস্কোখুস্কো চুল, কখনো কখনো দিশেহারা ভাব সত্ত্বেও তিনি একবারের জন্যও কমিক রিলিফে পরিণত হন না। এর কৃতিত্ব পরিচালককেও দিতে হবে। কারণ ইদানীং ফেলুদার ছবিতে লালমোহনবাবুকে আর ব্যোমকেশের ছবিতে অজিতকে ভাঁড়ে পরিণত করা প্রায় সব পরিচালকেরই বদভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিনেতারাও ভাঁড়ের অভিনয়েই উৎকর্ষ অর্জনের চেষ্টা করে থাকেন। এই সিরিজটি ব্যতিক্রম। এর কৃতিত্ব অবশ্যই চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক সৃজিতেরও।

এই পরিমিতিবোধ সার্বিক হলে সৃজিত কিছু অতি বুদ্ধিমান সংলাপের সাহায্যে ব্যোমকেশকে বামপন্থী প্রতিপন্ন করার হাস্যকর চেষ্টাটি করতেন না। শেষে ব্যোমকেশ-সত্যবতীর সন্তানের জন্মকে নকশালদের থানা দখলের সঙ্গে এক করে দিয়ে বিপ্লবের প্রতীকী সাফল্য বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাও করতেন না। ঘটনা হল, নকশালবাড়ি আন্দোলন বিপ্লব আনতে পারেনি। পারেনি বলেই হয়ত যত দিন যাচ্ছে নস্ট্যালজিয়া হিসাবে তার দাম বাঙালি ভদ্রলোক ভদ্রমহিলাদের মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে। সৃজিত পুরনো তেলে ব্যোমকেশভাজা বানাতে গিয়ে রন্ধনে এই মশলাটি যোগ করেছেন।

প্রযোজক দেব আর পরিচালক বিরসার তেলেভাজার মশলাটি ছিল হিন্দুত্ববাদ, প্রযোজক শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মস আর পরিচালক সৃজিতেরটি আধসেদ্ধ মার্কসবাদ। বেচারা ব্যোমকেশ।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

দেব দেবী মহাদেব আছেন, সত্যান্বেষী নিরুদ্দেশ

শো শুরু হওয়ার আগে লবিতে বসে দেওয়ালে লাগানো এলইডি স্ক্রিনে ওই ছবির প্রোমোশনালে দেখেছিলাম শিবের বেশে অক্ষয়কে। ফলে ছবি শুরুর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পর্দায় ত্রিশূল হাতে শিব এবং তাঁর মারামারি করার দৃশ্য দেখে ভাবলাম, এই রে! হল কর্তৃপক্ষ ভুল করে এই ছবি চলতে চলতে ওই ছবি চালিয়ে দিল না তো!

মমতা ব্যানার্জি বাংলা ছবির জন্য এত বছর ধরে এত করলেন, এতজনকে এত পুরস্কার দিলেন, আর কাজের সময়ে টলিউডকে কাজে লাগিয়ে ফেলল বিজেপি!

নিশ্চয়ই ভাবছেন সিনেমার আলোচনার সূচনা এসব রাজনৈতিক কথাবার্তা দিয়ে কেন? কী করা যাবে বলুন? যে মাল্টিপ্লেক্সে ব্যোমকেশ ও দুর্গ রহস্য দেখতে গিয়েছিলাম, সেখানে ঠিক পাশের স্ক্রিনেই চলছিল অক্ষয় কুমারের ওএমজি ২। শো শুরু হওয়ার আগে লবিতে বসে দেওয়ালে লাগানো এলইডি স্ক্রিনে ওই ছবির প্রোমোশনালে দেখেছিলাম শিবের বেশে অক্ষয়কে। ফলে ছবি শুরুর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পর্দায় ত্রিশূল হাতে শিব এবং তাঁর মারামারি করার দৃশ্য দেখে ভাবলাম, এই রে! হল কর্তৃপক্ষ ভুল করে এই ছবি চলতে চলতে ওই ছবি চালিয়ে দিল না তো! শুধু কি দৃশ্য? সাউন্ড ট্র্যাকে তখন ঝাঁ ঝাঁ করে বাজছে আজকালকার ডিজে বাজানো ভক্তিগীতির কায়দায় রচিত “বম বম সত্যান্বেষী” (পরেও যতবার ব্যোমকেশ অপরাধীকে ধাওয়া করে ততবার বাজে)। শ্রাবণ মাস চলছে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সিনেমা হলের চেয়ে ওই গান অনেক বেশি মানানসই তারকেশ্বরে যারা বাবার মাথায় জল ঢালতে যাচ্ছে তাদের জমায়েতে। গোয়েন্দা গল্প নিয়ে তৈরি ছবিতে ওই দৃশ্য আর এই গান ঢুকে পড়ার যুক্তি হিন্দুত্ববাদের প্রচার ছাড়া আর কী হতে পারে?

এমনিতে কোনো টেক্সটের পুনর্কথনে দোষ নেই, যদি তার পিছনে নিবিড় পাঠ থাকে। মুশকিল হল, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গরহস্য উপন্যাস তো বটেই, গোটা ব্যোমকেশ সমগ্র ঘেঁটেও এমন একটা বাক্য দেখানো শক্ত যেখানে লেখক ব্যোমকেশ বক্সীর নামটার দিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে কোনোরকম ঈশ্বরত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। বরং উল্টোটাই সত্যি। বিশ্বসাহিত্যের বহু প্রথিতযশা গোয়েন্দার চেয়ে ব্যোমকেশ বেশি আটপৌরে। আর্থার কোনান ডয়েল প্রায় প্রতি গল্পে শার্লক হোমস যে আর পাঁচজন মানুষের চেয়ে আলাদা তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। শরদিন্দু কিন্তু বারবার ব্যোমকেশের সাধারণত্বই যে তার বিশেষত্ব সেকথা প্রমাণ করেছেন। তাই সে তার বয়সী যে কোনো ছেলের মতই তদন্ত করতে গিয়েও প্রেমে পড়ে যায় এবং সত্যবতীকে বিয়ে করে। এমনকি গোটা ব্যোমকেশ সাহিত্যে ব্যোমকেশ-সত্যবতীর সন্তানকে শরদিন্দু স্রেফ ‘খোকা’ বলে গেছেন। সে যুগে গড়পড়তা বাঙালি ছেলেদের ডাকনাম হিসাবে খোকা বা খোকন বহুলপ্রচলিত ছিল। এখানে ব্যোমকেশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী করে তুলতেই যে শিব সাজানো হয়েছে, তার প্রমাণ সে শিব সেজে দাঁড়িয়ে থেকে দেশের সম্পদ বিদেশে চালানকারী সাহেবকে ধরে ফেলেই বলে, কোহ-ঈ-নূর নিয়ে গেছ বলে সবই নিয়ে যাবে? সাহেব অবশ্য নেহাতই ক্রেতা। বিক্রেতা যে ভারতীয় তাকে বিস্তর ঝাড়পিটের পর ধরে ফেলে জটাধারী ব্যোমকেশ বলতে ছাড়ে না যে এইসব লোককে শাস্তি দিতেই ব্যোমকেশকে বারবার ফিরে আসতে হবে। টুক করে অবতারবাদও ঢুকিয়ে দেওয়া গেল।

বস্তুত এই ছবির ব্যোমকেশ চরিত্র একটি ধারাবাহিকতা তৈরি করল। কিছুদিন আগে অরিন্দম শীল নির্দেশিত ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ওয়েব সিরিজে প্রথমবার ফেলুদা এনকাউন্টার করে অপরাধী মেরেছে। এবার বিরসা-দেব জুটি ব্যোমকেশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসাবে দেখালেন। তৃণমূল কংগ্রেস দলের সাংসদ দেব আবার এই ছবির অন্যতম প্রযোজকও বটে। অর্থাৎ টলিউডের মাধ্যমে বাংলার দুই জনপ্রিয় গোয়েন্দা যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ মডেল আর গুজরাট মডেল আপন করে নিলেন।

হিন্দু জাতীয়তাবাদ ভাল হোক আর মন্দই হোক, সত্যান্বেষীকে শিব বানিয়ে ফেলা নির্দেশক বিরসা দাশগুপ্ত ও চিত্রনাট্যকার শুভেন্দু দাশমুন্সীর শৈল্পিক মুনশিয়ানা বলে মেনে নেওয়া যেত, যদি এই প্রবল জাতীয়তাবাদী গোয়েন্দাটি বাকি ছবিতে চিরাচরিত ধুতি-শার্ট বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থাকতেন। কিন্তু তিনি অধিকাংশ দৃশ্যেই রীতিমত সুটেড বুটেড। শরদিন্দুর ব্যোমকেশও এতখানি সায়েব ছিল না। অবশ্য সেই ব্যোমকেশের সঙ্গে এই ব্যোমকেশকে মিলিয়ে দেখতে গেলে পদে পদে হোঁচট খেতে হবে। কারণ সিরিজের একেবারে প্রথম গল্পেই লেখক জানিয়ে দিয়েছিলেন, ব্যোমকেশ নিজেকে গোয়েন্দা বলতে ঘোর অপছন্দ করে। ব্যোমকেশ অজিতকে বলেছে “ডিটেকটিভ কথাটা শুনতে ভাল নয়, গোয়েন্দা শব্দটা আরও খারাপ।” এখানে দেখা যাচ্ছে তাকে টিকটিকি বলে উল্লেখ করলেও ব্যোমকেশের আপত্তি নেই।

সবচেয়ে বড় যে বদলটি ঘটানো হয়েছে এই ছবিতে, তা হল সত্যবতীকে (রুক্মিণী মৈত্র) গর্ভাবস্থায় দাদা সুকুমারের কাছে না পাঠিয়ে ব্যোমকেশ, অজিতের সঙ্গে অকুস্থলে পাঠানো হয়েছে। সত্যবতীর সহচরীর প্রয়োজনে পুরন্দর পাণ্ডের সুগৃহিণী স্ত্রীকেও হাজির করা হয়েছে। এই পরিবর্তনটি নিঃসন্দেহে জরুরি ছিল। কারণ দেব অভিনীত ব্যোমকেশ যত ভাল দৌড়তে পারে, মারামারি করতে পারে, সত্যান্বেষণে তত দড় নয়। দুর্গে না গিয়েও স্রেফ শুনে শুনে রামকিশোরের পরিবারের সদস্যদের চরিত্র বিশ্লেষণ সত্যবতীই অনেকটা করে দেয়। এমনকি নবীনচন্দ্র সেনের পলাশীর যুদ্ধ থেকে কয়েক লাইন আউড়ে গুপ্তধনের সূত্র ধরিয়ে দেওয়ার কাজটাও সে-ই করে দেয়। অর্থাৎ সত্যবতী একাই ব্যোমকেশ এবং অজিতের কাজ করে দিতে পারে। তাও আবার ঘরে বসে, মিস মার্পলের মত। কেন যে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের দীর্ঘ তালিকায় মমতা, শিবরাজ সিং চৌহান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আগাথা ক্রিস্টির নামটাও রাখা হল না? অবশ্য ব্যোমকেশ শিব হয়ে উঠলে সত্যবতীকে তো পার্বতী হতেই হয়। এর জন্যে কোনো বিদেশিনীর কাছে কেনই বা কৃতজ্ঞ থাকতে হবে?

আরও পড়ুন টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

সত্যান্বেষণে গিন্নী অনেকখানি সাহায্য করে দিলেও ব্যোমকেশকে বিস্তর কায়িক পরিশ্রম করতে হয়েছে। গল্পে ছিল ব্যোমকেশ-অজিতকে দুর্গ থেকে তাড়াতে নির্বিষ ঢ্যামনা সাপ ছেড়ে দেওয়ার কথা। সে সাপকে ধরেছিল পুলিস কনস্টেবল সীতারাম। এই ছবির সাপটি রীতিমত বিষধর এবং সাপ সম্পর্কে গবেষণায় আজ পর্যন্ত যা যা জানা গেছে, সেসবকে কাঁচকলা দেখিয়ে সে রীনা রায় অভিনীত নাগিন (১৯৭৬) ছবির মত মানুষ মারার উদ্দেশ্য নিয়েই ঘরে ঢোকে। আরেকটু হলেই ঘুমন্ত অজিতের (অম্বরীশ ভট্টাচার্য) ভবলীলা সে সাঙ্গ করে দিয়েছিল। ব্যোমকেশ খালি হাতে সেই সাপকে ধরে ঝুড়িতে পুরে ফেলে। এতদ্বারা বোধহয় দেব তাঁর পরের ছবি বাঘাযতীন-এ খালি হাতে বাঘ মারার রিহার্সালও করে নিলেন। হলই বা কম্পিউটার জেনারেটেড। তবে সম্ভবত দেবকে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে বেঢপ চশমাখানা সামলাতে। বাংলা ছবির বাজেটের কি এতই করুণ অবস্থা যে তাঁর মুখের গড়নের সঙ্গে মানানসই একখানা চশমা পাওয়া যায়নি? সারাক্ষণই বাঁকা মনে হয়। যেন ঠিক চেপে বসেনি, এখুনি খুলে পড়ে যাবে। প্রযোজক দেব কি অভিনেতা দেবের এই অসুবিধা খেয়াল করেননি?

সত্যবতীর চরিত্রে রুক্মিণীর একমাত্র গুণ হল তাঁর রূপ।

অম্বরীশ ছাড়া ছবির বাকি অভিনেতাদের প্রায় সকলকেই দেখে মনে হয়েছে তাঁরা থতমত খেয়ে আছেন, ঠিক কী করতে হবে বুঝে উঠতে পারছেন না। সে জন্যে তাঁদের বিশেষ দোষ দেওয়াও যায় না। সাবেকি বাঙালি ভদ্রলোক রামকিশোরের চরিত্রে রজতাভ দত্তকে যদি খামোকা স, শ সবই s-এর মত উচ্চারণ করতে হয় তাহলে নিজের ভূমিকা গুলিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। আরও গুলিয়ে যাওয়ার মত চরিত্র রামকিশোরের নায়েব চাঁদমোহন দত্তের (শঙ্কর দেবনাথ)। তিনি রীতিমত বাঙাল ভাষায় কথা বলেন, অথচ বেশভূষা খাঁটি হিন্দি বলয়ের মুনশিদের মত। বল্লভপুরের রূপকথা ছবিতে প্রধান চরিত্রে মন ভরিয়ে দেওয়া সত্যম ভট্টাচার্য এখানে কিছুতেই খলনায়ক হয়ে উঠতে পারলে না। মণিলালের চরিত্রে তিনি যেন সেই বল্লভপুরের ভালমানুষ রাজাই রয়ে গেলেন। শরদিন্দু তাঁর খলনায়কদের ব্যোমকেশের প্রতিস্পর্ধী হিসাবে গড়ে তুলেছেন বহু গল্পেই। পথের কাঁটা, চিড়িয়াখানা-র মত দুর্গরহস্য উপন্যাসেও তাকে শেষ পর্যন্ত ধরা যায় না। কিন্তু দেবাদিদেব মহাদেবকে অপরাধী ফাঁকি দিল – এ জিনিস কোথায় কার ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করবে কেউ বলতে পারে না। তাই পরিচালক সে ঝুঁকি নেননি। ক্লাইম্যাক্সটা হয়েছে একেবারে হিন্দি সিনেমার মত। দেব মরার ভান করে, হারার ভান করে শেষমেশ জিতে গেছেন। ছবিতে যে পরিমাণ হিন্দি, বাংলা সংলাপ মেশানো হয়েছে তাতে বলে দিতেই পারতেন “শুনুন মণিলালবাবু, হার কর জিতনেওয়ালে কো বাজিগর কহতে হ্যাঁয়।” দোষ হত না।

একমাত্র অম্বরীশই এই ছবিতে সাবলীল। কিন্তু মুশকিল হল, কোনো অজ্ঞাত কারণে বাংলা ছবির নির্দেশকরা সকলেই একমত হয়েছেন যে লালমোহনবাবু আর অজিত গোয়েন্দার বন্ধু কম, ভাঁড় বেশি। তাই তাঁকে দিয়ে বিস্তর ভাঁড়ামি করানো হয়েছে। এমনকি সিদ্ধি খাইয়ে মাতাল পর্যন্ত করা হয়েছে (শরদিন্দু সিদ্ধি খাওয়ার কথা লিখেছেন, টলমল করার কথা লেখেননি)। বাঙালি সাহিত্যিকের এমন চরিত্রচিত্রণ দেখলে শরদিন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন নির্ঘাত।

সবই বোঝা গেল, কিন্তু শেষে লগ্নজিতা চক্রবর্তীর গলায় ‘ও যে মানে না মানা’ কেন বেজে উঠল তা ঠিক বোধগম্য হল না। সবাই তো সবকিছু মেনে নিল। শরদিন্দু যেমন লিখেছেন তেমনভাবেই তুলসী আর রমাপতির বিয়ে হল, সত্যবতী মা হল, এমনকি রামকিশোরের দুই দুর্দান্ত ছেলের বাঁদরামিও প্রশমিত হল। তাহলে? রবীন্দ্রনাথের গান কি তুলসীপাতা, যে বাংলার সংস্কৃতির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে সবকটি নৈবেদ্যের উপর একখানা করে দিতেই হবে?

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: