খাড়া বড়ি থোড় বললেই উড়ে যাবে না নতুন ফেলুদা ছবি

সন্তোষ দত্তের জন্মশতবর্ষে যে ফেলুদা ছবি মুক্তি পাবে তাতে যদি জটায়ুর অভিনয়টা ভাল হয় তাহলে তাঁকে যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে।

বুঝে দেখ জটায়ুর কলমের জোর
ঘুরে গেছে রহস্য কাহিনীর মোড়
থোড় বড়ি খাড়া
লিখে তাড়াতাড়া
এইবারে লিখেছেন খাড়া বড়ি থোড়।

ফেলু মিত্তিরের ভক্তরা জানেন, এই পাঁচ লাইনের রচয়িতা প্রদোষচন্দ্র মিত্র স্বয়ং। হত্যাপুরী গল্পের শুরুতেই ফেলুদা রচিত এই লিমেরিক তোপসে পাঠকের কাছে হাজির করেছে। সন্দীপ রায়ের হত্যাপুরী ছবির বর্ণনাতেও এই ছড়া দিব্যি খেটে যায়। তবে ফেলুদাকে নিয়ে নতুন কিছু করা হয়েছে এমন প্রত্যাশা নিয়ে কে-ই বা সিনেমা হলে যাচ্ছে? শীতের ছুটির মধ্যে কোনো একটা দিন সপরিবারে খানিকটা স্মৃতিমেদুর সময় কাটানো – ফেলুদার ছবি দেখতে যাওয়ার এই তো আসল উদ্দেশ্য। সুতরাং সে ছবি অভিনব না হয়ে যত পরিচিত হয় ততই ভাল। তাছাড়া ফেলুদার ছবির সব দর্শকই গল্পগুলো পড়ে ফেলেছে – একথা বুকে হাত দিয়ে বলা ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখনকার স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের অনেকেরই ফেলুদার কথা বাবা-মায়ের মুখে শোনা। তারা বই পড়ে কম, বাংলা পড়ে আরও কম। ফলে ছবিগুলো এমনিতেই তাদের কাছে অভিনব। আমরা চল্লিশোর্ধ্বরা কনুইটা সিটের হাতলে ঠেকিয়ে হাতটা থুতনিতে রেখে যতই ভুরু কুঁচকে বিচার করি সন্দীপ সত্যজিতের ফেলুদাকে পর্দায় আনতে গিয়ে কোথায় কতটুকু সরলেন বা সরলেন না, সরলে সেটা রসোত্তীর্ণ হল কিনা; তরুণতর দর্শকদের অনেকের কাছেই কেবল গল্পটা নয়, ফেলু-তোপসে-জটায়ুর গোটা জগৎটাই নতুন। যতবার ফেলুদা চলচ্চিত্রায়িত হচ্ছে, ততবার তাদের নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে। বাঙালির সাংস্কৃতিক শিকড় যতখানি আলগা হয়ে গেছে, তাতে স্রেফ আর্কাইভ করে রাখার কথা ভেবে যদি সত্তর ছুঁই ছুঁই সন্দীপ এখনো পুরনো ফর্মুলাতেই ফেলুদা ছবি বানিয়ে যান তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া চলে না।

ছবির বিচার করতে গিয়ে এসব কথাও ভাবতে হচ্ছে – এটা নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু বাংলা ছবি, শুধু ছবিই বা কেন, বাংলার সংস্কৃতিই যে কপাল চাপড়ানোর মত অবস্থায় পৌঁছেছে তা নিয়ে তো আর ঢাকঢাক গুড়গুড় করার কিছু নেই। বাংলা ছবির দুরবস্থা যে নেহাত নিন্দুকের কল্পনা নয় তার ব্যবসায়িক ও শৈল্পিক – দু ধরনের প্রমাণই উপস্থিত। ২০২২ সালে গোটা চারেক ছবি প্রেক্ষাগৃহে লোক টানতে পেরেছে, যার মধ্যে একটা আবার বাংলাদেশের ছবি। এতেই প্রযোজক থেকে শুরু করে দর্শক অব্দি সকলেই আহ্লাদে আটখানা – এই হল ব্যবসায়িক প্রমাণ। আর শৈল্পিক প্রমাণ তো প্রায় এক দশক ধরে গোয়েন্দা ছবির প্রাবল্যেই পাওয়া যাচ্ছে।

এমন নয় যে পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় জনপ্রিয় গোয়েন্দা গল্প নিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি ছবি বা সিরিজ হয় না। বাঙালিরা যে ভাষার সিনেমা, সিরিজের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি পরিচিত সেই ইংরেজি ভাষাতেই শার্লক হোমস, আর্কুল পয়রো, মিস মার্পল প্রমুখ গোয়েন্দাকে নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ বড় পর্দার ছবি, টিভি সিরিজ হয়েছে; ওটিটির যুগে ওয়েব সিরিজও হয়ে চলেছে। কিন্তু প্রায় সমস্ত প্রযোজনাতেই নতুন কিছু করার প্রয়াস দেখা যায়, কখনো কখনো তার ফলে বিবিসির শার্লক সিরিজের মত চমকপ্রদ কিছুও তৈরি হয়।

সন্দীপ সত্যজিতের ছেলে হওয়ার সুযোগ নিয়ে নিজে ফেলুদার হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দিয়ে গল্পগুলোকে আজকের দিনে নিয়ে আসা ছাড়া কোনোরকম সৃজনশীলতা দেখাচ্ছেন না, ওদিকে কপিরাইট ধরে রেখে অন্য কাউকে আরও সৃজনশীল হওয়ার সুযোগও দিচ্ছেন না বলে আমরা – ফেলুদা পড়ে বড় হওয়া প্রজন্ম – অনুযোগ করতাম গত দশকে। সন্দীপ সে গুড়ে বালি দিয়েছেন অনেকদিন হল। তাঁর হাঁটুর বয়সী পরিচালকরা ফেলুদাকে নিয়ে ওয়েব সিরিজ করছেন। কিন্তু তাতেই বা ফেলুদা নব নব রূপে প্রাণে আসতে পারছে কই? তরুণ পরিচালকদের উদ্ভাবনী শক্তির নমুনা দেখে তো উল্লসিত হওয়া যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য শেয়াল দেবতা রহস্য আর ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা নিয়ে ওয়েব সিরিজ করেছিলেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। শেষমেশ সেখানে কলকাতার ঢাকা হয়ে যাওয়া আর তোপসের লেখা বইয়ের বদলে ব্লগে প্রকাশিত হওয়া ছাড়া কোনো যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখা যায়নি। ও জিনিসটিও স্টিভেন মফাট আর মার্ক গ্যাটিস শার্লক সিরিজে আগেই করে ফেলেছেন এবং সেখানে আর্থার কোনান ডয়েলের আখ্যানকে তাঁরা যতদূর নিয়ে গেছেন ততখানি পরীক্ষামূলক হওয়ার সাহস পরমব্রত দেখিয়ে উঠতে পারেননি। উপরন্তু স্বয়ং ফেলুদার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসে ঘুরঘুটিয়ার ঘটনার ক্লাইম্যাক্সে রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে পরিচিত দুটো লাইন আওড়াতে গিয়ে গুবলেট করেছেন। শেয়াল দেবতা রহস্যে ফেলুদার একটি সাংবাদিক প্রেমিকা প্রায় জুটিয়ে ফেলেছিলেন (শারলিন ফারজানা), শেষ অব্দি বোধহয় সন্দেশ পড়া প্রাচীন পাঠক-পাঠিকারা রেগে যাবেন ভেবে পিছিয়ে যান।

পরমব্রত তবু নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন, বাংলা ছবির রিমেক সম্রাট সৃজিত মুখোপাধ্যায় তো ফেলুদাকে নিয়ে পিরিয়ড পিস বানাতে গিয়ে ১৯৮০-র দশকের দমদম বিমানবন্দরে ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া ক্যাম্পেনের পোস্টার সেঁটে ফেলেছেন। মুক্তি পেতে চলেছে অরিন্দম শীল নির্দেশিত আরও একটা ফেলুদা ওয়েব সিরিজ। সেখানে আবার গ্যাংটকে এ জাতীয় গন্ডগোল দেখা না গেলেই হয়। পরিচালক অবশ্য এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এখানে ফেলুদা আধুনিক – স্মার্টফোন, স্মার্টওয়াচ ব্যবহার করেন। তবে সেটাই প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকলে খাড়া বড়ি থোড়ই ভবিতব্য।

সন্দীপের হত্যাপুরীকে এই পরিস্থিতি মনে রেখে বিচার করা ভাল।

তিনি প্রথম যখন বড় পর্দার জন্যে ফেলুদার ছবি তৈরি করতে শুরু করেন তখন যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি হতাশ করত তা হল কে অপরাধী তা গোড়াতেই দেখিয়ে দেওয়া। সত্যজিৎ নিজে সোনার কেল্লা আর জয়বাবা ফেলুনাথ – দুটো ক্ষেত্রেই তা করেছিলেন। কিন্তু গল্পের তুলনায় সে দুটো প্রায় আমূল পরিবর্তিত চিত্রনাট্য। ফলে বইয়ের ‘হু ডান ইট’ পর্দায় থ্রিলারে পরিণত হয়ে অন্যরকম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সন্দীপ আবার আমূল পরিবর্তন করতে চান না কখনোই, ফলে ছবির অবস্থা হত ন যযৌ ন তস্থৌ। হত্যাপুরীতে সে দ্বিধা নেই। চিত্রনাট্য মোটের উপর গল্পকেই অনুসরণ করেছে, ‘হু ডান ইট’ উৎকণ্ঠা বজায় রাখা হয়েছে। শুরুতে যে ফেলুদা আবিষ্কারক দর্শক প্রজন্মের কথা বলছিলাম, তাদের এই চিত্রনাট্য আকর্ষণ করবে। গল্প থেকে চোখে পড়ার মত পরিবর্তন বলতে জটায়ুর ড্রাইভার হরিপদবাবুকে বাদ দেওয়া। তাতে অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি।

এ ছবির সেরা অভিনেতা দুজন – সাহেব চ্যাটার্জী আর শুভাশিষ মুখোপাধ্যায়। সুপুরুষ সাহেবের শিশুর মত সরল হাসি বিলাস মজুমদারকে দারুণ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। হারবার্টের চরিত্রে অভিনয় করা শুভাশিস যে লক্ষ্মণ ভট্টাচার্যের চরিত্র ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও করে ফেলতে পারেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় (দুর্গাগতি সেন) সম্ভবত অভিনয় জীবনের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন যেখানে খেলার মাঠে যাকে ‘প্লেয়িং ফ্রম মেমরি’ বলে, তা করলেও দেখার মত হবে। ঠিক ফ্রাঙ্কো বারেসি যেভাবে ১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে ওটুকু করেই সেরা সময়ের রোমারিও, বেবেতোকে আটকে দিয়েছিলেন।

কিন্তু যে কোনো ফেলুদা ছবির আসল আকর্ষণ তো ওই তিনজন – গোয়েন্দা, তাঁর খুড়তুতো ভাই আর রহস্য রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী। তাঁদের অভিনয়ে গোলমাল হলে দারুণ চিত্রনাট্য, অসামান্য সিনেমাটোগ্রাফি – কোনোকিছুই ছবিকে বাঁচাতে পারে না। যে কোনো গোয়েন্দা গল্পের চলচ্চিত্রায়ণেই অবশ্য তাই। বেনেডিক্ট কামবারবাচ আর মার্টিন ফ্রিম্যান যথাক্রমে শার্লক হোমস আর ডাক্তার ওয়াটসনের চরিত্রে মারকাটারি অভিনয় না করলে বিবিসির শার্লক সিরিজ তাক লাগানো ভাবনা, চিত্রনাট্য, প্রযুক্তির ব্যবহার সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়তই। হত্যাপুরী ছবিতে তিন কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতাদের সন্দীপ এই প্রথম ব্যবহার করলেন। বস্তুত, ছবিটা যেমনই হয়ে থাক, সন্দীপের প্রশংসা প্রাপ্য এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে প্রবল প্রতাপশালী প্রযোজকের সঙ্গে কাস্টিং নিয়ে আপোস করেননি বলে। একই প্রযোজকের ব্যানারে অন্য পরিচালক যে কাস্ট নিয়ে কাজ করেছেন তাঁকেও সেই কাস্ট নিয়েই কাজ করতে হবে – এই অন্যায় আবদার মানবেন না বলে সন্দীপ প্রযোজকই বদলে ফেলেছেন। ছবিটা হতে পারত অনেক আগেই, কিন্তু পিছিয়ে গেছে। এখন কথা হল, তাঁর এই লড়াইকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারলেন কি তাঁর পছন্দের অভিনেতারা?

ফেলুদার কথায় শেষে আসব, কারণ ওটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তোপসেকে দিয়ে শুরু করা যাক। সন্দেহ নেই, সেই সোনার কেল্লার সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জির পরে এই প্রথম একজন তোপসেকে দেখে কচি ছেলে বলে মনে হয়েছে। সন্দীপ রায়ের টেলিফিল্মগুলোতে এবং সিনেমায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় আর পরমব্রত যখন ওই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তাঁদের মোটেই বছর পনেরোর ছেলে মনে হয়নি। বরং পরমব্রত নির্দেশিত ওয়েব সিরিজে ঋদ্ধি সেনকে কিছুটা বইয়ের তোপসে মনে হয়েছিল। হয়ত আগের ছবিগুলোতে সন্দীপ তোপসেকে একটু বড় ছেলে হিসাবেই দেখাতে চেয়েছিলেন। হত্যাপুরীতে আয়ুশ দাসকে কিন্তু সদ্য দাড়িগোঁফ ওঠা তোপসেই মনে হচ্ছে। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। সংলাপ বলায় তাঁর নিজেকে কচিতর করে তোলার চেষ্টা ভীষণ চোখে লাগে। উপরন্তু মেগাসিরিয়ালের অভিনেতাদের মত উত্তেজনা প্রকাশ করতে গেলে তিনি চোখ বড় বড় করে কথা বলেন। বড় পর্দায় স্বভাবতই সে চোখ আরও বড় বড় লাগে।

আরও পড়ুন টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

সন্দীপ রায় নিজে বলেছেন শিগগির আরও ফেলুদা ছবি করবেন, অন্য পরিচালকরাও ময়দানে নেমে পড়েছেন। ফলে আশা করা যায় ২০২৫ সালেও কোনো না কোনো ফেলুদা ছবি মুক্তি পাবে। বছরটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেবার সন্তোষ দত্ত একশোয় পড়বেন। বাষট্টি বছরের জীবনে যতগুলো ছবিতে কাজ করেছেন কোনোটাতেই একেবারে ফেলে দেওয়ার মত অভিনয় করেননি। তবু বেশিরভাগ দর্শক তাঁকে মনে রেখেছেন জটায়ু হিসাবে। তাঁর জন্মশতবর্ষে যে ফেলুদা ছবি মুক্তি পাবে তাতে যদি জটায়ুর অভিনয়টা ভাল হয় তাহলে তাঁকে যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে। কিন্তু লক্ষণ ভাল নয়। ওই চরিত্রের অভিনয় সন্তোষ দত্তের মৃত্যুর পর থেকে যেন ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। রবি ঘোষ আর অনুপকুমার তবু একরকম ছিলেন, অকালমৃত্যু না হলে হয়ত আরও ভাল করতেন। বিভু ভট্টাচার্যের আমল থেকে শুরু হয়েছে লালমোহনবাবুকে কমিক রিলিফে পরিণত করা। সন্দীপ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জটায়ু ভাঁড় নন, বন্ধু। এই কথাটা যে কোনো ফেলুদারসিকই বোঝেন, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে ওই চরিত্রের অভিনেতারা সন্তোষ দত্তের প্রয়াণের পর সাড়ে তিন দশকেও বুঝে উঠতে পারলেন না। সৃজিতের দার্জিলিং জমজমাট সিরিজে অনির্বাণ চক্রবর্তী তো প্রায় গোপাল ভাঁড় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সে না হয় অন্য পরিচালকের ছবি, কিন্তু সন্দীপের নিজের ছবির জটায়ুরা কেন নিজেদের ভাঁড় মনে করছেন? হত্যাপুরীর জটায়ু অভিজিৎ গুহ নিজেও একজন পরিচালক, অথচ তিনিও এ দোষ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সারাক্ষণই অতি-অভিনয় করে গেছেন। হোটেলের ঘরের একটা দৃশ্যে তো মনে হয়েছে তিনি ফেলুদাকেও ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

যে অভিনেতার কাস্টিং নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ ছিল, সেই ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তই কিন্তু সবচেয়ে জমাট অভিনয় করেছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর সব্যসাচী চক্রবর্তীর বাচনভঙ্গি আর উচ্চারণ ফেলুদাকে এমন খাঁটি বাঙালি চেহারা দিয়েছে যে প্রবাসী ইন্দ্রনীলের ঈষৎ টানওলা বাংলা অভ্যস্ত কানে কোথাও কোথাও একটু অস্বস্তি তৈরি করে, কিন্তু তাঁর অতীতের অভিনয় দেখা থাকলে বোঝা যায় সেখানেও অনেকটা উন্নতি করেছেন। তাছাড়া কেবল বাচনভঙ্গীই তো অভিনয় নয়। হাঁটাচলায়, স্থৈর্যে, সাহসে ইন্দ্রনীল ফেলুদা হয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছেন। তিনি আবীর চ্যাটার্জির মত সংলাপসর্বস্ব ফেলুদা নন, টোটা রায়চৌধুরীর মত বচ্চনপ্রতিম ফেলুদাও নন। ইন্দ্রনীলকে সত্যিই মগজাস্ত্র-নির্ভর গোয়েন্দা বলে মনে হয়েছে। জটায়ুকে হ্যাটা করার প্রবণতা, যা সব্যসাচী পরবর্তী ফেলুদাদের অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছিল, তাও ইন্দ্রনীলের মধ্যে নেই।

সম্প্রতি বাংলা ছবি, ওয়েব সিরিজে গোয়েন্দার ছড়াছড়ি। রোগা ভূত, মোটা ভূত, বাবা ভূত, ছানা ভূতের মত নানারকমের গোয়েন্দায় ভরে গেছে দ্বিগ্বিদিক। অথচ রহস্যের তেমন বৈচিত্র্য নেই। সোনাদা একের পর এক ছবিতে গুপ্তধনই উদ্ধার করে চলেছেন, একেনবাবুর জটায়ুসুলভ হিন্দি বলা আর বাংলা প্রবাদ ব্যবহারে ভুল করায় বৈচিত্র্য থাকলেও ঘুরে ফিরে সেই খুনের রহস্যের কিনারা করছেন। তার মধ্যে সন্দীপ ফেলুদার এমন একটা গল্প বেছে নিয়ে ছবি করেছেন যেখানে সোনাদানা নয়, অপরাধের লক্ষ্য প্রাচীন পুঁথি। খুনোখুনি যা হয়েছে সেগুলোও পুঁথির কারণেই। এ জন্যেও বোধ করি তাঁর ধন্যবাদ প্রাপ্য। পুঁথিকে ধন মনে করার বাঙালি সংস্কৃতি লুপ্তপ্রায়। দুর্গাগতি আর সিধুজ্যাঠার মত মানুষ, পাহাড়প্রমাণ টাকা যাঁদের কিনতে পারে না – তাঁরাও মিসিং লিঙ্কে পরিণত হয়েছেন। হত্যাপুরী নিদেনপক্ষে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রমাণ রেখে দিল যে এমন মানুষও একদা এই পশ্চিমবঙ্গে ছেল।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

টলমলে ট্রিবিউটে ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি গুবলেট

আমাদের যখন সবে গোঁফ দাড়ি গজাচ্ছে, তখন ট্রেনের কামরা বা পাবলিক টয়লেটের দেয়ালে সাঁটা কিছু বিজ্ঞাপন নজর কাড়ত। সেখানে লেখা থাকত একটা কথা, যার অর্থ বুঝতে না পেরে আমরা আকাশ-পাতাল ভাবতাম এবং বন্ধু মহলে বিস্তর আলোচনা করতাম। কথাটা হল, কৈশোরের কিছু “কুঅভ্যাস” ছাড়তে না পারলে নাকি বিবাহিত জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিজেরা কিশোর বলেই ওখানে কোন অভ্যাসের কথা বলা হত তা জানতে আমরা যারপরনাই উদগ্রীব ছিলাম। কথাটা মনে পড়ল সদ্য ওটিটিতে মুক্তি পাওয়া ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি দেখে। এই ওয়েব সিরিজের মূলধন হল ফেলুদা আর সত্যজিৎ সম্পর্কে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতা। ও জিনিসটা মানুষ মাত্রেরই থাকে, কিন্তু ওটা এই মুহূর্তে আমাদের জাতীয় কুঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই আমরা চিরকিশোর হয়ে পড়েছি। ফলে পুনরাবৃত্তিই আমাদের শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে, অনুকরণই আমাদের আপ্লুত করছে। গালভরা নাম হয়েছে ‘ট্রিবিউট’। অনীক দত্ত সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে তাঁকে ট্রিবিউট দিতে ছবি তৈরি করেছেন। সে ছবির বৈশিষ্ট্য (বিজ্ঞাপন জগতের ভাষায় – ইউনিক সেলিং পয়েন্ট) হল, নামভূমিকায় যিনি আছেন তাঁকে হুবহু সত্যজিতের মত দেখাচ্ছে (অথচ চরিত্রটির নাম সত্যজিৎ নয়), আর পথের পাঁচালীর দৃশ্যগুলোর দারুণ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। এতেই আমাদের আবেগে গলা বুজে আসছে। আসল পথের পাঁচালী দেখার উপায় থাকতে অনুকরণ কেন দেখতে যাব, সে প্রশ্ন করলে লোকে তেড়ে আসছে।

ব্যাপারটা শৈল্পিক হোক বা না হোক, স্মৃতিমেদুরতা (বাঙালিরা যাকে বলে নস্ট্যালজিয়া) যে লালমোহন গাঙ্গুলির ভাষায় “সেলিং লাইক হট কচুরিজ”, তাতে সন্দেহ নেই। ফলে সৃজিত মুখার্জিও নস্ট্যালজিয়া বেচতেই নেমেছেন। সিরিজের প্রথম পর্বের শুরুটাই হুবহু অনুকরণ, থুড়ি ট্রিবিউট। সোনার কেল্লা ছবিতে ফেলুদাকে পর্দায় প্রথমবার দেখানোর সময়ে শীর্ষাসনরত পদযুগল দেখানো হয়েছিল, তোপসে দৌড়ে এসে খবর দিয়েছিল মক্কেল এসেছে। এখানে পদযুগল এসেছে কয়েক সেকেন্ড পরে, প্রথমবার দেখানো হয়েছে শীর্ষাসনরত ফেলুদার মুখের ক্লোজ আপ। মুশকিল হল, অনুকরণেরও সক্ষমতা অক্ষমতা আছে। মক্কেল আসার খবর ফেলুদাকে তখুনি জানানোর দরকার পড়ে। জটায়ুর আগমন তো কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয় যে তৎক্ষণাৎ জানাতে হবে। কিন্তু নির্দেশক ওসব ভাবতে যাবেন কেন? দর্শককে নস্ট্যালজিয়ায় জবজবে করে ফেলতে পারাই আসল। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।

নস্ট্যালজিয়া নিশ্ছিদ্র করতে সিরিজটিকে পিরিয়ড পিসে পরিণত করা হয়েছে। একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই বোধহয় এমন সিনেমা বোদ্ধা দর্শক পাওয়া যায়, যাঁরা বিশ্বাস করেন ছবি সেপিয়া টোনে রাখলেই পিরিয়ড পিস হয়ে যায়। কারণ ফেলুদারা দার্জিলিংয়ে যে হোটেলে ওঠে, তার বাইরের দেয়াল আধুনিক কায়দার। আশির দশকের ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ট্রিবিউট দিতেই বোধহয় দার্জিলিংয়ের ঠান্ডাতেও এই সিরিজের ফেলুদা টোটা রায়চৌধুরীকে ফিনফিনে পাজামা আর পাঞ্জাবির উপরে স্রেফ একটা চাদর জড়িয়ে থাকতে হয়। কিন্তু বাইরে বেরোবার সময়ে তিনি দিব্যি টি-শার্ট পরে ফেলেন। মর্নিং ওয়াকেও চলে যান আধুনিক জামাকাপড় পরে। সেইসব সময়ে আশির দশক বজায় থাকে ফেলুদা আর তোপসের পেতে আঁচড়ানো চুলে। বিরূপাক্ষ মজুমদারের পুত্র সমীরণের সঙ্গে ফেলুদার বাকযুদ্ধ অবশ্য পুরোদস্তুর রেট্রো। ১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া প্রভাত রায়ের প্রতিকার ছবির কথা মনে পড়ে যায়। ভয় হয়, চোখা চোখা সংলাপ বলতে বলতে এখুনি চিরঞ্জিত আর ভিক্টর ব্যানার্জির মত টোটা আর সমীরণরূপী সুপ্রভাত দাস মারামারি শুরু করে দেবেন। ট্রিবিউট অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এই সিরিজে ফেলুদার সংলাপ সম্ভবত এমএলএ ফাটাকেষ্ট চরিত্রের অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীকে ট্রিবিউট। নইলে নিজের গায়ের জোর কতটা তা বোঝাতে ফেলুদা বলতে পারেন না “ঘোড়া যেমন চাঁট মেরে মানুষের মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে পারে, ঠিক তেমনই বহু দেশে ঘোড়াকে কেটে তার মাংস রান্না করে খাওয়া হয়।” (তারপর ঘাড় বেঁকিয়ে “সুস্বাদু। জানেন?”)

দার্জিলিংয়ে ফেলুদার কার্যকলাপ অবশ্য সৌমিত্র বা চিরঞ্জিতের চেয়েও যাঁকে বেশি মনে পড়ায় তিনি অমিতাভ বচ্চন। কারণ এই ফেলুদা চিতাবাঘের চোখে চোখ রাখতে পারেন, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেই গুনগুন করে গান গাইতে পারেন। সে আবার ইংরেজি গান, যেহেতু তাতে ল্যাভেন্ডার শব্দটা আছে এবং যে ধাক্কা মেরেছিল তার শরীর থেকে ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার পারফিউমের গন্ধ পেয়ে ফেলুদা তাকে চিনতে পেরেছেন। এখানেই শেষ নয়, ফেলুদা আহত, ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের উপর গোটা শরীরের ভার নিতে পারেন। তিনি আরও একটি জিনিস পারেন যা এমনকি আশির দশকের বচ্চনও পারতেন না। তা হল দু হাতে বন্দুক চালানো। সমীরণ মজুমদারের গাড়ির টায়ারে ফেলুদা গুলি করেন বাঁ হাতে, গাড়ি থেকে নেমে আবার বন্দুক তাক করেন ডান হাতে।

ভক্তরা নিশ্চয়ই বলবেন এসব পরিচালকের স্বাধীনতা। ফিল্মের সাহিত্যকে অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করার দায় নেই। সত্যজিৎ নিজেও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের গল্প নিয়ে ছবি করার সময়ে চিত্রনাট্যে অনেককিছু বদলে দিয়েছেন। কথাটা ঠিকই। এই স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার সৃজিতবাবু এই সিরিজে করেছেন। যেমন সত্যজিতের গল্পের টফ্রানিল বড়ি হয়ে গেছে ট্রফানিল। কিন্তু সমস্যা হল, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ছদিনে লিখিত এই গল্পে (সূত্র: ফেলুদা সমগ্র ১, ষষ্ঠ মুদ্রণ, নভেম্বর ২০০৯; আনন্দ) সত্যজিৎ যে টফ্রানিলের কথা লিখেছেন, সামান্য গুগল সার্চই বলে দিচ্ছে ওই ওষুধটি (Tofranil) অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট, যার প্রয়োজনীয়তা বিরূপাক্ষবাবু নিজে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু Trofanil বলে কোনো ওষুধের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এ যুগের সিধুজ্যাঠা গুগল Tromanil Plus বলে একটি ট্যাবলেটের কথা বলছে বটে, কিন্তু সেটিও রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অ্যাঙ্কিলোসিং স্পন্ডিলাইটিস এবং অস্টিওআর্থ্রাইটিসে ব্যবহার হয়। তাহলে কি পরিচালক সত্যজিতের উপর কলম চালিয়ে কোনো অদ্যাবধি অনাবিষ্কৃত ওষুধের সন্ধান দিলেন? পিরিয়ড পিসে কি তা করা চলে? প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে অবশ্য হতাশ হতে হবে। যেমন বিরূপাক্ষবাবুর বেয়ারা লোকনাথকে খুন করা হয়েছিল গলা কেটে। মৃতদেহের তলপেটের কাছেও কী করে রক্ত লাগল – এ প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।

গল্পের যে পরিবর্তনটিকে সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ বৈপ্লবিক আখ্যা দিচ্ছেন, সেটি চিত্রনাট্যকে কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে তা-ও যেমন বোঝা গেল না। দার্জিলিং জমজমাট গল্পে বলিউডের নায়িকা সুচন্দ্রার উল্লেখমাত্র আছে। এই সিরিজে কিন্তু তাঁর উপস্থিতি বেশ কয়েকটি দৃশ্যে। শুধু তা-ই নয়, ফিল্মের নায়ক রাজেন রায়না ওরফে বিষ্ণুদাশ বালাপোরিয়ার সঙ্গে তাঁর উদ্দাম প্রেম আছে – একথা একেবারে শুরু থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত দর্শককে (এবং ফেলুদাকে) একটি চুম্বন দৃশ্য উপহার দেওয়া ছাড়া চরিত্রটির আর কোনও ভূমিকা নেই। নায়ক-নায়িকার সম্পর্ক বিরূপাক্ষ মজুমদার হত্যা রহস্যকে নতুন কী দিতে পারল তা বোধহয় জিজ্ঞেস করা উচিত হবে না। কিন্তু সুলভ পর্নোগ্রাফির যুগেও বাঙালি দর্শকের একটি লং শটের চুম্বন দৃশ্যকে বৈপ্লবিক মনে হচ্ছে দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই।

একইরকম অবাক করে গল্পের সাধারণ ভদ্রলোক হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায়কে ‘অ্যাংগ্রি ওল্ড ম্যান’ গোছের চরিত্রে পরিণত করা। তিনি নাকি বিরূপাক্ষবাবুর উপর নজর রাখার জন্য লোক লাগিয়েছিলেন। কী উদ্দেশ্যে তার ব্যাখ্যা অবশ্য চিত্রনাট্যে নেই। উপরন্তু তিনি বলেন, “ব্লাড প্রেশার আর গেঁটে বাতের সমস্যা না থাকলে” তিনি হয়ত বিরূপাক্ষবাবুকে খুন করার চেষ্টা করতেন। এটাও কি আশির দশকের বচ্চনকে ট্রিবিউট? মানে পিরিয়ড পিস হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হঠাৎ একটিমাত্র দৃশ্যে একটিমাত্র দেয়ালে আখরি রাস্তা-র পোস্টার সাঁটা হয়েছে বলে জিজ্ঞেস করছি।

আরও পড়ুন ‘অলৌকিক মেগা সিরিয়াল দেখা সমাজের সত্যজিতের ছবি দেখার কোন কারণ নেই, তিনি উপলক্ষ মাত্র’

ট্রিবিউটাভ্যাস চরমে উঠেছে ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে। কদিন পরে কলকাতা মেট্রোর উত্তমকুমার স্টেশনের আশপাশে হাঁটতে গেলে নির্ঘাত কোনো ব্যোমকেশ বা ফেলুদার চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে যাবে। দেখা যাচ্ছে তাতেও যথেষ্ট ট্রিবিউট হয়নি। তাই সৃজিতবাবুর সিরিজে পুলক ঘোষাল জটায়ুর নারীচরিত্রহীন উপন্যাসের চিত্রনাট্যে নায়িকা আমদানি করার যুক্তি হিসাবে খাড়া করছেন শরদিন্দুর সত্যান্বেষীর বিবাহিত জীবনকে। আবার রহস্যোদ্ঘাটনের দৃশ্যে স্বয়ং ফেলুদা বলছেন চিত্রচোর গল্পের সঙ্গে নাকি বিরূপাক্ষ হত্যার ঘটনার মিল আছে। মিলটি যে কী তা আমার খাটো বুদ্ধিতে ধরা পড়ল না। শরদিন্দুর গল্পের অপরাধী তার পুরনো চেহারাটা গায়েব করার জন্য ছবি চুরি করেছিল। এ গল্পের অপরাধী তো বুঝতেই পারেনি তার একখানা পুরনো চেহারার ছবি রয়েছে নয়নপুর ভিলায়। অবশ্য আমাদের মত দর্শকের বুদ্ধির দৌড় কতটুকু তা নির্দেশক ভালই জানেন। তাই ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্যগুলি বার তিনেক করে না দেখিয়ে ক্ষান্ত দেননি। বিরূপাক্ষবাবুর বুকে ছুরি মারার শটটি যে কতবার কতভাবে দেখিয়েছেন তা গুনতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম।

নস্ট্যালজিয়া ছাড়া আর যে জিনিসটি এখন সেলিং লাইক হট কচুরিজ, সেটি হল গোয়েন্দা গল্প। এই দুয়ের চাপে এই সিরিজের একজন গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেছেন। তাঁর নাম অনির্বাণ চক্রবর্তী। সবে গত মাসে মুক্তি পেয়েছে আরেক গোয়েন্দার কীর্তিকলাপ নিয়ে ছবি দ্য একেন। সেই ছবিতে অনির্বাণ নিজেই গোয়েন্দা। এমন একজন গোয়েন্দা যিনি বিলক্ষণ ভাঁড়ামি করেন। বাংলা প্রবাদ বলতে ভুল করেন, হাস্যকর হিন্দি বলেন। দুটি ছবিরই প্রেক্ষাপট দার্জিলিং, লোকেশনেও মিল। অনেক ফ্রেমে মনে হয় একই ছবি দেখছি। কে জানে, হয়ত শুটিংও কাছাকাছি সময়ে হয়েছে। এই ডামাডোলে অনির্বাণ একেনবাবুই থেকে গেছেন, লালমোহনবাবু হয়ে উঠতে পারেননি। জটায়ু যে ভাঁড় নন তা অভিনেতা বা নির্দেশক কেউই বুঝে উঠতে পারেননি মনে হয়। বিশেষ করে অঘোরচাঁদ বাটলিওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করার সময়ে অনির্বাণ যা করেছেন তা সিনেমা কেন, যাত্রার মঞ্চেও বিসদৃশ লাগে। অবশ্য বিরূপাক্ষ মজুমদারের চরিত্রে বরুণ চন্দ, মহাদেব ভার্মার চরিত্রে সুব্রত দত্ত ইন্সপেক্টর যতীশ সাহার চরিত্রে লোকনাথ দে আর সুচন্দ্রার চরিত্রে মুনমুন রায় ছাড়া এই সিরিজে প্রায় সকলেই বাড়াবাড়ি করেছেন।

ফেলুদার চরিত্রে টোটাকে দিব্যি মানিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চিড়িয়াখানায় চিতাবাঘকে প্রায় কামড়াতে যাওয়া ফেলুদাকে তো মানায় না বটেই, কোনো শিক্ষিত মানুষকেই মানায় না। সোনার কেল্লায় মুকুল ভবানন্দকে দুষ্টু লোক বলে চিনতে পেরেছিল তখন, যখন সে ময়ূরের দিকে গুলি চালায়। জীবজগতের প্রতি এই সংবেদনশীলতা গোটা রায় পরিবারের অভিজ্ঞান। লীলা মজুমদারের ‘কুঁকড়ো’ গল্পেও যার প্রমাণ রয়েছে। ফেলুদাকে হি-ম্যান বানাতে গিয়ে সেই সংবেদনশীলতার জায়গায় আলিপুর চিড়িয়াখানায় যারা বাঘের খাঁচায় ঢুকে তাকে মালা পরাতে গিয়েছিল, তাদের মানসিকতা এনে ফেলা হয়েছে। সন্দীপ রায়ের ফেলুদাও অনেকের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারতেন না, কিন্তু নিদেনপক্ষে তাঁর ফেলুদা সলমন খান বা টাইগার শ্রফ মার্কা মোটা দাগের অ্যাকশন হিরো হয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন না। সৃজিতের ফেলুদা যদি পেশিবহুল চেহারার, বাঘ সিংহের সাথে লড়াই করা পুরোদস্তুর একটি নতুন চরিত্র হয়ে উঠতেন, তাহলেও কথা ছিল। ভাবা যেত বিবিসির শার্লক সিরিজের মত নতুন কিছু হল। কিন্তু এক পা নস্ট্যালজিয়ার সেপিয়া নৌকায় রেখে অন্য পা হাস্যকর মাচোইজমে রাখা এই টলমলে ট্রিবিউট আপন মনে গাওয়ার মত শীর্ষ সঙ্গীতটি ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্র জগৎকে কী দিল?

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

%d bloggers like this: