এখনো তিরিশের নিচে বয়স এবং পৃথিবীর নানা বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ আছে যাদের, তাদের হয়ত তেমন আলোড়িত করছে না এই খবর যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা আর ছাপা হবে না। কারণ তাদের ন্যাট জিও যেমন ছিল তেমনই থাকছে। হাতের মোবাইল, ল্যাপটপ বা বাড়ির টিভিতে মহাবিশ্বের নানা বিস্ময় গোগ্রাসে গেলা যাবে যথারীতি। কিন্তু কলেজ লাইব্রেরিতে হলুদ বর্ডার দেওয়া মহার্ঘ পত্রিকাটি উল্টে পাল্টে দেখেই যাদের সুদূরের পিয়াসা মেটাতে হয়েছে আজ থেকে বছর বিশেক আগে পর্যন্ত, কিনে পড়ার সাধ হলেও সাধ্য হয়নি – তাদের মনে হতে বাধ্য যে একটা যুগের অবসান হল।
এই পত্রিকার যা ইতিহাস তাতে যুগের অবসান কথাটা অন্তত এক্ষেত্রে একেবারেই খবরের কাগজের অতিব্যবহৃত লব্জ হয়ে থাকছে না। ১৮৮৮ সালে স্রেফ স্কলারলি জার্নাল হিসাবে চালু হওয়া পত্রিকা, যা একসময় সারা বিশ্বে মাসে ৪০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে, তার ছাপা বন্ধ হয়ে যাওয়া যুগের অবসান তো বটেই। তবে এমন যুগাবসান প্রকাশনা এবং সাংবাদিকতার জগতে গত এক দশক ধরে হয়েই চলেছে। করোনা অতিমারীর পর থেকে গতি বেড়েছে। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বিপুল জনপ্রিয় বহুজাতিক পত্রিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে এখনো প্রকাশিত হয়) দ্য উইক তাদের অস্ট্রেলিয় সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে সেই ২০১২ সালে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমোন্নতি এবং ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীতেই ছাপা পত্রিকা এবং খবরের কাগজের চাহিদা কমে যাচ্ছে বলে প্রকাশনা সংস্থাগুলোর মালিকদের মত। মার্কিন দেশের বিখ্যাত খবরের কাগজ দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট গত নভেম্বর মাসে রবিবারের কাগজের সঙ্গে যে পত্রিকাটি দিত তার প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছে।
ভারতে নয়ের দশকে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর ‘মিডিয়া বুম’ হয়েছিল। সেইসময় বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় বহু নতুন খবরের কাগজ খোলা হয়, দিল্লি বা মুম্বাইয়ের শতবর্ষ প্রাচীন কাগজগুলো ভারতজুড়ে সংস্করণ চালু করে। ২০১৬ সালের পর থেকে এমন বহু কাগজ, কাগজের সংস্করণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে ২০২০-২২ সময়কালে, অতিমারীতে লোকে কাগজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছে – এই যুক্তিতে। সেই প্রক্রিয়া এখনো চলছে। পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে বসলে উত্তরবঙ্গ সংবাদের একটা গোটা পাতা ভরে যেতে পারে। কথা হল, স্মার্টফোন এবং ক্রমশ দ্রুততর ইন্টারনেট পরিষেবার ফলে অনেকেরই ছাপা পত্রিকা বা খবরের কাগজের প্রতি নির্ভরতা বা আকর্ষণ যে কমেছে তা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকেই মালুম হয়। কিন্তু সেই সংখ্যাটা ঠিক কত? এর কোনো সর্বজনমান্য তথ্যপ্রমাণ কোথাও পাওয়া যায় না। আজ পর্যন্ত কোনো প্রকাশনা সংস্থা কোনো পত্রিকা, কাগজ বা ক্রোড়পত্র ছাপা বন্ধ করে দেওয়ার সময়ে প্রকাশ্যে জানাননি যে তার বিক্রি কতটা কমে গিয়েছিল। তাতে কোম্পানির কত টাকার ক্ষতি হচ্ছিল। বিদেশের কথা জানি না। এ দেশে যে বেশকিছু ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয় বৈজ্ঞানিক উপায়ে পরিচালিত মার্কেট রিসার্চ নয়, মালিকদের খামখেয়ালিপনার ভিত্তিতে – তার প্রমাণ আছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই পশ্চিমবঙ্গের এক বহুল প্রচারিত কাগজ তাদের দুটি ক্রোড়পত্র বিনা নোটিসে বন্ধ করে দেয়। কয়েকদিন আগে “আবার সে এসেছে ফিরিয়া” বলে রঙ্গমঞ্চে ফেরত এসেছে তার একটি। এই আচরণের ব্যাখ্যা একমাত্র পাগলা দাশু দিয়েই হতে পারে, অর্থনীতি দিয়ে নয়।
অবশ্য এসব বলে কোনো লাভ নেই। আজকাল সরকারই জবাবদিহি করতে চায় না, বিপুল পুঁজির অধিকারী ব্যবসায়ীরা জবাবদিহি করতে যাবেন কোন দুঃখে? পাঠক ভাবতে পারেন, জবাবদিহি করার প্রশ্ন আসছেই বা কেন? যুগ বদলায়, প্রযুক্তি বদলায় – এ তো চিরকালের নিয়ম। এমনি এমনি কি আর কবি বলেছেন “বৃদ্ধযুগের গলিত শবের পাশে/প্রাণকল্লোলে ঐ নবযুগ আসে”? মুশকিল হল, এই নবযুগ আসার উল্লাস সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যেই ক্রমশ কমে আসছে, কারণ দেখা যাচ্ছে যখনই নতুন প্রযুক্তি এসে পুরনো প্রযুক্তিকে বাতিল করে দেয়, তখনই বেশকিছু মানুষের রুটিরুজি নিয়ে টানাটানি পড়ে। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে তত সেরকম মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ছাপা পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ায় ১৯ জনের চাকরি গেছে বলে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে। এটি অবশ্য লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা। অসাংবাদিক কর্মচারীদের খবর কেউ রাখে না। যা-ই হোক, সাধারণভাবে কোনো প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে যত লোকের চাকরি যায় তার তুলনায় এই সংখ্যা নগণ্যই বলতে হবে। যা বেশি দুশ্চিন্তার তা হল শুধু যে মুদ্রণ প্রযুক্তিকে ওয়েব প্রযুক্তি টপকে যাওয়ায় পত্রপত্রিকা বন্ধ হচ্ছে আর কিছু মানুষের চাকরি যাচ্ছে তা তো নয়। গতবছর মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন, যার সঙ্গে মুদ্রণ ব্যবসার কোনো সম্পর্ক নেই, তারাও কয়েকশো কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। বাজফিড আর ভাইস, দুটোই সম্পূর্ণ ওয়েব মাধ্যম, তারাও সবমিলিয়ে প্রায় সাড়ে চারশো মানুষকে ছাঁটাই করেছে।
আরও পড়ুন টুইটার, বাইজু’স আঁধারে ছাঁটাই সম্পর্কে কয়েকটি কথা
কেবল সংবাদমাধ্যম নয়, অন্য সব ক্ষেত্রেই বিপুল কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়েছে। অ্যামাজন, গুগল, মেটার মত সংস্থার নাম সবাই জানে বলে তাদের ছাঁটাইয়ের খবর শিরোনাম হয়। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সামগ্রিক অবস্থাই আশঙ্কাজনক। এর উপর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার মত কথা হল, এ আই আসিছে চড়ে জুড়িগাড়ি। এই বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখছি বহুজাতিক এইচ আর কোম্পানি চ্যালেঞ্জার, গ্রে অ্যান্ড ক্রিসমাস দাবি করেছে এ বছরের মে মাসে ৪,০০০ মানুষ কাজ হারিয়েছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কল্যাণে। ওই প্রতিবেদনেই দেখলাম আইবিএমের সিইও অরবিন্দ কৃষ্ণ বলেছেন তাঁরা ধাপে ধাপে ৬,৮০০ কর্মীর জায়গায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আসবেন। এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই নাকি ৪,১৭,৫০০ চাকরি গেছে বিভিন্ন ক্ষেত্র মিলিয়ে। বছরের শুরুতেই এর চেয়ে বেশি চাকরি গিয়েছিল সেই ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে, সংখ্যাটা ছিল ৮,২০,০০০। মার্চ মাসে বিশ্ববিখ্যাত সংস্থা গোল্ডম্যান সাখস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সারা বিশ্বের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন পূর্ণ সময়ের চাকরি খাবে।
আসলে যন্ত্র তো আর চাকরি খায় না, মানুষের চাকরি খায় মানুষই। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সাংবাদিকই বলুন আর তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী, তাঁর কাজটা যে যন্ত্রকে দিয়ে করালে আরও কম খরচে আরও দক্ষভাবে করানো যাবে – সে সিদ্ধান্ত কিন্তু নেয় কয়েকজন মানুষ। তা প্রযুক্তি যদি মানুষের চেয়ে ভাল কাজ করতে পারে, কেন তার ব্যবহার করব না? সিলিং ফ্যান কেনার সামর্থ থাকলে কি হাতপাখা ব্যবহার করি আমরা? নাকি এলপিজি কেনার সামর্থ থাকতেও কয়লার উনুনে রান্না করি? দুটো প্রশ্নেরই উত্তর না। কিন্তু এগুলো বোধহয় ভুল প্রশ্ন। ঠিক প্রশ্ন হল, প্রযুক্তি মানুষের জন্য, নাকি মানুষ প্রযুক্তির জন্য?
উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত