নামকরা লোকেদের কেচ্ছাকাহিনিতে রুচি আছে এমন মানুষের সংখ্যা কোনো দেশে কোনোকালেই দুর্লভ নয়। তথাগত রায়ের যেমন কর্মহীন অবসরজীবনের দুটি ব্রত – মুসলমানদের গাল পাড়া আর লেনিন সিফিলিসে মারা গিয়েছিলেন – একথা প্রচার করা। সারা পৃথিবীতেই কার্ল মার্কস পরিচারিকার সন্তানের পিতা হয়েছিলেন কিনা, জন এফ কেনেডি আর মেরিলিন মনরোর যৌনতা কতটা গনগনে ছিল, মাও সে তুং সমকামী ছিলেন কিনা (যেন সমকামী হওয়া ভীষণ অন্যায়) – এসব পড়তে বেশকিছু লোক মুখিয়ে থাকে। ফলে কেচ্ছার পাত্রপাত্রীরা মরে ভূত হয়ে গিয়ে থাকলেও এ নিয়ে আজও বইপত্র লেখা হয়ে চলেছে। বাঙালিদেরও কেচ্ছাকাহিনিতে বিলক্ষণ রুচি আছে এবং তার মধ্যে প্রিয়তম হল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক নিয়ে কেচ্ছা। খবরের কাগজে তিন-সাড়ে তিন দশক যাবৎ বিখ্যাত মানুষদের কেচ্ছা লিখেই এক সাংবাদিক রীতিমত প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছেন। রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরী নিয়ে একখানা উপন্যাসও ‘নামিয়ে দিয়েছেন’। সে উপন্যাসের যে শুধু বিস্তর কাটতি তা নয়, কিছুদিন আগে শুনলাম এক গবেষককে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক অধ্যাপক জিজ্ঞেস করেছিলেন “আচ্ছা, ওই সুইসাইড নোটটা কোন বইতে পাব বলুন তো?” সোশাল মিডিয়ার যুগে এই কেচ্ছাপ্রীতি যে আরও বেড়েছে তা বলাই বাহুল্য। মুশকিল হল, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীদের ফালতু আড্ডার গণ্ডি পেরিয়ে এখন এসব রাজনৈতিক বিতর্কের জায়গা দখল করে ফেলছে।
সিপিএমের বিরুদ্ধে তর্কে যুক্তি না পেলেই কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপির লোকেরা বলতে শুরু করে জ্যোতি বসু অতি বদ লোক। কারণ তিনি বউ মারা যাওয়ার পর শালিকে বিয়ে করেছিলেন। যেন এর মত পাপ আর দ্বিতীয় নেই এবং জ্যোতিবাবু পৃথিবীর প্রথম ব্যক্তি যিনি এ পাপ করেছেন।
রাহুল গান্ধী মাঝেমধ্যে বিদেশ গেলেই বিজেপি এবং তাদের বশংবদ সংবাদমাধ্যম জল্পনা শুরু করে – ইউরোপের কোনো দেশে নির্ঘাত তাঁর কোনো বান্ধবী আছে, তিনি তার কাছেই যান। রাহুলের মা সোনিয়া ইতালিতে রেস্তোরাঁয় ‘ওয়েট্রেস’ ছিলেন এমনও বলা হয়েছে বিজেপির পক্ষ থেকে (যেন অমন নোংরা কাজ আর হয় না) এবং কয়েক বছর আগে সে কাজের অনুষঙ্গে নানা অশালীন ইঙ্গিতও করা হত নিয়মিত।
নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে যোগ দিয়ে ঘর ছাড়ার আগে বালক বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। তাই তিনি এখনো বিবাহিত না অবিবাহিত – তা নিয়েও বিস্তর কটুকাটব্য হয়ে থাকে।
তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক বছর আগে একবার বলেছিলেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সন্ধেবেলা নন্দনে যেতেন নারী সংসর্গ করতে।
কদিন আগে কুণাল ঘোষ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে যৌন কেচ্ছা উস্কে দিতে তাঁকে সমকামী বলে টিটকিরি দিয়েছিলেন (এর চেয়ে বড় টিটকিরি কি আর আমাদের সংবেদনশীল নেতারা খুঁজে পান?)।
তারপর সাগরদীঘি বিধানসভা কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থীর হাতে দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ের রাগ সামলাতে না পেরে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হুমকি দিয়ে বসলেন, তাঁর মুখ খোলালে ভাল হবে না। তিনি কংগ্রেস নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরীর গাড়ির চালক এবং কন্যা সংক্রান্ত অনেককিছু জানেন। সেসব ফাঁস করে দেবেন।
এর প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস মুখপাত্র কৌস্তভ বাগচী ঠিক করলেন আরও নিচে নামবেন। তাই টিভি স্টুডিওতে বসে টেনে বার করলেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা দীপক ঘোষের লেখা কেচ্ছাকাহিনি।
কেচ্ছা নিয়ে মেতে থাকার সুবিধা হল, কোনো মানুষের সমালোচনা করার জন্য ন্যূনতম পড়াশোনা বা ভাবনাচিন্তা করতে হয় না। রবীন্দ্রনাথ বা মার্কসের লেখা এক লাইনও না পড়ে, লেনিন বা মাওয়ের কাজ সম্পর্কে কিছুই না জেনেও মনের সুখে গাল পাড়া যায়। তেমনই মমতার রাজনীতি, তাঁর প্রশাসন চালানোর ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি, দুর্নীতি, আধিপত্যবাদ – কোনোকিছুর বিরুদ্ধেই কোনো লড়াই না করে স্রেফ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কেচ্ছা নিয়ে চেঁচামেচি করে দিব্য আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়। কোনো পরিশ্রম হয় না।
যে বইটি নিয়ে কথা হচ্ছে, কয়েক বছর আগে পিডিএফ আকারে সেটি হাতে এসে পৌঁছেছিল। কয়েক পাতার বেশি এগোবার প্রবৃত্তি হয়নি। কোনো রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিরই হবে বলে মনে হয় না। কেচ্ছাকাহিনির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, তা মুখরোচক, কিন্তু যে পড়ে তার কল্যাণ-অকল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কহীন। সেই কারণেই যারা পড়ে তারা তারিয়ে তারিয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, প্রমাণযোগ্যতার অভাব। এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটিই, বিজ্ঞাপনের ভাষায় বললে, কেচ্ছার ইউএসপি। যে কেচ্ছা সত্য বা মিথ্যা বলে প্রমাণ করা সম্ভব, তার নিষিদ্ধ মজাটিই নষ্ট হয়ে যায়। ঘোষমশায়ের বইতে এই দুটি বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। ফলে ভোররাত্তিরে গ্রেপ্তার হওয়া কৌস্তভ এবং দারুণ গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন বলে মনে করা যেসব ব্যক্তি পিডিএফটি পশ্চিমবঙ্গের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার শপথ নিয়েছেন, তাঁরা কিছু লোককে ক্ষণিক উত্তেজনার উপাদান জোগানো ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারবেন না। ওতে মমতা আইনত শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ বা প্রমাণ নেই। ঘোষমশাই যেসব ব্যাপারকে নৈতিক অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছেন সেসবও তাঁর মতে অনৈতিক। পশ্চিমবঙ্গের আপামর জনগণের অনৈতিক না-ও মনে হতে পারে। বিশেষত বামপন্থী বলে পরিচিত সিপিএম দলের কর্মী, সমর্থকদের যদি ওর সবকটিই অনৈতিক বলে মনে হয় তাহলে খুবই চিন্তার বিষয়। পার্টি আর কত শতাংশ বামপন্থী আছে তা নিয়েই নেতৃবৃন্দকে চিন্তা করতে হবে সেক্ষেত্রে।
এতগুলি কথা বলে নিতে হল, কারণ কৌস্তভের গ্রেপ্তারি আমাদের এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যার ভয়ঙ্করতা উপলব্ধি এবং প্রতিবাদ এই মুহূর্তের রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রে এসে পড়েছে ঘোষমশাই লিখিত কেচ্ছাকাহিনি।
কৌস্তভ যা-ই বলুন, ওই বই ছেপে বা পিডিএফ আকারে হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া আদৌ কোনো রাজনৈতিক কাজ নয়। কারণ ওটি কোনো নিষিদ্ধ ইশতেহার নয়, যা ছড়িয়ে দিলে রাষ্ট্রকে জোর ধাক্কা দেওয়া যাবে। কিন্তু ওই কেচ্ছাকাহিনির গুণাগুণ বিচার নিষ্প্রয়োজন। যা নিন্দাযোগ্য তা হল কৌস্তভের গ্রেপ্তারি। কোনো মানুষের, বিশেষত কোনো মহিলার, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা কুরুচিকর। তা করার জন্য কৌস্তভ এবং বইয়ের লেখক ঘোষমশায়েরও চরম নিন্দা করা যেতে পারে। কিন্তু একজন ক্ষমতাশালীর নামে কেউ কেচ্ছা লিখেছে, আর সেই কেচ্ছা একজন প্রকাশ্যে বলেছে বলে তাকে গ্রেপ্তার করার মত অগণতান্ত্রিকতা আর নেই। গণতান্ত্রিক অধিকার মূলত অপ্রিয় কথা বলার অধিকার। তার ভাষা, আঙ্গিক সবসময় ভদ্র সভ্য হয় না। কোনটি সভ্য আর কোনটি নয়, তাও নিতান্ত তর্কাতীত ব্যাপার নয়। একজন মহিলার বিরুদ্ধে কুৎসা করা হয়েছে, রাজ্যের প্রধানকে অসম্মান করা হয়েছে – এইসব যুক্তিতে যদি এই গ্রেপ্তারিকে মেনে নেওয়া হয়, তাহলে যে কোনোদিন আমি বা আপনি বাজারে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করার জন্য গ্রেপ্তার হতে পারি। সোশাল মিডিয়া পোস্ট করার জন্যও গ্রেপ্তার হতে পারি, যেমনটা অম্বিকেশ মহাপাত্র বা রোদ্দূর রায়ের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। কোনটা আইনি, কোনটা বেআইনি, কোনটা শালীন ভাষা, কোনটা অশালীন – সে বিচার তো পরে আদালতে হবে। কিন্তু রাজ্যের প্রধান পদাধিকারীর সমালোচনা করা বা তাঁকে গালি দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারির মধ্যেই যে ক্ষমতার আস্ফালন এবং সাধারণ নাগরিকের হয়রানি জড়িয়ে আছে, যা শিলাদিত্য চৌধুরীকে ভোগ করতে হয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে একনায়কতন্ত্রের লক্ষণ।
সপ্তাহ দুয়েক আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সম্পর্কে কটূক্তি করার অভিযোগে কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরাকে প্লেন থেকে নামিয়ে আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করে গ্রেপ্তার করেছিল আসাম পুলিস। উক্তিটি আদৌ কটূক্তি ছিল কিনা নিজের চোখে দেখে বিচার করুন।
CONGRESS BRIEFING ON ADANI ROW
— Mirror Now (@MirrorNow) February 17, 2023
“WE ARE DEMANDING JPC FOR ANSWERS. WHY ARE ALL AGENCIES SILENT ON #ADANIROW?” ASKS @PAWANKHERA PIC.TWITTER.COM/6ABJOG6PHX
তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, এটি কটূক্তিই। কিন্তু যে দেশে প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করলেই গ্রেপ্তার হতে হয় সে আবার গণতান্ত্রিক দেশ হয় কী করে? পবন বা কৌস্তভ নামকরা লোক, তাই গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই জামিন পেয়েছেন। পবনের ক্ষেত্রে স্বয়ং দেশের প্রধান বিচারপতি শুনানি করে জামিন দিয়েছেন। আমি, আপনি গ্রেপ্তার হলে তো এমন হবে না। দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে রাজধানীর বুকে মিটিং, মিছিল করার ‘অপরাধে’ ৪১ দিন হাজতবাস করে সবেমাত্র জামিন পেলেন নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি ও তাঁর দলের সদস্যরা। এর আগে একইরকম ঘটনা ঘটেছিল সিপিএম নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জিসহ অনেকের বেলায়। সেক্ষেত্রে আমার, আপনার পচে মরা ছাড়া কোনো পথ আছে কি? গ্রেপ্তার করার নিয়মকানুন কী, গ্রেপ্তার হওয়া মানুষের অধিকারগুলিই বা কী – তাও তো আমরা আইনজীবী কৌস্তভের মত করে জানি না। তাহলে কি আমি লেখা বন্ধ করে দেব, আপনারা পড়া এবং শেয়ার করা বন্ধ করে দেবেন? এই আমাদের গণতান্ত্রিক রাজ্য? এই আমাদের বিজেপিকে রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে না দেওয়ার প্রতিদান?
স্বীকার্য যে আমাদের সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে প্রকাশ্য আলোচনায় মহিলাদের সম্বন্ধে কথা বলার সময়ে আমাদের শব্দচয়ন এবং বিষয় নির্বাচন কিছুটা বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশের আইনও কতকটা তাই বলে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, মুখ্যমন্ত্রী যে কোনো মহিলা নন। তিনি রাজ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। তাঁর হাতে যতখানি ক্ষমতা আছে তা পশ্চিমবঙ্গের অন্য কোনো মহিলা দূরের কথা, কোনো পুরুষের হাতেও নেই। রোজ এ রাজ্যের যতজন মহিলা রাস্তাঘাটে কটূক্তি এবং তার চেয়ে অনেক বেশি – যৌন হয়রানি – হজম করেন, তাঁরা কিন্তু এত ক্ষমতার অধিকারী নন। কৌস্তভের ক্ষেত্রে যে তৎপরতা দেখিয়েছে রাজ্য পুলিস, সে তৎপরতা তাঁরা তো আশা করতেই পারেন না, এমনকি অনেকসময় ধর্ষণের অভিযোগেও পুলিসকে নড়ে বসতে দেখা যায় না। উপরন্তু এ রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী সেই ২০১১ সাল থেকে যে কোনো ধর্ষণের ঘটনাতেই হয় ধর্ষিত মহিলার দোষ দেখতে পান, নয় বিরোধীদের চক্রান্ত দেখতে পান। পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, হাঁসখালি – কোথাও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অর্থাৎ ক্ষমতার ভাষা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তিনি পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি। টিভি স্টুডিও থেকে কেচ্ছা ছড়ানোর কারণে কৌস্তভের গ্রেপ্তারি দেখে সুজেট জর্ডান বোধহয় কবরে পাশ ফিরে শুলেন। একটি হতকুচ্ছিত বইয়ের পিডিএফ শেয়ার করা তাঁর কবরকে আরও কণ্টকাকীর্ণ করবে।
নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত