বিবি বিদায় নিলেও বদলাবে না ইজরায়েল

বিবি লঙ্কা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এখন সেখানে যে যাবে সে-ই হবে রাবণ।

বিবি

“… সরে যাওয়ার পর তাঁর উত্তরাধিকার বলতে আরও সুরক্ষিত একটা দেশ থাকবে না, থাকবে একটা গভীরভাবে বিভাজিত সমাজ, যা দেওয়ালের আড়ালে বাস করে।” কথাগুলো লিখেছিলেন একজন প্রধানমন্ত্রীর জীবনীকার, ২০১৮ সালে প্রকাশিত জীবনীতে। দেশটা নানা ভাষা নানা মতের দেশ ভারত নয়। নেতার নাম নরেন্দ্র মোদী নয়। দেশটার নাম ইজরায়েল, নেতার নাম বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু, বইটার নাম বিবি, লেখক ইজরায়েলি সাংবাদিক আনশেল ফেফার। একটানা বারো বছর, সব মিলিয়ে ১৫ বছর, ক্ষমতায় থাকার পর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় বন্ধু বিবি সম্প্রতি পদচ্যুত হলেন।

বিবির বন্ধু, শত্রু উভয়েই বলেন পদ আঁকড়ে থাকায় তাঁর জুড়ি নেই। বহুদিন থেকেই গদি টলোমলো। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, ২০১৯ সালে প্রথম ক্ষমতাসীন ইজরায়েলি নেতা হিসাবে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। অভিযোগ তিনি কোটিপতিদের কাছ থেকে দামি উপহার নিয়েছেন, তার বদলে সংবাদমাধ্যম ও টেলিকম কোম্পানির মালিকদের অন্যায় সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। বিবির বন্ধুর দেশে এসব কোনও অভিযোগই নয়। যারা অভিযোগ করছে তাদের পাপ্পু, দেশদ্রোহী, আর্বান নকশাল ইত্যাদি বলে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়। কিন্তু ইজরায়েলে তা হবার জো নেই। অতিমারীর মধ্যেও বিরাট মিছিল হয়েছে বিবিকে সরানোর দাবিতে। কিন্তু বিবির অমিত শাহ না থাকলেও কৌশল আছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন কৌশলের জোরেই তিনি বিরোধীদের দ্বিধাবিভক্ত করে রেখে এতদিন ক্ষমতায় টিকে গেলেন। শেষমেশ তাঁরই প্রাক্তন চিফ অফ স্টাফ, প্যালেস্তাইন সম্বন্ধে তাঁরই মত গোঁড়া মানসিকতার নাফতালি বেনেত্তে থেকে শুরু করে আরব ইসলামিস্ট পর্যন্ত সকলে হাত মিলিয়ে নেতানিয়াহুকে পদচ্যুত করতে পারলেন।

যা যা অভিযোগ আছে তাতে বছর দশেক কারাবাসের সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু বিবি সফলভাবে ইজরায়েলকে প্রবলভাবে যুযুধান দেশে পরিণত করেছেন। তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন প্যালেস্তাইন সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, এখন আর তা-ও নেই বলে মনে করা হচ্ছে। পিটিয়ে সবকিছুই ঠান্ডা করে দেওয়া যায় — এই মানসিকতা দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। উত্তরসূরী বেনেত্তের সাথে নেতানিয়াহুর মতাদর্শগত তফাত নেই। অর্থাৎ বিবি লঙ্কা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এখন সেখানে যে যাবে সে-ই হবে রাবণ।

আরও পড়ুন বিবিসিকে বাদ দিয়ে বিশ্বগুরু থাকতে পারবেন মোদী?

ইজরায়েল অবশ্য রাষ্ট্র হিসাবে বিবির আগে থেকেই আধিপত্যবাদী। তবে বিবির মত বুক ফুলিয়ে আধিপত্যবাদকে আদর্শ হিসাবে খাড়া করতে সকলে পারে না। ১০ই জুলাই ১৯৯৬ তারিখে মার্কিন কংগ্রেসে প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি বলেছিলেন হিব্রু ধর্মশাস্ত্রে লেখা আছে, ঈশ্বর তাঁর ভক্তদের শক্তি দেবেন এবং শান্তি দিয়ে আশীর্বাদ করবেন। অতএব শক্তি থেকেই যে শান্তি আসে — এটাই সত্য। গোদা বাংলায় বললে, সবই ব্যাদে আছে এবং ব্যাদে যা আছে তা-ই শেষ সত্য। বোঝা শক্ত নয়, কেন বিবি আর মোদী সাহেবের গলাগলি হয়েছিল। কেনই বা স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারের অনুসৃত বিদেশনীতি থেকে সরে এসে ইজরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়ল মোদী সরকার, কেন ভারতের আন্দোলনকারীদের মোবাইল ফোনে পেগ্যাসাসের মত ইজরায়েলি সফটওয়্যারের উঁকি ঝুঁকি শুরু হল।

মোদীর মতাদর্শগত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হাতে আর সেই সঙ্ঘের গুরু গোলওয়ালকর ছিলেন নাজি ভক্ত। ‘উই, অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ বইতে ইহুদী নিধনের জন্য তিনি জার্মানির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তা সত্ত্বেও মোদী কী করে ইজরায়েলের সাথে গা মাখামাখি করেন, তা নিয়ে বিজেপি-বিরোধীদের প্রায়ই বিস্ময় প্রকাশ বা কটাক্ষ করতে দেখা যায়। তাঁরা আসলে এখনও হলোকস্টের যুগে পড়ে আছেন, মোদী আর বিবি এগিয়ে গেছেন। দুজনেই জানেন এ যুগে আর এক লপ্তে গণহত্যা করে ‘শত্রু’ জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব নয়। শক্তি প্রদর্শন করে ক্রমশ প্রান্তিক করে দেওয়াই পথ। সে কাজ করতে পারলে কে ক্ষমতায়, তাতে কিছু এসে যায় না। ভারতকে ইজরায়েলের মত লঙ্কায় পরিণত করতে বিবির সাহায্য প্রয়োজন ছিল। মোদীর পরে যে দলের যিনিই আসুন, তিনি যেন বেনেত্তির মতই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন তা নিশ্চিত করতে হবে তো।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার।

Leave a Reply

%d bloggers like this: