এ লেখার শিরোনামের জন্য আমি এক অগ্রজ সাংবাদিকের কাছে ঋণী। তাঁর সঙ্গে যে সময় কাজ করতাম তখন নানা কথায় তিনি বলতেন “বাঙালি ভুল জায়গায় সিরিয়াস, তার ভুল জায়গায় আবেগ।” সত্যি বলতে তখন কথাটা শুনে বেশ রাগই হত। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে যা চলছে তাতে তাঁকে সামনে পেলে করজোড়ে নিবেদন করতাম “গুরু, তুমিই ঠিক। তুমিই সত্য।” কথাটা হোয়াটস্যাপেও লেখা যায়, কিন্তু তাতে আবেগটা (ভুল জায়গায় হলেও) ঠিক ফুটিয়ে তোলা যায় না।
বিষয়টা হল এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানির টিভি বিজ্ঞাপন। জনগণ দেখছি যারপরনাই রুষ্ট। ডান, বাম, যখন-যেমন-তখন-তেমন নির্বিশেষে সকলেই গেল গেল রব তুলেছেন। বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতির জন্যে কেঁদে কেটে একসা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান তথা কবিতার প্যারডি বানিয়ে ফ্ল্যাট বেচছে প্রোমোটার। তাতে বাঙালি সংস্কৃতি প্রায় ক্যাওড়াতলা পৌঁছে গেছে বলে অভিযোগ। যতদিন লোকে ফেসবুকে বিষোদগার করছিল তদ্দিন ব্যাপারটা নিয়ে আদৌ ভাবনা চিন্তা করিনি। কিন্তু তারপর জানলাম শ্রীরামপুরে (যেখানে প্রাসাদোপম ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর মাথা তুলে দাঁড়ানোর কথা) নাকি এ নিয়ে কারা সব মিটিং মিছিলও করে ফেলেছে। ভুল জায়গায় সিরিয়াস হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
কার সংস্কৃতি কে রাখে? ভদ্দরলোকেরা আজকাল পারতপক্ষে ছেলেমেয়েকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেন না, কেউ করলে দিন রাত কানের কাছে বলতে থাকেন “এসব স্কুলের মিডিওকাররাও কিন্তু ওদের স্কুলের ফার্স্ট বয়দের থেকে ভাল।” যেন ইংরিজি মাধ্যম স্কুল থেকে ফি বছর শয়ে শয়ে শেক্সপিয়ার আর ডিকেন্স বেরোচ্ছে, বাংলা মাধ্যম থেকে কেবল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি লিট।
ইংরিজির জন্যে আকুতি না হয় তাও মানা গেল, ইদানীং আবার বাংলা সরিয়ে হিন্দিকে দ্বিতীয় ভাষা করবার হিড়িক পড়েছে বাঙালি বাবা মায়েদের মধ্যে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মাঝে একবার, কে জানে কোন লগ্নে, বললেন বাংলার সব শিশুকে বাংলা পড়াতেই হবে। তাতে প্রগতিশীল বাঙালিরা একেবারে রে রে করে উঠলেন। তখন সংস্কৃতি, ঐতিহ্য — এসব মনে ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী লগ্ন দোষ কেটে যেতেই আবার ওসব ভুলে গিয়ে হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে নেমে পড়েছেন। সেসবের বিরুদ্ধে কে কে কোথায় কোথায় মিছিল করেছেন জানতে ইচ্ছে করে। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো উঠে যাচ্ছে। কদিন আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত স্কুলটাই উঠে যেতে বসেছিল, কিছু ক্ষুদিরামপ্রতিম মানুষ আপাতত আটকেছেন। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী কদিন আগে বলেছেন সরকার ভাবছে স্কুলগুলোকে ইংরিজি মাধ্যম করে দেবে কিনা। এসবের কটা প্রতিবাদ হয়েছে? বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোর মানোন্নয়নের দাবীতে সরকারের পেছনে কজন লেগেছে? ওসবে কারোর আগ্রহ নেই। কোথায় কোন বিজ্ঞাপনে দ্বিজেন্দ্রলালের প্যারডি করা হয়েছে তাই নিয়ে আন্দোলন।
এসব নাটক যতই করুন, দুনিয়াশুদ্ধ লোক জেনে গেছে বাঙালির বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। নাহলে বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানির সাহস হয় না কলকাতার দৈনিকগুলোর প্রথম পাতায় ছাপার বিজ্ঞাপনের বয়ানটা স্রেফ গুগল ট্রান্সলেটরের হাতে ছেড়ে দেওয়ার। নিশ্চিত থাকতে পারেন ওরকম তামিলে চেন্নাইয়ের কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোলে বা অমন মালয়ালমে তিরুবনন্তপুরমের কাগজে বিজ্ঞাপন বেরোলে কোম্পানিটির সর্বভারতীয় সি ই ও টিকে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে হত।
আর জানবে না-ই বা কেন? পনেরো থেকে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী বাঙালিদের কথা শুনেছেন?
“আরে ইয়ার, তোদের একটা কথা কতবার বলতে হবে?”
“বস, কাজটাতে এত এফর্ট দিলাম, অব এক পার্টি তো বনতা হ্যায়।”
“যা-ই বল, মেয়েটা কিন্তু একটু হটকে।”
“উফ! কাকিমা আলুর দমটা যা হয়েছে না। অসাম।”
কারোর দিকে আঙুল তুলে লাভ নেই। এই ভাষায় কথা বলছে আমার আপনার ভাই, বোন, ছেলেমেয়েরা। বিদ্রোহ, বিপ্লব যা করতে ইচ্ছে করে নিজের ঘর থেকে শুরু করুন না। আর যদি আমার মত অক্ষম হন, তাহলে স্রেফ “চেপে যান”, লোক হাসাবেন না।
আমার মত মফঃস্বলের গাঁইয়ার কথা ছেড়ে দিন, শহুরে বাঙালিদের মুখে, ফি হপ্তায় মলে যাওয়া বাঙালিদের কাছে গত এক দশক ধরে শুনছি বাংলা সিনেমায় নাকি নবজাগরণ এসেছে। তা নবজাগরণের যুগে বাংলা ছবির নাম কী হচ্ছে? ম্যাডলি বাঙালি; মাছ, মিষ্টি অ্যান্ড মোর; আমি আর আমার গার্লফ্রেন্ডস, ঘরে অ্যান্ড বাইরে, অ্যাডভেঞ্চারস অফ জোজো। যেসব ছবির নাম তবু আগাগোড়া বাংলা সেগুলোরও টাইটেল কার্ডে বাংলা হরফ খুঁজে পাওয়া ভার। এমনকি আমাদের এ যুগের মহানায়ক, যিনি নাকি সংসদে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, তাঁর ছবির পোস্টারেও বাংলা হরফ খুঁজে হতাশ হয়েছি। সে ছবিটার রেডিও বিজ্ঞাপনে শুনলাম তিনি বললেন “Let’s celebrate পয়লা বৈশাখ, let’s celebrate Kabir.” উত্তমকুমার মরে বেঁচেছেন। আমার শুধু ভয় করে এই রিমেকের যুগে আবার সপ্তপদী রিমেক না হয়। শেক্সপিয়ারের সংলাপ বলা তাঁর দ্বারা হবে না, উৎপল দত্তকে লাগবে — এটা বোঝার বিনয় বা কান্ডজ্ঞান তো এখনকার মহানায়ক বা নির্দেশকদের মধ্যে দেখা যায় না। উত্তম, অজয় করের মত ভেতো বাঙালি তো এঁরা নন, সারাসসোয়াতির সাক্ষাৎ বরপুত্র সক্কলে।
তা ভদ্রমণ্ডলী এসবের প্রতিবাদ কবে করবেন? এতে ঐতিহ্যে আঘাত লাগছে না? নাকি আপত্তিটা দ্বিজেন্দ্রলালে হাত দেওয়া হয়েছে বলে? তা যদি হয় তাহলে ব্যাপারটা আরো হাস্যকর। দ্বিজেন্দ্রলাল স্বয়ং প্যারডি লিখতেন। রবীন্দ্রনাথের গান “সে আসে ধীরে, যায় লাজে ফিরে / রিনিকি ঝিনিকি রিনিঝিনি মঞ্জু মঞ্জীরে।” দ্বিজেন্দ্রলালের প্যারডি “সে আসে ধেয়ে, এন ডি ঘোষের মেয়ে / ধিনিক ধিনিক ধিনিক, চায়ের গন্ধ পেয়ে।” আপনি বলতেই পারেন কাজটা ভাল হয়নি, আমাদের কবিগুরুকে নিয়ে মশকরা অতি গর্হিত ব্যাপার ইত্যাদি। কিন্তু যিনি নিজেই প্যারডিশিল্পী, তাঁর লেখার প্যারডি হলে আন্দোলনে নামা চলে না। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের কোন গানের বাণীর দিকে আদৌ কান না দিয়ে ঝাঁ ঝাঁ করে পাঁচশো বাজনা বাজিয়ে বা মাঝখান থেকে গাইতে শুরু করার চেয়ে একখানা ভাল প্যারডি করা অনেক বেশি উদ্ভাবনী শক্তির পরিচায়ক। আচ্ছা সত্যি বলুন তো, এত যে দ্বিজেন্দ্রপ্রেম দেখা যাচ্ছে, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি” ছাড়া ওঁর লেখা আর কটা গান কজনের মনে আছে? গোটা পাঁচেকের বেশি কি? তাহলে যে গীতিকারকে পরশু অব্দি ভুলে ছিলেন তাঁকে নিয়ে সংস্কৃতির ঢাক তেরে কেটে তাক তাক করে না বাজালেই নয়?
কারো কারো অবশ্য আপত্তি অন্যত্র। “এরকম একটা গানকে সামান্য ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহার করল? এর সাথে জাতীয় আবেগ জড়িয়ে…।” আবার ভুল জায়গায় আবেগ। বিজ্ঞাপনের ইতিহাস না ঘেঁটেও বোঝা যায় চিরকাল বহু জনপ্রিয়, আবেগজড়িত আসল গান, আসল সুরকে ব্যবহার করে বহু বিজ্ঞাপন তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তেই যেমন একটা ধূপের বিজ্ঞাপনে ভীষণ বেসুরো গলায় “আমার এ ধূপ না পোড়ালে / গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে” গাওয়া হচ্ছে। বাজি রেখে বলতে পারি এই লেখায় যে মুহূর্তে টাইটান শব্দটা আপনি পড়বেন, অমনি মাথায় একটা সুর বেজে উঠবে। সেটা কী আসলে? মোজার্টের ২৫ নম্বর সিম্ফনির একটা অংশ। ওটা টাইটানের বিজ্ঞাপনে ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে আসছি। ওটা বাদ দিয়ে আজ আর টাইটান ঘড়ির কথা ভাবাই যায় না। তাতে কী এসে গেল মোজার্টের? কী-ই বা এসে যায় রবীন্দ্রনাথের? নাকি বক্তব্যটা এই যে আসল গান গাও আপত্তি নেই, প্যারডি গেয়ে জিনিস বেচা চলবে না? এ যুক্তি তো খন্ডনেরও অযোগ্য।
সত্যি সত্যি আন্দোলন করবেন? ইস্যু কম পড়িয়াছে? কেন? কোথাও কোন চাকরিতে কর্মীদের অধিকার বলে কিছু থাকছে না। তাই নিয়ে পথে নামুন না। এ তো আপনারই ইস্যু, চাষাভুষোদের ইস্যু নয়, যারা মিছিলে নামলে আমরা সাদা কলারের চাকুরেরা বলি “কোন কাজ নেই, কলকাতায় ঘুরতে আসে আর ফ্রিতে বিরিয়ানি খেয়ে যায়।”
গত তিরিশ বছরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার ঠ্যালায় কলকাতার জলাভূমি প্রায় নিশ্চিহ্ন, মফঃস্বলে পুকুর চুরি আর বাগধারা হয়ে নেই। তার ফলে ক্রমবর্ধমান জঞ্জালের স্তূপ, সাবমার্সিবল পাম্পের বাড়বাড়ন্তে ভূগর্ভের জলস্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। অথচ এগুলো কোন রাজনৈতিক দল ইস্যু বলে মনে করে না। এসব নিয়ে আন্দোলন করুন না। স্তূপীকৃত জঞ্জাল কোন সংস্কৃতির পরিচায়ক?
রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সুবিধার্থে আইন কানুন বদলে ফেলে হেরিটেজ বিল্ডিং ভেঙে ফেলার সুবব্যবস্থা হয়েছে। তাতে ঐতিহ্য সঙ্কটে পড়েনি? তার প্রতিবাদ করবেন না?
উন্নয়নের নামে হাজার হাজার গাছ কাটা হয়ে গেল। আপনারা সৌন্দর্যায়ন হচ্ছে বলে আহ্লাদে আটখানা হলেন। গাছের চেয়ে কংক্রিট ভাল — এই সৌন্দর্যবোধ কোন সংস্কৃতির অভিজ্ঞান? এখন বায়ু দূষণে দিল্লীর সাথে পাল্লা দিচ্ছে কলকাতা। তা নিয়ে আন্দোলন করবেন না? বাঙালির তো প্রাণ রক্ষার সঙ্কট সেটা। প্রাণ বাঁচলে তবে তো সংস্কৃতি বাঁচবে। ঐতিহ্য কার? মানুষেরই তো?
নাঃ! বাদ দিন। এত কে ভাবতে যাবে? আর এসব নিয়ে মিছিল করতে গেলে আবার চড়াম চড়াম ঢাক বাজার সম্ভাবনা আছে। তার চেয়ে “শ্রীকান্তর গান এত ভালবাসতাম, আর ও কিনা এই বিজ্ঞাপনে গাইল!” বলে হা হুতাশ করতে করতে সিরিয়াস আলোচনা করা যাক।
ভুল জায়গায় সিরিয়াস
দুনিয়াশুদ্ধ লোক জেনে গেছে বাঙালির বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই
দারুণ লেখা। তবে দ্বিজেন্দ্রলাল শিবির বনাম রবীন্দ্রনাথ শিবিরের লড়াইটা খুব একপেশে ছিলোনা। এক বিখ্যাত রবীন্দ্র ভক্ত কবি, নিজে ছন্দের রাজা নামে পরিচিত, দ্বিজেন্দ্রলালের কবিতার প্যারডি করলেন; বিষয় দ্বিজেন্দ্রলালের মদ্যপানের প্রতি প্রবল আসক্তি। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সেই কবিকে ভর্ৎসনা করলেন না। এসব বোধহয় চেপে যাওয়াই ভালো!!