থামো, ভাবো

আমাকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে কেউ যদি বলে “ঐ একটা লম্পট ধর্ষক যাচ্ছে”, তাহলে আমার বলবার কিছু নেই

ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার হিড়িকের পাশাপাশি আমাদের ছাত্রজীবনের শেষ দিক থেকেই সাংবাদিক হওয়ার হিড়িক দেখেছি। বিখ্যাত হতে কে না চায়? টিভিতে মুখ দেখানোর অভিলাষ বা কাগজে ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখার আশ বহু ছেলেমেয়েকে গত দুই দশকে সাংবাদিকতায় আকৃষ্ট করেছে। পেশার সুবিধাগুলো এত দৃশ্যমান যে এই একটা অন্যরকম পেশায় যাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করলে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বাবা-মায়েরাও আপত্তি করেননি, উলটে সাধ্যাতীত সাহায্য করেছেন। আত্মীয়স্বজনরাও সপ্রশংস চোখে তাকিয়েছে। কিছু সত্যিকারের ভাল প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা একগাদা জার্নালিজম স্কুল এই হিড়িকটাকে আরো উশকে দিয়েছে।
এই হিড়িক কলকাতাঘেঁষা মফঃস্বলে বসে আমার সাড়ে তেরো বছরের সাংবাদিক জীবনে খুব টের পেয়েছি। বহু অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে তাদের বাবা-মায়ের সাথে, যারা একটু বেশি সপ্রতিভ তারা একাই, আমার কাছে এসেছে কী করে সাংবাদিকতা পড়া যায়, কী করে সাংবাদিক হওয়া যায় সেই প্রশ্ন নিয়ে। আমার চাকরিজীবনের প্রথম তিন চার বছর বাদ দিলে বাকি সময়টা তথ্যগুলো দিয়েও তাদের নাগাড়ে নিরুৎসাহিত করে গেছি। আমি যে কলেজের ছাত্র সেই কলেজের মাস্টারমশাইরা বছরখানেক আগে এই একই ব্যাপারে আমাকে বলতে ডেকেছিলেন। সেখানে গিয়েও খুব উৎসাহব্যঞ্জক কিছু বলতে পারিনি। এই আচরণে অনেকেই বা সকলেই অসন্তুষ্ট হয়েছেন, হয়ত প্রকাশ করেননি। গত কয়েকদিনের ঘটনাবলী তাঁদের মধ্যে যাঁরা লক্ষ্য করেছেন তাঁরা আশা করি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
কোন পেশায় সবাই ভাল লোক নয়, সব পেশারই ভালমন্দ আছে — এই জাতীয় ধ্রুব সত্য বলে যে সত্যকে আজ আর আড়াল করা যাবে না সেটা এই যে আমাকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে কেউ যদি বলে “ঐ একটা লম্পট ধর্ষক যাচ্ছে”, তাহলে আমার বলবার কিছু নেই। কারণ এদিক থেকে আমার পেশার বিশ্বাসযোগ্যতা বিনষ্ট হয়ে গেছে। আমি নিজে যদি তেমন ইতর না-ও হই, তেমন ইতররা যে আমার পেশায় আছে তার প্রচুর তথ্যপ্রমাণ জনসমক্ষে এসে গেছে। আজ যদি কোন বাবা-মা বলেন “আমার মেয়েকে আর যা-ই হোক সাংবাদিকতা করতে দেব না” তাহলে তাঁদের রক্ষণশীল বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আমিও মেয়ের বাবা। আমিই কি শ্বাপদসঙ্কুল জঙ্গলে জেনেশুনে মেয়েকে ছেড়ে দেব? কোন বাবা-মাই কি তা পারে?
যেদিন গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে এই পেশাটার আমার আর দরকার হবে না সেদিন এ বিষয়ে আরো লিখব। আজ শুধু এটুকু বলি যে আমার মহিলা সহকর্মীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেছে গত কয়েকদিনে। কারণ পুরুষ হয়ে জন্মানোর সৌভাগ্যে আমরা জানতেই পারি না এমন অনেক নিপীড়ন সহ্য করেও তাঁরা আমাদের সমান তালে কাজ করেন।
যে তরুণ তরুণীরা এখনো সাংবাদিক হতে চায় তাদের বলি, থামো, ভাবো, তারপর সিদ্ধান্ত নাও। খ্যাতির শুরু আছে, শেষ আছে। কুখ্যাতির শেষ নেই।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন।

Leave a Reply

%d bloggers like this: