“আবার সে এসেছে ফিরিয়া।” ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে সেল, ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে বোনানজা, টিভিতে ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে স্পেশাল, শপিং মলে আজাদি ডিসকাউন্ট, খাসির মাংস, পিকনিক, মদ আর ডেসিবেল নিরপেক্ষ বক্স সহযোগে ছুটি কাটানো — সব ফিরে এসেছে। কিন্তু নাজিব ঘরে ফেরে নাই, রোহিত ঘরে ফেরে নাই, পেহলু ঘরে ফেরে নাই, রাকবর ঘরে ফেরে নাই।
মেয়ে স্কুলের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে। সেই সংক্রান্ত কিছু কেনাকাটা করতে গতকাল সন্ধ্যায় দোকানে গেছি। দোকানের দোরগোড়ায় দুই প্রবীণ আমাদের মফঃস্বলের এলায়িত সন্ধ্যার সদ্ব্যবহার করছিলেন খোশগল্প করে। যখন দোকানে গিয়ে বসলাম তখন আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল তরুণ প্রজন্মের অধঃপতন। বোধহয় প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রবীণেরা এই আলোচনা করে আসছেন। আর বছর কুড়ি বাঁচলে হয়ত আমিও করব। তাই কথাগুলোয় কান দিইনি। দিতে হল, যখন শুনলাম একজন বলছেন “এদের সব্বোনাশ করে দিল সিনেমা। সে সিনেমা করে কারা? এই খানগুলো। শাহরুখ খান, সলমন খান, আমির খান। পাকিস্তানের লোক পাকিস্তানের কালচার এখানে চালিয়ে দিল। দিয়ে কোটি কোটি টাকা করে ফেলল।”
আমার কান খাড়া।
“আর এদের নিয়ে কী করবে তুমি? তাড়াতেও তো পারবে না। তাড়াতে গেলে আবার এই ছেলেমেয়েরাই সব আপত্তি করবে।”
এরপর চুপ করে থাকা অসম্ভব, অনুচিতও। অতএব লোকটার দিকে ঘুরে সোজা প্রশ্ন করলাম “আপনি কি শাহরুখ খানকে পাকিস্তানি বললেন?”
“হ্যাঁ বললাম। তো?”
“আপনি জানেন শাহরুখের ঠাকুর্দা কে?”
“না। বয়ে গেছে।”
“শাহরুখের ঠাকুর্দা নেতাজির সাথে আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। সেই লোক পাকিস্তানি? তাহলে হিন্দুস্তানি কে? আপনি?”
বলার পর, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, লোকটা একেবারে থম মেরে গেল। আরো মিনিট পাঁচেক ছিলাম দোকানে। দুজনের একজনও আর একটা শব্দ বার করেনি মুখ থেকে। বেশ আনন্দই হল। কিন্তু মাথাটা ঠান্ডা হওয়ার পর আর সে আনন্দ থাকল না। ভেবে দেখুন, শাহরুখ খানের ঠাকুর্দা যে আজাদ হিন্দ ফৌজে ছিলেন সেটা তো নেহাতই ঘটনাচক্র। এদেশের কোটি কোটি মুসলমানের পরিবারের কেউ ওরকম নাম করা লোক ছিলেন না। পরাধীন ভারতের কোটি কোটি হিন্দু পরিবারের মতই তাঁরা নিতান্ত সাধারণ মানুষ, হয়ত স্বাধীনতা আন্দোলনে কণিকামাত্র অবদান ছিল অথবা ছিল না। তা বলে তাঁরা আমার চেয়ে কম ভারতীয় বলে ধরে নিতে হবে? দিবারাত্র তাঁদের দেশপ্রেমের প্রমাণ দিতে হবে?
কই, আমাকে তো কেউ জিজ্ঞেস করে না আমি দেশপ্রেমিক কিনা? আমার ভারতীয়ত্ব নিয়ে তো কেউ প্রশ্ন তোলে না। পরিচিত যারা জানে আমার ঠাকুর্দা ইংরেজ আমলে ইংরেজদের অধীনে চাকরি করতেন, তারাও জাতীয় পতাকার প্রতি আমার আনুগত্য নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলে না। এই যে আমি শাহরুখ খানের সমর্থনে তাঁর পিতামহের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তুলে ধরলাম, এতে কি আমি মুসলমানবিদ্বেষী ছদ্ম জাতীয়তাবাদকেই এক ধরণের বৈধতা দিলাম?
দোকানে বসা বৃদ্ধের হয়ত সাহস বা সামর্থ্য কোনটাই নেই নিজের দেগে দেওয়া দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কিছু করার, কিন্তু ঐ লোকটার মত একজনই তো গতকাল গুলি করতে গিয়েছিল ছাত্রনেতা উমর খালিদকে। গুলিটা তো আসলে খালিদকে নয়, করা হয়েছে আমাদের স্বাধীনতাকে। যে দেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষ সহনাগরিকদের নাগরিকতার, দেশের প্রতি আনুগত্যের শংসাপত্র দিতে সদাব্যস্ত, সে দেশে আসলে তো স্বাধীনতা নেই। যতই স্কুলে স্কুলে সাতসকালে পতাকা তোলা হোক।
শুধু ক্রেতা হওয়ার স্বাধীনতা কোন স্বাধীনতাই নয়।
Copyright © All rights reserved.
Proudly powered by Powered by WordPress.com.
%d bloggers like this: