শিশুসুলভ আচরণ শিশুরা করলেই ভাল লাগে, তাই না? বড়রা তেমন করলে সবসময় যে হেসে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব তা নয়। অনেকসময় অসহ্য লাগতেই পারে। আর সত্যি কথা বলতে কি, বড়রা শিশুদের ভাল আচরণগুলো অনুসরণ করছে এমনটা কমই দেখা যায়, বেছে বেছে খারাপগুলোই করে। এব্যাপারে বড়দের ধারাবাহিকতা এমনই যে আমার তো সন্দেহ হয় আদৌ খারাপ আচরণগুলো শিশুদের নিজেদের মাথা থেকে বেরোয় কিনা। হয়ত সেগুলো তারা বড়দের থেকেই শিখেছে! অনেকক্ষেত্রে তো আমি নিশ্চিত যে ওগুলো তাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে।
নার্সারিতে পড়ে তিনটে বাচ্চা মেয়ে। দুজন টকটকে ফরসা, একজন শ্যামবর্ণ। ফরসা দুজনের একজন আর শ্যামবর্ণ মেয়েটা রোগা প্যাটকা, অন্যজন গোলগাল। একজনের বাবা-মা চাকরিজীবী, দুজনের মা গৃহবধূ। একজনের বাবার ব্যবসা। মেয়ে তিনটে কিন্তু এসব কিছুই জানে না এবং জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। প্রত্যেকের কাছে অন্য দুজনের একটাই পরিচয় “বন্ধু”। এরকমটা বড়দের মধ্যে বড় একটা দেখা যায় কি? বড়রা তো বন্ধুত্বও পাতায় অনেককিছু বিচার করে। কেউ কেউ তো বামুন না কায়েত না শিডিউলড কাস্ট সেটাও বিচার করে।
এবার এই তিনজনের মধ্যে ঢুকে পড়লেন একজনের বাবা-মা। কোন একদিন শ্যামবর্ণ মেয়েটার বাবার চোখে পড়ল গোলগাল মেয়েটা স্কুলে এসেছে বাবার গাড়ি চেপে। পত্রপাঠ মেয়েকে বোঝানো হয়ে গেল “ওর সাথে মিশবি না। ওরা অনেক বড়লোক, ওদের সাথে আমাদের মেলে না।” এরকম অযৌক্তিক যুক্তিকে ছেলেমানুষি ছাড়া কিছু বলা যায় কি? কিন্তু এটাকে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই কারণ মেয়ে পরেরদিন স্কুলে গিয়ে তিন নম্বর বন্ধুকেও বুঝিয়ে দিল, গোলগাল মেয়েটার সাথে বন্ধুত্ব করা উচিৎ নয়। অর্থাৎ বড়দের অন্যরকম মানুষকে এড়িয়ে চলা বা অকারণে শত্রু মনে করার যে অভ্যাস তা ঢুকিয়ে দেওয়া হল ছোটদের মধ্যে। গাড়ির মালিক হওয়ার কারণে অন্যদের ছোট করে দেখার কোন প্রবণতা যদি মেয়েটার বা তার বাবা-মায়ের মধ্যে দেখা যেত, তাহলে নাহয় ভাবা যেত মেয়ের বাবা তাকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন মাত্র। কিন্তু এক্ষেত্রে তেমন কোন প্রমাণ নেই।
আরেকটা উদাহরণ দিই।
ক্লাস ফাইভের দুটো মেয়ে। তারা একসাথে এক স্কুলে পড়ছে সেই নার্সারি থেকে। ভারী ভাব। একজন টুকটুকে, অন্যজন কুচকুচে। বড়রা কাউকে ফেয়ার এন্ড লাভলি মাখতে বলতেই পারে কিন্তু শিশুরা ওসব নোংরা ছেলেমানুষি করে না ফলে দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতেই পারে না এতগুলো বছর ধরে। অথচ সেই টুকটুকে মেয়েটা একদিন কুচকুচে মেয়েটাকে বলল “শোন, তুই না আমার পাশে বসবি না। তুই তো খুব কালো, আমার পাশে বসলে আমার রঙ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।”
এই ছেলেমানুষি এতবছর পরে মেয়েটার মাথায় এল কোথা থেকে বলুন দেখি, যদি বড়রা না শিখিয়ে থাকে?
শিশুরা আর শিশু থাকছে না আজকাল। কারণ বড়রা থাকতে দিচ্ছে না। আমাদের বড়রা এর চেয়ে অনেক ভাল ছিলেন। মানতেই হবে নিজেদের কুবুদ্ধিগুলো বড় হওয়ার আগেই আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেন না। “অমুক মেয়ের সাথে মিশবি না কারণ তুই ফরসা আর ও কালো” বা “অমুকের বাবার গাড়ি আছে, তোর বাবার নেই। অতএব ও তোর বন্ধু হতে পারে না” এরকম বলতে আমার বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের বাবা-মা — কাউকে শুনিনি। তাঁরা অবশ্য যারা ফেল টেল করে তাদের সাথে মেশা বড় একটা পছন্দ করতেন না, যারা ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হত তাদের মায়েরা কেউ কেউ কড়া নজর রাখতেন যাতে তারা আমাদের মত সাধারণ ছেলেপুলের সাথে না মেশে। কিন্তু তা বলে ছেলেমেয়েদেরই এসব বলতে শিখিয়ে দিতেন না। আর তাঁদের বাবা-মায়েরা সম্ভবত আরো উন্নত জীব ছিলেন কারণ আমার স্কুলমাস্টার বাবার কোন ক্লাসে একবারে না ওঠা অনেক বন্ধু আমৃত্যু ছিল।
আসলে বোধহয় তখনকার বাবা-মায়েরা পরীক্ষার নম্বর পাওয়ার সাথে মানুষ হওয়ার যে কোন যোগাযোগ নেই সেটা বুঝতেন, আমরা বুঝি না। আমাদের সময়ে এমন বেশকিছু ছেলেমেয়ের দেখা পাওয়া যেত যাদের সম্পর্কে ঠাট্টা করে বলা হত “যে ক্লাসে ওঠে সেখানেই শিকড় গেড়ে ফ্যালে।” আজকাল বোধহয় পাশ করা আরো সহজ হয়ে গেছে বলে খুব একটা কেউ ফেল করে না। কিন্তু তাতে কী? মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় যে আমাদের ছেলেমেয়েরা অনবরত ফেল করে চলেছে। আমাদের সময়কার সবচেয়ে খারাপ ছাত্ররাও কিন্তু শিশু থেকে কিশোর হতে না হতেই পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার জন্যে একটা দুধের শিশুকে খুন করে ফেলার কথা কল্পনাও করতে পারত না।
আবার বড়দের ছেলেমানুষি দেখুন — এই যেখানে অবস্থা সেখানে স্কুলে, বাড়িতে, টিভিতে ঘটা করে শিশু দিবস পালন করছে। নাকি এটার মানে হল “এই একটা দিন তোমাদের শিশু থাকার অনুমতি দিলাম। বাকি ৩৬৪ দিন বড়দের মত নোংরামো করতে হবে”?
বড়দের ছেলেমানুষি
শিশুরা আর শিশু থাকছে না আজকাল। কারণ বড়রা থাকতে দিচ্ছে না