ছোটবেলায় মা-জেঠিমার কাছে শোনা একটা গল্প: এক শাশুড়ি দিনরাত চিৎকার করে ছেলের বউকে গালমন্দ করত, তাই পাড়ার লোকে তার নিন্দে করত। শেষমেশ একদিন বুড়ির চেঁচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা বুড়িকে ধমকাবেন বলে সে বাড়ি চলেই গেলেন। গিয়ে দ্যাখেন বউ বুড়িকে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখে ঝাঁটাপেটা করছে, তাতেই বুড়ির চিৎকার এবং গালাগালি। বউয়ের কিন্তু মুখে রা টি নেই।
মধ্যপ্রদেশের কৃষক আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালানোর পরে যা হচ্ছে তা নিয়ে ভদ্দরলোকেদের প্রতিক্রিয়া দেখে গল্পটা মনে পড়ল। মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশের চাষীদের অবস্থা বহু বছর ধরেই গল্পের শাশুড়ির চেয়েও শোচনীয়। তাদেরকে বউ, মানে আমাদের নির্বাচিত সরকারগুলো, আক্ষরিক অর্থেই না খাইয়ে মারছে। আর তারা যখন গলায় দড়ি দিয়েছে তখন নেশা, কেজরিওয়ালের প্ররোচনা, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি নানা কাল্পনিক কারণ দেখিয়ে তাদের পাত্তাই দেওয়া হয়নি।
এই কিছুদিন আগে যখন তামিলনাড়ুর খরাক্লিষ্ট চাষীরা নিজেদের দুরবস্থা একদা চা বিক্রেতা প্রধানমন্ত্রীর কানে তোলবার আশায় নিজেদের পেচ্ছাপ পর্যন্ত খেলেন তখনো আমার আপনার মত ভদ্দরলোকেরা পায়ের উপর পা তুলে অর্ণব গোস্বামী নামক এক আপাতনির্বোধের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী গোগ্রাসে গিলছিল। সীমান্তে সৈনিকরা মরছে আর চাষী ব্যাটারা নিজেদের দুর্দশাটাই বড় করে দেখছে! কতবড় আস্পর্ধা! এবার যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, চাষীরা রাস্তায় নেমেছে তখন এক দেশপ্রেমিক সরকারের পুলিশ তাদের গুলি করে চুপ করানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু যার পেট খালি তাকে চুপ করানো বড় শক্ত। ফেসবুক করা মায়েরা না জানলেও চাষী পরিবারের শিশুদের মায়েরা বিলক্ষণ সেটা জানেন। সরকার অবশ্য জানে না। তাই যা হবার তাই হয়েছে। ক্ষুধিত মানুষ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ঢিল ছুঁড়েছে, বাস পুড়িয়েছে। আর অমনি ভদ্দরলোকেদের ন্যাকা ন্যাকা মন্তব্য শুরু হয়েছে “কৃষকদের সমস্যার কথা সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। কিন্তু হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন নিন্দনীয়।”
আরে মশাই, হিংসার আশ্রয় নিল বলে তবু আমার মত ধ্বজভঙ্গ সাংবাদিকরা ব্যাপারটা আপনাদের চোখের সামনে আনতে বাধ্য হল। নইলে ১২০ কোটি লোকের দেশে গোটাছয়েক চাষা মরে গেলে কি-ই বা এসে যায়? আর পুলিশ তো বলেছেই যে তারা গুলি চালায়নি। মধ্যপ্রদেশ তো প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যে চলা একটা রাজ্য, তা হয়ত প্রাচীন ভারতে আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টির মত পাপীদের বুকে গুলিবৃষ্টির প্রযুক্তিও চালু ছিল। হয়ত সেভাবেই ঐ চাষার বাচ্চাগুলো মরেছে। কে বলতে পারে?
তাছাড়া সরকার গুরুত্ব দিয়ে ভাববেটা কী? রিমের পর রিম লেখা হচ্ছে কৃষিঋণ মকুব করলে সরকারী তহবিলের কি বিপুল ক্ষতি হবে তাই নিয়ে। আমার আপনার মত ভদ্দরলোকেরাই তো বলে চাষীরা যখন কর দেয় না তখন তারা “ফ্রি লোডার”। এদের আবার ঋণ মকুব করা! বরং কর্পোরেট ট্যাক্সে ছাড় দেওয়া হোক। মুকেশ আম্বানির বাড়িতে আরো পাঁচটা সুইমিংপুল হোক, গৌতম আদানি আরো চারটে দেশে কয়লা তুলতে যাক। এতে হয়ত সরকারের টাকা একটু কম পড়বে কিন্তু এদের ব্যবসা বাড়লে তো এরা আমাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের চাকরি দেবে।
এই আশার পেছনের যুক্তিটা আজও বুঝলাম না। কোন কর্পোরেট আবার লাভের মুখ দেখলে নতুন চাকরি দেয়? সবাই বরং কর্মী কমিয়ে, কম লোক দিয়ে বেশি কাজ করিয়ে মুনাফা বাড়ায়। বারো বছর হল একটা কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করছি। আজ অব্দি কতগুলো নতুন পদ তৈরি হতে দেখলাম অনেক কাগজপত্র ঘেঁটে, লাইব্রেরিতে দিনরাত পড়ে থেকে হয়ত বলতে পারব, অথচ আজ এই চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেল, কাল অমুক কাগজের ছটা সংস্করণ উঠে গেল, পরশু তমুক কাগজ ১৫০ লোককে ছাঁটাই করে দিল — এ তো লেগেই আছে। এসব খবর জানতে আজকাল সংবাদমাধ্যমের লোকও হতে হয় না, আবালবৃদ্ধবনিতা জানে। তবু কর্পোরেটকে আমাদের ফ্রি লোডার মনে হয় না, কৃষিঋণ মকুব তো দূরে থাক, কৃষককে ভর্তুকি দিলেও মনে হয় আমার ট্যাক্সের টাকার অপব্যবহার হচ্ছে। তা এই আমাদের ভোটে নির্বাচিত সরকার চাষীদের দাবিদাওয়া মানতে যাবে কেন?
বড্ডবেশি পলিটিসাইজ করে ফেললাম, তাই না? যে ফসল ফলায় তার পরিবারই না খেয়ে থাকে — এই আশ্চর্য ঘটনাটা কোন অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ঘটানো সম্ভব হয় কেউ যদি আমায় বুঝিয়ে দিতে পারে, আমি জীবনে আর পলিটিক্সমুখো হব না। কী বললেন? এর পেছনে কংগ্রেস আছে? কংগ্রেস, সিপিএম, নকশাল, মাওবাদী, এন্টি ন্যাশনাল, লুটিয়েন্স এলিট — যারা যারা এই আন্দোলনের পেছনে আছে তাদের প্রতি আমার অকুণ্ঠ ভালবাসা রইল। আমার মত সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তর তোয়াক্কা না করে যদি তারা চাষীদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে তো বেশ করেছে। কী? এসব ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে বলছেন? এই করে যদি কোন পার্টি ক্ষমতায় আসে তবে সে ক্ষমতায় আসার যোগ্য। তারপর লঙ্কায় এসে যদি সে-ও রাবণ হয় তখন রাবণবধের দায়িত্বও হাত বদলাবে নাহয়। ক্ষতি কি?
না খেয়ে মরে চাষা, এবং গুলি খেয়ে
এই কিছুদিন আগে যখন তামিলনাড়ুর খরাক্লিষ্ট চাষীরা নিজেদের দুরবস্থা একদা চা বিক্রেতা প্রধানমন্ত্রীর কানে তোলবার আশায় নিজেদের পেচ্ছাপ পর্যন্ত খেলেন তখনো আমার আপনার মত ভদ্দরলোকেরা পায়ের উপর পা তুলে অর্ণব গোস্বামী নামক এক আপাতনির্বোধের মুখনিঃসৃত অমৃতবাণী গোগ্রাসে গিলছিল