একশো বছরের বেশি হল দুনিয়ায় মার্কসবাদী আর মার্কসবিরোধী — দু ধরণের লোকই আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। দু পক্ষেরই অনেক ভাল ভাল যুক্তি আছে। কিন্তু বেশকিছু উঁচু ডিগ্রিধারী লোককেও দেখতে পাই মার্কসবাদ সম্পর্কে অত্যন্ত হাস্যকর কিছু যুক্তি দেন। সেগুলো এত দুর্বল যে তার প্রতিযুক্তি দিতে মার্কসবোদ্ধা হতে লাগে না। তারই কয়েকটা প্রতিযুক্তিসহ নীচে দিলাম —
১) সাম্য ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক। প্রকৃতিবিরোধী। অতএব সাম্যবাদী সমাজ একটি ইউটোপিয়া।
তাই তো! কিন্তু একটা অসুবিধা হয়ে গেল যে! সমাজ, রাষ্ট্র — এগুলোও অস্বাভাবিক। প্রকৃতিবিরোধী। এগুলো মানুষ বানিয়েছে। এগুলোকেও ফেলে দেওয়া দরকার তাহলে। প্রযুক্তি ব্যাপারটা তো ভীষণভাবেই প্রকৃতিবিরোধী। অতএব বাড়ির জলের লাইন, বিদ্যুতের লাইন কাটিয়ে দিন, হাতের ফোনটা এখনই ছুঁড়ে ফেলে দিন, জামাকাপড় ত্যাগ করে সপরিবার উলঙ্গ হয়ে থাকুন। আসলে বাড়িটাও প্রকৃতিবিরোধী। অতএব জঙ্গলে চলে গিয়ে পর্ণকুটিরেই থাকা উচিৎ।
২) মার্কসবাদের উদ্ভব হয়েছিল শিল্পবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে। এখন আর সেই মতবাদের কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই কারণ পৃথিবী বদলে গেছে।
আচ্ছা পুঁজিবাদের উদ্ভব কি কৃষিবিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে? সেই পৃথিবী এতদিনে বদলায়নি?
৩) কমিউনিস্ট শাসন সব দেশেই গুলাগ, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচুর মৃত্যুর কারণ হয়েছে। অত্যন্ত দমনমূলক শাসনব্যবস্থা। সেই শাসনব্যবস্থার প্রবক্তার তত্ত্বের কোন দাম নেই।
প্রথমত, আপনি কি জানেন মার্কসবাদী মানেই বলশেভিক বা চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নয়? পিট সিগার আর এরিক হবসবম দুজন প্রসিদ্ধ মার্কসবাদী। কিন্তু দুজনেই বলশেভিক শাসনের বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন। এমনকি চে গেভারাও বলেছেন। উদাহরণ হিসাবে আরো বলা যায় যে কিউবাতে কাস্ত্রো যেভাবে শাসন চালিয়েছেন তার সাথে কিন্তু রাশিয়া বা চীনের পার্থক্য বিস্তর।
দ্বিতীয়ত, কমিউনিস্ট শাসন ছাড়া পৃথিবীর আর কোন শাসনব্যবস্থাই কি কারো মৃত্যুর কারণ হয়নি? ভারতে বিয়াল্লিশের মন্বন্তরে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছিল তারা কোন কমিউনিস্ট শাসনের প্রজা? কদিন আগে টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এখনো এদেশে বছরে ১২০০০ কৃষক আত্মহত্যা করেন। তাঁদের মৃত্যুর জন্যে দায়ী কোন কমিউনিস্ট সরকার? ১৯৯১ এর পর থেকে সারা পৃথিবীতে অপুষ্টিজনিত কারণে যত শিশুর মৃত্যু হয়েছে তাদের জীবনের দাম দেবে কোন কমিউনিস্ট সরকার? নাকি ঐ মৃত্যুগুলো দুর্ঘটনার মধ্যে পড়ে?
জারের গুলাগ পরে স্তালিনের গুলাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অত্যন্ত অন্যায় কোন সন্দেহ নেই। মার্কসবাদে কোথাও গুলাগের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে বলে জানি না। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন যদি গুলাগের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করত, চমৎকার হত। কিন্তু গুয়ান্তানামো বে জিনিসটা কী? আবু ঘ্রাইবটা কী ব্যাপার? সিঙ্গাপুরের যে একনায়ক কয়েকবছর আগে মারা গেলেন তাঁর রাজত্বে বিরোধীরা কেমন ছিলেন? কেমন আছেন আজকের তুরস্কের বিরোধীরা, রাশিয়ার বিরোধীরা, ভারতের বিরোধীরা, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধীরা? যত দোষ মার্কস ঘোষ? স্তালিন, মাও, পল পটের দোষে যদি মার্কসবাদ বাতিল করতে হয় তাহলে পুঁজিবাদী দেশগুলোর কতজন শাসকের দোষে কতবার পুঁজিবাদ বাতিল হওয়া উচিৎ?
৪) মার্কসবাদ গরীবদের জন্য। পুঁজিবাদ উন্নয়নের মাধ্যমে গরীবদের বড়লোক করে দিচ্ছে। অতএব মার্কসবাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
দারুণ সুসংবাদ। কবে কখন কোথায় এটা হচ্ছে খবর দেবেন, প্লিজ। পুঁজিবাদের ঝান্ডা নাড়তে ছুটে যাব কথা দিচ্ছি। আপাতত যা দেখছি আমেরিকা, ফ্রান্সের মত দেশেও দারিদ্র্য, বেকারত্ব নাকি বেড়েই চলেছে। তাই লোকে খচে বোম হয়ে এমনসব লোকেদের ভোট দিচ্ছে যাদের দেখে বড় বড় পুঁজিবাদীদেরও মাথায় হাত। আর বাকি বিশ্বের কথা ছেড়েই দিন। আমরা তো তৃতীয় বিশ্ব। এখানে একই শহরে এন্টিলা আর ধরভি। ফোন বলছে “জিও”, মন বলছে “মর”। এই বাজারে মার্কস ফার্কস চলে নাকি?