তখন সবে খিস্তি শিখছি । রোজ বিকেলে আর কেউ না থাকলেও আমরা দুজন মিলেই ক্রিকেট খেলতাম । একদিন শুনি বন্ধুটি উইকেট পুঁততে পুঁততে গুনগুন করে গাইছে “হাসপাতালের বেডে টি বি রোগীর সাথে খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা । তবু রেডিওটা টিভিটার সাথে সুর ধরে সারে জাঁহা সে আচ্ছা” । আমি এরকম আজব গান জম্মে শুনিনি । গানে খিস্তি ! ভাল লাগল বললে ভুল হবে তবে নতুন লাগল নিঃসন্দেহে । রাতে খেতে বসে বললাম “জানো এরকম নাকি একটা গান বেরিয়েছে ।” মা শুনেই ছ্যা ছ্যা করে উঠল । বাবা বলল “আমিও কোথায় একটা শুনলাম ! মাইকে বাজছিল । এসব হুজুগের গান । দুদিন খুব চলবে । তারপর আর খুঁজে পাওয়া যাবে না ।” আমার কৌতূহল কমল না ।
স্কুলে অনেক সহপাঠী দেখলাম গায়কের খুব ভক্ত । একজন আমাকে ক্যাসেটের নাম (অ্যালবাম বলতে তখন শুধু ছবি সাঁটার বই-ই জানতাম), অন্যান্য গানগুলো সম্পর্কে তো বললই, নচিকেতার অতীত বর্তমান সম্বন্ধেও বেশ কিছু জ্ঞান দিয়ে দিল । আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে গানগুলো শুনতে । কী করে যে শুনি ! তার কিছুদিন আগেই কয়েকটা গানহীন বছর কাটানোর পর বাবার বকেয়া মহার্ঘ ভাতার কিছুটা দিয়ে ফিলিপসের টু ইন ওয়ান কেনা হয়েছে । বাড়িতে নিয়ে এসে চালানো উচিৎ হবে না বুঝতে পারছি । ভাবছি বন্ধুটার বাড়ি একদিন যাওয়া যায় কিনা ।
হঠাৎ একদিন বাবা বলল “দ্যাখ তো বড়দার কাছে নচিকেতার ক্যাসেট আছে কিনা ?”
আমার অবসরপ্রাপ্ত বড়দাজেঠু গান আর বইয়ের পোকা । বোধহয় সেইজন্যেই মনটা আশ্চর্যরকমের জোয়ান । জগন্ময় মিত্রও শোনে আবার সুমন, নচিকেতাও শোনে । দৌড়ে নিয়ে এলাম । বাবার ভাবান্তরের কারণ জানার চেয়ে গানগুলো শোনার আগ্রহ ছিল অনেক বেশি । তারপর একঘন্টা ধরে দু পিঠের গানগুলো বাপ ছেলে মিলে শুনলাম । মা তিতিবিরক্ত । বাবাকে বলল “তুমিও বসে বসে এইসব গান শুনছ ?”
বাবা বলল “শুনতেই হবে । সময়ের ধ্বনি । কান না পাতলে যে সময়টাকে চেনা যাবে না । আমাদের যুব ফেডারেশনের শঙ্কর খুব জোর দিয়ে আজকে বলল ‘আপনি শুনে দেখুন, হাবুলদা । আপনার যদি খারাপ লাগে আমি নিজে শোনা ছেড়ে দেব ।’ তাই ভাবলাম শুনে দেখি । ভাল গান । হতাশায় ভরপুর । এত হতাশ যে খিস্তি দিচ্ছে । বেশ করছে । খিস্তি দেওয়ার মত হলে দেবে না ? ছেলেপুলেদের চাকরি নেই বাকরি নেই । খিস্তি দেবে না তো কি ? কিন্তু গলায় সুর আছে, গানে প্রাণ আছে ।”
“সে তো সুমনের গানও সময়ের গান । ওর তো খিস্তি দিতে লাগে না ?” মা বলল ।
“ওর গান সুন্দর করে সত্যি কথা বলে তাই ভাল । এর গান কর্কশ করে সত্যি কথা বলে তাই ভাল । দুটোই ভাল ।”
মা নাক সিঁটকে বলল “কিন্তু এ গান বেশিদিনের নয় । সুমনের গান থাকবে ।”
“হতে পারে । কিন্তু সে বিচার ইতিহাস করবে । আমি কে ?”
তারপরেই বাবা আমায় জিজ্ঞেস করল কোন্ গানটা সবচেয়ে ভাল লাগল । সত্যি কথাটা লজ্জায় বলতে পারলাম না । বললাম “শুধু বিষ শুধু বিষ দাও ।” বাবা বলল “বাজে কথা বলিস না । তোর সবচেয়ে ভাল লেগেছে “লাল ফিতে সাদা মোজা । আমি তোর বাপ রে ।”
ধরা পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছি তখন । ভাবছি বাবা কি জানতে পেরে গেছে এক সহপাঠিনীর সম্পর্কে আমার দুর্বলতা ? আমি তো আমার দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছাড়া কাউকে বলিনি ! এমনকি মেয়েটাকেও কিছু বলিনি । বলার সাহসই নেই । সে আমার চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক ভাল, কি সুন্দরী কি সুন্দরী ! ওরকম একটা মেয়ের যে আমাকে পছন্দ হতেই পারে না তা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই । তাছাড়া ও কাউকে বলে দিলে আমার বাবার মানসম্মান থাকবে না । বাবা আমায় বকবে কি মারবে সে তো পরের কথা । ফলে কায়দা করে তার নাম না লিখে কিছু বোগাস কবিতা লেখা ছাড়া আর কিছুই তো আমি করিনি ! তাও বাবা বুঝে গেল !
এইসব সাত-পাঁচ ভাবছি, তখনই বাবা বলল “এই বয়সে সব কথা বাড়ি এসে আমাদের বলবি । বন্ধুর মত । মাকে হোক বা আমাকে হোক । তাহলে আমরা তোকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচাতে পারব । তবে একটা কথা আমাদেরও বলবি না । নীলাঞ্জনার কথা । তাকেও বলবি না । শুধু নিজের মনে তার সাথে কথা বলবি । এই বয়সে প্রেমে পড়লে স্বভাব ভাল থাকে যদি প্রেম ‘করা’ ব্যাপারটা মাথায় না ঢোকে । ভালবাসার চেয়ে ভাল জিনিস তো নেই । প্রথমবার এটা হলে নিজের মধ্যে প্রাণভরে অনুভব করতে হয় । বিশেষ করে প্রথম প্রেমের অনুভূতি আর ফেরত পাওয়া যায় না । এটা বলাবলি করতে গিয়ে নষ্ট করে ফেলিস না । ভালবাসাটা তোর । সে ভালবাসে কি না বাসে তাতে কী এসে গেল ?”
আজকে মনে হচ্ছে বাবা হওয়ার একটা বড় শিক্ষা আমার বাবা আমাকে সেদিনই দিয়েছে।
নিভৃতে যতনে
ধরা পড়ে গিয়ে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছি তখন । ভাবছি বাবা কি জানতে পেরে গেছে এক সহপাঠিনীর সম্পর্কে আমার দুর্বলতা ? আমি তো আমার দুই ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছাড়া কাউকে বলিনি ! এমনকি মেয়েটাকেও কিছু বলিনি । বলার সাহসই নেই । সে আমার চেয়ে লেখাপড়ায় অনেক ভাল, কি সুন্দরী কি সুন্দরী !