সলিল চৌধুরী স্মরণে একটি মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা

গত তিরিশ বছরে বাঙালির সংস্কৃতি চর্চা ক্রমশ যে কোনো উপলক্ষে গোটা দশেক রবীন্দ্রসঙ্গীত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাওয়া আর সত্যজিৎ রায়ের গোটা পাঁচেক ছবির চর্বিতচর্বণের কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে। যে ‘কালচার’ নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই, তাতে যে গর্ব করার মত আর কোনো পাত্র-পাত্রী আছেন বা সঙ্গীত, নাটক, সিনেমা ইত্যাদির আর কোনো ধারা আছে তা টের পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন নয় যে রবীন্দ্রচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে বা সত্যজিতের ছবির চর্চা অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে। আসলে ক্রমিক আত্মবিস্মৃতির ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতের উইকেট দুটোই এখনো টিকে আছে, বাকিরা জনমন থেকে ক্রমশ কতিপয় রসিকের বৈঠকখানায় অবসৃত হয়েছেন। ওরই মধ্যে সলিল চৌধুরীর অবস্থা কিছুটা ভাল। একসময় পাড়ার রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় গান গেয়ে, আবৃত্তি করে সংস্কৃতি চর্চায় হাতেখড়ি হত বঙ্গসন্তানদের। গত শতকের নয়ের দশক থেকে বুগি উগি সেই সন্ধ্যাগুলোকে স্থানচ্যুত করতে শুরু করে। এখন নানা বয়সের গানের রিয়্যালিটি শোয়ে বিখ্যাত হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষাই বাঙালি শিশু, কিশোরদের সংস্কৃতি চর্চার পথ নির্ধারণ করে। সেসব শোয়ে সলিলের গানের বেশ খানিকটা দাম আছে। তার একটা বড় কারণ তিনি একদা হিন্দি সিনেমা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, লতা মঙ্গেশকরের মত শিল্পী তাঁর সুরে, কথায় বাংলা গানও গেয়েছেন। নইলে ওই দামও আজ সলিল পেতেন কিনা সন্দেহ।

ওটুকুর উপর ভরসা করে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন শহরাঞ্চলের প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া করে সপ্তাহের মাঝখানে গোটা সন্ধে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে – এ কথা চট করে বিশ্বাস হতে চায় না। ফলে যখন জানা যায় উত্তরপাড়ার ‘মীড়’ এই কাণ্ডটি ঘটাতে চলেছে ২২ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যায়, তখনই চট করে গুগল করে নিতে হয় সেদিন সলিলের জন্মদিন বা মৃত্যুদিন কিনা। শুধু সঙ্গীতচর্চা নয়, যে কোনো চর্চাই যে আসলে ৩৬৫ দিনের কাজ সেকথা আজকাল মনে রাখা শক্ত। গুগল সার্চ যখন জানিয়ে দিল সলিলের মৃত্যুদিন চলে গেছে সপ্তাহ দুয়েক আগেই আর জন্মদিনের মাস দুয়েক দেরি আছে, তখন বোঝা গেল আবেগ কাজে লাগিয়ে নাম কেনা মীড়ের সদস্যদের উদ্দেশ্য নয়। তাঁরা শ্রোতাদের ‘অতল সলিলে’ নিয়ে যেতে চান নিতান্ত সলিল চৌধুরীর গানের টানেই।

গান নির্বাচনেও দেখা গেল পরিশ্রমের ছাপ। মীড়ের কচিকাঁচারা সমবেত সঙ্গীতে ‘শ্রাবণ অঝোর ঝরে’, ‘ঝিলিক ঝিলিক ঝিনুক খুঁজে পেলাম’ ইত্যাদি গানে অন্য স্বাদ এনে দিয়েছে। বাংলা ভাষার এই দুর্দিনেও এক ঝাঁক বাঙালি কিশোর-কিশোরী নিখুঁত উচ্চারণে ‘দুপুরের রৌদ্রের নিঃঝুম শান্তি শান্তি/নীল কপোতাক্ষীর কান্তি’ গাইছে – এই দৃশ্য, এই ধ্বনি মনোমুগ্ধকর। কিন্তু পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী চমকে দিয়েছেন তাঁর ছাত্রীদের গাইতে দেওয়া একক গানের পছন্দে। ১৯৫৬ সালে জাগতে রহো ছবিতে আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘ঠান্ডি ঠান্ডি সাওন কি পুহার’ গানটি আজ কতজনেরই বা পরিচিত? আরও বড় চমক লহনা ভট্টাচার্যের কণ্ঠে সলিল রচিত ও সুরারোপিত ‘সেই মেয়ে’। রবীন্দ্রনাথের ময়নাপাড়ার মেয়ে কৃষ্ণকলিকে শিল্পী সলিলের চোখ দেখেছিল ছেচল্লিশের মন্বন্তরে শীর্ণ বাহু তুলে কলকাতায় যারা ফ্যান ভিক্ষা করত তাদের মধ্যে। সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে গায়ে কাঁটা দেওয়ার মত সেই গান কৈশোর না পেরনো লহনাকে গাইতে দিয়ে অনুষ্ঠানের নির্দেশক বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কিন্তু লহনা যে অনায়াস দক্ষতায় অত লম্বা এবং দুরূহ গানটি গেয়েছেন তা ঝুঁকি সার্থক করেছে।

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে তথাগত ভট্টাচার্য অন্য স্বাদ এনে দিয়েছেন ‘মোর মতন আর দেশপ্রেমিক নাই’, বাড়ি থেকে পালিয়ে ছবির ‘আমি অনেক ঘুরিয়া শ্যাষে আইলাম রে কইলকাত্তা’, গঙ্গা ছবির ‘ইচ্ছা করে পরাণডারে’ ইত্যাদি গানগুলি গেয়ে।

শেষ শিল্পী ছিলেন সৌরভ স্বয়ং। ‘পাগল হাওয়া’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ শিল্পী হিসাবে তাঁর জাত চেনায়। তবে এই সন্ধের পবিত্রতম মুহূর্ত তিনি তৈরি করতে পেরেছেন ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’ গানে। সলিলের মত অত বড় শিল্পীর শিল্পকর্মেও অমন বিশুদ্ধ গানের সংখ্যা হয়ত খুব বেশি নয়। ওই গান গেয়ে আক্ষরিক অর্থে শ্রোতাদের অতল সলিলে নিয়ে যেতে পেরেছেন সৌরভ।

আরও পড়ুন সকল অহঙ্কার হে আমার

অনুষ্ঠানের মেজাজ যে তারে বাঁধা ছিল তাতে ঈষৎ বেসুরো ঠেকেছে ‘শপথ’ কবিতা অবলম্বনে নাচ এবং সমবেত কণ্ঠে ‘পথে এবার নামো সাথী’ গানটি। বিশেষত, গানটি যে সময়ে রচিত তার তুলনায় যুগ এতটাই বদলে গেছে, আমাদের পথে নামার অভ্যাস এতটাই কমে গেছে, নামার উদ্দেশ্যেরও এত তারতম্য ঘটেছে যে গানটি এখন নিজেই নিজের প্যারডি বলে মনে হয় অনেকসময়। দোষটা অবশ্য প্রতিবেদকের সিনিসিজমেরও হতে পারে। বরং অনেক বেশি কালজয়ী ‘রানার’। সৌরভের মত দরাজ গলার কোনো শিল্পীর কণ্ঠে ওই গান হয়ত মধুরতর স্মৃতি হয়ে উঠতে পারত।

সেদিন উত্তরপাড়া গণভবনে তিলধারণের জায়গা ছিল না লিখতে পারলে চমৎকার হত, কিন্তু ঘটনা হল বহু দর্শকের চেয়ে মনোযোগী দর্শক সঙ্গীতানুষ্ঠানের রসগ্রহণের পক্ষে বেশি সুবিধাজনক। সেদিক থেকেও ‘অতল সলিলে’ তৃপ্তিদায়ক। ইদানীং যে কোনো প্রেক্ষাগৃহে মোবাইল ফোনের আওয়াজ শিল্পী এবং অন্য দর্শকদের যতখানি বিরক্তি উদ্রেক করে, এদিন তার অর্ধেকও করেনি।

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত

%d bloggers like this: