সাহিত্য ও সাংবাদিকতা অপ্রিয় সত্য ছাড়া বৃথা

সাংবাদিকতা করা মানেই হল, সজাগ দৃষ্টিতে যে ক্ষমতাশালী – সে সরকার হতে পারে, ব্যবসায়ী হতে পারে, মাস্টার হতে পারে, ডাক্তার হতে পারে, উকিল হতে পারে – তার দোষত্রুটি খেয়াল করা এবং সকলের চোখের সামনে সত্য উদ্ঘাটিত করা।

দক্ষিণ দিনাজপুরের বুনিয়াদপুর মহাবিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের আমন্ত্রণে গত ১৫ মার্চ ২০২৩ (বুধবার) ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘সাহিত্য ও সাংবাদিকতা’ বিষয়ে এই ভাষণ দেওয়া হয়েছিল।

শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আমার প্রণাম, প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসা। আমাকে আজ বলতে ডাকার জন্যে কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং সংস্কৃত বিভাগকে ধন্যবাদ। তোমাদের যে মাস্টারমশাইরা আমার আগে বললেন, তাঁরা আমার উপরে একটা গুরুভার চাপিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা আশা করেছেন যে আমার বক্তৃতা থেকে তোমরা একটা পেশাগত দিশা পাবে। এখন আমি নিশ্চিত নই সেটা পাবে কিনা। তোমরা শুনে দ্যাখো।

জীবন সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না, আমাকে দিয়েছে। ইংরেজি অনার্সের ছাত্র হিসাবে যখন বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তখন একটা পেপারে আমাদের ৪০ নম্বরের প্রবন্ধ লিখতে হত। সেবার সবাই বলেছিল একটা প্রবন্ধ আসবেই। টেস্ট পরীক্ষায় এসেছিলও বটে। আমি অনেক বই-টই ঘেঁটে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, টেস্ট পরীক্ষার খাতা দেখানোর সময়ে মাস্টারমশাই “চমৎকার হয়েছে” বলে পিঠও চাপড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষা দিতে বসে দেখি, সে প্রবন্ধ আসেনি। এসেছে আজকের বিষয়টা – সাহিত্য ও সাংবাদিকতা। যেহেতু প্রস্তুতি ছিল না, সেহেতু সেদিন কীরকম লিখেছিলাম শুনেই বুঝতে পারছ। নম্বরও পেয়েছিলাম তেমনই। আমার সেই সময়কার সহপাঠী এবং তোমাদের মাস্টারমশাই ডঃ শান্তিগোপাল দাসের কল্যাণে আমি আজ দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছি। আজকের পরীক্ষকরা, মানে তোমরা, নিশ্চয়ই অত কড়া পরীক্ষক নও। দ্যাখো আজ পাস করতে পারি কিনা।

এই বক্তৃতার আয়োজক যেহেতু এই কলেজের সংস্কৃত বিভাগ, বিশেষ করে সেই কারণেই ধরে নিচ্ছি, রাজা বিক্রমাদিত্য আর কালিদাস – এই নাম দুটো কারোর অজানা নয়। বিক্রমাদিত্যের নবরত্নসভা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটা গল্প শুধু সংস্কৃত কেন, প্রায় যে কোনো বিভাগের লোকেরই জানা। সেই গল্পটা দিয়েই আজকের আলোচনা শুরু করব। নবরত্নসভায় কালিদাস ছাড়াও আরেকজন কবি ছিলেন, তাঁর নাম বররুচি। তাঁর একটু অভিমান বা ক্ষোভ ছিল, যে রাজা তাঁর চেয়ে কালিদাসকে বেশি গুরুত্ব দেন, যদিও কবি হিসাবে তিনি কালিদাসের চেয়ে কোনো অংশে কম যান না। এই ক্ষোভের কথা রাজা জানতেন। তা তিনি ঠিক করলেন একদিন প্রমাণ করে দেবেন কালিদাস মহত্তর কবি। কীভাবে করলেন? একদিন সভাসদদের নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছেন, সামনে একটা মরা গাছ পড়ে আছে। রাজা ওই গাছটা দেখিয়ে বররুচিকে বললেন “কবিবর, এ নিয়ে এক লাইন হয়ে যাক?” কবি বললেন “শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠত্যগ্রে।” তারপর রাজা কালিদাসকে বলতে বললেন। তিনি বললেন “নীরসতরুবরঃ পুরতো ভাতি।” আর কোনো সংশয় রইল না। যিনি শুকিয়ে যাওয়া গাছেও রসসঞ্চার করতে পারেন তাঁর চেয়ে বড় কবি আর কে আছে?

বাংলা ভাষার সম্ভবত সর্বকালের সেরা সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু অবশ্য মেঘদূতম অনুবাদ করে তার ভূমিকায় লিখেছেন, প্রচলিত ধারণাটা ভুল। আসলে বররুচির শ্লোকটাই সাহিত্য হিসাবে উন্নততর। কিন্তু সে বিতর্কে যাব না, কারণ আমার এই গল্পটা বলার উদ্দেশ্য আলাদা। কথা হল, সাহিত্য হিসাবে কালিদাস যা বলেছেন তা হয়ত মহত্তর, কিন্তু সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বররুচি যা বলেছেন সেটাকেই এগিয়ে রাখতে হবে। কোনোরকম অলঙ্করণ বাদ দিয়ে সত্যকে তুলে ধরা – এই যদি সাংবাদিকতার কাজ হয়, তাহলে মানতেই হবে বররুচি বেশি সফল।

কিন্তু সাংবাদিকতার কাজ কি এটাই? অলঙ্করণ বাদ দিয়ে সত্যকে তুলে ধরা? অলঙ্করণ করলে কি সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকতা থাকে না? আরও প্রশ্ন আছে। সত্য বলা কি শুধু সাংবাদিকতারই কাজ, সাহিত্যের কাজ নয়? সাহিত্য মানে কি স্রেফ কতকগুলো বানানো কথা? সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি বা অন্য যে কোনো ভাষার সাহিত্য নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা সকলেই বোধহয় মানবেন যে কবিতাই হল সাহিত্যের সবচেয়ে বিমূর্ত ধারা। কারণ কবিতার প্রকরণ এবং বিষয়বস্তু – দুটোতেই কল্পনার আধিপত্য। তা বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন, শঙ্খ ঘোষ, আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগেই তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় লিখে দিয়েছেন “সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার। কিন্তু জীবিকাবশে শ্রেণীবশে এতই আমরা মিথ্যায় জড়িয়ে আছি দিনরাত যে একটি কবিতার জন্যেও কখনো-কখনো অনেকদিন থেমে থাকতে হয়।” এরপর তো আর সত্য বলা সাহিত্যের কাজ নয়, এ কথা বলার অবকাশ নেই। তাহলে?

আমরা বরং আগে ভেবে দেখি যে সাংবাদিকতা আসলে কী? ইংরেজি সাহিত্যের মাস্টারমশাই, দিদিমণি এবং ছাত্রছাত্রীরা জর্জ অরওয়েলের কথা জানেন। অরওয়েল বলেছিলেন সাংবাদিকতা হল তাই, যা কেউ না কেউ প্রকাশিত হতে দিতে চায় না। বাকি সবই হল জনসংযোগ, মানে পাবলিক রিলেশন বা সংক্ষেপে পি আর। যা অরওয়েলের সময়ে না হলেও, আমাদের সময়ে একটা আস্ত পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমাদের মধ্যে যারা ভবিষ্যতে কোথাও কোনো গণমাধ্যমের পাঠক্রমে ভর্তি হবে, তারা দেখতে পাবে একইসঙ্গে সাংবাদিকতা এবং পাবলিক রিলেশন পড়ানো হয়। কিন্তু অরওয়েলের কথাটা শুনলেই বোঝা যাচ্ছে, দুটো আসলে পরস্পরবিরোধী বিষয়।

ব্যাপারটা কীরকম? ধরা যাক, তোমাদের কলেজে সাংবাদিকতা বিভাগ চালু করা হচ্ছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ খবরটা স্থানীয় কাগজের সম্পাদকদের কাছে পাঠালেন, তারাও ছেপে দিল। এটা প্রয়োজনীয় কাজ হল, কারণ এলাকার সাংবাদিকতা পড়তে আগ্রহী ছেলেমেয়েরা জানতে পারল এবং তাদের অভিভাবকরা জানতে পারলেন। কিন্তু এটা জনসংযোগ হল, সাংবাদিকতা হল না। এবার ধরা যাক, কোনো কলেজে সাংবাদিকতা বিভাগ আছে, সেখানে ছেলেমেয়েরা ভর্তিও হয়েছে। অথচ সেখানে অধিকাংশ ক্লাস হয় না, সময়ে পরীক্ষা হয় না। কারণ বেশিরভাগ অধ্যাপক বহুদিন হল কলেজেই আসেন না। এই খবরটা কোনো কাগজে কি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল বা কোনো খবরের চ্যানেলে দেখানো হল। এইটা সাংবাদিকতা হল। কারণ এ খবর বাইরে যাক তা কলেজ কর্তৃপক্ষ চাইবেন না। আবার এমনও হতে পারে যে তাঁরা চাইছিলেন খবরটা প্রকাশিত হোক, হইচই হোক। কারণ এই অচলাবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলছে, কর্তৃপক্ষ প্রতিকার করতে চেয়েও পারেননি উপরতলার চাপে বা অবজ্ঞায়। সেক্ষেত্রে আবার এ খবর প্রকাশিত হোক সেটা উপরতলা চাইবে না।

তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারা যাচ্ছে, সাংবাদিকতা বলে রোজ যা চলছে আমাদের চারপাশে, তার অধিকাংশই আসলে পি আর। মোটেই সাংবাদিকতা নয়। রাত্রিবেলা স্টুডিওতে বসে গলা ফাটিয়ে “দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো” বলা সাংবাদিকতা নয়। কিন্তু এরকম হচ্ছে তো। কেন হচ্ছে? সে আবার একটা আলাদা আলোচনার বিষয়। এই বক্তৃতাতেও শেষদিকে খানিকটা সে আলোচনায় আসব, কারণ তোমাদের শান্তিগোপাল স্যার আমাকে পইপই করে বলে দিয়েছেন, কী করে সাংবাদিক হতে হয় সেটা যেন বলি। সেকথা বলতে গেলে ওই আলোচনায় ঢুকতেই হবে। কিন্তু আপাতত আমরা দেখব, যে সাহিত্য আর সাংবাদিকতা নিয়ে একত্রে আলোচনা কেন দরকার? সাংবাদিকতা আর সাহিত্যে কোথায় মিল, কোথায় অমিল? দুটোর মধ্যে কি আদৌ কোনো সীমারেখা আছে? সে রেখা কি সবসময় বজায় থাকে? না থাকলে কোথায় মুছে যায়?

এ পর্যন্ত আমাদের আলোচনা থেকে যা উঠে এসেছে, তার মধ্যে দুটো জিনিস আলাদা করে চিহ্নিত করা দরকার। ১) সাংবাদিকতা আর সাহিত্য – দুয়ের কাজই সত্য বলা, ২) সাংবাদিকতার কাজ অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করা। এই দ্বিতীয় কাজটার উল্লেখে সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্যের একটা তফাতের আভাস পাওয়া যায়। কারণ প্রাথমিকভাবে আমরা সাহিত্যের কাছে কেন যাই? আরও সহজ করে যদি বলি – গল্পের বই, কবিতার বই, নাটক বা প্রবন্ধের বই পড়তে চাই কেন? আনন্দ পাব বলে। তাহলে সাহিত্য পড়ার মূল উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আনন্দ পাওয়া? এমনটা শুধু যে আমাদের মত সাধারণ মানুষেরই মত তা নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের পথে বইয়ের তথ্য ও সত্য প্রবন্ধে লিখেছেন “যে প্রকাশচেষ্টার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপন প্রয়োজনের রূপকে নয়, বিশুদ্ধ আনন্দরূপকে ব্যক্ত করা, সেই চেষ্টারই সাহিত্যগত ফলকে আমি রসসাহিত্য নাম দিয়েছি।” প্রবন্ধের নামটা খেয়াল করো। আজকের বিষয়ের সঙ্গে মিল আছে। সাংবাদিকতা ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করছি; প্রবন্ধের নাম ‘তথ্য ও সত্য’। রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন তা যদি ঠিক হয়, তাহলে মানতে হবে যে সত্য প্রকাশ করা সাংবাদিকতার মত সাহিত্যেরও কাজ বটে, কিন্তু অপ্রিয় সত্য নয়। তোমাদের শান্তিগোপাল স্যারের পাশে বসে যখন সংস্কৃত ক্লাস করতাম, তখন শিখেছিলাম প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রেও উপদেশ দেওয়া হয়েছে “সত্যম অপ্রিয়ম মা বদ”। মানে অপ্রিয় সত্য বোলো না। এটাই তাহলে সাহিত্যে পালনীয়, তাই না?

কিন্তু এই যুক্তি মানলে বিশ্বসাহিত্যের সেরা সৃষ্টির অনেকগুলোকেই যে আর সাহিত্য বলে মানা যাবে না! ইংরেজ কবি পিবি শেলি ‘টু আ স্কাইলার্ক’ কবিতায় লিখেই দিয়েছেন “Our sincerest laughter/With some pain is fraught/Our sweetest songs are those that tell of saddest thought.” মানে আমরা যখন সবচেয়ে জোরে হাসি, তার মধ্যেও কিছুটা বেদনা মিশে থাকে। আমাদের সবচেয়ে মিষ্টি গান সেগুলোই, যেগুলোতে সবচেয়ে কষ্টের কথা বলা আছে। কথাগুলো গানের ক্ষেত্রে যতটা সত্যি, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ততটাই সত্যি। ধরো বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের যে স্থান, ইংরেজি সাহিত্যে তো সে স্থান উইলিয়াম শেক্সপিয়রের। তিনি ১৬১৬ সালে মারা গেছেন, আজ ৪০০ বছর পরেও তাঁর কোন নাটকগুলো বারবার পড়া হয়, মঞ্চে অভিনীত হয়, বারবার নানা রূপে সিনেমার পর্দায় নিয়ে যাওয়া হয়? কমেডিগুলো নয়, ট্র্যাজেডিগুলো। ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, ওথেলো, জুলিয়াস সিজার, রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট। সারা পৃথিবীর সাহিত্য সমালোচকরা মানেন, এগুলোই শেক্সপিয়রের সেরা কাজ। অথচ এগুলো যে শুধু বিয়োগান্ত তা নয়, প্রথম চারটে নাটকের কেন্দ্রে আছে চারটে খুন। পঞ্চমটায় দুই নিরপরাধ যুবক-যুবতীর মৃত্যু ঘটে। উপরন্তু শত্রুতা, বিশ্বাসঘাতকতা, অন্তর্ঘাত, অবৈধ প্রেম এসবে ভর্তি এই নাটকগুলো। ওগুলোর বিজ্ঞাপনে অনায়াসে লেখা যেত “লাশ কা মাউন্টেন, খুন কা ফাউন্টেন। ডেঞ্জার! ডেঞ্জার! ডেঞ্জার!” কথাটা ম্যাকবেথ, ওথেলো আর হ্যামলেট অবলম্বনে বিশাল ভরদ্বাজের মকবুলওমকারা আর হায়দার  ছবিগুলো যারা দেখেছে তারা পরিষ্কার বুঝতে পারবে।

শেক্সপিয়র তবু অনেক আধুনিক দৃষ্টান্ত। একেবারে রামায়ণ, মহাভারতে চলে যাই। রাম-সীতা আর লক্ষ্মণকে বনবাসে যেতে হল কেন? রামের সৎ মা কৈকেয়ী আর দাসী মন্থরার ষড়যন্ত্রে। রাম-রাবণের যুদ্ধই বা লাগল কেন? রাবণ অন্যের বউকে অপহরণ করলেন বলে। পাশ্চাত্য জগতের পুরাণ হোমারের ইলিয়াড, তারও কেন্দ্রে একজন নারীর উপর কর্তৃত্ব কায়েম করা নিয়ে যুদ্ধ – সেই নারী হলেন হেলেন অফ ট্রয়। আর মহাভারতে কতগুলো অপ্রিয় সত্য আছে সেকথা তো গুনতে শুরু করলে শেষ হবে না। আজকের ভারতের আইনকানুন, নীতি নৈতিকতা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে এখন মহাভারত লিখলে প্রথমে বইটা নিষিদ্ধ হয়ে যেত, তারপর ব্যাসদেবের বাড়িতে ঢিল পড়ত, শেষমেশ পুলিস এসে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিত। সবচেয়ে বড় কথা, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড – সবই শেষপর্যন্ত যুদ্ধের গল্প। রামায়ণে তবু উত্তরকাণ্ড বলে একটা ব্যাপার আছে। মহাভারত তো যুদ্ধের পর কার কী হল সে গল্প দিয়েই শেষ। যুদ্ধে যে আসলে কেউ জেতে না – একথা শান্তিপর্বে ব্যাসদেব যেভাবে দেখিয়েছেন তাতে মহাভারতকে যদি পৃথিবীর প্রাচীনতম যুদ্ধবিরোধী সাহিত্যকর্ম বলে চিহ্নিত করি তাহলে ভুল হবে না।

সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সাংবাদিকতার মত সাহিত্যেরও একটা বড় কাজ অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করা। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের “বিশুদ্ধ আনন্দরূপ” কথাটার বিস্তার আমরা আনন্দ বলতে যা বুঝি তার চেয়ে অনেক বেশি এবং তার মধ্যে এইসব মহান সাহিত্য অনায়াসে এঁটে যায়। কারণ আমাদের দেশের প্রাচীন নন্দনতত্ত্বে নবরসের কথা বলা হয়েছে। যে কোনো মহান সাহিত্য ওই নটার এক বা একাধিক রসের সন্ধান দেয়। যে কোনো রসেই রয়েছে বিশুদ্ধ আনন্দরূপ। যাকে ট্র্যাজেডি বলা হয়, তাতে শেষে পাওয়া যায় করুণরস। সে রসে যে বিশুদ্ধ আনন্দরূপ রয়েছে সে ব্যাপারে এমনকি পাশ্চাত্যের প্রাচীন নন্দনতত্ত্বের গুরু অ্যারিস্টটলও একমত। ওই আনন্দরূপ আবিষ্কার করে যে অনুভূতি হয় তিনি তার নাম দিয়েছেন catharsis

এখন ঘটনা হল, যত দিন গেছে, সাহিত্যে অপ্রিয় সত্যের ভাগ কিন্তু তত বেড়েছে। ফলে সাহিত্যের আজ যে চেহারা দাঁড়িয়েছে তার সবটা আমরা নবরসের ধারণা দিয়ে বা অ্যারিস্টটল, রবীন্দ্রনাথের ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারব না। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সারা পৃথিবীর মানুষের উপর এবং স্বভাবতই সাহিত্যের উপর পড়েছে। আমাদের দেশে, বিশেষ করে বাংলায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, পরবর্তীকালে নকশাল আন্দোলন, তারপর ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রভাবও পড়েছে সাহিত্যে। ফলে অপ্রিয় সত্যের পরিমাণ বেড়েই চলেছে, এখনো বাড়ছে। পাশাপাশি সাংবাদিকতার পরিমাণ ও বিস্তার বেড়েছে। সাংবাদিকতার সঙ্গে সাহিত্যের সীমারেখাও অস্পষ্ট হয়েছে। এটা কাকতালীয় নয়, যে বিংশ শতাব্দীর বহু বিখ্যাত সাহিত্যিক জীবনের কোনো পর্বে বা সারাজীবন পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ থেকে শুরু করে বাংলার প্রমথনাথ বিশী, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় বা আজকের প্রচেত গুপ্ত – তালিকা তৈরি করলে কয়েক মাইল লম্বা হবে। পৃথিবীর যেসব জায়গায় মানুষ বেশি কষ্টে আছে, জীবনযুদ্ধ যেখানে বেশি প্রবল, সেখানে সাহিত্য আর সাংবাদিকতার তফাত আরও কমে এসেছে। এর সবচেয়ে দগদগে উদাহরণ প্যালেস্তাইনের কবি, পেশায় সাংবাদিক রাফীফ জিয়াদার একখানা কবিতা। তোমরা ইউটিউবে গিয়েই সার্চ করলে স্বচক্ষে দেখতে পাবে রাফীফ কীভাবে সমস্ত শরীর, মন দিয়ে কবিতাটা আবৃত্তি করেছেন।

কয়েক বছর আগে সেই ভিডিও দেখে ইংরিজিতে লিখিত এই কবিতার বাংলা ভাষান্তর করেছিলাম। তোমরা শুনে দ্যাখো, ইজরায়েলি হানাদারির মুখে বেঁচে থাকা প্যালেস্তিনীয়দের কথা কীভাবে রাফীফের কলমে উঠে এসেছে। এটা কি সাহিত্য, নাকি সাংবাদিকতা? নাকি দুটোই। তোমরাই বিচার করো।

আজ আমার শরীরটা মুখরোচক বুলেটিন
সাউন্ড বাইট আর শব্দসংখ্যায় বাঁধা,
পরিসংখ্যানে ভারি,
সব প্রশ্নের মাপা উত্তর দিতে তৈরি।
আমার ইংরিজিটা ঘষেমেজে,
জাতিপুঞ্জের সনদগুলো ঝালিয়ে নিয়ে এসেছি
তবু সে আমায় জিজ্ঞেস করল:
“মিস জিয়াদা, তোমার মনে হয়না সব মিটে যাবে
যদি তোমরা শিশুদের হিংসার পথ দেখানো বন্ধ করো?”
আমি শান্ত হওয়ার শক্তি খুঁজলামকিন্তু শান্তি তো আমার জিভের ডগায় নেই
গাজায় বোমাবৃষ্টি দেখতে দেখতে
শান্তি এইমাত্র কেটে পড়ল
আমরা বাঁচতে শেখাই, ভাই
(রাফীফ, হাসতে থাকো),
আমরা বাঁচতে শেখাই
আমরা প্যালেস্তিনীয়রা বাঁচতে শেখাই
ওরা শেষ আকাশের টুকরোটা দখল করে নেওয়ার পরেও,
শেষ আকাশপারে পাঁচিল তোলার পরেও,
আমরা বাঁচতে শেখাই

কিন্তু আজ আমার শরীরটা মুখরোচক বুলেটিন
সাউন্ড বাইট আর শব্দসংখ্যায় বাঁধা

“আরে আমাদের একটা গল্প চাই, একটা মানবিক গল্প,
রাজনৈতিক খবর-টবর নয়
আমরা লোককে তোমার, তোমার দেশের লোকের ব্যাপারে
জানাতে চাই
“বৈষম্য”, “দখলদারী” এইসব শব্দ চলবে না,
এটা রাজনৈতিক ব্যাপার নয়
সাংবাদিক হিসাবে আমাদের বল তোমার কথা,
মানে যা রাজনৈতিক নয়, এমন কিছু।”

আজ আমার শরীরটা মুখরোচক বুলেটিন

“ধরো গাজার একজন মহিলার গল্প যার চিকিৎসা দরকার,
বা তোমার কথাই বল নাআচ্ছা তোমার কটা হাড় ভাঙা?
এতগুলো কি যে সূর্য ঢেকে যাবে?
আমাকে তোমাদের মৃতদেহগুলো দাও না,
আর নামের তালিকা,
বারোশো শব্দের মধ্যে

আজ আমার শরীরটা মুখরোচক বুলেটিন
সাউন্ড বাইট আর শব্দসংখ্যায় বাঁধা,
এমনভাবে যাতে সন্ত্রাসবাদীদের রক্ত দেখে যাদের মন গলে না
তাদেরও নাড়িয়ে দেওয়া যায়

কিন্তু ওরা ব্যথা পেয়েছে,
গাজার গরু-ছাগলগুলোর জন্য ওরা সত্যিই খুব ব্যথিত
তাই আমি ওদের জাতিপুঞ্জের সনদগুলো দিলাম,
আর বললাম আমরা নিন্দা করি,
ঘেন্না করি, প্রত্যাখ্যান করি ওগুলো।
এটা সমানে-সমানে লড়াই নয়:
দখলদার আর ভিটেমাটি চাটি হওয়া লোকজন,
আর একশো, দুশো, এক হাজার মৃতদেহের কথা বলছি।
তা ছাড়া যুদ্ধাপরাধ আর গণহত্যার কথা বলছি
বলতে বলতে হাসি,
হেসে বলি “সন্ত্রাসবাদীদের কথা বলছি না কিন্তু”
আমি আবার গুনি, বারবার গুনি –
একশো, দুশো, এক হাজার মৃতদেহ।
কেউ আছেন? কেউ শুনছেন?
আহা, ঐ মড়াগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে
যদি হাউ হাউ করে কাঁদতে পারতাম,
যদি সব উদ্বাস্তু শিবিরে খালি পায়ে দৌড়ে যেতে পারতাম,
আর সব শিশুর কান চেপে রাখতে পারতাম,
যাতে ওদের বোমার আওয়াজ শুনতে না হয় বাকি জীবন
আমার মত!

আজ আমার শরীর মুখরোচক বুলেটিন
আর শোনো ভাই, তোমার জাতিপুঞ্জের সনদ
কস্মিনকালেও এ ব্যাপারে কিস্যু করেনি
আর কোনো সাউন্ড বাইট, কোনো সাউন্ড বাইট,
সে যতই নিখুঁত হোক না কেন,
আমার ইংরিজি যতই ঝরঝরে হোক না কেন,
কোনো সাউন্ড বাইট সে জীবনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
কোনো সাউন্ড বাইট পারবে না এসব মেটাতে।

আমরা বাঁচতে শেখাই ভাই,
আমরা বাঁচতে শেখাই

আমরা প্যালেস্তিনীয়রা রোজ সকালে জেগে উঠি
বাকি দুনিয়াকে বাঁচতে শেখাব বলে

সভ্যতার ইতিহাস যত লম্বা তার সাপেক্ষে বিচার করলে সাংবাদিকতা অত্যন্ত আধুনিক ব্যাপার, কিন্তু সাহিত্য অতি প্রাচীন। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে আধুনিক যুগ বলতে বিভিন্ন সময়কে বোঝানো হয়, আধুনিকতার সংজ্ঞাও সেই অনুযায়ী বদলে যায়। এখানে আধুনিক শব্দটা আমি সাহিত্যের ইতিহাসে যে অর্থে ব্যবহার হয় একেবারেই সে অর্থে ব্যবহার করছি না। শব্দটার সবচেয়ে সংকীর্ণ যে অর্থ, মানে সাম্প্রতিককালের ব্যাপার – সে অর্থেই ব্যবহার করলাম। তাহলে এতক্ষণ ধরে সাহিত্য আর সাংবাদিকতার অমিলগুলোকে বাতিল করতে করতে এসে এতক্ষণে একটা অমিল স্বীকার করলাম। তার মানে নিশ্চয়ই সাহিত্য আর সাংবাদিকতার সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে বললেও কোনো একটা সীমারেখা আমি মানি?

মানি তো বটেই। কী সেটা? উদ্দেশ্যের সীমারেখা। আবার রবীন্দ্রনাথের সংজ্ঞায় ফিরে যাই। “যে প্রকাশচেষ্টার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপন প্রয়োজনের রূপকে নয়, বিশুদ্ধ আনন্দরূপকে ব্যক্ত করা, সেই চেষ্টারই সাহিত্যগত ফলকে আমি রসসাহিত্য নাম দিয়েছি।” সাহিত্যের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আবহমানকাল ধরে চলছে। রবীন্দ্রনাথের আমলেও জোরদার বিতর্ক চলছিল। সেইসময় অনেকের মত ছিল সাহিত্যের উদ্দেশ্য লোককে শিক্ষিত করা। রবীন্দ্রনাথ তাতে ঘোর আপত্তি করেছিলেন। ওই সাহিত্যের পথে বইতেই ‘বাস্তব’ নামে প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন “লোক যদি সাহিত্য হইতে শিক্ষা পাইতে চেষ্টা করে তবে পাইতেও পারে, কিন্তু সাহিত্য লোককে শিক্ষা দিবার জন্য কোনো চিন্তাই করে না। কোনো দেশেই সাহিত্য ইস্কুল-মাস্টারির ভার লয় নাই। রামায়ণ মহাভারত দেশের সকল লোকে পড়ে তাহার কারণ এ নয় যে, তাহা কৃষাণের ভাষায় লেখা বা তাহাতে দুঃখী-কাঙালের ঘরকরনার কথা বর্ণিত। তাহাতে বড়ো বড়ো রাজা, বড়ো বড়ো রাক্ষস, বড়ো বড়ো বীর এবং বড়ো বড়ো বানরের বড়ো বড়ো লেজের কথাই আছে। আগাগোড়া সমস্তই অসাধারণ। সাধারণ লোক আপনার গরজে এই সাহিত্যকে পড়িতে শিখিয়াছে।” সাহিত্যের উদ্দেশ্য নিয়ে এতরকম পরস্পরবিরোধী মতামত আছে, যে তা থেকে কোনো মোদ্দাকথা বের করা অসম্ভব। এই হলে যতজন বসে আছেন তাঁদের প্রত্যেককে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেন সাহিত্য পড়েন? আলাদা আলাদা উত্তর পাওয়া যাবে। আবার সাহিত্যিকদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেন লেখেন? তাহলেও কোনো একটা উত্তর পাওয়া যাবে না। কিন্তু একথা ঠিক, যে বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান আছে এমন কোনো সাহিত্যিক বলবেন না “লিখতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু লেখা আমার চাকরি, তাই লিখি।”

সাংবাদিকদের অনেককে জিজ্ঞেস করলে কিন্তু এই উত্তরটা পাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ সাহিত্যের মূলে আছে মানসিক প্রয়োজন বা আরেকটু তরল করে বললে, সাহিত্য হৃদয় সংক্রান্ত ব্যাপার। সাংবাদিকতার মূলে আছে ব্যবহারিক প্রয়োজন। কথাটা শুধু সাংবাদিকের দিক থেকেই সত্যি তা নয়। একজন পাঠকও যে জন্যে পয়সা দিয়ে গল্পের বই কেনেন, সেই কারণেই খবরের কাগজ কেনেন কি? যে কারণে হলে গিয়ে বা মোবাইলে সিনেমা দ্যাখো তোমরা, ঠিক সেই কারণেই টিভিতে বা মোবাইলে খবর শোনো কি? তা তো নয়। সাহিত্য পড়ো বা সিনেমা দ্যাখো উপভোগ করার জন্যে। কিছু ক্ষেত্রে হয়ত নতুন কিছু জানার জন্যে। কাগজ পড়ো বা টিভিতে কি মোবাইলে খবর পড়ো চারপাশে কী হচ্ছে জানতে চাও বলে। যা হচ্ছে তার সঙ্গে নিজের রোজকার ভালমন্দ জড়িয়ে আছে বলে। কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়রের লেখা যদি কেউ না-ই পড়ে তার কী ক্ষতি হবে? ভারতের মত দেশে বেশিরভাগ লোকই তো সাহিত্য পড়ে না। কারণ সাহিত্য পড়তে গেলে যে প্রাথমিক পড়াশোনা করা দরকার তার সুযোগই পায় না। যারা পায় তাদের অনেকের হাতেও খাওয়া, পরা, থাকার ব্যবস্থা করে এবং পাঠ্য বইয়ের ব্যবস্থা করে এতটা অতিরিক্ত পয়সা থাকে না যে সাহিত্য পাঠ করার জন্যে শখ করে বই কিনবে। কিনে পড়ার ক্ষমতা না থাকলেও মানুষ যাতে বই পড়তে পারে তার জন্যে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বলে একটা চমৎকার জিনিস মানুষ আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু সে জিনিস তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। সে যা-ই হোক, আর্থিক ক্ষমতা না থাকলেও কিন্তু মানুষ খবর সংগ্রহ করতে চেষ্টা করে। নিজে কাগজ কিনতে না পারলে দোকানে গিয়ে পড়ে, প্রতিবেশীর কাগজ চেয়ে নিয়ে পড়ে। ইদানীং অবশ্য কাগজের জনপ্রিয়তা কমছে। কিন্তু মোটামুটি সকলেই টিভিতে খবর শোনে। নিদেনপক্ষে হাতের মোবাইলে বিভিন্ন ওয়েবসাইট খুলে খবর দেখে। ফেসবুকে দেখে, হোয়াটস্যাপে দেখে। অনেকসময় ভুয়ো খবরও দেখে ফ্যালে, কিন্তু দ্যাখে। মানুষের খবরের খিদে কিছুতেই মেটে না।

সাহিত্য আর সাংবাদিকতা যাদের জন্যে, অর্থাৎ পাঠক বা দর্শক – তাঁদের উদ্দেশ্যে যখন এরকম তফাত আছে, তখন সাহিত্য আর সংবাদ উৎপাদনের উদ্দেশ্যেও তফাত থাকতে বাধ্য। সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য মানুষকে অবগত করা। কী বিষয়ে? তা ঠিক করে সংবাদ পরিবেশকরা, চলতি কথায় সংবাদমাধ্যম। যেখানে সাংবাদিকরা চাকরি করেন। অর্থাৎ খবরের কাগজ বা চ্যানেল বা ওয়েবসাইট বা নিউজ এজেন্সি। পৃথিবীর যে কোনো দেশের খবরের কাগজ হাতে নিলে বা খবরের সাইট খুললে বা খবরের চ্যানেল দেখলে দেখা যাবে বিভাগগুলো মোটামুটি একই। রাজনীতির খবর, অর্থনীতির খবর, খেলার খবর, বিনোদন জগতের খবর। আমাদের দেশে এখনো খুব বেশি চল নেই যে দু ধরনের খবরের, সেগুলো হল পরিবেশ সম্পর্কিত খবর আর বিজ্ঞানের খবর। কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে একেকটা সংবাদমাধ্যমে একেকটা বিভাগের গুরুত্ব একেকরকম। কেউ রাজনীতির খবর বেশি পরিবেশন করে, কেউ সিনেমা-টিনেমা নিয়ে বেশি মেতে থাকে, কেউ আবার খেলা নিয়ে। যারা রাজনীতির খবর বেশি দেয় তাদের মধ্যেও কেউ এ দলের খবর বেশি দেয়, কেউ ও দলের খবর বেশি দেয়। এই তফাতগুলো কেন হয়? সে প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আগে অন্য একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার। এই যে বললাম, মানুষকে অবগত করা। আচ্ছা, অবগত হওয়ার দরকারটা কী? এই বুনিয়াদপুরে বসে যদি না-ই জানা যায় কলকাতায় কী হচ্ছে, দিল্লিতে কী হচ্ছে, ইউক্রেনের রাজধানী কিভে কী হচ্ছে বা নিউইয়র্কে কী হচ্ছে; তাতে ক্ষতিটা কী?

ক্ষতি ছিল না, যদি আমরা একটা রাজতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক দেশে বাস করতাম। আমাদের অধিকার বলে কিছু থাকত না, আইনকানুন বলেও কিছু থাকত না। রাজা বা একনায়কের মুখের কথাই হত আইন, আমাদের সবাইকে মুখ বুজে সেই আইন মেনেই চলতে হত। প্রতিবাদ করলেই পুলিস মিলিটারি ইত্যাদি দিয়ে মারধোর করা হত, জেলে পুরে দেওয়া হত, গুমখুন করা হত। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট ইংল্যান্ডের রানির শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার তিন বছরের মাথায়, ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি, আমরা, মানে ভারতের সাধারণ নাগরিকরা, একটা কাণ্ড করে বসেছি। আমরা একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু করেছি। পৃথিবীর অন্য অনেক গণতান্ত্রিক দেশের মত এই সংবিধান অনুযায়ী আমাদের কিসে ভাল, কিসে মন্দ; কোন আইনটা করা হবে আর কোন আইনটা বাতিল করা হবে, আমাদের প্রতিনিধি হয়ে কারা দেশ চালাবে – এসব ঠিক করার দায়িত্ব আমরা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছি। তা এইসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো আমরা নেব কী করে যদি কোথায় কী হচ্ছে সে সম্পর্কে অবগতই না থাকি? আর অবগত থাকা মানে মূলত খারাপ কী কী হচ্ছে সে সম্পর্কে অবগত থাকা। মানে আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কোথায় কোথায় তাঁদের যে দায়িত্ব আমরা দিয়েছি ভোটের মাধ্যমে, তা থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন সে সম্পর্কে অবগত থাকা। মানে ঘুষ নিচ্ছেন কি? আমাদের ভুল বুঝিয়ে বা অন্ধকারে রেখে এমন কোনো আইন তৈরি করছেন কি যাতে আমাদের ক্ষতি হতে পারে? তাঁদের হাতে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে – মানে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, পুলিসবাহিনী, সেনাবাহিনী – সেগুলো ব্যবহার করে এমন কিছু করছেন কি, যাতে তাঁরাই যে আমাদের ভৃত্য সেই ব্যাপারটা উল্টে গিয়ে আমরা তাঁদের ভৃত্য হয়ে যাই? যেসব সরকারি পরিষেবা আমাদের পাওয়ার কথা, তা আমরা সবাই পাচ্ছি কি? এমন নয় তো, যে কলকাতায় সরকারি হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বুনিয়াদপুরে পাওয়া যাচ্ছে না? বা বুনিয়াদপুরে সরকারি স্কুলে লেখাপড়া হচ্ছে, মেদিনীপুরে হচ্ছে না? বর্ধমানে মসৃণ রাস্তা হচ্ছে, কিন্তু ঔরঙ্গাবাদে হচ্ছে না? সরকার আমাদের মত সাধারণ লোকেদের মধ্যে মারদাঙ্গা লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে না তো? অন্য কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে এমন কোনো চুক্তি করছে না তো, যাতে সরকারের আমাদের উপর নজরদারি করতে সুবিধা হয় এবং আমাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়? আমাদের টাকায় তৈরি সরকারি সংস্থা জলের দরে একজন, দুজন ধনী লোককে বেচে দিচ্ছে না তো?

এই সমস্ত বিষয়ে অবগত হওয়ার জন্যে একটা গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমন হতেই পারে, আমার যে সিদ্ধান্তটা মনে হয় ঠিক তোমার মনে হল সেটা ঠিক নয়। কিন্তু আমার কেন মনে হয় ঠিক, আর তোমার কেন মনে হয় ঠিক নয় তা নিয়ে তর্ক হওয়া উচিত। তর্কে আমি ভুল প্রমাণিত হলে আমাকে তোমার সিদ্ধান্ত মানতে হবে, তুমি ভুল প্রমাণিত হলে তোমাকে আমার সিদ্ধান্ত মানতে হবে। এই প্রক্রিয়াতেই আমাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে বিতর্ক চলবে পৌরসভায়, পঞ্চায়েতে, বিধানসভায়, লোকসভায়, রাজ্যসভায়। তারপর সংখ্যাগরিষ্ঠ যাতে মত দেবে তাই হবে। একেই বলে গণতন্ত্র। কিন্তু আমাদের হাতে যদি তথ্যই না থাকে, তাহলে মত দেব কিসের ভিত্তিতে? দিলে কিছুদিন পরে বোঝা যাবে এমন মত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যা অধিকাংশ মানুষের মত হলেও আসলে তাদের পক্ষেই ক্ষতিকর হয়েছে। এমনটা ঘটেও, কারণ মানুষ মাত্রেই ভুল করে। একা করে বলেই অনেকে মিলেও ভুল করতে পারে। ভুল শোধরাতে হলেও আগে তো বুঝতে হবে ভুল করেছি। কী করে বুঝব, যদি আমার কাছে তথ্যই না থাকে?

এই ব্যাপারগুলো শুধু সরকারের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কের বেলায় নয়, যে কোনোরকম ক্ষমতায় যে আছে তার সঙ্গে যে ক্ষমতায় নেই তার সম্পর্কের বেলাতেই সত্যি। সুতরাং এবার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, অরওয়েল কেন বলেছিলেন, সাংবাদিকতা হচ্ছে তাই, যা কেউ না কেউ প্রকাশিত হতে দিতে চায় না? কোনো ক্ষমতাশালী তো চাইবে না তার কুকীর্তির খবর প্রকাশ পাক। যে সৎ ক্ষমতাশালী সে-ও হয়ত চাইবে না তার ভুলচুক লোকে জেনে যাক, কারণ সে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। সুতরাং সাংবাদিকতা করা মানেই হল, সজাগ দৃষ্টিতে যে ক্ষমতাশালী – সে সরকার হতে পারে, ব্যবসায়ী হতে পারে, মাস্টার হতে পারে, ডাক্তার হতে পারে, উকিল হতে পারে – তার দোষত্রুটি খেয়াল করা এবং সকলের চোখের সামনে সত্য উদ্ঘাটিত করা। আমি যখন সাংবাদিকতার ছাত্র ছিলাম, আমাদের এক মাস্টারমশাই বলেছিলেন “একশোটা শকুন মরলে একটা সাংবাদিক জন্মায়।” কথাটা কিন্তু নিন্দাসূচকভাবে বা ব্যঙ্গার্থে বলা নয়। বলার অর্থ হল, শকুনকে যেমন সারাক্ষণ ভাগাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, সাংবাদিকেরও কাজ হল সারাক্ষণ কোথায় কী অন্যায় হচ্ছে খুঁজে যাওয়া। আমাদের চারপাশ পরিষ্কার রাখার জন্যে শকুন কতটা প্রয়োজনীয় প্রাণী সে সম্পর্কে পুরনো দিনের লোকেদের ধারণা ছিল, আমাদের নেই। ফলে শকুন এখন একটা লুপ্তপ্রায় প্রাণী। সাংবাদিকও লুপ্তপ্রায় প্রাণী। কারণ যুগের হাওয়ায় সংবাদ হয়ে গেছে তেল, সাবান, শ্যাম্পু, এয়ার কন্ডিশনারের মত একটা পণ্য। ফলে সাংবাদিকরা চাকরি করেন যেসব সংবাদমাধ্যমে তারা আর সাংবাদিকদের দিয়ে শকুনের কাজটা করাতে চায় না, সেলসম্যান বা সেলসগার্লের কাজ করায়। কে না জানে, ব্যবসা করতে গেলে ক্ষমতাশালীর সঙ্গে বিবাদ করা চলে না? কিছু নাছোড়বান্দা সাংবাদিক এখনো আছেন, যাঁরা কিছুতেই বিক্রেতা হয়ে যেতে রাজি নন। তাঁরা কেউ ইন্টারনেটের সুযোগ নিয়ে ইউটিউব চ্যানেল খুলছেন, ফেসবুক পেজ খুলছেন। আমরা কয়েকজন যেমন একটা ওয়েবসাইট খুলেছি। কিন্তু এইভাবে সাংবাদিকতা করার অসুবিধা হল বড় বড় সংবাদমাধ্যমের মত আমাদের বিরাট পুঁজি নেই, বিজ্ঞাপন নেওয়ার উপায় নেই। কারণ বিজ্ঞাপন নিলেই বিজ্ঞাপনদাতারা হয়ে যাবেন ক্ষমতাশালী, তখন আর তাঁরা আমাদের শকুনের কাজটা করতে দেবেন না।

এই কারণেই আজকাল বেশকিছু ক্রাউড-ফান্ডেড মিডিয়া তৈরি হয়েছে। মানে তুমি সেই সাইটে গিয়ে কোনো লেখা পড়লে বা ভিডিও দেখলে, দেখে তার জন্যে টাকা দিলে। সেই টাকাতেই যারা কাজ করছে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হবে, সাইটের কাজকর্ম চলবে। তোমরা নিশ্চয়ই জানো এরকম অনেক সংবাদমাধ্যমের কথা। আমি যে সাইটের সঙ্গে যুক্ত সেটাও এরকমই একটা সাইট। কিন্তু বাংলায় এভাবে কাজ চালানো দ্বিগুণ শক্ত। কারণ সারা ভারতের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের উপরেও হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা তো চলছেই, সেইসঙ্গে বাংলা যে একটা ফালতু ভাষা, সেটা বাঙালিরা নিজেরা সবচেয়ে বেশি করে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। এই যে আমি বক্তৃতা দিচ্ছি বাংলায়, আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সংস্কৃত বিভাগ। অথচ এই ফ্লেক্সটা লেখা হয়েছে ইংরেজিতে। এমতাবস্থায় তোমাদের বাংলায় সাংবাদিকতা করতে বলি কী করে? আদৌ সাংবাদিক হতেই বা বলি কী করে, যা তোমাদের মাস্টারমশাইরা আমাকে বলতে বলছেন? বলার সমস্যা আছে।

পৃথিবীর কোন দেশে সাংবাদিকরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন তা নিয়ে প্রতি বছর একটা সমীক্ষা হয়। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ বলে এক আন্তর্জাতিক সংগঠন এই সমীক্ষা করে। ২০২২ সালের সর্বশেষ সমীক্ষায় ভারতের স্থান ছিল ১৮২টা দেশের মধ্যে ১৫০ নম্বরে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক – যাঁদের মধ্যে তোমাদের সবচেয়ে জানা নাম হয়ত গৌরী লঙ্কেশ – খুন হয়ে গেছেন। খুন হয়ে যাওয়া সাংবাদিকদের একটা লম্বা তালিকা দেওয়া সম্ভব। বক্তৃতা অতি দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে সে তালিকা দিচ্ছি না। শুধু এইটুকু তোমাদের বলে দিই, যে খুন হয়ে যাওয়াই একমাত্র সম্ভাব্য বিপদ নয়। তোমরা হয়ত সিদ্দিক কাপ্পান বলে একজনের নাম শুনেছ। তিনি কেরালার সাংবাদিক। উত্তরপ্রদেশে একটি দলিত মেয়ে ধর্ষিত হয়, খুন হয়, তারপর অভিযোগ ওঠে যে রাজ্যের পুলিসই নাকি দেহটা তার বাবা-মাকে অন্ধকারে রেখে রাতের অন্ধকারে জ্বালিয়ে দিয়েছে। সারা পৃথিবীর লোক টিভির পর্দায় দেখে ফেলেছে ঘটনাটা। তারপর সে ঘটনা নিয়ে আরও গভীরে লিখবেন বলে কেরালা থেকে সিদ্দিক যাচ্ছিলেন হাথরাসে। তিনি পৌঁছবার আগেই, কোনো প্রতিবেদন লেখার আগেই, স্রেফ লিখতে পারেন বলেই পুলিস তাঁকে গ্রেপ্তার করে হাজতে পুরে দেয়। তারপর দুবছরের বেশি সময় কারাবাস করে সিদ্দিক এই কিছুদিন আগে জামিন পেয়েছেন। জামিন, খালাস নয় কিন্তু। মানে মামলাটা এখনো চালু আছে। অথচ পুলিস তাঁর বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ করেছে তার পক্ষে বিন্দুমাত্র প্রমাণ দেখাতে পারেনি।

এইরকম বিপদের মুখে আমাদের দেশের সাংবাদিকরা এখন সাংবাদিকতা করেন। তোমরা ঠিক আমার ছেলেমেয়ের বয়সী নও, কিন্তু আমার ভাইবোনের মত তো বটেই। তা আমি এগুলো জেনেশুনে কী করে তোমাদের বলি, যে সাংবাদিকতা করো? ভারত সরকার অবশ্য বলেছে যে ওই সমীক্ষাটা ভুল। মেথডোলজি ভুল, অনেক কম নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ইত্যাদি। কিন্তু আমি যদি কোনো মেয়ের বাবা না হতাম, তাহলে হয়ত কায়মনোবাক্যে সরকারের কথা বিশ্বাস করে নিয়ে তোমাদের বলতে পারতাম, ঠিক আছে। সরকার একটা কথা বলেছে আর একটা সংগঠন উল্টো কথা বলেছে। তোমরা নিজেরা ময়দানে নামো, নেমে পরখ করে দ্যাখো সত্যিটা কী। কিন্তু আমি বাপু তোমাদের সে ঝুঁকি নিতে বলতে পারছি না।

এ প্রসঙ্গে বলে দিই, ইতিহাস বলছে কোনো দেশ যখন সাংবাদিকদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, তখন সাহিত্যিকরাও শান্তিতে থাকতে পারেন না। তোমরা তেলুগু ভাষার কবি ভারভারা রাওয়ের কথা হয়ত জানো। এই অশীতিপর কবিও দীর্ঘকাল কারান্তরালে কাটিয়েছেন ওইরকমই আরেকটা অভিযোগে, যা পুলিস আজ অব্দি প্রমাণ করতে পারেনি। আপাতত জামিনে বাইরে আছেন অসুস্থ বলে। পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে অভিজিৎ রায়ের মত ব্লগারদের হত্যার কথাও তোমরা নিশ্চয়ই জানো। ব্লগাররা ঠিক সাহিত্যিক না হলেও সাংবাদিকতা আর সাহিত্যের মাঝামাঝি একটা জায়গায় বিচরণ করেন বলা যায়। আবার বিশ্ববিখ্যাত সলমন রুশদির উপর প্রাণঘাতী আক্রমণের কথাও নিশ্চয়ই জানো। তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন, একটা চোখ প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উদাহরণ অসংখ্য, যা থেকে বোঝা যায় সারা পৃথিবীর সাংবাদিক এবং সাহিত্যিকদের জন্যে এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় নয়।

আরও পড়ুন সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের স্তম্ভ নয়, গণতন্ত্রই সংবাদমাধ্যমের স্তম্ভ

কী করে সাংবাদিক হতে হয় আসলে সেটাই আমি এতক্ষণ ধরে বলেছি, যদি তোমরা বুঝে থাকো। কিন্তু কী করে সাংবাদিকতার চাকরি পেতে হয় তা বলা আমার সাধ্যের বাইরে। কারণ সমস্ত সংবাদমাধ্যম ব্যাপকভাবে সাংবাদিক ছাঁটাই করেছে গত ৫-৬ বছরে। কোভিড-১৯ আসার আগে থেকেই বহু কাগজ, টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। অতিমারীর সময়ে ওটাকে অজুহাত করে আরও বেশি কর্মী সংকোচন করা হয়েছে, বহু বড় বড় কাগজ তাদের অনেক জায়গার সংস্করণ তুলে দিয়েছে, যেগুলো রেখেছে সেখানেও প্রচুর সাংবাদিক এবং অন্যান্য বিভাগের কর্মীদের চাকরি গেছে। যে সাংবাদিকদের চাকরি যায়নি, তাঁরা অরওয়েলের ভাষায় পাবলিক রিলেশন করতে বাধ্য হচ্ছেন। আজকাল পাবলিক রিলেশন যেহেতু নিজেই একটা আলাদা পেশা, সেহেতু ও কাজটা করতে হলে সরাসরি তাতে যাওয়াই ভাল। কারণ তাতে সাংবাদিকদের চেয়ে বেশি মাইনে পাওয়া যায়। কোথায় শিখবে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় – তিনটে জায়গাতেই সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের পাঠক্রমের অঙ্গ হিসাবেই ওটা পড়ানো হয়। যারা আরেকটু দূরে যেতে পারবে, তারা ওড়িশার ঢেঙ্কানল বা দিল্লির ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মাস কমিউনিকেশনসে পড়তে পারো। এছাড়া আছে চেন্নাইয়ের এশিয়ান কলেজ অফ জার্নালিজম। এগুলো অনেকদিনের প্রতিষ্ঠান। এছাড়া একগুচ্ছ নতুন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে যারা সাংবাদিকতা এবং পি আর পড়ায়। তাদের তত্ত্বতালাশ তোমরা গুগল করলেই পাবে।

যে কথাটা বলে শেষ করব সেটা হল সাহিত্য যেমন সাংবাদিকতার মত অপ্রিয় সত্য উদ্ঘাটন করে তেমন সাংবাদিকতাও দেখার গভীরতায় এবং ভাষার সৌন্দর্যে সাহিত্যে বা শিল্পে উত্তীর্ণ হতে পারে। যে কারণে শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিলাম, অলঙ্করণ করলে কি সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকতা থাকে না? উত্তর হল আলবাত থাকে। বস্তুত, সঠিক অলঙ্করণ ছাড়া সাংবাদিকতা যে বার্তা দিতে চাইছে তা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। পাঠকের কাছে আদৌ না পৌঁছতে পারে। সাংবাদিকতা সম্পর্কে আমরা এভাবে ভাবতে অভ্যস্ত নই, কারণ সাংবাদিক বলতেই আমরা রিপোর্টার বুঝি। কথাটার মানে আসলে সাংবাদিক নয়। রিপোর্টার মানে প্রতিবেদক, যিনি যা ঘটেছে তার প্রতিবেদনটা এনে দেন। সেটা অবশ্যই সাংবাদিকতা, কিন্তু ওই প্রতিবেদনকে যথাযথভাবে সাজিয়ে পাঠক বা দর্শকের সামনে হাজির করা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। সেই কাজ যাঁরা করেন তাঁদের মধ্যে অনেকরকম লোক আছেন। এক দলের নাম সম্পাদক। কোন খবরটা নেব, কোনটা নেব না তা সম্পাদকরা ঠিক করেন। কোন খবরটাকে কীভাবে নেব তাও সম্পাদকরা ঠিক করেন। কোন খবরটা কাগজের প্রথম পাতায় যাবে, কোনটা ভিতরে যাবে; কোনটা প্রথম পাতায় ছবিসহ বড় করে যাবে, কোনটা ছোট করে এক কলমে যাবে – এই সমস্ত সিদ্ধান্ত, যা বাদ দিয়ে সাংবাদিকতা হয় না, সেগুলো সম্পাদকরা নেন। উপরন্তু সংবাদের অলঙ্করণ মানে শুধু সম্পাদনাও নয়। চিত্রসাংবাদিক বা ফটোগ্রাফারদের আমরা সাংবাদিক ভাবতে অভ্যস্ত নই, কিন্তু তাঁদের কাজ আসলে সাংবাদিকতার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এমন সব ছবি তোলা সম্ভব যে ছবি নিজেই গোটা ঘটনাটা বলে দেবে, আলাদা করে প্রতিবেদন লেখার দরকারই হবে না। তার উপর কাগজ, টিভি, ওয়েবসাইট – সর্বত্রই আছেন গ্রাফিক ডিজাইনাররা। তাঁরা কোনো প্রতিবেদনের নির্যাস বা প্রতিবেদনের অতিরিক্ত কিছুও আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে পারেন। এতরকম অলঙ্করণ ঠিকঠাক হলে, তবে কাজটা সাংবাদিকতা হয়ে ওঠে। মানে প্রকৃত অলঙ্করণ ছাড়া সাংবাদিকতা হয় না।

এছাড়াও সাংবাদিকতার মধ্যেই প্রতিবেদন বা রিপোর্টের চেয়েও গভীরে গিয়ে লেখা হয় এবং সাহিত্যে উত্তীর্ণ হতে পারে এরকম এক স্বতন্ত্র ধারা আছে। তার নাম রিপোর্টাজ। বাংলা ভাষায় যাঁরা ভাল রিপোর্টাজ লিখেছেন তাঁদের একজন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি আমাদের ভাষার একজন উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকও বটে। তাঁর একটা ছোট্ট রিপোর্টাজের নাম ‘মাটিতে এক ঋতু’। তার শেষদিকটা পড়ে এই বক্তৃতা শেষ করব। এখানে দীপেন্দ্রনাথ লখনৌয়ের উপকণ্ঠে একটা বস্তির কথা লিখছেন।

… পেছনে ভাঙা লোহার বেড়ার ওপর দিয়ে রেললাইন চলে গেছে কানপুরের দিকে। সামনেও কালো পিচের চওড়া রাস্তা। বাঁ দিকে পচা নালা, দক্ষিণে মজা নর্দমা। ধার ঘেঁষে মানুষ তার প্রতিদিনের কাজটুকু সেরে রেখেছে। জমাট দুর্গন্ধ। আর এরই মধ্যে ওদের সেই এক টুকরো পৃথিবী। যার ওপর দিয়ে অন্তত খ্রিস্ট জন্মের পরও এক হাজার ন’শো চুয়ান্নটি বসন্ত চলে গেছে।

মাথা হেঁট করে ফিরে আসছিলাম। কিন্তু, হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হল।

অবাক বিস্ময়ে দেখলাম একটা খুপরির দোরগোড়ায় আধহাতটাক জমি কুপিয়ে কে যেন দুটো ঝাউ আর কী একটা বুনো ফুলগাছের ডাল সযত্নে পুঁতে দিয়েছে। এত ছোট যে চোখে পড়ে কি পড়ে না। জমিটার চারপাশ সুন্দর করে নিকোনো। এত তুচ্ছ যে সহজেই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।

জিজ্ঞেস করলাম : কে পুঁতেছে রে?

আধডজন ছেলে কাছেই খেলা ছেড়ে অবাক হয়ে আমাদের দেখছিল। ছুটে গিয়ে সামনের অন্ধকার কুঠরিটা থেকে কানহাইয়ালালকে ধরে আনল। নাম জানতে চাইলাম। রুগ্ন বাছুরের মতো নির্বোধ আর অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে সে উত্তর দিল।

বললাম : এই ডাল তুমি পুঁতেছ এখানে?

অপরাধীর ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ল সে।

জিজ্ঞেস করলাম : কেন?

মিষ্টি সুরে দেহাতি ঢঙে সে উত্তর দিল : কাহে, গাছ হোবে।

গাছ হলে কী হবে?

আবার সে বিমূঢ় দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ফিক করে হেসে ফেলল হঠাৎ। হলদে রঙের ছোট্ট দাঁতগুলো বার করে কেমন এক সলজ্জ ভঙ্গিতে বলল : কাহে, ফুল হোবে।

বললাম : ফুল হোনেসে কেয়া হোগা কানহাইয়ালাল?

কিছু না ভেবেই ঝটপট উত্তর দিল সে : কাহে, সুন্দর হোবে।

আর প্রশ্ন করতে পারলাম না। দেখলাম ওখানকার শ্রমিকনেতা, আমাদের সঙ্গী সরফজি এক দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁরও চোখে শিল্পীর দৃষ্টি। তাঁর ঠোঁটেও কী এক সার্থকতার হাসি।

তারপর কলকাতায় ফিরে এসেছি।

এখানে দৈনিক স্টেটসম্যান পড়ি, সাপ্তাহিক ‘দেশ’-এর পাতা ওলটাই। অ্যালবার্ট হলে বসে বিবর্ণ কফির স্বাদে মশগুল থেকে বন্ধু আর পরিচিতের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে তর্ক করি। আবার, ইতিহাসের নতুন মূল্যবোধকে যাচাই করার জন্য ডাক এলে ছুটে যাই ময়দানের সভায়। জীবন এখানে দ্রুত, বৈচিত্র্য আর পরস্পর-বিরোধিতার আবর্তে প্রাণ এখানে অবিরাম দোলায় দুলছে।

কিন্তু এরই মধ্যে থেকে থেকে মনে পড়ে যায় সেই দিনটা। মন্ত্রের মতো কতকগুলো কথা আর স্বপ্নের মতো গোটা দুই মুখ।

আর মনে হয়, আবার ফাল্গুন আসছে।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের স্তম্ভ নয়, গণতন্ত্রই সংবাদমাধ্যমের স্তম্ভ

গত ২১ মে, ২০২২ (শনিবার) কলকাতার ন্যাশনাল মাইম ইনস্টিটিউটে হাতিবাগান সঙ্ঘারাম নাট্যদলের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রদত্ত সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে এই বক্তৃতা পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত রূপে প্রকাশ করা হল। আলোচনার বিষয় ছিল ‘আলো-অন্ধকারে আমাদের সময় – কী করণীয়, কী স্মরণীয়’।

উপস্থিত সকলকে নমস্কার, হাতিবাগান সঙ্ঘারামকে জন্মোৎসবের শুভেচ্ছা। আজকাল ভাল কাজ করতে চায় এমন কোনো সঙ্ঘের সন্ধান পেলে ভারি আরাম হয়। আপনারা আরও অনেকদিন আমাদের মনের আরাম, প্রাণের আরাম দিন, সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণাও দিন – এই কামনা করি।

আমার কাছে যখন আজকের আলোচনায় অংশগ্রহণ করার প্রস্তাবটা এল, আলোচনার বিষয়টা শুনেই আমার যা মনে পড়ল সেটা বলি। করোনা অতিমারির শুরুর দিক পর্যন্ত আমি একটা খবরের কাগজে সম্পাদনার চাকরি করতাম। ওই চাকরিতে যেমন হয়, অফিস থেকে বেরোতাম মাঝরাত্তির নাগাদ; অফিসের গাড়ি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসত। আমরা রোজ বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের সামনে দিয়ে যেতাম। স্টেডিয়াম সমেত বাইপাসের অনেকটা জায়গায় অত রাতেও আলো চুঁইয়ে পড়ত। ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়ে বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকটা প্রথম পড়ি। ওই নাটকের একটা দৃশ্য আমাদের পাঠ্য ছিল। সেই দৃশ্যে একটা বিয়েবাড়ির বর্ণনা আছে। লেখা হয়েছে, সেখানে আলো চুঁইয়ে পড়ছে। যে মাস্টারমশাই পড়িয়েছিলেন, তিনি খুব যত্ন করে আমাদের বুঝিয়েছিলেন যে কোনো জিনিস চুঁইয়ে পড়ে তখনই, যখন তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়ে যায়। তা ২০১৭ সালে যখন ভারতে অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপের আসর বসেছিল, তখন থেকেই ওই এলাকা চুঁইয়ে পড়া আলোয় ভেসে যাচ্ছে। এখন মহাবিশ্ব তো নিত্যতার সূত্র মেনে চলে, যাকে ইংরেজিতে বলে ল অফ কনজারভেশন। তার মানে পৃথিবীর যেখানেই আলো চুঁইয়ে পড়ে, বুঝতে হবে সেখানেই অন্য কোনো জায়গার আলো এনে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। সেই জায়গাটাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অন্ধকারে। আপনার চারপাশে তাকান, দেখবেন এরকম চুঁইয়ে পড়া আলোর জায়গা ২০-২৫ বছর ধরে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। আর আমরা এই আলোর বৃত্তেই থাকি বলে খেয়াল করি না, যে অন্ধকার এলাকাগুলোও বাড়ছে আলোর গতিতে।

সেই কারণেই আমাদের সময়ের আলো, অন্ধকার নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন বোধ হচ্ছে। নইলে, শুধু আমাদের সময় কেন, যে কোনো সময়েই তো আলো আর অন্ধকার দুটোই থাকে। কিন্তু আমাদের সময়ে অন্ধকারের গভীরতা আর ব্যাপ্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে অনেক প্রবীণ মানুষেরও অভূতপূর্ব বলে মনে হচ্ছে। এখানে সঞ্জয়দা (সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়) আছেন। পশ্চিমবঙ্গ ১৯৬০, ৭০-এর দশকে যে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে গেছে তাকে ওঁর মত করে কজন জানে? সঞ্জয়দা সে নিয়ে লিখলে বা বললে সেই অন্ধকার একেবারে জ্যান্ত মনে হয়। আর নৃসিংহবাবু (নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী) তো বললেনই, আলো আর অন্ধকার সৃষ্টির সমবয়সী। সুতরাং ইতিহাসে এমন কোনো যুগ ছিল না যা সম্পূর্ণ অন্ধকারমুক্ত। কিন্তু পরিমাণগত এবং গুণগত তফাত ঘটে। বিরাট তফাত। আমাদের সময়ের আলোচনায় যাওয়ার আগে এই কথাগুলো বলে নিতে হল, কারণ জীবনানন্দ দাশের ছিল একজন বনলতা সেন, আর আমরা হলাম অভ্যাসের দাস। আমাদের আছে হাজার হাজার বনলতা সেন। আপনি বর্তমানের কোনো অন্ধকারের দিকে আঙুল দেখালেই তাঁরা জম্বিদের মত দলে দলে তেড়ে আসবেন, বলবেন “এখন প্রতিবাদ করছেন? এতদিন কোথায় ছিলেন?”

মাঠে যেমন বাউন্ডারি না থাকলে খেলা যায় না, তেমনি আলোচনারও সীমা ঠিক করে না নিলে আলোচনা করা যায় না। আমি যেহেতু সাংবাদিকতা করি, তাই মূলত সাংবাদিকতার অন্ধকার নিয়েই আলোচনা করব, প্রসঙ্গক্রমে অন্য অন্ধকারের কথা এসে পড়বে।

আমি যদি আপনাদের জিজ্ঞেস করি, সাংবাদিক শব্দটা শুনলেই প্রথমে কার নাম মনে আসে? কোনো সন্দেহ নেই, অনেকেই বলবেন অর্ণব গোস্বামী। সকলেই যে লোকটাকে পছন্দ করেন বলে বলবেন তা নয়, যাঁরা অপছন্দ করেন তাঁদেরও প্রথমে ওই নামটাই মনে আসবে। লোকটি অন্ধকার এতটাই ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। কেউ কেউ হয়ত একেবারে বিপরীত মেরুর রবীশ কুমারের নাম করবেন। এছাড়া সুমন দে, মৌপিয়া নন্দী, অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি নামও উঠে আসতে পারে। পুরনো লোকেরা বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, বরুণ সেনগুপ্ত, গৌরকিশোর ঘোষ, কুলদীপ নায়ার, সি আর ইরানি ইত্যাদি নাম বলবেন। কিন্তু আজকে আমি আপনাদের সামনে একেবারে অন্য কতকগুলো নাম বলব। আজকের ভারতবর্ষে আসল সাংবাদিকতা এঁরাই করছেন। সৈনিকরা নিজের জীবন বাজি রেখে লড়েন, এই সাংবাদিকরা নিজের সর্বস্ব বাজি রেখে খবর তুলে আনছেন।

প্রথম নামটা পবন জয়সোয়াল। উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের এই সাংবাদিক ২০১৯ সালে জনসন্দেশ টাইমস বলে একটা স্থানীয় কাগজে খবর করেন, যে একটা স্কুলে মি ডে মিলে স্রেফ রুটি আর নুন দেওয়া হচ্ছে। সে খবর ক্রমশ সারা দেশে হইচই ফেলে দেয়, যোগী সরকারের মুখ পোড়ে। উত্তরপ্রদেশ পুলিস তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক চক্রান্ত, কর্মরত সরকারি কর্মচারীর কাজে বাধা দেওয়া আর প্রতারণা – এই তিনটে অভিযোগে এফ আই আর দায়ের করে। যথারীতি শেষ অব্দি একটা অভিযোগও প্রমাণ করে উঠতে পারেনি। পবন ক্যান্সারে ভুগছিলেন, চিকিৎসা করার মত যথেষ্ট আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। গত ১১ এপ্রিল তিনি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ, বিরোধী নেতা অখিলেশ যাদব আর কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে ট্যাগ করে অর্থসাহায্য চেয়ে টুইট করেন। নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্যও দিয়ে দেন। ওঁরা কতটা সাহায্য করেছিলেন জানি না, কোনো কোনো সাধারণ মানুষ করেছিলেন। পবন গত ৫ মে মারা গেছেন।

দ্বিতীয় নাম যোগেন্দ্র সিং। তিনি কোনো স্থানীয় কাগজেও কাজ করতেন না, তাঁর ছিল ‘শাহজাহানপুর সমাচার’ নামে একটা ফেসবুক পেজ। ২০১৫ সালের ৩০ মে সেই পেজে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের মন্ত্রী, সমাজবাদী পার্টির রামমূর্তি বর্মা এক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে ধর্ষণ করেছেন এবং জোর করে জমি দখল করেছেন – এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়। আপনাদের মধ্যে যারা সোশাল মিডিয়ায় খুব সক্রিয়, তাদের মনে পড়তে পারে একটা ভাইরাল ছবি – শরীরের বেশিরভাগটা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া একটা মানুষ বুকে হেঁটে এগোবার চেষ্টা করছে। সেই মানুষটাই যোগেন্দ্র। কিছু মানবাধিকার সংগঠন ঘটনাটা নিয়ে চেঁচামেচি না করলে পুড়ে মরেও যোগেন্দ্রর ভাইরাল হওয়া হত না। মন্ত্রীমশাই আর কয়েকজন পুলিসকর্মীই যে যোগেন্দ্রকে জীবন্ত দাহ করেছেন সেটাও চাপা পড়ে যেত।

তৃতীয় নাম সিদ্দিক কাপ্পান। এই সাংবাদিক কয়েক বছর হয়ে গেল উত্তরপ্রদেশে হাজতবাস করছেন এমন এক প্রতিবেদনের জন্য, যা তিনি লিখতে পারতেন বলে উত্তরপ্রদেশ সরকারের ধারণা। এতদিন হয়ে গেল তাঁকে জামিন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। কাশ্মীরওয়ালা কাগজের সম্পাদক ফাহাদ শাহ আর ফ্রিলান্স সাংবাদিক সাজ্জাদ গুলের হাজতবাসও বেশ কয়েক মাস হয়ে গেল। তবে কাশ্মীরের কথায় যাব না, কারণ ওখানকার সাংবাদিকদের উপর নির্যাতনের যত বড় তালিকাই তৈরি করি না কেন, সেটা অসম্পূর্ণ তালিকা হবে। বরং মধ্যপ্রদেশের কথা বলি।

সিধি জেলার সাংবাদিক কণিষ্ক তিওয়ারি। তিনি গিয়েছিলেন নাট্যশিল্পী নীরজ কুন্দেরের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানার বাইরে যে প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছিল তা কভার করতে। পুলিস তাঁকে এবং কয়েকজন প্রতিবাদী থিয়েটার কর্মীকে থানার ভিতর টেনে নিয়ে যায়, ১৮ ঘন্টা মত লকআপে আটকে রাখে। তাঁর অভিযোগ, মারধরও করা হয় এবং জামাকাপড় খুলে ফেলতে বাধ্য করা হয়। শেষের অভিযোগটা যে মিথ্যে নয় তা আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, কারণ শুধু অন্তর্বাস পরিহিত বন্দীরা জড়সড় হয়ে এক পুলিস অফিসারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, এ ছবিও ভাইরাল হয়েছিল।

একটা নামও পশ্চিমবঙ্গের নয় দেখে নিশ্চয়ই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন? ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৫০ নম্বরে নেমে যাওয়া এই দেশে আমাদের রাজ্যটাকে আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মত মরুদ্যান আখ্যা দেবেন ভাবছেন কি? তাহলে আরেকটা নাম বলি। বিপ্লব মন্ডল। ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল কলকাতা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজগুলো খুঁজে দেখুন। অধিকাংশ কাগজের প্রথম পাতায় পাবেন এঁর কথা। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াকে আঁতুড়েই মুখে ধান পুরে মেরে ফেলার যে চেষ্টা চলছিল সেদিন, তার ছবি তুলে ফেলার অপরাধে রাজনৈতিক গুন্ডারা চিত্রসাংবাদিক বিপ্লবকে মারধোর করে, জামাকাপড় খুলে নেয়, সে ছবি মোবাইলে তোলা হয় এবং হুমকি দেওয়া হয় “ভাইরাল করে দেব কিন্তু।” সৈনিকদের মত ‘জীবন’ বাজি রেখে কাজ করছেন না বলে কেন ‘সর্বস্ব’ বাজি রেখে বললাম বোঝা গেল তো?

এটা কিন্তু এক দিকের অন্ধকার। শুধু এই দিকে অন্ধকার থাকলে উল্টো দিকে আলো দেখা যেত। কিন্তু উল্টো দিকটা কীরকম? বিপ্লবের কথা অধিকাংশ কাগজে বেরিয়েছিল বলেছি, সব কাগজে বলিনি কিন্তু। যে কাগজগুলোতে বেরোয়নি, তার মধ্যে একটা হল সেই কাগজ, যাদের হয়ে উনি সেদিন ছবি তুলতে গিয়েছিলেন। এটাই আজকের সাংবাদিকতার বাস্তবতা। আমি যখন সাংবাদিকতায় আসি ২০০৫ সালে, তখন একেই পড়তে পড়তে চাকরি পেয়ে গেছি বলে ধরাকে সরা জ্ঞান করতাম। তার উপর সিনিয়ররা একেকজনকে দেখিয়ে বলতেন “ওই যে অমুকদাকে দেখছিস? ও কর্পোরেশনে ঢুকলে মেয়র পর্যন্ত থরথর করে কাঁপে। কখন কী খবর করে দেবে, মেয়রের চেয়ার নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে।” “তমুক দিদিকে দ্যাখ। পুলিস কমিশনারও ওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমতা করে।” আমরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, ওঁদের মত হতে হবে।

ওই সাংবাদিকদের কি রাবণের মত দশটা মাথা ছিল, নাকি দুটো করে অতিরিক্ত হাত-পা জামাপ্যান্টের ভিতর লুকনো থাকত? তা তো নয়। তাহলে সরকার, সরকারি দল, পুলিস, প্রশাসন, বিরোধী দল – সকলকে চটানোর মত খবর করার সাহস পেতেন কী করে? পেতেন, কারণ জানতেন আমার কাগজ আমার পিছনে আছে। আমার নামে যদি মামলা হয়, কাগজের উকিল বুঝে নেবে। আমাকে যদি গ্রেপ্তার করা হয়, আমার সম্পাদক জামিনের ব্যবস্থা করবেন, পরদিন কাগজে বিরাট করে খবর বেরোবে যে সরকার সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করছে। আর রাজনৈতিক গুন্ডারা যদি পেটায়, মিডিয়ার গাড়ি যদি ভাঙচুর হয়, তাহলে শুধু তাঁর কাগজ বা চ্যানেল নয়, গোটা সংবাদমাধ্যম সরকারের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগবে। শুধু পশ্চিমবঙ্গের কথা বলছি না, সারা দেশেই এরকম হত। আর এখন? সরকারের বিরুদ্ধে বা কোনো ক্ষমতাশালী, পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে খবর করতে গেলে প্রথমে আপনি আপনার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলবে “চেপে যা বাপু। কী দরকার?” যদি এমন হয় যে আপনার বসটির মেরুদণ্ড এখনো সোজা, তাহলে খবরটা হয়ত হয়ে গেল, কিন্তু পরদিন আপনি আর আপনার বস – দুজনের চাকরি নিয়েই টানাটানি হবে। এভাবে অসংখ্য ভাল সাংবাদিকের চাকরি গেছে গত এক দশকে। সারা দেশেই গেছে। প্রতিদিন যে আরও কত সরকারবিরোধী খবর এবং টাকার কুমিরদের কুকীর্তির খবর বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে বা লঘু করে ফেলা হচ্ছে ভারতবর্ষের নিউজরুমগুলোতে, তার হিসাব করার চেয়ে মাথার চুল গোনা সহজ।

কাদের অঙ্গুলিহেলনে হচ্ছে এরকম? কাগজ এবং চ্যানেলের মালিকদের। কেন তাঁরা এরকম হয়ে গেছেন গত এক দশকে? সবচেয়ে বড় কারণ – বিজ্ঞাপন।

সংবাদমাধ্যম বলতে কাদের বোঝায়? স্বাধীনতার পর থেকে ভারত যে আধা-সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ে চলছিল, তাতে যে দু-একটা শিল্পক্ষেত্রে সরকারি অংশগ্রহণ নগণ্য ছিল তার একটা হল মিডিয়া। গত সহস্রাব্দের প্রায় গোটাটাই মিডিয়া বলতে মোটের উপর প্রিন্ট মিডিয়াকেই বোঝাত, কারণ তার আগে অব্দি তো টিভির খবর মানে কেবল দূরদর্শনের বুলেটিন। কেবল টিভি তো ঘরে ঘরে থাকত না, কারণ সেটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। তা তখনকার খবরের কাগজগুলো ১৯৯১ সালের অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর থেকে আমাদের কী বুঝিয়েছে? না, ভর্তুকি খুব খারাপ জিনিস। কোনোকিছুতে ভর্তুকি দেওয়া সরকারের উচিত নয়। সবকিছু খোলা বাজারে ছেড়ে দেওয়া উচিত, সেখান থেকে যার যা কেনার সামর্থ আছে সে সেটা কিনবে, যার সামর্থ নেই সে কিনবে না। অথচ এই যে তিরিশ বছর হয়ে গেল উদারীকরণের, সমস্ত সময়টা জুড়ে খবরের কাগজগুলো কিন্তু নিউজপ্রিন্ট কেনার সময়ে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেয়ে এসেছে। মানে আপনি সকালবেলা আপনার বাড়ির কাগজটায় ভর্তুকির বিরুদ্ধে একশো যুক্তি পড়ে পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে জমিয়ে তর্ক করে এসেছেন, কাগজের মাধ্যমে জনমত তৈরি হয়েছে, সরকার সেই জনমত শিরোধার্য করে ধীরে ধীরে সবেতেই ভর্তুকি কমিয়ে গেছে। কমাতে কমাতে ২০২২ সালে এসে আপনার রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম হয়ে গেছে হাজার টাকা। এদিকে আপনার কাগজের মালিক কিন্তু সরকারকে একবারও বলেনি, যে আমার নিউজপ্রিন্ট কিনতে ভর্তুকি লাগবে না। শুধু তা-ই নয়, সমস্ত সংবাদমাধ্যম গাছেরও খেয়েছে, তলারও কুড়িয়েছে। মানে কাগজ কেনার সময়ে একবার ভর্তুকি পেল, আবার সেই কাগজে খবর ছেপে যখন বার করবে তখন সরকারি বিজ্ঞাপনও পেল। তাহলে ডাবল সাবসিডি হল? এখানেও শেষ নয়। এর উপর আবার বেসরকারি বিজ্ঞাপন ছেপেছে। এখন তো বিজ্ঞাপন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে আপনি কাগজের প্রথম পাতা খুঁজে পাবেন না। যাঁরা খুব ভোরে ওঠেন তাঁরা শুরুর বিজ্ঞাপনের পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে ঘুমিয়েও পড়তে পারেন।

টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। তারাও অনেক টাকার সরকারি বিজ্ঞাপন পায়, সঙ্গে বেসরকারি বিজ্ঞাপনও চলে। সেটা মেনে নেওয়া যেত, যদি এরা দর্শকদের থেকে টাকা না নিত। ডিটিএইচ যুগের আগে যেমন চ্যানেলগুলো আপনার থেকে টাকা নিতে পারত না। তাহলে আয় করবে কোথা থেকে? সুতরাং বিজ্ঞাপন দরকার ছিল। আমি কূপমণ্ডূক, কিন্তু যাঁরা বিভিন্ন দেশে গেছেন তাঁরা জানেন, সাবস্ক্রিপশন মডেলে টিভি চললে কিন্তু এত বিজ্ঞাপন থাকে না। আমাদের এখানে তো এখন অনুষ্ঠানের মাঝে বা খবরের মাঝে বিজ্ঞাপন হয় না, বিজ্ঞাপনের মাঝে একটুখানি খবর হয়। ক্রিকেট খেলা দেখতে বসলে দেখবেন কোনো কোনো ওভারের একটা-দুটো বল হয়ে যাওয়ার পর বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়। আসলে চ্যানেল মালিক আর বড় কাগজের মালিকদের লোভের কোনো শেষ নেই। “এ জগতে হায় সে-ই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি।”

আরও পড়ুন সত্যান্বেষী পাঠক জাগুন, সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে গেলে ইতিবাচক খবর লিখতে হবে

এই হল বড় কাগজ, বড় মিডিয়ার কাণ্ড। আর ছোট কাগজগুলোকে এই সরকারি বিজ্ঞাপনের জুজু দেখিয়েই যে যেখানে ক্ষমতাসীন সে সেখানে পকেটে পুরে রেখেছে। কারণ কাগজের ব্যবসায় একটা মৌলিক স্ববিরোধ আছে। আপনারা অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন, যে কাগজটা আপনি পাঁচ টাকা দিয়ে কেনেন সেটা তৈরি করতে খরচ হয় ১০-১৫ টাকা। এটা অতিমারীর আগের হিসাব বললাম, এখন হয়ত আরও বেশি। তা এই খরচ পুষিয়ে তারপর লাভ করতে গেলে ছোট কাগজগুলোর পক্ষে সরকারি বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে চলা অসম্ভব। বড় কাগজ বলতে কী বোঝাচ্ছি? পাঁচ লক্ষের বেশি বিক্রি হয় যে কাগজগুলো। আর ছোট কাগজ মানে যারা মেরে কেটে এক-দু লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গের মত রাজ্যে বড় কাগজ একটা কি দুটো। সেই কাগজগুলো এত বেসরকারি বিজ্ঞাপন পায়, যে ওই যে বললাম – প্রথম পাতা খুঁজতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। ছোট কাগজ কিন্তু ওসব বিজ্ঞাপন পায় না সাধারণত। কেন পায় না? কারণ সেগুলো কম লোকের হাতে যায়। যিনি বিজ্ঞাপনদাতা, তিনি তো যত বেশি সম্ভব লোকের কাছে পৌঁছতে চান। ফলে যে কাগজের বিক্রি বেশি সেই কাগজই বেশি বিজ্ঞাপন পায়। মানে তেলা মাথাতেই তেল পড়ে। সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কিন্তু নিয়মটা আলাদা। আপনার কাগজের বিক্রি যা-ই হোক, যদি নামটা ডিএভিপি (মানে ডিরেক্টোরেট অফ অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড ভিজুয়াল পাবলিসিটি)-র খাতায় থাকে, তাহলেই সরকার আপনাকে বিজ্ঞাপন দেবে। সরকার এই নিয়মটাকেই ব্যবহার করে। অমুক প্রতিবেদনে আমার দুর্নীতি দেখিয়েছ? যাও, তোমাকে বিজ্ঞাপন দেব না। তমুক সিদ্ধান্তের নিন্দে করেছ? আজ থেকে তোমার বিজ্ঞাপন বন্ধ।

কতকগুলো টাকার অঙ্ক না বললে আপনাদের বিশ্বাস না-ও হতে পারে যে সরকারি বিজ্ঞাপন এত বড় ব্যাপার। তাই কয়েকটা অঙ্ক বলি। প্রায়ই দেখবেন কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন থাকে। ওরকম একটা বিজ্ঞাপনের দর বড় কাগজগুলোতে উনিশ বিশ। ২০২০ সালে আমি তেমন একটা কাগজেই কাজ করতাম। সেখানে ওই বিজ্ঞাপনের দাম ছিল এক কোটি টাকা। আধ পাতার বিজ্ঞাপন হলে পঞ্চাশ লাখ। এবার মনে করে দেখুন, গত লোকসভা নির্বাচনের সময়ে প্রত্যেক দফায় কতবার আপনার বাড়ির কাগজটার পাতা জুড়ে মোদীজিকে দেখেছেন, তারপর হিসাব করুন কত টাকার বিজ্ঞাপন একেকটা কাগজ বিজেপির থেকে পেয়েছে। এ তো গেল নির্বাচনের সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের বিজ্ঞাপনের কথা। ওগুলো তাও কোট আনকোট সরকারি বিজ্ঞাপন নয়। গত এক দশকে সরকারের বিজ্ঞাপন দেওয়ার বহর কীভাবে বেড়েছে তার একটা ধারণা দিই। এগুলো সবই অতিমারীর আগের হিসাব। পরেরগুলো আসতে এখনো সময় লাগবে।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে একজন তথ্যের অধিকার আইন (মানে রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট) অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের কাছে জানতে চেয়েছিলেন সরকার সংবাদমাধ্যমে কত টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে। উত্তরে সরকার জানায় এপ্রিল ২০১৪ থেকে অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত অঙ্কটা ছিল ৩,৭৫৫ কোটি টাকা। ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের ভাগে ১,৬৫৬ কোটি আর ছাপা কাগজে বা পত্রিকায় ১,৬৯৮ কোটি। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দিল্লি সরকার, মানে আম আদমি পার্টির সরকার। তারা শুধু ২০১৫ সালেই ৫২৬ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল।

তা এতগুলো টাকার বিজ্ঞাপনের মায়া ত্যাগ করে কোন সংবাদমাধ্যম সরকারের বিরুদ্ধে যায় এমন খবর করবে? পশ্চিমবঙ্গের কথা বেশি বলব না। কারণ এখান থেকে আবার বাড়ি ফিরতে হবে তো, বিপ্লব মন্ডল করে দিলে মুশকিল। গতবছর একসঙ্গে চারটে রাজ্য আর একটা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, মানে পুদুচেরিতে, ভোট হয়েছিল। তার মধ্যে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় এক নম্বরে ছিল আমাদের রাজ্য। প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা খরচ করেছিল এই রাজ্যের দলগুলো। প্রায় ১ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা খরচ করে শীর্ষে ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মত বা তার চেয়েও বেশি করে কীভাবে সোশাল মিডিয়া ভোটারদের প্রভাবিত করে তা নিয়ে একটা আলাদা আলোচনা করা যায়, তার মধ্যে যাচ্ছি না।

বিজ্ঞাপন দিয়ে মিডিয়াকে কিনে নেওয়ার কাজটা কিন্তু শুধু সরকার করে না, কর্পোরেটও করে। আর আমাদের দেশে তো ক্রমশ যাহা কর্পোরেট তাহাই সরকার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে কোনো কাগজ যেমন সরকারের সমালোচনার মধ্যে যায় না, চ্যানেলগুলো যেমন দিনরাত প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীদের গুণগান করতে ব্যস্ত থাকে, তেমনি শিল্পপতিদের কুকীর্তিও প্রকাশ করা যায় না। শুধু তা-ই নয়, কাগজের প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত কোথাও আপনি কারোর সমালোচনা করতে পারবেন না। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এখন তো আইপিএলের দেখাদেখি অনেকগুলো খেলাতেই ওরকম আলো ঝলমলে লিগ হয়। আমার ডিপার্টমেন্টের এক জুনিয়রকে সেরকম একটা লিগ কভার করতে পাঠানো হয়েছিল। সে সেখান থেকে একটা কপি ফাইল করল, যে এখানে বাজনা তো প্রচুর, কিন্তু খাজনা নেই। মানে লোকে সেভাবে খেলা দেখতে আসছে না, গ্যালারি রোজই খালি থাকছে। এই কপি পাতায় বসে যাওয়ার পর ফেলে দিতে হয়েছিল। কারণ আমার কাছে উপরতলা থেকে ফোন এল, ওই লিগ কাগজকে কোটি পাঁচেক দিয়েছে। অতএব তাদের খামতি-টামতি লেখা যাবে না।

মানে বুঝতেই পারছেন, টাকা দিয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা যদি রাজনীতিতে একবার চালু হয়ে যায়, তাহলে সব ক্ষেত্রেই সেটা চলে। অগণতান্ত্রিকতা, অসহিষ্ণুতাও তাই এখন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বত্র। শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতা নেত্রী নয়, বিরাট কোহলি পর্যন্ত অপ্রিয় প্রশ্ন শুনলে রেগে যান। আজকাল খেলোয়াড়দের সাক্ষাৎকার নেওয়া মানে হচ্ছে, আগে থাকতে প্রশ্নগুলো দলের মিডিয়া ম্যানেজারের কাছে জমা দিতে হবে। তিনি যে প্রশ্নগুলো করতে অনুমতি দেবেন কেবল সেগুলোই জিজ্ঞেস করা যাবে। মানে ফিক্সড ইন্টারভিউ ব্যাপারটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে।

এই যে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ – এটাই আজকের সাংবাদিকতার অভিনব অন্ধকার। আগে কি এমন হত না, যে কোনো সাংবাদিক কোনো শিল্পপতির থেকে ঘুষ নিয়ে তাঁর সম্পর্কে বা তাঁর ব্যবসা সম্পর্কে ভাল ভাল কথা লিখলেন, বা লেখা উচিত এমন কোনো খবর লিখলেন না? বিলক্ষণ হত। রাজনৈতিক নেতারা, প্রশাসনের মাথারা, মন্ত্রীরা, অভিনেতারা – অনেকেই এ কাজ করাতেন। অনেকসময় ঘুষ দিয়েও করাতে হত না এগুলো, স্রেফ প্রভাব খাটিয়ে বা সাংবাদিকের সাথে খাতিরের জোরে করানো হত। কিন্তু সেগুলো চুপিচুপি করা, কোনো কোনো সাংবাদিক করতেন। কাজটার পেশাগত স্বীকৃতি ছিল না। এখন কিন্তু আর সাংবাদিক একা একা দুর্নীতি করতে পারেন না। এখন তাঁর কাগজ বা তাঁর চ্যানেল সরাসরি নির্দেশ নেয় ক্ষমতাশালীদের কাছ থেকে। দরাদরিও করে। ফলে কোনো সাংবাদিক সৎ সাংবাদিকতা করতে গেলে একলা হয়ে যাবেন। চুপচাপ ঘাড় নীচু করে কর্তৃপক্ষ যা বলছেন তাই করে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অন্যথায় চাকরি চলে যাবে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাণও যেতে পারে।

আর সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে যে একতা ছিল, সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে। আগে একজন সাংবাদিককে কেউ আক্রমণ করলে শুধু তাঁর সংস্থা নয়, সমস্ত সংস্থার সাংবাদিক পাশে দাঁড়াত। কারণ প্রতিযোগিতা ছিল খবর করা নিয়ে, ক্ষমতাশালীর প্রিয়পাত্র হওয়া নিয়ে নয়। এখন সাংবাদিক হয়ে গেছেন গৌণ, খবর করা নিয়ে প্রতিযোগিতাও স্তিমিত। কারণ প্রতিযোগিতাটা এখন সরকার আর বিরাট পুঁজিওলা লোকেদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার। সেই প্রতিযোগিতা তো মিডিয়া হাউসগুলোর মধ্যে, সাংবাদিক সেখানে বোড়ে মাত্র। সাংবাদিককে দরকারই নেই, দরকার ম্যানেজার। সেই কারণে অতিমারীর অজুহাতে গোটা দেশের অসংখ্য বড় কাগজ অনেকগুলো সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে, কাগজ আর চ্যানেলগুলো প্রচুর সাংবাদিক ছাঁটাই করেছে। মালিকদের দরকার বাধ্য লোক। তারা অযোগ্য হলেও কোনো অসুবিধা নেই, বরং সুবিধা। কারণ সাধারণত অযোগ্য লোকের পোষ মানার তাগিদ বেশি হয়। এর মধ্যে যোগ্য লোক যাঁরা টিকে আছেন, তাঁদের নিজেদের যোগ্যতা জোর করে ভুলে টিকে থাকতে হচ্ছে। আপনি হয়ত সকালের কাগজে একগুচ্ছ ভুল দেখে বা টিভির খবরে ভুলভাল, হাস্যকর আলোচনা দেখে মন খারাপ করছেন। ভাবছেন ছি ছি! এই কাগজটা কোথায় ছিল, কোথায় নামল! ভুল করছেন, কোত্থাও নামেনি। আপনি সকালে যেটা হাতে পাচ্ছেন সেটা আসলে একটা রসিদ। কার রসিদ? যে বা যারা নিজের পছন্দের খবর ছাপাতে টাকা দিয়েছে তাদের রসিদ। মানে বিরাট বিরাট স্পনসর এসে পড়ার আগের যুগে পাড়ার দুর্গাপুজোর সুভেনির হত না? সেই জিনিস। আপনি মাস গেলে কাগজওলাকে টাকা দিলেন মানে আসলে কাগজে যারা বিজ্ঞাপন দেয় তাদের আপনি ভর্তুকি দিলেন। টিভির পর্দায় যা দেখছেন তা-ও ইলেকট্রনিক রসিদ। জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, খবর হচ্ছে সেটাই যেটা কেউ একজন চায় না প্রকাশিত হোক। বাকি সব হচ্ছে পাবলিক রিলেশন।

তা পাবলিক রিলেশন তো আর পাবলিকের স্বার্থে করা হয় না। পাবলিককে সম্মোহিত করে রাখার জন্য করা হয়। সেটাই করা হচ্ছে। আপনার দরকার চাকরি, আপনাকে আমি পড়াচ্ছি অমুক নেতার তমুকের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের রসালো কাহিনি। তাঁরা পয়লা বৈশাখে ছাদে নাচ করলেন, গরমের ছুটিতে কাশ্মীর বেড়াতে গেলেন। আপনি দেখছেন সবজি মাছ মাংস সবকিছুর আগুন দাম, ২০১৪ সালে যে দামে দুটো গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যেত এখন সে দামে একটা পাওয়া যাচ্ছে। আমি আপনাকে দেখাচ্ছি কী? না তাজমহল কি আসলে তেজো মহালয় ছিল? কারণ ওটা করার জন্যই আমার কাগজ বা আমার চ্যানেল বিজ্ঞাপন, এবং পেড নিউজ, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ঘুষ, পাচ্ছে। সরকারের অকর্মণ্যতা নিয়ে খবর করতে গেলে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

এর সঙ্গে আরও একটা বিপদ আছে। বিরাট বিপদ। কমলে কামিনী জানেন তো? ওই যে চণ্ডীমঙ্গলে ছিল? একজন মহিলা পদ্মফুলের উপর বসে আস্ত আস্ত হাতি গিলে ফেলছে? ওইভাবে পদ্মফুলের উপর বসে মুকেশ আম্বানি একের পর এক ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে গিলে ফেলছেন। এমন প্রায় কোনো সংবাদমাধ্যমের নাম আপনি ভেবে উঠতে পারবেন না, যেখানে তাঁর অন্তত কিছুটা অংশীদারিত্ব নেই। নিজেদের হাতে তৈরি সিএনএন-আইবিএন ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল রাজদীপ সরদেশাই আর তাঁর স্ত্রী সাগরিকা ঘোষকে। কারণ রাঘব বহলের থেকে ওটা কিনে নিয়েছিল রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। ওই নেটওয়ার্ক এইট্টিন গ্রুপের যত চ্যানেল, যত ওয়েবসাইট সবই এখন মুকেশের সম্পত্তি। তাছাড়াও অজস্র সংবাদমাধ্যমে তিনি নানা মাত্রায় আছেন। এমনকি SEBI (মানে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া)-র রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, সম্ভবত এনডিটিভিরও ৫২% শেয়ার এখন মুকেশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মহেন্দ্র নাহাতার। ভারতীয় মিডিয়া ইতিমধ্যেই অভিজাততন্ত্রে পরিণত হয়েছে, ক্রমশ আক্ষরিক অর্থে মনোপলির দিকে এগোচ্ছে। এইসব কারণে, লক্ষ করুন, আমি যে অসমসাহসী সাংবাদিকদের নাম করলাম প্রথম দিকে, তাঁরা কেউ আপনাদের জানা কোনো সংবাদমাধ্যমের কর্মী নন। কেউ স্থানীয় কাগজের কর্মচারী, কারোর একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে, কেউ শুধু একটা ফেসবুক পেজ চালান। নির্ভীক সাংবাদিকতা আজকের ভারতে এই মানুষগুলোই করছেন।

কী করে পারছেন? এর উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আজকের আলোচনার বিষয়ের দ্বিতীয় অংশটার উত্তর। কী করণীয়?

এই মুহূর্তে ভারতে সত্যিকারের সাংবাদিকতা বলতে যা বোঝায়, কয়েকটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেটা করার একমাত্র জায়গা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বিকল্প সংবাদমাধ্যম (alternative media)। কয়েকটা নাম আমরা সবাই জানি – দ্য ওয়্যারনিউজক্লিকনিউজলন্ড্রিকুইন্ট ইত্যাদি। এরা অনেকেই স্থানীয় স্তরের যে লড়াকু সাংবাদিকরা এতদিন বিভিন্ন বড় সংবাদমাধ্যমে নামমাত্র পারিশ্রমিকে দারুণ কাজ করতেন, তাদের কিছুটা বেশি টাকা দিয়ে খবর কেনে। সরকারবিরোধী, কর্পোরেটবিরোধী খবর এরা করে উঠতে পারে কারণ এই ওয়েবসাইটগুলো চলে মূলত সাবস্ক্রাইবারদের টাকায়, বিজ্ঞাপনের টাকায় নয়। বাংলায় কিন্তু এই ব্যাপারটা এখনো সেভাবে চালু হয়নি। না হওয়ার জন্য আপনি, আমি সবাই খানিকটা দায়ী। হয়নি বলে পশ্চিমবঙ্গে যে নিউজ সাইটগুলো আছে, তার অনেকগুলোই কনটেন্টের দিক থেকে বিকল্প নয়।

আমি শুধু বিজ্ঞাপনের কথা বলেছি, পেড নিউজের মধ্যে ঢুকিনি। কারণ সেটা আবার নিজেই একটা আলাদা বিষয়। এ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক পি সাইনাথের দারুণ কাজ আছে। এমনিতে আজকাল সংবাদমাধ্যমকে টাকা দিয়ে আপনি করাতে পারবেন না এমন কাজ নেই। ২০১৮ সালে কোবরাপোস্ট একটা স্টিং অপারেশন করেছিল। তাতে কোবরাপোস্টের প্রতিনিধিরা একটা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের প্রতিনিধি সেজে ভারতের অনেকগুলো বড় বড় মিডিয়া হাউসের কর্তাদের কাছে গিয়েছিলেন। প্রস্তাব ছিল, আমরা টাকা দেব, সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর করতে হবে এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সুবিধা হয় এমন খবর করতে হবে, নানারকম ইভেন্টের আয়োজন করতে হবে। দুটো মাত্র মিডিয়া হাউস রাজি হয়নি – পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আর ত্রিপুরার দৈনিক সংবাদ।

এই অন্ধকারের মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কেন নেমে এল এই অন্ধকার? ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার চেয়েও ঘন এই অন্ধকার কেন আটকাতে পারল না সংবাদমাধ্যম? দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান তো শুধু ভারতে হয়নি। পৃথিবীর দুটো প্রাচীন গণতন্ত্র – ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – দু জায়গাতেই ঘোর দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছে গত এক দশকে। সেখানে মিডিয়ার এ অবস্থা হয়নি তো।

ইন্টারনেটে ইংল্যান্ডের কাগজগুলো পড়ে দেখুন, রোজ তুলোধোনা করছে বরিস জনসনকে। সরকার তাদের কিচ্ছুটি করতে পারে না। মাসখানেক আগেই দেখলাম আইটিভির একজন সাংবাদিক মুখোমুখি বসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর লাইভ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ভদ্রমহিলার বয়স আমাদের নাভিকা কুমারের মতই হবে। কিন্তু তিনি এমন সব প্রশ্ন করছিলেন, যে জনসনবাবু পালাতে পথ পাচ্ছিলেন না। একবার আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলেন, আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব আমি করছি। মহিলা সটান বলে দিলেন, না, করছেন না। তারপর তথ্যপ্রমাণও দিয়ে দিলেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নিউইয়র্ক টাইমস তাদের ‘ওপিনিয়ন’ নামে যে বিভাগটা আছে তাতে ‘ট্রাম্প’স লাইজ’ শিরোনামে পুরো পাতা জুড়ে একটা লেখা ছেপেছিল। কী ছিল সেই লেখায়? কিচ্ছু না। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প যত মিথ্যে কথা বলেছেন তার তালিকা, সঙ্গে সত্যিটা কী – সেইটা। আমরা কি স্বপ্নেও ভাবতে পারি ভারতের কোনো কাগজে ‘মোদী’জ লাইজ’ বলে একটা পাতা বেরোবে? যে দু-একটা কাগজ এখনো ধারাবাহিকভাবে সরকারবিরোধী খবর করে – ধরুন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বা বেঙ্গালুরুর ডেকান হেরাল্ড, কি কলকাতার টেলিগ্রাফ – তারাও পেরে উঠবে না। আবার দেখা যায় এরাও নিজের রাজ্যের সরকারের ব্যাপারে অনেকসময় নরম। কারণ সকলেরই ক্ষমতার সীমা আছে। কদিন পরপরই দেখবেন খবর হয় – এনডিটিভির প্রণয় রায়, রাধিকা রায়ের পাসপোর্ট সিজ করা হয়েছে। বা দ্য ওয়্যারের অফিসে ইডির রেড, অথবা নিউজক্লিকের কর্ণধারকে টানা ছ ঘন্টা জেরা। তাছাড়া অবাধ্য সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকদের নামে কথায় কথায় মানহানির মামলা, থানায় ডেকে পাঠিয়ে হয়রানি – এসব চলতেই থাকে। উপরন্তু যে মানিকজোড় ক্রমশ ভারতের সব শিল্পের দখল নিচ্ছেন, তাঁদের অন্য জোড়টি, গৌতম আদানি, তিনিও মৃদুমন্দ গতিতে মিডিয়া জগতে ঢুকে পড়ছেন। কুইন্টের মাইনরিটি স্টেক কিনেছেন সদ্য। সুতরাং বিকল্প সংবাদমাধ্যমও যে আমাদের সময়ের আলো হয়ে বেশিদিন টিকতে পারবে, এমন ভরসা করা যায় না।

তাহলে কী স্মরণীয়? কী করণীয়?

প্রথমেই আমাদের মধ্যে গেড়ে বসে থাকা একটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণাকে সমূলে উৎপাটিত করতে হবে। আমরা ছোট থেকে শুনে এসেছি যে আইনসভা (মানে সংসদ, বিধানসভা, বিধান পরিষদ ইত্যাদি), প্রশাসন (মানে পুলিস, আমলা প্রমুখ), বিচারব্যবস্থার (মানে আদালত) পর সংবাদমাধ্যম হল গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। খবরের কাগজ হল “people’s Parliament always in session” – এরকমও বলা হয়েছে। এখন বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে, যে এগুলো একদম ভুল। আসলে সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ নয়, গণতন্ত্রই সংবাদমাধ্যমের একমাত্র স্তম্ভ। গণতন্ত্র শক্তিশালী হলে সংবাদমাধ্যম শক্তিশালী হয়, গণতন্ত্র ধসে পড়লে সংবাদমাধ্যমও ধসে পড়ে।

ইংল্যান্ড, আমেরিকার সাংবাদিকরা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছেন কারণ বাম, মধ্য, ডান যে-ই ক্ষমতায় আসুক; ওখানকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো এত শক্তিশালী, যে একটা স্তরের বেশি বেয়াদপি করা যায় না। আপনার দেশের রাজনীতি নীতিহীনতা, দুর্নীতি আর মানুষ-মারা আদর্শের স্বর্গরাজ্য হয়ে যাবে আর সংবাদমাধ্যম একা কুম্ভ হয়ে গণতন্ত্রের গড় রক্ষা করবে – এ হয় না। আপনার সমাজ সংখ্যালঘুর রক্ত চাইবে আর টিভি চ্যানেলগুলো রেডিও রোয়ান্ডা হয়ে উঠবে না – এ অসম্ভব।

আমেরিকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে দেখুন আর ভারতের বিরোধী শক্তিগুলোকে দেখুন। আমেরিকার ডেমোক্র্যাট নেতারা রাহুল গান্ধীর মত ট্রাম্পের সাথে লড়াই করতে করতে আচমকা ইউরোপে ছুটি কাটাতে চলে যেতেন না। ওখানে আমাদের এখানকার মত ঘোষিত মার্কসবাদীদের সংখ্যা এবং শক্তি – দুটোই নগণ্য। কিন্তু ডেমোক্র্যাট দলের বামপন্থী বার্নি স্যান্ডার্স, আলেক্সান্দ্রা ওকাসিও কর্তেজরা যে লড়াই দিয়েছিলেন, এখনো দিচ্ছেন, তার ফলে ট্রাম্পপন্থী লোকেরা তো বটেই, এমনকি ডেমোক্র্যাটদের ভিতরের দক্ষিণপন্থীরাও কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। অসংখ্য দলে বিভক্ত ভারতের বামপন্থীদের তো তার চেয়ে অনেক বেশি জোরদার লড়াই দেওয়ার কথা। কিন্তু পারছেন কই? বুলডোজারের সামনে সিপিএমের বৃন্দা কারাতের সঙ্গে নকশাল নেতা রবি রাইও দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। যেখানে সম্ভব সেখানেই স্বৈরাচারী শাসকের বুলডোজারের সামনে যদি ওঁরা ওইরকম ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে পারেন, তাহলে কিছুটা লড়াই হতে পারে। কিন্তু এ দেশের কমিউনিস্টদের অনেকটা সময় এবং উদ্যম নষ্ট হয় কে কার চেয়ে বেশি কমিউনিস্ট তার চুলচেরা হিসাব করতে গিয়ে।

আর যে আঞ্চলিক দলগুলো আছে, তাদের মধ্যে লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল ছাড়া প্রায় সকলেই কখনো না কখনো বিজেপির সাথে ঘর করেছে, ক্ষমতায় থাকাকালীন চরম দুর্নীতির ইতিহাসও আছে। তাছাড়া তাদের নেতা-নেত্রীদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ্রহ যতখানি, আরএসএসের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে নামার আগ্রহ ততখানি নয়। বরং রামনবমী পালন, মন্দির বানানো, বিভিন্ন পুজোর আয়োজনে বিজেপির চেয়ে বেশি বিজেপি হওয়ার প্রতিযোগিতায় তারা বেশি স্বচ্ছন্দ। সংখ্যালঘুদের ত্রাতার অভিনয় করে ক্ষমতায় এসে দাঙ্গাবাজদের দলের টিকিটে উপনির্বাচনে দাঁড় করাতে তাদের কোথাও বাধে না। ফলে অবাধে মসজিদের কুয়ো থেকে শিবলিঙ্গ উদ্ধার চলছে। গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত আমাদের চোখের সামনে ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। সে ইতিহাস অবশ্য পড়বে না আমাদের ছেলেমেয়েরা। তারা পড়বে হলদিঘাটের যুদ্ধে রাণাপ্রতাপের সেনাবাহিনী আকবরের বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিল। তারা ভগৎ সিং পড়বে না, পড়বে আরএসএসের প্রথম সঙ্ঘচালক কেশব বলিরাম হেড়গেওয়ারের বক্তৃতা।

এমতাবস্থায় সাংবাদিকতার অন্ধকার কাটানো অসম্ভব। সে অন্ধকার কাটবে তখনই, যখন ভারত আবার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ হবে।

কী করে হবে সেটা? মোডাস অপারেন্ডি যদি আমার জানা থাকত, তাহলে আমি আজ এখানে এসে আপনাদের সামনে এতক্ষণ ধরে বক্তৃতা দিতাম না। কাজটা করতে নেমে পড়তাম। কিন্তু আমি জীবনে একদিনও সক্রিয় রাজনীতি করিনি, আর এই কাজটা রাজনীতির লোকেদেরই কাজ। তাঁদেরই করতে হবে। এখানে আমি রাজনীতি বলতে দলীয় রাজনীতির কথা বলছি, সরকার পরিবর্তনের কথা বলছি। কিন্তু আমার ধারণা, যে অন্ধকারে ভারতবর্ষ প্রবেশ করেছে তার থেকে মুক্তি স্রেফ সরকার পরিবর্তন হলেই হবে না। সেই কারণেই আমরা যারা দলীয় রাজনীতির বাইরের লোক, তাদেরও সেতুবন্ধনে কাঠবিড়ালির ভূমিকা নিতে হবে বলে আমার মনে হয়।

তার জন্যে প্রথমেই আমাদের নিজেদের রাজনৈতিক করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক করে তোলা মানে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়া নয়। সে কেউ প্রয়োজন বোধ করলে যোগ দিতেই পারেন। কিন্তু যেটা অবশ্যই করা দরকার সেটা হল কাজকর্মে, জীবনচর্যায় রাজনৈতিক হওয়া। এই ব্যাপারটায় অন্তত এই মুহূর্তে ভারতের ফ্যাসিবাদীরা বামপন্থী এবং মধ্যপন্থীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে।

একটা উদাহরণ দিই, তাহলেই বোঝা যাবে কথাটা। এই কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়া তোলপাড় হয়ে গেল একজন রেডিও জকির একটা মন্তব্য নিয়ে। তা উনি যে চ্যানেলের বিতর্কসভায় গিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন, সেই চ্যানেলটা আমি দেখি না। কারণ ওটা যে খবরের চ্যানেল নয়, ফ্যাসিবাদীদের প্রোপাগান্ডা চ্যানেল সেটা অনেকদিন আগেই পরিষ্কার হয়ে গেছে এবং তারাও এটা গোপন করার চেষ্টা করে না। কিন্তু একটা লেখার জন্য আমার ওই ক্লিপটা, যেখানে ওই ভদ্রমহিলা বিতর্কিত কথাগুলো বলেছেন, সেটা দেখার দরকার পড়েছিল। ওই কয়েক মিনিটের ক্লিপে আমার দুজনকে চোখে পড়ল যাঁরা ঘোষিত ফ্যাসিবিরোধী। একজন নামকরা অধ্যাপক, আরেকজন বিখ্যাত সাহিত্যিক। তা আমি যদি ফ্যাসিবাদীদের প্ল্যাটফর্মকে বয়কট করার মত সামান্য কাজটুকুও করতে না পারি, তাহলে আমি কিসের ফ্যাসিবিরোধী? ওঁরা তো তবু দলীয় রাজনীতির বাইরের লোক। তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম ইত্যাদি যেসব দল ঘোষিত আরএসএস বিরোধী – অবশ্য, তৃণমূল সম্পর্কে না জেনে ওই শব্দটা প্রয়োগ করা হয়ত আমার উচিত হচ্ছে না।। কারণ গত বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভে রাহুল কাঁওয়ালকে বলেছিলেন তাঁর বিজেপিকে নিয়ে সমস্যা, তিনি সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়ছেন না। কারণ তারা ভোটে লড়ে না (এই ভিডিওতে ১৩ মিনিট ১১ সেকেন্ড থেকে)। যা-ই হোক, কথা হচ্ছে বিজেপিবিরোধী দলের প্রতিনিধিরাই বা ওই চ্যানেলে কী প্রত্যাশা নিয়ে যান? কেন বয়কট করতে পারেন না? আমাদের মত সাধারণ মানুষ তো ওঁদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। ওঁরা কিন্তু বুঝতেই পারছেন না, যে এই বয়কটটা একটা দরকারি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তই যদি না নেওয়া যায়, তাহলে গণতন্ত্রকে কী করে বাঁচাব আর ফ্যাসিবাদকে কী করে হারাব? লক্ষ করে দেখবেন, কোনো বিজেপি নেতা তো বটেই, দলীয় রাজনীতির বাইরের কোনো দক্ষিণপন্থীও রবীশ কুমারের শোতে যায় না, ওয়্যার বা নিউজক্লিকে লেখে না।

আসলে গত তিরিশ বছরে আমাদের সকলেরই যে সত্তাটা সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সেটা হল ক্রেতা সত্তা। ফলে আমাদের চিন্তাভাবনাও হয়ে গেছে ব্র্যান্ড নির্ভর। কোনটা রাজনীতি আর কোনটা স্রেফ দলাদলি সেটা ভুলে গেছি। আমাদের মধ্যে এক ধরনের অরাজনৈতিক পার্টিজানশিপ তৈরি হয়েছে, যা আসলে হয়ত ব্র্যান্ড নির্ভরতা। আমরা ভাবছি একটা মতাদর্শ মানে একটা ব্র্যান্ড। আর ব্র্যান্ডেড জিনিসের তো একটাই এক্সক্লুসিভ বিক্রেতা থাকে। ফ্যাসিবাদ ব্র্যান্ডের বিক্রেতা হল বিজেপি, মার্কসবাদ ব্র্যান্ডের বিক্রেতা সিপিএম – এরকম আর কি। আমাদের রাজ্যে তো ব্র্যান্ড বুদ্ধ, ব্র্যান্ড মমতা – এই শব্দবন্ধগুলো অনেকদিন ধরেই চালু। এগুলো আমাদের অবচেতনেও কাজ করে। তো ব্র্যান্ড চেনা হয়ে গেলে আমরা কী করছি? কে কোন দলের সমর্থক আর আমি কোন দলের সমর্থক – তা দিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া ঠিক করছি এবং আমার ক্রিয়া বলে আর কিছু থাকছে না।

আপনার সাথে কোনো বিষয়ে আমার তর্ক হলে আমি আপনার যুক্তিগুলো মন দিয়ে শুনছি না, বোঝার চেষ্টা করছি না। যুক্তিগুলো খণ্ডন করে আপনাকে হারানোর চেষ্টা করছি না। আমি চট করে আপনার ফেসবুক প্রোফাইল দেখে জেনে নিচ্ছি কোন বিষয়ে আপনার কী প্রতিক্রিয়া ছিল, তা থেকে ঠিক করে নিচ্ছি আপনি কোন দলের লোক। তারপর আপনি আমার পছন্দের ব্র্যান্ডের লোক হলে আপনি অন্যায় বললেও একমত হয়ে যাচ্ছি, নাহলে ন্যায্য কথা বললেও ঝগড়া করছি। এয়ারটেল ভাল, না ভোডাফোন ভাল? এই নিয়ে যদি দুজন ঝগড়া করে, গালাগালির পর্যায়ে চলে যায়, আপনি দেখে হাসবেন তো? অথচ এটা কিন্তু সেই জিনিসই হচ্ছে। ফ্যাসিবাদ ঠিক এটাই চায়।

অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ আর বাইরে নেই, আপনার ভেতরে আমার ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। এটাকে বার করতে হলে যেখানে সম্ভব সেখানেই ফ্যাসিবাদীদের সংস্রব ত্যাগ করতে হবে। কোনো ছোঁয়াচে রোগ হলে আমরা সকলের থেকে সরে থাকি দুটো কারণে। এক, যাতে রোগটা আরও ছড়াতে না পারে। দুই, যাতে আমার নিজের সংক্রমণ বেড়ে না যায়। আমাদের মারাত্মক ছোঁয়াচে ঘৃণার রোগ হয়েছে। এই রোগ তাড়াতেও আমাদের আগে ফ্যাসিবাদীদের সঙ্গে সমস্তরকম সম্ভাব্য সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে বলে আমার মনে হয়। কাউকে হয়ত বন্ধু ত্যাগ করতে হবে, কাউকে কোনো আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক তুলে দিতে হবে। কিন্তু কাজটা করতেই হবে। আমরা যে যার মত গায়ে হাওয়া লাগিয়ে চলব আর এত বড় বিপদ থেকে দেশটা বেঁচে যাবে, আমরা আবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলব – এরকম ভাবনা অনৈতিহাসিক।

একবার আমারই কাছাকাছি বয়সের কয়েকজন পুরস্কারপ্রাপ্ত বাঙালি সাহিত্যিকের সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয়েছিল। তাঁরা হিন্দি আগ্রাসন আটকাতে হবে বলে দিনরাত ফেসবুকে পোস্ট করতেন। অথচ নিজেদের ছেলেমেয়েকে বাংলা বই পড়ান না। সেদিনের আড্ডায় বললেনও “বাংলার চেয়ে হিন্দি পড়লে যদি বেশি লাভ হয়, তাহলে সন্তানকে আমি হিন্দিই পড়াব। বাংলা কেন পড়াব?”

এরকম ভণ্ডামি করে কোনোদিন ফ্যাসিবাদীদের হারানো যায়নি। কেবল প্রতিক্রিয়া দিয়ে পৃথিবীর কোনো দেশে গণতন্ত্র রক্ষা হয়নি। ক্রিয়া দরকার। কীরকম ক্রিয়া? আমি ডাক দিলে তো এক হাজার লোক জড়ো হবে না, যে একটা মিছিল কি মিটিং করব? কিন্তু মিছিল, মিটিংয়ে যেতে তো পারব। অন্তত সেটুকু করি। যদি আমি লিখলে পাঁচজন লোক পড়ে, তাহলে একটু লিখি। যদি বললে আপনাদের মত কিছু লোক শোনে, তাহলে একটু বলি। যে কবিকে আমরা ঠাকুর বানিয়ে শিকেয় তুলে ভুলে গেছি এবং যাঁর জন্মদিনে আমরা কোনো কেলেঙ্কারি করতেই বাকি রাখি না, সেই কবি লিখেছিলেন

কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।”

এই মাটির প্রদীপের কাজটা আমরা করতে পারি। ভীষণ ক্লান্তিকর, হতাশায় ডুবিয়ে দেওয়ার মত কাজ কিন্তু। কারণ চারপাশের অন্ধকার এত গাঢ়, রাতটা এত দীর্ঘ যে মাঝে মাঝে মনে হবে একটা অন্ধকার অট্টালিকায় আপনি একা প্রদীপ হয়ে জ্বলছেন। এই হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্যে একটু আশার বাণী আমি শোনাতে পারি আগাথা ক্রিস্টির লেখা থেকে। দ্য পেল হর্স উপন্যাসের এক জায়গায় কয়েকটা চরিত্র ‘ইভিল’-এর ধরন ধারণ নিয়ে আলোচনা করছিল। সেখানে একটা চরিত্র বলে, যে হিটলারের মত লোকেরা ইভিল হলেও নিশ্চয়ই তাদের বিরাট ব্যক্তিত্ব ছিল। পরে যখন অপরাধী ধরা পড়ে, দেখা যায় লোকটা নেহাত ফালতু। তখন এক পুলিস অফিসার বলেন “Evil is not something superhuman, it’s something less than human. Your criminal is someone who wants to be important, but who never will be important, because he’ll always be less than a man.”

সাংবাদিক পরিচয়ে এতগুলো কথা বললাম। ফলে কেউ এই প্রশ্নটা তুলতেই পারেন, যে আমার তো নিরপেক্ষ হওয়ার কথা। আমি পক্ষ নিচ্ছি কেন? সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ হওয়া উচিত, এই ধারণাটাকেও বাতিল করা দরকার। এ দেশে কথাটা খোলাখুলি বলা হয় না এখনো, সবরকম পক্ষপাতদুষ্ট কাজ নিরপেক্ষতার ভান বজায় রেখে করা হয়। কিন্তু সেই ১৯৪২ সালে আমেরিকায় হাচিন্স কমিশন বলে একটা কমিশন তৈরি করা হয়েছিল। তার কাজ ছিল আধুনিক গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নির্ধারণ করা। ১৯৪৭ সালে সেই কমিশন রিপোর্ট দেয়। সেই রিপোর্টে “factually accurate but substantially untrue” প্রতিবেদন লেখার ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। কথাটা কেমন পরস্পরবিরোধী মনে হচ্ছে না? ঘটনা হিসাবে নিখুঁত হলে আবার অসত্য হবে কী করে?

২০২০ সালের অগাস্ট মাসে আমেরিকান প্রেস ইনস্টিটিউটের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর টম রোজেনস্টিয়েল ট্রাম্পের আমলে উত্তর-সত্যের (post truth) মোকাবিলা কীভাবে করতে হবে সেটা বলতে গিয়ে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন ধরুন, আমি নিও নাজিদের বলা একগাদা কথা রিপোর্ট করেছি, যেটা ঘটনা হিসাবে নিখুঁত। মানে তারা সত্যিই এই কথাগুলো বলেছে। কিন্তু যা বলেছে, সেগুলো ডাহা মিথ্যে। তার মানে আমি কী করলাম? আমি মিথ্যে কথাগুলোকে নিখুঁতভাবে রিপোর্ট করলাম। আমি যদি রিপোর্টে না বলি যে এগুলো সব মিথ্যে কথা, তাহলে তো সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো হবে না। অথচ সত্য উদ্ঘাটন করাই তো সাংবাদিকের কাজ।

আমি মাস দুয়েক আগে অল্টনিউজের কর্ণধার প্রতীক সিনহার সাক্ষাৎকার নিলাম। উনি আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, সমাজে ঘৃণার এমন চাষ হয়েছে যে স্রেফ কোনটা ভুয়ো খবর আর সত্যিটা কী, সেটা বলে দিয়ে কাজ মিটছে না। কারণ আমরা ফেক নিউজ থেকে হেট স্পীচের স্তরে পৌঁছে গেছি।

সুতরাং সাংবাদিককে এখন পক্ষ নিতেই হবে। প্রাইম টাইম নিউজে যারা ঘৃণা ছড়ায় তারা মিথ্যার পক্ষ নিয়েছে, আমি সত্যের পক্ষ নিলাম।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

%d bloggers like this: