আজ জুটেছে, কাল কী হবে লাতিন আমেরিকার ফুটবলের?

জিদান প্রয়াত সক্রেটিসের মত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন না। মারাদোনার মত ফিদেল কাস্ত্রো বা কিউবাপ্রীতিও নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে জিদানের মনুষ্যত্বের কাছেই টাকার অঙ্কটা অশ্লীল বলে মনে হয়েছিল।

ফরাসি সম্রাট পঞ্চদশ লুই নাকি বলেছিলেন, আমার পরেই আসবে প্লাবন। লিওনেল মেসি এখন পর্যন্ত তেমন কিছু বলেছেন বলে জানা যায়নি। তবে বিশ্বকাপ ফাইনালই যে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে তাঁর শেষ ম্যাচ ছিল সেকথা তো জানা গেছে। এখন প্রশ্ন হল, আর্জেন্টিনার ফুটবল দলের ভবিষ্যৎ কী? দিয়েগো মারাদোনা ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ থেকে ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে বহিষ্কৃত হন। পরে পাকাপাকিভাবে অবসর নেওয়ার সময়ে বলেন, আমার পরে অনেকদিন বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছবে না আর্জেন্টিনা। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছিল। ১৯৯০ সালে রোমে তাঁর নেতৃত্বে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার ২৪ বছর পরে আবার আর্জেন্টিনা ফাইনালে পৌঁছয় ২০১৪ সালে রিও দি জেনেইরোতে। মারাদোনার মত মেসির আমলেও আর্জেন্টিনা দুবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলল। আবার কবে ফাইনালে পৌঁছবে? প্রশ্নটার পরিসর আরেকটু বড় করে নেওয়া যাক? লাতিন আমেরিকার কোনও দল আবার কবে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলবে? বা লাতিন আমেরিকার দলগুলোর ভবিষ্যৎ কী? প্রশ্নগুলো বৈধ, কারণ বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল ব্রাজিলও শেষবার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছে কুড়ি বছর হয়ে গেল। কেবল ফাইনালে পৌঁছনোকেই সাফল্যের প্রমাণ হিসাবে ধরে নিয়ে অবশ্য কোনও আলোচনা করা যায় না। কিন্তু ঘটনা হল গত তিন দশকে সামগ্রিকভাবেই লাতিন আমেরিকা বিশ্বকাপে ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে ইউরোপের তুলনায়।

এমনিতেই চিলে, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা বা প্যারাগুয়ের মত দলে মাঝেমধ্যে কয়েকজন চোখ টানার মত ফুটবলার আসেন, তখন তাঁদের নিয়ে হইচই হয়। কিন্তু দল শেষপর্যন্ত বিশ্বকাপে বেশিদূর এগোতে পারে না। উরুগুয়ে দুবার বিশ্বকাপ জিতেছিল সেই গত শতকের প্রথমার্ধে, স্মরণকালে তাদের সেরা বিশ্বকাপ ২০১০। মূলত দিয়েগো ফোরলানের নৈপুণ্যে আর লুই সুয়ারেজের আক্ষরিক অর্থে হাতযশে সেমিফাইনালে উঠে তারা হেরে যায় এবং প্লে অফে জার্মানির কাছে হেরে চতুর্থ স্থান দখল করে। তাই বিশ্বকাপে লাতিন আমেরিকার ফুটবল মানে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাই। সেই ব্রাজিল পরপর তিনটে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে দুবার চ্যাম্পিয়ন হয় দুই সহস্রাব্দের সন্ধিকালে। তারপর ২০১৪ সালের আগে আর সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি এবং ঘরের মাঠে মারাকানা স্টেডিয়ামের সেই সেমিফাইনাল ব্রাজিল সমর্থকদের পক্ষে বিভীষিকা হয়ে আছে। এবারের ব্রাজিলকে অনেক বেশি জমাট দেখাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল নেইমার-নির্ভরতাও নেই। কিন্তু সেই ব্রাজিলও কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিল। আর্জেন্টিনা ১৯৯০ আর ২০১৪— এই দুই ফাইনালের মাঝে একবারও শেষ চারে পৌঁছয়নি। স্বভাবতই আর্জেন্টিনার এবারের সাফল্যে ইউরোপের আধিপত্য খর্ব হল বলে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে অনেকের যে উল্লাস, তার স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দিহান হওয়ার কারণ আছে। আধিপত্য আদৌ খর্ব হয়েছে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ আছে। আগামীবার থেকে বিশ্বকাপ ৪৮ দলের হয়ে গেলে ইউরোপের প্রাধান্য উল্টে বেড়েও যেতে পারে। প্রশ্ন হল, এমন হচ্ছে কেন? ২০০২ থেকে ২০২২— এই দুই দশকে এমন কী ঘটল যে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা ক্রোয়েশিয়ার চেয়েও কম ধারাবাহিক হয়ে পড়ল? ইতালি, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড তো বটেই, গত ২০ বছরে বুলগেরিয়া, রোমানিয়ার মত বিশ্বকাপে অনিয়মিত দলের সামনে পড়লেও কেন হেরে যায় লাতিন আমেরিকার দানবরা? এইসব প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরও। সে উত্তর মাঠের ভিতরে খুঁজলে অগভীর জবাব পাওয়া যাবে।

বিশ্বকাপে ইউরোপের বাইরের যে দলগুলো খেলতে এসেছিল, তাদের সকলের খেলোয়াড় তালিকার দিকে তাকালেই একটা জিনিস চোখে পড়ে। প্রত্যেক দলেই ইউরোপে ক্লাব ফুটবল খেলা খেলোয়াড়দের সংখ্যা প্রচুর। বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ২৬ জনের দলে রিজার্ভ বেঞ্চের গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আর্মানি আর মাঝমাঠের খেলোয়াড় থিয়াগো আলমাদা ছাড়া সকলেই ইউরোপের কোনও না কোনও ক্লাবের খেলোয়াড়। একমাত্র আর্মানিই খেলেন নিজের দেশের ক্লাব রিভার প্লেটে। ব্রাজিল দলের ছবিটাও খুব আলাদা নয়। অতিরিক্ত গোলরক্ষক ওয়েভার্তন খেলেন সাও পাওলোর পালমেইরাসে আর মাঝমাঠের এভের্তোন রিবেইরো, আক্রমণভাগের পেদ্রো খেলেন রিও দি জেনেইরোর ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোতে। এছাড়া রক্ষণভাগের দানি আলভেস খেলেন মেক্সিকোর উনিভার্সিদাদ নাসিওনাল এসিতে। আর সবাই ইউরোপে খেলেন। আফ্রিকার দেশগুলোর দল ঘাঁটলেও একই ব্যাপার দেখা যাবে। এমনকি এবার চমকে দিল যে জাপান দল, তাদেরও ২৬ জনের মধ্যে শুধু জার্মানির লিগেই খেলেন আটজন। এর সরাসরি ফলাফল হল, ফুটবলে ঘরানা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। আফ্রিকা বা এশিয়ার ক্ষেত্রে সেটা খুব বড় কথা নয়। কারণ বিশ্ব ফুটবলে এই দুই মহাদেশ এতটাই পিছিয়ে থেকে শুরু করেছে যে তাদের এখনও নিজস্ব ঘরানা বলে কিছু তৈরি হয়নি। ইউরোপে খেলতে খেলতে বরং তাদের লাভই হয়। কবি লিখেছিলেন “দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে”। এশিয়া, আফ্রিকার এখনও নেওয়ার পালা চলছে। অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে হয়ত দেওয়ার পালা আরম্ভ হবে। কিন্তু লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তা নয়। লাতিন আমেরিকার নিজস্ব ঘরানা ছিল। সারা পৃথিবীর লাতিন আমেরিকান ফুটবলের ভক্তরা তাতেই মোহিত হয়েছিলেন। সেই ঘরানার প্রাণ হল ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, যা চোখের আরাম। সে খেলাকেই ‘জোগো বোনিতো’ অর্থাৎ ‘বিউটিফুল গেম’ বলা চলে। কিন্তু ফুটবল তো মানুষ খেলে। দেবতারা খেলে না, রোবটরাও নয়। ফলে সারা বছর যেভাবে খেলছেন একজন ফুটবলার, তিনি কালেভদ্রে জাতীয় দলের হয়ে একেবারে অন্য দর্শনে, অন্য কায়দায় খেলবেন কী করে? সেকথা জাতীয় দলের কোচকেও বুঝতে হয়, গা জোয়ারি চলে না। ফলে লাতিন আমেরিকান ফুটবলের রহস্য নষ্ট হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীই আসলে খেলে ইউরোপের খেলা। সে খেলায় ইউরোপকে হারাতে যে কালঘাম ছুটে যাবে আর সকলের তাতে আর আশ্চর্য কী? কিন্তু ক্ষতি শুধু ওটুকু নয়।

কিলিয়ান এমবাপের একটা মন্তব্যে নাকি বেজায় চটেছেন আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। সেই কারণেই দুর্ভেদ্য গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ ফাইনাল শেষ হওয়ার পর থেকে এমবাপেকে বিদ্রুপ করেই চলেছেন, একেকসময় তা শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করছে। এমবাপে কিছুদিন আগে বলেছিলেন “ইউরোপে আমাদের সুবিধা হল সারাক্ষণ নিজেদের মধ্যে নেশনস লিগের মত উচ্চমানের ম্যাচ খেলি। ফলে আমরা যখন বিশ্বকাপে যাই তখন তৈরি হয়ে যাই। কিন্তু ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আমেরিকায় এইরকম সুযোগ পায় না। সেখানকার ফুটবল ইউরোপের মত উন্নত নয়। সেই কারণেই গত কয়েকটা বিশ্বকাপে ইউরোপিয়ানরাই জিতেছে।” এমিলিয়ানোর অসভ্যতাকে সমর্থন না করেও তাঁর আবেগকে ধরতে পারা সম্ভব। শুধু তো আর্জেন্টিনা নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার ফুটবল সম্পর্কেই একটা বড় কথা বলেছেন এমবাপে। খোদ ফ্রান্সকেই হারিয়ে দিয়ে মুখের মত জবাব দেওয়া হয়েছে বলে ভাবতেই পারেন এমিলিয়ানো। কিন্তু এমবাপের কথাটা ভেবে দেখার মত।

ইউরোপের চেয়ে লাতিন আমেরিকার ফুটবল যে পিছিয়ে পড়েছে তার পরিসংখ্যানগত প্রমাণ ইতিমধ্যেই দিয়েছি। তবে এমবাপে উদাহরণ দিতে গিয়ে একটু ভুল করেছেন। উয়েফা নেশনস লিগ চালু করেছে সদ্য। উদ্দেশ্য ক্লাব ফুটবলের দাপটে আন্তর্জাতিক ফুটবলের আকর্ষণ কমে যাওয়ার সমস্যা সামলানো। কিন্তু তাতে একটা বড় জিনিস স্বীকার করে নেওয়া হয়, সেটা হল ফুটবল খেলাটাকে চালায় আসলে ক্লাব ফুটবল। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইউরোপের ক্লাব ফুটবল। লাতিন আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে বছর বিশেক হল, আর নেশনস লিগের বয়স মাত্র তিন। লাতিন আমেরিকা পিছিয়ে পড়েছে কারণ তাদের ক্লাব ফুটবল পিছিয়ে পড়েছে। কেন পিছিয়ে পড়ল? কারণটা বিশুদ্ধ অর্থনীতি। ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, জার্মানির দ্বিতীয় সারির ক্লাবগুলোও যে পারিশ্রমিক দিতে পারে তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারে না আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় দুই ক্লাব চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিভার প্লেট আর বোকা জুনিয়র্সও। নেইমারকে খেলানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না ব্রাজিলের ফ্ল্যামেঙ্গো বা পালমেইরাস। আফ্রিকার ক্লাবগুলোর সঙ্গে তো আরও দুস্তর ব্যবধান।

এমন নয় যে লাতিন আমেরিকার খেলোয়াড়দের ইউরোপে চলে যাওয়া এই সহস্রাব্দেই শুরু হয়েছে। মারাদোনা, ক্যারেকা, রোমারিও, বেবেতো, রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহো, রবার্তো কার্লোসরাও বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ, নাপোলি, জুভেন্তাস বা এসি মিলানে খেলেছেন। কিন্তু তাঁদের সার, জল দিয়ে বড় করে তুলত আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের ফুটবলব্যবস্থাই। তারপর তাঁদের খেলা দেখে চড়া দামে কিনে নিত ইউরোপের ক্লাবগুলো। মারাদোনার মারাদোনা হওয়া শুরু বোকা জুনিয়র্সে। কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে তিনি ফিরেও যান নিজের দেশে, তাঁর শেষ ক্লাব নেউয়েলস ওল্ড বয়েজ। কিন্তু ফুটবলের অর্থনীতি যেভাবে বদলে গেছে তাতে মেসি নিজের মাইনে কমাতে রাজি হয়েও বার্সেলোনাতেই থাকতে পারলেন না, আর্জেন্টিনায় ফিরে যাওয়া তো দূরের কথা। অবশ্য মেসি আর্জেন্টিনা ছেড়েছেন অনেক ছোট বয়সে। চে গুয়েভারার জন্মস্থান রোজারিওর রুগ্ন শিশু মেসির প্রতিভা ছোটবেলাতেই চিনে নিয়ে বিশ্বখ্যাত লা মাসিয়ায় তুলে এনেছিলেন বার্সেলোনার স্পটাররা। মেসি ও তাঁর পরিবারের হয়ত কিছুটা কৃতিত্ব প্রাপ্য তিনি স্পেনের নাগরিকত্ব গ্রহণ না করে আর্জেন্টিনার হয়েই সারাজীবন খেললেন বলে। কিন্তু ঘটনা হল পৃথিবী জুড়ে বেড়ে চলা অর্থনৈতিক বৈষম্যের সুযোগে কচি বয়সেই ইউরোপে চলে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা বা আফ্রিকার ফুটবল প্রতিভা। মেসির মত ছোট বয়সে না হলেও, কেরিয়ার শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই। তারপর আর কিসের ঘরানা? গোটা পৃথিবীকে এক অর্থনীতির ছাঁচে ঢালাই করার যে পরিকল্পনা বিশ্বায়ন বা নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনীতির, তারই ফলশ্রুতিতে গোটা পৃথিবীর ফুটবলই আসলে হয়ে দাঁড়াচ্ছে ইউরোপের ফুটবল। জার্সির রংটুকুই যা আলাদা। মেসির মত জন্মগত প্রতিভা সকলের থাকে না, ফলে ফুটবলের সৌন্দর্য সিস্টেম ছাপিয়ে সকলের পায়ে জায়গা করে নিতেও পারে না। যে তরুণ আর্জেন্টাইন বা ব্রাজিলিয়ানের ফুটবল শিক্ষা হবে ইউরোপের কোচের হাতে, সারাবছর খেলবেন ইউরোপে, তিনি ড্রিবল করায় বিশ্বাস করবেন কম। এটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন বোর্ডের ঘরে যে ধন আছে, ক্রিকেটের ঘরে সে ধন আছে?

ফুটবলের আলোচনায় অর্থনীতি শব্দটা দেখেই যাঁরা নাক কুঁচকে ভাবছেন অপ্রাসঙ্গিকভাবে রাজনীতি এনে ফেলা হচ্ছে বা ইউরোপ কেবল টাকার জোরে সবাইকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে বলায় যাঁরা রাগ করছেন তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিই ২০১৩ সালের কথা। সে বছর ওয়েলশ ফুটবলার গ্যারেথ বেলকে ইংল্যান্ডের টটেনহ্যাম হটস্পার থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরো (১৩১.৮৬ মিলিয়ন ডলার) দাম দিয়ে কিনে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। সেটা তখনকার রেকর্ড ট্রান্সফার ফি। বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন এবং সেইসময় রিয়ালে কার্লো আনচেলোত্তির সহকারী জিনেদিন জিদান বলেই ফেলেন “আমাকে দশ বছর আগে কেনা হয়েছিল ৭৫ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার) দিয়ে আর আমি বলেছিলাম আমি অত দাম পাওয়ার যোগ্য নই। এখন আমার মনে হয় কোনও খেলোয়াড়ই এত দাম পাওয়ার যোগ্য নয়। এটা স্রেফ ফুটবল। দুর্ভাগ্যজনক, দুর্বোধ্য যে এত টাকা কেন খরচ করা হচ্ছে।” জিদান প্রয়াত ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার সক্রেটিসের মত কমিউনিস্ট পার্টি করতেন বলে তো শোনা যায় না। মারাদোনার মত ফিদেল কাস্ত্রো বা কিউবাপ্রীতিরও খবর নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই যে আলজিরীয় অভিবাসীদের সন্তান জিদানের মনুষ্যত্বের কাছেই কোথাও টাকার অঙ্কটা অশ্লীল বলে মনে হয়েছিল। এখন ২০২২, সর্বকালের সবচেয়ে দামি ট্রান্সফারের তালিকায় প্রথম দশেরও বাইরে চলে গেছেন বেল।

পুরো তালিকাটা দেখুন এখানে। তারপর ভেবে দেখুন, মার্কিনি মদতে বারবার নির্বাচিত সরকার পড়ে যায়, অর্থনীতির দফারফা হয়ে যায় যে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, ভেনিজুয়েলা, পেরুতে— সেখানকার ফুটবল কী করে লড়বে ইউরোপের সঙ্গে? কুড়ি বছর পরে একবার একটা দলের বিশ্বকাপ জয় কি সত্যিই কিছু প্রমাণ করে? এ মাসেই আর্জেন্টিনায় মুদ্রাস্ফীতির হার ৯৯ শতাংশে পৌঁছবে বলে মনে করছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। বুয়েনস এয়ার্সের রাস্তা ভরিয়ে মেসির দলকে অভিবাদন জানিয়েছে যে হবু ফুটবলাররা, তাদের কজন ওই নীল-সাদা জার্সি গায়ে চাপানোর সঙ্কল্প বজায় রাখতে পারবে? প্রশ্নটা শুধু আবেগের নয়। মারাদোনার দল যখন বিশ্বকাপ জিতেছিল তখনও আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অবস্থা ভাল ছিল না। কিন্তু দুনিয়াটা বদলে গেছে। বার্সেলোনা ছেড়ে কোনও নিঃস্ব নাপোলিকে ইতালি, ইউরোপের রাজা করতে যাননি মেসি। গেছেন কাতারি ধনকুবেরদের অর্থে পুষ্ট প্যারিসের ক্লাবে। যেখানে তাঁর পাশে খেলেন নেইমার আর এমবাপে— সবচেয়ে দামি ট্রান্সফারের তালিকায় যথাক্রমে এক আর দুই নম্বরে থাকা ফুটবলার।

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত

মেসি বিশ্বকাপ জিতলেন, শিল্প বিশ্বজয়ী হল আবার

মেসি কানায় কানায় ভরে উঠলেন। তিনি কী ভাবছিলেন জানি না, কিন্তু কাল টিভির পর্দাজোড়া উল্লাসে মনে হচ্ছিল কে যেন নেই।

আলতামিরার গুহাবাসীরা কি প্লেনে চড়ে দেশ দেশান্তরে যেতে পারত? না। তারা কি কম্পিউটার ব্যবহার করত? না। তারা কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে মানুষের কাজ যন্ত্রকে দিয়ে করাতে পারত? তাও নয়। তারা কি একটা বোতাম টিপে কয়েক হাজার মাইল দূরের জনপদ ধ্বংস করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করে ফেলেছিল? মোটেই না। তারা কি ক্যান্সারাক্রান্ত মানুষের মৃত্যু পিছিয়ে দেওয়ার উপায় জানত? একেবারেই না। কিন্তু তারা বাইসন আঁকতে পারত। সে বাইসন দেখতে অর্থ আর সামর্থ থাকলে আজও সারা পৃথিবীর মানুষ ছুটে যায়। মানুষের আর কিছুই থাকে না, শিল্পটুকুই থেকে যায়। যতদিন না আমাদের এই গ্রহটা মহাবিশ্বের অনিবার্যতায় জীবজগৎহীন জড়পিণ্ডে পরিণত হচ্ছে, ততদিন আর সব কিছু বদলে যাবে, ফুরিয়ে যাবে। থেকে যাবে আমাদের শিল্প।

সেইজন্যেই সাফল্যের চেয়েও শিল্প আমাদের চোখ টানে বেশি, স্মৃতির বেশি জায়গা অধিকার করে। দিয়েগো মারাদোনা তাই অনেকের চেয়ে কম গোল করে, অনেকের চেয়ে কম ট্রফি জিতেও বহু মানুষের হৃদয়সম্রাট হয়ে রয়েছেন। ক্লাবের হয়ে লিওনেল মেসির চেয়ে বেশি খেতাব ভবিষ্যতে জিততেই পারেন কোনো ফুটবলার, ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোই তো খুব পিছিয়ে ছিলেন না। মেসির চেয়ে বেশি গোল হয়ত কিলিয়ান এমবাপেও করে ফেলবেন। কিন্তু যেসব দৃশ্যের জন্ম দিয়েছেন দেড় দশকের বেশি সময়, কাতারের ফুটবল মাঠে যেসব ছবি এঁকেছেন গত একমাস – সেগুলো দিয়েই স্মৃতির মণিকোঠায় মেসির জায়গা পাকা হয়ে গেছে, মারাদোনার মতই। আর কে না জানে স্মৃতির কোনো লেবেল লাগে না, শিল্পে কোনো GOAT হয় না, কোনো র‍্যাঙ্কিং চলে না। এমন কোনো সঙ্গীতরসিক আছেন কি যিনি ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খানের গান শুনতে ভালবাসেন বলে পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর গান শোনেন না, হিসাব করেন দুজনের মধ্যে কে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ? আমাদের স্মৃতি তো নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগামী ভিড়ে গাদাগাদি ট্রেনের কামরা নয়, যেখানে উত্তমকুমারের চকিত চাহনির পাশে জায়গা হবে না সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দীপ্তির।পথের পাঁচালী পড়ে কাঁদলে পুতুলনাচের ইতিকথা-র নির্লিপ্তিতে মুগ্ধ হওয়ার জায়গা থাকবে না – এত সীমিত নয় মানবিক আবেগ।

আর যদি শিল্প জয়যুক্ত হয়? কাল তেমন এক রাত ছিল।

বার্সেলোনার জার্সিতে তিনি যত ফুল ফুটিয়েছেন ইউরোপের মাঠে মাঠে, আর্জেন্টিনার নীল-সাদা জার্সিতে লাতিন আমেরিকায়, দক্ষিণ আফ্রিকায়, রাশিয়ায় – সব সত্ত্বেও থেকে যাচ্ছিল অপূর্ণতা। রত্নখচিত মুকুটে যে কোহ-ই-নূর না থাকলে আর সবই বৃথা মনে হয়। শুধু আর্জেন্টিনা সমর্থকদের মনে হয় তা নয়, মেসির মুখ দেখলে বোঝা যেত তাঁর নিজেরও মনে হয়। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির কাছে হারের পর সর্বত্রগামী হয়েছিল মেসির অশ্রুসিক্ত ছবি।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

পৃথিবীর মানচিত্রে আর্জেন্টিনার একেবারে অন্য প্রান্তে থাকা ফুটবলে অনুন্নত দেশ ভারতের বাসিন্দা আমরা বিশ্বকাপ দেখি স্রেফ আনন্দের খোঁজে। আমরা প্রাক্তন উপনিবেশ, আমরা তৃতীয় বিশ্ব। স্বভাবতই এ দেশের বেশিরভাগ মানুষের সমর্থন সফল ইউরোপের চেয়ে বেশি ঝুঁকে থাকে শিল্পী লাতিন আমেরিকার দিকে। ভারতে যখন থেকে বিশ্বকাপ লাইভ দেখা যায় তখন থেকেই নিখুঁত জার্মানি, ইতালি বা লড়াকু চেক রিপাবলিক, ক্রোয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের আবেগকে বেশি উস্কে দেয় ক্যামেরুন বা নাইজেরিয়া। আজও কি বেশ কাছের মানুষ মনে হয় না রজার মিল্লাকে? এ দেশে যারা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা স্পেনের সমর্থক তাদের মনও তো আসলে কেড়ে নিয়েছিলেন ডেভিড বেকহ্যাম, জিনেদিন জিদান, ইনিয়েস্তার মত বল প্লেয়াররা – ছবি আঁকার নৈপুণ্যে। মানুষ হিংসুটে, মানুষ দাঙ্গাবাজ, মানুষ অকারণে মানুষকে অপমান করে। আইজ্যাক আসিমভ যথার্থই লক্ষ করেছিলেন, মানুষ একমাত্র জীব যারা অন্য জীবকে খাঁচায় পোরে। তবু তো মানুষ যে আনন্দ দেয় তার আনন্দ কামনা করে। খেলার মাঠে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেন শিল্পী ফুটবলাররা। তাই তাঁদের প্রতি পক্ষপাত থাকবেই। বহু মানুষ তাই চেয়েছিলেন, মেসির হাতে যেন একবার বিশ্বকাপটা ওঠে। য়োহান ক্রয়েফ কখনো বিশ্বকাপ ছুঁতে পারেননি, জর্জ বেস্টের সে সুযোগই ছিল না। সে দুর্ভাগ্য যেন মেসির না হয়।

হয়নি। কাল সেই উদ্দাম হাওয়ার রাত ছিল। অন্তত গত চল্লিশ বছরের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বিশ্বকাপের ফাইনাল। যেখানে ৩৫ বছরের মেসি প্রথমার্ধেই পেনাল্টি থেকে গোল করলেন, মাঠজুড়ে খেললেন। মাঝমাঠে নিজেদের গোলের দিকে মুখ করে বল পেলেন মেসি, মেসি থেকে জুলিয়ান আলভারেজ, আলভারেজ থেকে ম্যাক অ্যালিস্টার, ম্যাক অ্যালিস্টার থেকে আংহেল দি মারিয়া – ছবির মত গোল হল। আশি মিনিট একতরফা খেলা হওয়ার পর মেসির এক হাত যখন বিশ্বকাপে, তখন ৯৭ সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটো গোল করে ফ্রান্সকে ম্যাচে ফেরালেন এরপর যিনি বিশ্বের অবিসংবাদী সেরা ফুটবলার হয়ে উঠবেন, সেই এমবাপে।

তারপর অতিরিক্ত সময়ের শেষ প্রান্তে ফের গোল দিয়ে মেসি যখন উচ্ছ্বাসে ভাসছেন, ভাবছেন সোনার পরী এবার তাঁর হাতের মুঠোয়, তখনই সামান্য ভুলে পেনাল্টি। হাওয়া ঘুরে গেল আবার। তারপর যদি বনস্পতির বিরাট ছায়া না দিতেন সোনার দস্তানার অধিকারী এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, হয়ত প্যারিসেই উড়ে যেত সোনার পরী।

নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা বিশ্বকাপ ফাইনাল, এ যুগের সেরা ফুটবল শিল্পীর মুকুটে কোহ-ই-নূর বসিয়ে দেওয়ার ফাইনাল।

মেসি কানায় কানায় ভরে উঠলেন। তিনি কী ভাবছিলেন জানি না, কিন্তু কাল টিভির পর্দাজোড়া উল্লাসে মনে হচ্ছিল কে যেন নেই। সেই তিনি, যিনি ২০১০ সালে মেসির দলের কোচ হয়েও এমন অস্থির পদচারণা করতেন সাইডলাইনে যে মনে হত নিজেই নেমে পড়বেন। যিনি গত বিশ্বকাপেও গ্যালারিতে ছেলেমানুষের মত হাসতেন, কাঁদতেন, চিৎকার করতেন আর্জেন্টিনার ম্যাচে। যিনি ভিআইপি, তবু ভিআইপি নন। যাঁর সঙ্গে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের ফুটবল খেলতে না জানা একজন সাধারণ আর্জেন্টিনা সমর্থকের কোনো তফাত থাকত না, উদ্বিগ্ন সঙ্গীসাথীরা পিছন থেকে জামা ধরে টেনে রাখতেন – পাছে মানুষটা টাল সামলাতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। ১৯৮৬ সালে প্রায় একা দেশকে বিশ্বকাপ জেতানোর পর যিনি জীবদ্দশায় আর আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় দেখতে পেলেন না, আমূল বদলে যাওয়া ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্ব ফুটবলে ২০ বছর পর লাতিন আমেরিকার বিশ্বজয়ের রাতে সেই আকাশলীন দিয়েগোকে বলতে ইচ্ছে করছিল

ফিরে এসো মারাদোনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার…

মেসি
ছবি @ElDiegoPics টুইটার হ্যান্ডেল থেকে

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

Messi, Mbappe, Pele and Maradona in grand finale

Believers could hold this as proof that matches are made in heaven because there could not have been a more fitting finale to the most competitive World Cup in memory.

One can only see Pele’s Brazil up against Diego Maradona’s Argentina in the FIFA video game, but reality has refused to be left too far behind. It has set up Kylian Mbappe’s France against Lionel Messi’s Argentina. Believers could hold this as proof that matches are made in heaven because there could not have been a more fitting finale to the most competitive World Cup in memory. Japan have beaten Germany; Saudi Arabia have defeated Argentina and Tunisia have beaten France in this edition. Africa got its first World Cup semifinalist in Morocco, who got rid of Spain and Portugal. In short, this World Cup has made the glorious uncertainties of the game the only certainty. In such a World Cup, to have two finalists who started the tournament as favourites feels like a twist in the tale.

There could not be a better final for a neutral. On one hand is Messi, compared both fairly and unfairly to Maradona, in what would be his last World Cup match going by his own assertion. On the other is the obvious heir to Messi’s throne as the best footballer in the world – Mbappe.

Just as Pele was a boy wonder when Brazil won their first World Cup in 1958, Mbappe was an eye-catching teen when France won it in Russia four years back. One could already see his brilliance and wonder what he could become. Today, Mbappe is the scariest predator in attacking third since Brazil’s Ronaldo in 1998 and 2002. The French has scored nine World Cup goals so far and he is just 23. Thus he has broken Pele’s record for most World Cup goals before turning 24. His place among the all-time World Cup greats seems inevitable, especially if he scores in the final. And we are not even discussing his assists, his sheer presence on the field which makes the opposition lose track of threats like Olivier Giroud, Antoine Griezmann or Ousmane Dembele.

How incredible Didier Deschamps’ lot is can be gauged from the fact that they have had all bases covered without having Karim Benzema in attack, Paul Pogba and Ngolo Kante in the midfield. Not that the French defenders have not fluffed their lines at all – they conceded two penalties against England for example – but the imposing figure of Hugo Lloris under the bar has not let them concede many.

This French side has looked unbeatable (not counting the Tunisia loss when Deschamps basically fielded his reserve bench) but they are up against Argentina. Messi’s Argentina. If football is more art than a game for you, it is difficult not to love Messi, no matter which team you support. This, by far, has been his best show at a World Cup. Like Mbappe, Messi has scored five goals so far. But even more captivating has been his overall control of the game, the culmination of which was his hypnotism of Croatian defender Josko Gvardiol in the semifinal. The resultant assist to young sensation Julian Alvarez sealed the final berth and this happened when people were not finished discussing Messi’s final pass to Nahuel Molina for Argentina’s first goal against the Netherlands in the quarterfinal.

Unlike his previous World Cups, Messi, at 35, has looked like a free bird in the company of talents like Alvarez, Lautaro Martinez, Alexis Mac Allister, Rodrigo de Paul et al. They have been so efficient that Lionel Scaloni could give a player of Angel de Maria’s calibre breaks. The defence of Nicolas Otamendi, Cristian Romero, Nicolas Tagliafico, Marcos Acuna et al has been solid after the Saudi disaster. Even more solid has been Emiliano Martinez with the gloves. Two saves in the penalty shootout against the Dutch reminded one of Sergio Goycochea, who kept rescuing Maradona’s side from one shootout after another in Italia 90. Having someone like that under the bar is reassuring for those who think Messi deserves to sign off with the World Cup in his hand, for the joy he has provided millions with for almost two decades.

Read IPL auction: Where privilege holds court

But is Messi really up against France or is he up against Maradona? The emotional genius who took Argentina to glory almost single-handedly in 1986, set the bar so high that even Messi has found it beyond reach till now. The bar shall not be lowered and to be honest, nobody deserves the World Cup more for what he has done over the years. The team that plays better over the all-important 90 minutes deserves it. That was West Germany in 1990 and Germany in 2014. That is why Maradona and Messi had to end those evenings in tears. Maradona is remembered as much for his success as his imperfections. Can squeaky clean Messi script the perfect ending?

Originally published in The Meghalayan

কাতারে বিশ্বকাপ: নিরোর অতিথি আমরা সবাই

এমন নয় যে কেবল একখানা জমকালো বিশ্বকাপ আয়োজন করতে হবে বলেই তারা হঠাৎ শ্রমিকদের এভাবে নিংড়ে নেওয়া শুরু করেছে। দুনিয়াসুদ্ধ লোকের জানা ছিল কাতারে নিয়মকানুন সর্বনেশে।

রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন – এ কথা খুবই প্রচলিত। উইলিয়ম শেক্সপিয়র অবশ্য অন্য আরেকটা বাজনার কথা লিখেছেন। কিন্তু সে বিতর্ক থাক। কথা হল, বাজনদার হওয়া ছাড়াও নিরোর নানারকম গুণ ছিল। যেমন তিনি নিজের বাগানে অতিথিদের জন্যে এলাহি নৈশ পার্টির আয়োজন করতেন। সে পার্টির আলোর ব্যবস্থা করা হত অভিনব কায়দায়। কিছু অসহায় লোককে আলকাতরায় চুবিয়ে কাঠের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হত, তারপর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হত। জ্যান্ত মানুষগুলো পুড়ত আর আলোয় আলো হয়ে উঠত নিরোর বাগান। সেসব কয়েক হাজার বছর আগেকার কথা। তখনকার মানুষ এখনকার তুলনায় অসভ্য ছিল – এই বলে নিরোর অতিথিদের মাফ করে দেওয়া যেতে পারে হয়ত। কিন্তু আমাদের মাফ করা হবে কোন অজুহাতে? আমাদের যুগেও তো আনন্দের আয়োজনগুলো, বিশেষ করে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ আখ্যা দেওয়া হয় যে মোচ্ছবগুলোকে, সেগুলো নিরোর পার্টির মতই বহু মানুষের জীবন, জীবিকা, স্বাধীনতার বিনিময়ে আয়োজিত হচ্ছে। কলকাতায় অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল বিশ্বকাপ হলে বস্তি উচ্ছেদ হয়, আমেদাবাদে ডোনাল্ড ট্রাম্প এলে গরীব মানুষগুলোকে লুকিয়ে ফেলতে উঁচু পাঁচিল তুলে দেওয়া হয়। কাতারে আজ থেকে যে বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে তার আয়োজন করতে যা যা করা হয়েছে সেসবও তো গোপন নেই। তবু তো আমরা মেতে উঠব, তাই না?

কী হয়েছে জানেন না বলছেন? তা না জানতেও পারেন। কারণ এ যুগের নিরোরা সভ্য মানুষ। তাঁরা অমন বুক ফুলিয়ে অতিথিদের দেখিয়ে দেখিয়ে ওসব করেন না। অতিথিদের নজর যাতে কেবল ভাল ভাল জিনিসে পড়ে তার বন্দোবস্ত করার জন্য গাদাগুচ্ছের সংবাদমাধ্যমও আছে। তারা আর কতটুকু জানতে দেয় এসব? তবে বিদেশি সংবাদমাধ্যম এসে পড়লে হাটে হাঁড়ি ভেঙে যায় অনেক সময়। তাই একবার বলে দিই যতটুকু জানা গেছে।

কাতারের রাজপরিবার এবং ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বলেছেন ২০১০ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত নির্মাণকাজ করতে গিয়ে মারা গেছেন মোটে তিনজন শ্রমিক। কিন্তু ফেয়ার স্কোয়ার নামের মানবাধিকার সংগঠন বলেছে ওই সংখ্যাটা নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তাদের সুপ্রিম কমিটির বক্তব্য, আরও ৩৬ জন বিভিন্ন নির্মাণস্থলে দিনের কাজ শেষ করার খানিকক্ষণ পরেই মারা গেছেন। কিন্তু কাতার সরকার এবং ফিফা তাঁদের হিসাবের মধ্যে রাখেনি, বলে দিয়েছে ওগুলো “প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু”। অবশ্য এ-ও হিমশৈলের চূড়া। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামে যে বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংস্থা আছে, তাদের বিশ্বাস করলে বলতে হয় আসলে কয়েক হাজার শ্রমিক মারা গেছেন গত ১২ বছরে।

বিশ্বকাপ আরম্ভের দিন সকালে মেসি, নেইমার, রোনাল্ডো, এমবাপে, লেওয়ানডস্কিদের নিয়ে সুস্বাদু লেখা উপহার দেওয়ার বদলে তেতো সত্যের ঝাঁপি খুলে বসার জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। মৃত শ্রমিকদের কথা না তুলে পারলাম না। তার কারণ ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ান কাগজের তদন্তমূলক প্রতিবেদনে বছর খানেক আগেই উঠে এসেছে এই তথ্য, যে স্রেফ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কারই ৬,৫০০ প্রবাসী শ্রমিক মারা গেছেন কাতারের আনন্দযজ্ঞে। সবে বছর দুয়েক হল, নিজের দেশের রাজপথ দিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের হাজার হাজার মাইল হেঁটে যেতে দেখেছি নিরম্বু উপবাসে। হাঁটতে হাঁটতে মরে যেতে দেখেছি, ক্লান্ত হয়ে রেললাইনের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ট্রেনের চাকায় পিষে যেতে দেখেছি। সে স্মৃতি টাটকা থাকতেও বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার উত্তেজনায় প্রবাসী শ্রমিকদের দুরবস্থা কী করে ভুলে যাই বলুন?

তবে হ্যাঁ, যত শ্রমিকেরই মৃত্যু হয়ে থাক আর যত শ্রমিকই কাতারের অতি দুর্বল শ্রম আইনের সুযোগে চরম শোষিত হয়ে থাকুন (অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে সংখ্যাটা এক লক্ষের বেশি), দেখার মত একটা জিনিস যে দেখা যাবে আগামী একমাস, তাতে সন্দেহ নেই। অনেক শ্রমিক বলেছেন তাঁদের দিয়ে দিনে ১৪-১৮ ঘন্টা কাজ করানো হয়েছে। এত পরিশ্রম কি আর বৃথা যাবে? শুধু কাতারকে দোষ দিয়ে অবশ্য লাভ নেই। এমন নয় যে কেবল একখানা জমকালো বিশ্বকাপ আয়োজন করতে হবে বলেই তারা হঠাৎ শ্রমিকদের এভাবে নিংড়ে নেওয়া শুরু করেছে। দুনিয়াসুদ্ধ লোকের জানা ছিল কাতারে নিয়মকানুন সর্বনেশে। ফিফার সদস্যরা সব জেনেশুনেই তাদের বিশ্বকাপ আয়োজনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। কিসের বিনিময়ে তাঁদের এহেন বদান্যতা সে আবার আরেক কাহিনি।

আপনি বলতেই পারেন, এসব রাজনীতির কথা, ফুটবল কোথায়? কিন্তু মনে রাখবেন, এবারের বিশ্বকাপ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া হয়েছে ইউক্রেন আক্রমণ করার জন্যে। সুতরাং আর ফুটবল অরাজনৈতিক, বিশ্বকাপ অরাজনৈতিক – এসব বলার অধিকার ফিফা বা কাতারের নেই। ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন নতুন কাতারে নতুন শ্রম আইন বলবৎ করা এবং মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স সেন্টার তৈরি করানোর জন্য ফিফাকে চাপ দেবে বলে ঘোষণা করেছে। আটটা দলের অধিনায়ক মাঠে নামবেন সমপ্রেমী, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি বিবিধ লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের সমর্থনে রামধনু রংয়ের ‘ওয়ানলাভ’ আর্মব্যান্ড পরে। বেশকিছু দল কাতারের সমপ্রেমবিরোধী দমনমূলক আইনের প্রতিবাদে ফ্যান জোন করবে না ঠিক করেছে। এছাড়াও বেশ কয়েকজন ফুটবলার ও কোচ বলেছেন কাতারে বিশ্বকাপের আয়োজন করাই উচিত হয়নি। সুতরাং অন্তত এবারের বিশ্বকাপের আর অরাজনৈতিক হয়ে থাকার উপায় নেই। সেকথা বুঝেই বোধহয় ইনফান্তিনো হঠাৎ দারুণ কাতারি, আরব, আফ্রিকান, সমপ্রেমী, প্রতিবন্ধী, প্রবাসী শ্রমিক হয়ে উঠেছেন। এমনকি বলেছেন কাতারের নিন্দে করার আগে ইউরোপের নিজেদের তিন হাজার বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত। আহা, এমন ভাল ভাল কথা যদি সারা বছর বিশ্বের বড় বড় পুঁজির অধিকারীরা ভাবতেন!

তবে একথা বললে সত্যের অপলাপ হবে যে এই প্রথম এত বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এতখানি রাজনৈতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একনায়কতান্ত্রিক যে কোনো সরকার চিরকাল এরকম প্রতিযোগিতাকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের কাজে লাগায়। রুশ একনায়ক ভ্লাদিমির পুতিন ২০১৮ বিশ্বকাপকে ব্যবহার করেছিলেন, আর্জেন্টিনার একনায়ক হর্হে রাফালে ভিদেলা একইভাবে ব্যবহার করেছিলেন ১৯৭৮ বিশ্বকাপকে, বেনিতো মুসোলিনি ১৯৩৪ বিশ্বকাপকে। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে আর্য রক্তের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে অ্যাডলফ হিটলারকে যেভাবে ল্যাজে গোবরে হতে হয়েছিল জেসি ওয়েন্সের দাপটে, সে ইতিহাস মনে রাখেন না। রাখার দরকার নেই। কারণ মুসোলিনি আর ভিদেলার আমলে যথাক্রমে ইতালি আর আর্জেন্টিনায় ঠিক কী কী ঘটেছিল ইতিহাসে তা স্পষ্ট লেখা থাকলেও ওই দুই বিশ্বকাপে যে ফুটবলাররা খেলেছিলেন, তাঁরা সকলেই যে অংশগ্রহণের জন্য লজ্জিত বা তাঁদের জয় রক্তলাঞ্ছিত মনে করেন তা কিন্তু নয়। কারোর মতে তাঁরা খেলেছিলেন দেশের মানুষের জন্য, দেশের শাসকের জন্য তো নয়। কেউ আবার বলেন মাঠের বাইরে কী ঘটছে সে সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা ছিল না। কিছু ফুটবলার সৎভাবে স্বীকার করেন সবকিছুই জানা ছিল, কিন্তু তাঁরা কী-ই বা করতে পারতেন? এই তিন দলের কেউই যে সম্পূর্ণ ভুল তা বলা চলে না। কারণ খেলোয়াড়দের ক্ষমতার সীমা আছে। বল পায়ে অতিমানবিক দেখতে লাগে বলেই তাঁরা কেউ সত্যি সত্যি অতিমানব নন।

আরও পড়ুন বড়লোকের খেলা

সত্যি কথা বলতে মুসোলিনি আর ভিদেলা আয়োজিত বিশ্বকাপে যা যা ঘটেছিল, তার তুলনায় কাতারে যা হতে চলেছে সেটা বড়জোর নোংরামি। কাতারে অন্তত কোনো স্টেডিয়াম থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে ডিটেনশন ক্যাম্প নেই, আর্জেন্টিনায় কিন্তু ছিল। উপরন্তু মুসোলিনি যেভাবে ফাইনালের রেফারিকে পর্যন্ত চোখ রাঙিয়ে ইতালির বিশ্বকাপ জয় নিশ্চিত করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে, কাতারের রাজার পক্ষে তা করা প্রায় অসম্ভব। কাতার যদি গ্রুপ এ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছয় তাহলেই যথেষ্ট। কারণ তাদের গ্রুপে আছে নেদারল্যান্ডস আর আফ্রিকান সিংহ সেনেগাল। সাদিও মানে শেষ মুহূর্তে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলেও তারা যথেষ্ট শক্তিশালী দল।

গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ডের পক্ষে গ্রুপ বি মোটেই কঠিন হওয়ার কথা নয়। হ্যারি কেন ও তাঁর দলবল ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা দলগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে, কারণ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে (২০১৮) পৌঁছবার পরের ইউরোতেই (২০২০) ফাইনাল খেলার বিরল কৃতিত্ব এই দল অর্জন করেছে। তবে ১৯৬৬ সালের ইংল্যান্ড দলের বিশ্বজয়ের কৃতিত্ব এখনো অধরা। এফ এ-র সঙ্গে সাউথগেটের চুক্তির মেয়াদ ২০২৪ পর্যন্ত। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছেন, যে জানা আছে এবার ট্রফি জিততে না পারলে ওই চুক্তি কাজে আসবে না। গত কয়েক বছরে ক্রমাগত উন্নতি করে চলা এই দলটা কেনই বা গ্যারেথ বেলের ওয়েলস, নড়বড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইরানকে নিয়ে চিন্তিত হতে যাবে?

একই কথা প্রযোজ্য গ্রুপ সি-র আর্জেন্টিনার জন্য। এমনকি দিয়েগো মারাদোনার খেলোয়াড় জীবনেও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ অভিযান শুরু হত অস্থিরভাবে। এই প্রথম ওই বিরল প্রতিভার মানুষটি না থাকবেন ড্রেসিংরুমে, না থাকবেন শিশুসুলভ উদ্দীপনা নিয়ে সমর্থক হিসাবে গ্যালারিতে। অনেকদিন পরে এবার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ খেলতে নামছে ফেভারিটদের মধ্যেও ফেভারিট হিসাবে, যদিও লায়োনেল মেসি সেকথা মানতে চাইছেন না এখনো। কদিন আগেই তিনি দাবি করেছেন আর্জেন্টিনা মোটেই ফেভারিট নয়। কথাটা নিঃসন্দেহে দলের উপর চাপ তৈরি হতে না দেওয়ার জন্য বলা। টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত একটা দল যদি ফেভারিট না হয় তাহলে শব্দটার মানে কী? এবারের বিশ্বকাপ মেসির জন্যে শেষ সুযোগ। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে যতরকম খেতাব জেতা সম্ভব প্রায় সবই জিতে ফেলেছেন একাধিকবার, বিশ্বের সর্বকালের সেরাদের মধ্যেও তাঁর নাম লিখে ফেলেছেন অগণিত মানুষ। তবুও মারাদোনা নামক একটা দেওয়ালের সামনে এসে বারবার থমকে দাঁড়াতে হয়েছে মেসিকে। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা এবং সারা পৃথিবীর সমালোচকরা বারবার বলে এসেছেন, বার্সেলোনার মেসি আর আর্জেন্টিনার মেসি এক নয়। তিনি নীল-সাদা জার্সিতে তো কিছুই জেতেননি। মারাদোনা প্রয়াত হলেন ২০২০ সালে, আর পরের বছরই মেসি আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা জিতে ফেললেন। এবার তাঁর সামনে মারাদোনার ১৯৮৬ সালের কীর্তি ছুঁয়ে ফেলার সুযোগ। মারাদোনা অবশ্য প্রায় একা হাতে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ভরা যৌবনে, মেসি এখনই ৩৫। ইতিমধ্যেই বার্সেলোনা ছেড়ে তাঁকে প্যারিস সাঁ জা-য় সরে যেতে হয়েছে, ২০২৬ সালে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা-মেক্সিকোর বিশ্বকাপে মেসি মাঠে নামার অবস্থায় থাকেন, তাহলেও বিশ্বকাপ জেতার অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাছাড়া এত শক্তিশালী দলই বা প্রতি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা পাবে কোথায়? সাধারণত আর্জেন্টিনা গোল করেও নিশ্চিন্ত হতে পারে না। কিন্তু এবার লায়োনেল স্ক্যালোনির দলে অন্তত একজন ক্রিস্টিয়ান রোমেরো আছেন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায়।

গ্রুপ ডি-র প্রথম স্থানের লড়াইটা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স আর বিপজ্জনক ডেনমার্কের মধ্যেই থাকার কথা, যদি না অস্ট্রেলিয়া কোনো চমক দেয়। এই নিয়ে পরপর পাঁচটা বিশ্বকাপ খেলবে তারা, কিন্তু এবারের বিশ্বকাপটা আরেকটু হলেই ফসকে যাচ্ছিল। শেষমেশ আন্তঃমহাদেশিয় প্লে অফে পেরুকে হারিয়ে কাতারে পৌঁছতে হয়েছে। ইউরো ২০২০-তে ডেনমার্ক সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল। সেইসময় মাঠেই অসুস্থ হয়ে পড়া ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন নিজের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন, সম্প্রতি ফ্রান্সকে ডেনমার্ক দুবার হারিয়েছেও বটে। তবু দিদিয়ের দেশঁর ছেলেরা বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দল। পল পোগবা আর এনগোলো কান্তে অবশ্য মাঝমাঠে থাকছেন না, কিন্তু গত বিশ্বকাপের বিস্ময়বালক কিলিয়ান এমবাপে এখন ২৩ বছরের ভয়ঙ্কর গোলশিকারী। সঙ্গে থাকার কথা ছিল করিম বেনজেমার। কিন্তু তিনি আবার উরুর চোটে ছিটকে গেলেন গতকাল। ফ্রান্সের গোলে অবশ্য নির্ভরযোগ্য উগো লরিস থাকছেন।

গ্রুপ ই থেকে যে দুই দলের দ্বিতীয় রাউন্ডে না ওঠাই অঘটন হবে, সেই স্পেন আর জার্মানির বেশ মিল আছে। দুটো দলই প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, কিন্তু বেশ কিছুদিন কোনো ট্রফি জিততে পারেনি। জার্মান ফুটবল ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ সময় গত চারটে বছর। রাশিয়া বিশ্বকাপে গ্রুপ থেকেই তাদের বিদায় সকলকে চমকে দিয়েছিল। তারপর ইউরো ২০২০-তেও তারা দ্বিতীয় রাউন্ডের গন্ডি টপকাতে পারেনি। কিন্তু হান্সি ফ্লিকের দলে আবার একগুচ্ছ পৃথিবীর প্রথম সারির ফুটবলার এসে গেছেন। গোল করার জন্য সার্জিও ন্যাব্রি, লেরয় সেন, কাই হ্যাভের্তজ, টিমো ওয়ার্নারের পরেও আছেন ৩৩ বছরের থমাস মুলার। পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। ম্যানুয়েল নয়ারকেও ভুলে গেলে চলবে না, তিনি তো শুধুই গোলরক্ষক নন।

লুই এনরিকের স্পেনেও প্রতিভাবান আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের ছড়াছড়ি। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকা এই মুহূর্তে পেদ্রি, যাঁর বয়স মাত্র ১৯, বিশ্বকাপ চলাকালীন কুড়িতে পা দেবেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই বার্সেলোনার জার্সি গায়ে প্রায় ১০০ ম্যাচ খেলা হয়ে গেছে। বার্সেলোনার আরেক তরুণ আনসু ফাতিকে নিয়েও অনেকের বিরাট আশা। ফিট থাকলে তিনি একাই বিশ্বকাপ মাতিয়ে দিতে পারেন বলে কারো কারো ধারণা। ইউরো ২০২০-তে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া স্পেন বিশ্বকাপের যোগ্যতার্জন পর্ব পেরিয়ে এসেছে বেশ অনায়াসেই। তবে পেদ্রি, ফাতিদের করা গোল এনরিকের রক্ষণ ধরে রাখতে পারবে কিনা সেটাই বড় কথা। বটবৃক্ষের মত সার্জিও বুস্কেৎস অবশ্য থাকবেন ওই তরুণদের পিছনে।

গত বিশ্বকাপের রানার্স আপ ক্রোয়েশিয়ার জন্য গ্রুপ এফ সহজ হওয়ার কথা। কারণ এই গ্রুপে তাদের চ্যালেঞ্জ করার মত দল একমাত্র বেলজিয়াম, যাদের কেবলই শক্তিক্ষয় হয়েছে গত চার বছরে। অন্যদিকে জ্লাটকো ডেলিচের অধীন ক্রোয়েশিয়ার ক্রমোন্নতি হয়েছে। ২০১৮ বিশ্বকাপের বেলজিয়াম দলকে বলা হয়েছিল সোনালি প্রজন্ম। সেই প্রজন্ম প্রায় শেষ। ভিনসেন্ট কম্পানি অবসর নিয়েছেন, রোমেলু লুকাকু আগের মত বিপজ্জনক নেই আর ইডেন হ্যাজার্ডের চোটে জর্জরিত সময় কেটেছে রিয়াল মাদ্রিদে। এখনো প্রথম দলে নিয়মিত নন। একমাত্র কেভিন ডি ব্রুইন আর গোলরক্ষক থিবাউ কুতোয়া আগের বিশ্বকাপের ফর্মেই আছেন বলা যায়।

গ্রুপ জি-র ক্যামেরুন উচ্চাকাঙ্ক্ষী দল। রিগোবার্ট সংয়ের ছেলেরা যখন মার্চ মাসে আলজেরিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ছাড়পত্র আদায় করলেন, তখন ক্যামেরুনের কিংবদন্তি প্রাক্তন ফুটবলার স্যামুয়েল এটোয়ো দলকে বলেছিলেন “আমরা কাতারে যাব বিশ্বকাপ জিততে।” স্বপ্ন সবসময় বড় করে দেখাই ভাল। কিন্তু এটোয়োর স্বপ্ন সফল করতে ক্যামেরুনকে প্রথম রাউন্ডেই সার্বিয়া আর সুইটজারল্যান্ডের মত শক্ত বাধা ডিঙোতে হবে। দ্রাগান স্তোইকোভিচের অধীনে সার্বিয়া শুধু জিততে চায় না, অনেক গোল করতে চায়। তাদের হারানো মোটেই সহজ নয়। কিন্তু দল হিসাবে আরও জমাট মুরাত ইয়াকিনের সুইটজারল্যান্ড, যাদের প্রাণভোমরা গ্রানিৎ ঝাকা। এই দল ইউরোর দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সকে ১-৩ পিছিয়ে পড়েও শুটআউটে হারিয়েছিল, কোয়ার্টার ফাইনালেও স্পেনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল পেনাল্টি শুটআউট অব্দি।

এমন একটা গ্রুপ হয়ত তিতের ব্রাজিলের পক্ষেও নেহাত সহজ হবে না, যদিও পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা এই গ্রুপ থেকে প্রথম হয়ে উঠবে বলেই সকলে আশা করবে। মেসির মত নেইমারও এবার যে দলে খেলবেন তাঁর খেলোয়াড় জীবনে সেটাই সম্ভবত ব্রাজিলের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। রাফিনিয়া, রিচার্লিসন, লুকাস পাকেতা – নেইমার ছাড়াও তিতের হাতে গোল করার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এতজন হাজির। তার উপর মাঝমাঠে আছেন ক্যাসেমিরো আর রক্ষণভাগে বর্ষীয়ান থিয়াগো সিলভা। কার তাতে কী, তিতে যদি ষষ্ঠ খেতাবের স্বপ্ন দেখেন?

ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোরও এটাই শেষ বিশ্বকাপ। পিয়ার্স মর্গানের সঙ্গে যে সাক্ষাৎকারের জন্যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তাঁকে ক্লাব থেকে তাড়াতে চলেছে বলে খবর, সেখানেই তিনি জানিয়েছেন আর ২-৩ বছর খেলে চল্লিশে অবসর নিতে চান। সেক্ষেত্রে বিশ্বকাপের মুখে অমন একখানা সাক্ষাৎকার কেন দিতে গেলেন তা বিস্ময়কর। এমনিতেই পর্তুগাল পড়েছে শক্ত গ্রুপে। গ্রুপ এইচে তাদের প্রতিপক্ষ ঘানা, উরুগুয়ে আর দক্ষিণ কোরিয়া। ঘানা অবশ্য শেষ ১২ ম্যাচের মাত্র দুটো জিতেছে, কিন্তু হেড কোচ ওটো অ্যাডো যথার্থই বলেছেন, ঘানা হল বড় প্রতিযোগিতার দল। তারা ২০১০ সালে বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের স্বাদ পেয়ে গেছে। ফলে তাদের হালকাভাবে নেওয়া যায় না। আবার উরুগুয়ে শুধু যে দুবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (যদিও বহুকাল আগে – ১৯৩০, ১৯৫০) তা নয়, এবারে তাদের দল যথেষ্ট শক্তিশালী। লুই সুয়ারেজ আর এডিনসন কাভানি তো আছেন বটেই, আছেন দিয়েগো গোদিন। এঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে থাকবে রিয়াল মাদ্রিদের ফেদেরিকো ভ্যালভের্দের তারুণ্যের দীপ্তি। কোচ দিয়েগো আলোনসোর বিশ্বাস এই দল তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জিততে পারে। সে বিশ্বাসের শক্ত পরীক্ষা গ্রুপেই হয়ে যাবে। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত এই গ্রুপে আছে দক্ষিণ কোরিয়া – এশিয়ার সবচেয়ে ধারাবাহিক দল। এমনকি ব্রাজিল, জার্মানি, আর্জেন্টিনা আর স্পেনকে বাদ দিলে একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়াই টানা দশটা বিশ্বকাপ খেলতে চলেছে। তাদেরও বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। টটেনহ্যামের সন হিউং-মিন সুস্থ থাকলে এবং ফিট থাকলে কোরিয়াও বেগ দিতে পারে।

এমতাবস্থায় রোনাল্ডো ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ফর্ম হারিয়ে বসলেন, একটা ম্যাচের মধ্যেই মাঠ ছেড়ে চলে গেলেন, বিস্ফোরক সাক্ষাৎকারে বললেন ইউনাইটেড ম্যানেজার এরিক টেন হ্যাগকে মোটেই শ্রদ্ধা করেন না। ওই ক্লাব এবং ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ফুটবলার ওয়েন রুনিকে অকারণেই ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলেন। পর্তুগালের আর যে ফুটবলার যেমনই খেলুন না কেন, বলাই বাহুল্য রোনাল্ডো স্বমহিমায় না থাকলে ২০১৬ ইউরো জয় আর ২০১৯ উয়েফা নেশনস লিগ জয় সম্ভব হত না।

পাঠক, আপনি যদি পর্তুগালের ভক্ত হন, তাহলে রোনাল্ডোর জন্য প্রার্থনা করুন। যদি অন্য কোনো দলের সমর্থক হন তাহলে তাদের জন্য প্রার্থনা করুন। কিন্তু বিনীত অনুরোধ, সঙ্গে কাতারের মৃত এবং অত্যাচারিত মানুষের জন্যও প্রার্থনা করুন। প্রার্থনায় কিছু হয় না, কিন্তু এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারবেন? আমরা সকলেই তো নিরোর অতিথি হয়ে গেছি, কেউ বাদ নেই। কারণ আজ বিশ্বজুড়ে অনেক নিরো।

নাগরিক ডট নেটে প্রকাশিত

%d bloggers like this: