শাহেনশাহ ও ফ্যাসিবিরোধী ইশতেহার

তৃণমূল-বিজেপির লড়াইটা তাহলে রাজনৈতিক নয়, আদর্শগতও নয়? ওটা আক্ষরিক অর্থেই খেলা? এসব প্রশ্ন কোন সংবাদমাধ্যমকে করতে দেখা যাচ্ছে না।

অমিতাভ বচ্চনের নায়ক জীবনের শেষ দিকের ছবি শাহেনশাহ । সেখানে অমিতাভের একই অঙ্গে দুটো রূপ। রাতের বেলায় তিনি সাদা চুল, সাদা দাড়িতে অদ্ভুতদর্শন কালো পোশাক পরে লোহার হাত দিয়ে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করে বেড়ান। দিনের বেলায় খাকি উর্দি পরে যা যা করা উচিৎ নয়, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে ঠিক সেগুলোই করে বেড়ান। অপরাধীদের সমঝে চলেন, একটু আধটু ঘুষ-টুষও নিয়ে থাকেন। গত ৩০-৪০ বছরে বলিউডি নীতিবোধ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেঁধিয়ে গেছে, সে আমরা ভারতের যে প্রান্তেই থাকি আর যে ভাষাতেই কথা বলি। আমরা এখন বিশ্বাস করি, একই লোক দিনের বেলায় ঘুষ খেয়ে রাতের বেলায় গুন্ডা বদমাইশদের টাইট দিতেই পারে। তাই সন্ন্যাসী রাজা ছবিতে উত্তমকুমার ফিরে এসেছেন দেখে গ্রামের লোক যেমন আপ্লুত হয়, মুকুল রায় বিজেপি থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরে এসেছেন দেখেও আমরা তেমনি আবেগে ভাসি। আমরা মানে বিজেপি-বিরোধী, ফ্যাসিবাদ-বিরোধীদের কথা বলছি। আসলে যাঁদের উদ্যোগে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ দখল করার আন্তরিক প্রচেষ্টা বিফল হল আর কি। এ তো নেহাত বানিয়ে বলা নয়, স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি স্বীকার করেছেন।

এ রাজ্যে তো এখন দুটোই পক্ষ — বিজেপি আর বিজেপি-বিরোধী। বিজেপি মানে কেবল ৭৭ জন বিধায়ক নয়। রাজ্য সরকারের যে কোনও বিষয়ে যারা সমালোচনা করে, তারা সকলেই বিজেপি। এমনটাই বিজেপি-বিরোধীরা, মানে যাঁরা এ যাত্রায় বাংলাকে বাঁচালেন, তাঁরা বলে দিয়েছেন। আপাতত তর্কের খাতিরে কথাটা সত্য ধরে নিয়ে বলি, এর বাইরে একটা পক্ষ থাকার কথা ছিল, যে কোনও চালু গণতন্ত্রে থাকে। তা হল সংবাদমাধ্যম। দুঃখজনকভাবে সে পক্ষটা আর পশ্চিমবঙ্গে আছে বলে মনে হচ্ছে না। থাকলে কোনও কাগজ, কোনও চ্যানেল প্রশ্ন তোলে না, যে বিজেপিকে আটকানোর জন্য মানুষ তৃণমূলকে ঢেলে ভোট দিলেন সেই বিজেপির সর্বভারতীয় পদাধিকারীকে মমতা ব্যানার্জি কেন দলে নিচ্ছেন? উল্টে সোৎসাহে আলোচনা চলছে, মুকুলবাবু বিজেপির কত বড় “অ্যাসেট” ছিলেন, তাঁকে কেড়ে নেওয়ায় বিজেপির কেমন কোমর ভেঙে দেওয়া গেল। সংবাদমাধ্যমের একটা মস্ত সুবিধা হল, রাজনৈতিক নেতাদের যা-ও বা প্রশ্ন করা যায়, তাদের প্রশ্ন করা যায় না। নইলে জিজ্ঞেস করা যেত, নিজে জেতা ছাড়া মুকুল রায় বিজেপির আর কোন লাভের কারণ হয়েছেন? নিজের এলাকায় নিজের ছেলেকেও যিনি জেতাতে পারেন না, তিনি কোন বিচারে “অ্যাসেট”? এই প্রশ্নগুলো আগাম আন্দাজ করে কোন কোন সংবাদমাধ্যম বলেছে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাফল্যের কাণ্ডারী ছিলেন মুকুলবাবু। কিমাশ্চর্যম তৎপরম! পশ্চিমবঙ্গের মত এত বড় রাজ্যের একটা জেলার একজন প্রভাবশালী নেতা নাকি গোটা রাজ্যের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছিলেন! আচ্ছা, নাহয় ফেলেছিলেন। তাহলে বিধানসভায় পারলেন না কেন? তবে কি ইচ্ছা করেই এবার আর প্রভাব ফেললেন না? যদি তা-ই হয় তাহলে কেন করলেন এমন? এসব প্রশ্নের উত্তর না থাকতে পারে, কিন্তু সর্বদা উত্তর জোগানো তো সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়, তাদের কাজ সর্বদা প্রশ্ন করা। সেসব করতে বিশেষ কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বরং বেচারা মুকুলবাবুকে বিজেপি কেমন প্রান্তিক করে দিয়েছিল, তা দিনরাত আমাদের জানানো হচ্ছে।

এই প্রান্তিক তত্ত্বটা খেয়াল করার মত। কারণ ভোটের ফল বেরোবার পরপর পড়া যাচ্ছিল দিলীপ ঘোষের মত জননেতাকে বিজেপি এবারের নির্বাচনে প্রান্তিক করে দিয়েছিল, তাই এই ফল। এখন আবার মুকুলবাবুর প্রান্তিকতার কথা শোনা যাচ্ছে। এদিকে মুকুলবাবুর প্রস্থান সম্পর্কে দিলীপবাবুর বক্তব্য হল, বিজেপিতে যারা আসে তাদের সবাই টিকতে পারে না, কারণ ওখানে “তপস্যা” করতে হয়। টিএমসি-র মত কাট মানি আর সিন্ডিকেট কালচারের দল থেকে এসে বিজেপিতে টেকা মুশকিল। তা এই দুজনেই যদি প্রান্তিক হয়ে থাকেন, তাহলে কেন্দ্রে ছিলেন কে? শুভেন্দু অধিকারী? আচ্ছা, যদি কদিন পরে তাঁকেও বিজেপি প্রান্তিক করে দেয়, তাহলে তিনিও কি তৃণমূলে ফেরত আসবেন? এখন সংবাদমাধ্যম বলছে বিজেপি যখন ২০০ আসনের স্বপ্নে বুঁদ ছিল, তখন মুকুলবাবু তিন-তিনটে পরামর্শ দিয়েছিলেন। যার মধ্যে দুটো হল ধর্মীয় মেরুকরণ না করা আর মমতা ব্যানার্জিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করা। তার ফলেই নাকি তাঁকে কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয়। বিজেপিতে যোগ দিয়েও ধর্মীয় মেরুকরণের বিপক্ষে বলার মত নায়কোচিত দু-একটা কাজ কি আর শুভেন্দুবাবুও করেননি? তিনি যখন ফিরে আসবেন, তখন নিশ্চয়ই আমরা সেসব জানতে পারব।

অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী নিজ মুখে বহুবার বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর কাছে মুকুল আর শুভেন্দু এক নয়। মুকুলবাবুকে মাতৃক্রোড়ে ফিরিয়ে নেওয়ার দিন সাংবাদিক সম্মেলনে তো বলেছেনই, মুকুলের সাথে কোনদিন মতপার্থক্য হয়নি এবং মুকুল বিজেপিতে গিয়েও কোনদিন পার্টির বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলেনি। মুখ্যমন্ত্রী নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, বয়সও হয়েছে। হয়ত স্মৃতি সবসময় ঠিকমত কাজ করে না। তার উপর মনটা দরাজ, ছোটখাট কথা মনে রাখেন না। কিন্তু সাংবাদিকদের কেউ কি প্রশ্ন তুলেছেন, মতপার্থক্য না হয়ে থাকলে একটা লোক পার্টি ছেড়ে অন্য পার্টিতে গেল কেন? গেলেও যদি সম্মুখসমরে ছেড়ে আসা পার্টির বিরুদ্ধে সত্যিই একটা কথাও না বলে থাকে, সে-ও তো ভারী আশ্চর্যের কথা। ইউরো চলছে, ফুটবলপ্রেমীরা জানেন যে ইউরোপের এক ক্লাবের ফুটবলার নিজের দলে খুব একটা খেলার সুযোগ না পেলে অনেকসময় সেই মরসুমেই অন্য ক্লাবে খেলতে চলে যান। কখনো কখনো দেখা যায় পুরনো ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলায় গোলও করে ফেলেছেন। তাতে কিন্তু পরে আবার পুরনো ক্লাবে খেলা আটকায় না। মুকুলবাবুর বিজেপিতে যাওয়াও কি তেমন ব্যাপার ছিল? তৃণমূল-বিজেপির লড়াইটা তাহলে রাজনৈতিক নয়, আদর্শগতও নয়? ওটা আক্ষরিক অর্থেই খেলা? এসব প্রশ্ন কোন সংবাদমাধ্যমকে করতে দেখা যাচ্ছে না। দেখে শুনে মনে হয় তাঁরাও পক্ষ নিয়ে বসে আছেন। স্রেফ লাভ ক্ষতির অঙ্কে চলা সংবাদমাধ্যমের মালিকরাও ফ্যাসিবিরোধী সঙ্ঘে যোগ দিয়েছেন নাকি? হবেও বা।

অবশ্য মুকুলবাবুর ঘরে ফেরা আরও কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যে প্রশ্নগুলো করা ফ্যাসিবিরোধী সংবাদমাধ্যমের কর্তব্য। যেমন ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ক্যাম্পেনের মানুষজন এবং লিবারেশন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য — যাঁদের মমতা ব্যানার্জি নাম করে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন — তাঁরা কি মিথ্যে এত মেহনত করলেন? ওঁরা তো বরাবরই বলছিলেন এবারের লড়াই বাংলার মনীষা বাঁচানোর লড়াই। এটা কেবল রাজনৈতিকও নয়, রীতিমত সামাজিক সাংস্কৃতিক লড়াই। তৃণমূলের জয় এবং বিজেপির পরাজয়ের পরেও তো দীপঙ্করবাবু একাধিক সাক্ষাৎকারে এবং খবরের কাগজে নিজের লেখাপত্রে বারবার বলেছেন বাংলার মানুষ বিভাজনের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন বলেই এই ফলাফল হয়েছে। তা সেই ফলাফলের সুবিধা পেল যে দল, সেই দলের তাহলে কিছুই এসে যায় না মানুষ কী জন্যে ভোট দিয়েছে তা নিয়ে? তারা ফ্যাসিবাদী দলের নেতাকে দলে নিতেই পারে? বিজেপি ফ্যাসিবাদী নাকি স্রেফ অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী, তা নিয়ে শূন্য পাওয়া সিপিএমে সেই ২০১৪ থেকে বিতর্ক চলেছে। বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী বলে না মেনে নেওয়াই যে সিপিএমের কমতে কমতে শূন্য হয়ে যাওয়ার কারণ — সে কথা বিকল্প বামেরা বারবার বলেছেন। অর্থাৎ তাঁদের নিজেদের কোন সংশয় নেই যে বিজেপি ফ্যাসিবাদী। তাহলে সেই দলের নেতাকে দলে নেওয়ার পরেও কি তৃণমূল ফ্যাসিবিরোধী দল রইল? লিবারেশন মুকুলবাবুর প্রত্যাবর্তন নিয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে তার বয়ান এইরকম:

রাজ্যের গণ রায় সার্বিকভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে ছিল। ক্ষমতার লোভে দলবদল করে বিজেপিতে গিয়ে যারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে আজ আবার ক্ষমতার আকর্ষণেই তারা বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরে এলে আবার জনতার রায় নিতে হবে। এই দলবদলের সুবিধাবাদী রাজনীতি থেকে পশ্চিমবঙ্গের ও দেশের রাজনৈতিক পরিসরকে মুক্ত করা আজ গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

এই বিবৃতিতে কোথাও ফ্যাসিবিরোধী দল হিসাবে তৃণমূলের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ল না কমল, নাকি একই রইল তা নিয়ে কোন মন্তব্য নেই। “মৌনং সম্মতি লক্ষণম” কথাটা যদি ঠিক হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে লিবারেশন মনে করছে বিশ্বাসযোগ্যতা যেমন ছিল তেমনই আছে। কেবল “আবার জনতার রায় নিতে হবে”, অর্থাৎ মুকুলবাবু (আরও যাঁরা আসতে চলেছেন, বোধহয় তাঁরাও) পদত্যাগ করে আবার ভোটে দাঁড়িয়ে বিধায়ক হলেই আর আপত্তি নেই। লিবারেশনের কর্মী সমর্থকরা সোশাল মিডিয়ায় যা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে তাঁদের অনেকের ধারণা এতে বিজেপির শক্তি কমল। তাই তাঁরা বরং উল্লসিত। সত্যিই শক্তি কমল কিনা তা অচিরেই বোঝা যাবে, কিন্তু ফ্যাসিবাদী বলতে কী বোঝায় সেই প্রশ্ন নিয়ে তাহলে আবার আলোচনা করা প্রয়োজন। ভারতে বিজেপি-বিরোধী সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে যে মতটা, তা হল বিজেপিকে যে ভোট দেয় সে-ই ফ্যাসিবাদী। এই মত ঠিক না ভুল সেটা আলাদা কথা, কিন্তু বিজেপি নেতারা ফ্যাসিবাদী, তবে অন্য দলে চলে গেলেই আর ফ্যাসিবাদী থাকে না — এই চিন্তায় নতুনত্ব আছে। গোয়বেলস বা গোয়রিং যদি নাজি পার্টি ছেড়ে দিতেন, তাহলে কি তাঁরা আর নাজি থাকতেন না? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিতে হবে। কেবল লিবারেশনকে নয়, সমস্ত বিজেপি-বিরোধী তৃণমূলে উদ্ধার খোঁজা মানুষকেই দিতে হবে। আজ সংবাদমাধ্যম এসব প্রশ্ন তুলছে না বলে হয়ত দিতে হচ্ছে না, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে দিতেই হবে। দীপঙ্করবাবুর মত নেতৃস্থানীয়দের হয়ত প্রকাশ্যে দিতে হবে, বাকিদের নিজেদের বিবেকের কাছে উত্তর দিতে হবে। কারণ ফ্যাসিবাদ এত সহজে হারে না। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়েছে বলেই বিজেপি-আরএসএস হেরে গেছে, এমন ভাবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

নেই বলেই সাধারণ অবস্থায় যে কোন সরকারকে তার যেসব কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্নের মুখে ফেলা উচিৎ, তৃণমূল সরকারকে সেগুলোর ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোন কারণ নেই। অথচ সকলেই তা করে চলেছেন। আমি একটা বিজেপি-বিরোধী ওয়েবসাইটের হয়ে লিখতাম। আমার লেখায় সাধারণত উল্লিখিত খবরগুলোর তথ্যসূত্র দিয়ে থাকি। কোন একটা লেখায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারও যে কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যায় কারচুপি করছে, মৃতের সংখ্যা গোপন করছে — এমন অভিযোগের কথা লিখেছিলাম। অভিযোগটা আমার নয়। যে কাগজ সেই অভিযোগ তুলেছিল, সেই কাগজের প্রতিবেদনের লিঙ্ক দিয়েছিলাম। সাইটের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন লেখাটা নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন “এ কি আর একা পশ্চিমবঙ্গ সরকার করে? সবাই তো করে। এ আর লেখার কী আছে?” আমার লেখাটা অবিকৃত অবস্থাতেই প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু সাইটের মনোভাব এ থেকে বোঝা যায়। মূলধারার সংবাদমাধ্যমেরও একই মনোভাব। যোগী বা শিবরাজ সিং চৌহানের রাজ্যের যেসব কুকর্ম নিন্দাযোগ্য, তা এ রাজ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশযোগ্যও নয়।

পশ্চিমবঙ্গের সাথে সাথেই কেরালায় বিধানসভা নির্বাচন হল। এখানে যেমন তৃণমূল কংগ্রেস হৈ হৈ করে জিতল, ওখানে তেমনই আধিপত্য নিয়ে জিতেছে সিপিএম নেতৃত্বাধীন এলডিএফ। সেই মন্ত্রিসভার কে কে সদস্য হলেন, কেন হলেন — তা নিয়ে এ রাজ্যের এবং সারা দেশের সংবাদমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হল। বিজেপি-বিরোধীরাই সমালোচনার পুরোভাগে ছিলেন। এ রাজ্যের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে কিন্তু একটা শব্দও কেউ উচ্চারণ করলেন না। অথচ যাঁদের মন্ত্রী করা হয়েছে তাঁদের সম্বন্ধে নারদকাণ্ড সামনে আসার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন এরা এরকম জানলে মন্ত্রী করতেন না। এবার জানা সত্ত্বেও কেন করলেন, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেন না। সংবাদমাধ্যমের কথা নাহয় বাদ দেওয়া গেল, যাঁরা আগামী দিনে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মোদীর বিকল্প হিসাবে মমতাকে ভাবছেন — তাঁদেরও কি দায়িত্ব নয় মমতার সরকারকে উন্নততর করতে চাপ দেওয়া?

এ রাজ্যে এখন সংসদীয় ক্ষমতার দিক থেকে কংগ্রেস টিমটিম করে জ্বলছে, বামপন্থীরা নেই। বিধানসভায় বামফ্রন্ট নেই, বাইরেও থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে ফরোয়ার্ড ব্লকের ঘোষণায়। গত দশ বছরে এরা যে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ তা-ও স্পষ্ট। নইলে সারদার মত সবচেয়ে গরীব মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দেওয়া আর্থিক কেলেঙ্কারির পরেও দুবার কোন দল ক্ষমতায় ফিরতে পারে না। তা এই যখন অবস্থা, তখন সরকারকে কড়া প্রশ্ন করার কাজটা বিজেপি-বিরোধী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কেন করছেন না? নিজ নিজ ক্ষমতায় ইয়াসের পর ত্রাণ পৌঁছে দিতে তাঁরা যত উৎসাহী, গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে পরিবেশের বারোটা বাজানো হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে তাঁরা তত উৎসাহী নন কেন? পৃথিবীর কোন সমুদ্র সৈকত আগাগোড়া কংক্রিটে বাঁধিয়ে দিয়ে সমুদ্রের দোরগোড়ায় বাজার বসানো হয়? দীঘা নিয়ে এই প্রশ্ন এ রাজ্যের পরিবেশবিদরা করবেন না? বাঁধ তৈরি, মেরামতি — এসব প্রশ্নই বা কাদের জন্য তোলা রয়েছে? ই এম বাইপাসের দু ধারের অজস্র গাছ কেটে কংক্রিটে বাঁধিয়ে রেলিং দেওয়াকে যখন সৌন্দর্যায়ন বলে চালানো হয়, তখন নাহয় চুপ ছিলেন। এখন অন্তত মুখ খুলুন। যশোর রোডের ধারের গাছগুলোকে বাঁচাতে গিয়েছিল যে পড়ুয়ারা, তাদের কথা কারো মনে আছে আজ? নাকি এসব প্রশ্ন পরের সাইক্লোন অব্দি থুড়ি পরের নির্বাচন অব্দি তোলা থাকবে?

নির্বাচনের ফল বেরোবার পরের দেড় মাস বামপন্থীদের, বিশেষ করে সিপিএমের, কী করা উচিৎ তা নিয়ে কয়েক গিগাবাইট লেখা হয়ে গেল (আমিও লিখেছি)। সরকারের কী করা উচিৎ সে আলোচনা কি এবার শুরু হওয়া উচিৎ নয়? নাকি বাকি দেশে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাই সংবাদমাধ্যম এবং বিরোধীদের কাজ, কিন্তু এ রাজ্যে সরকারকে রক্ষা করা কাজ? ভারতের ফ্যাসিবিরোধী ইশতেহার কি সেরকমই বলছে?

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি টুইটার থেকে।