
পূর্বকথা: ভোট মিটে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় বিপ্লবকে নিয়ে বাবলুর চায়ের দোকানে ঢুকেছিল রবীন। সেখানে ভোট কেমন হল জিজ্ঞেস করায় একজন মুখের উপর বলে তাদের কোনদিনই ভোট দিতে দেয় না রবীনের পার্টি। শুনে বিপ্লব বাবার উপর রাগ করে বাড়ির পথ ধরে।
“আপনার মৃত্যুচিন্তা আসে?”
“আসে।”
“কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই মৃত্যুতে বিশ্বাস করেন না?”
“ও জিনিসটায় বিশ্বাস না করে কি উপায় আছে, মাস্টারমশাই?”
“না, মানে আমি বলছি আমাদের কাছে মৃত্যু মানে যেমন সব শেষ, আপনি নিশ্চয়ই তা মনে করেন না?”
“কেন?”
“না ঐ যে গীতায় কি সব আছে? আমার গিন্নী বলে ‘বাসাংসি জীর্ণানি…”
“…যথা বিহায় / নবানি গৃহ্নাতি নরোয়পরাণি। / তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি / সংযাতি নবাণি দেহী।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন না?”
“পড়েছি। ঋষিবাক্য, চট করে অবিশ্বাস করি কী করে? কিন্তু কথা কী জানেন? যতক্ষণ শরীর না যাচ্ছে ততক্ষণ তো এটা সত্যি কিনা তা বোঝার উপায় নেই। আর সত্যি যদি হয়ও, নতুন শরীরে গিয়ে কি আমি টের পাব যে এই আমি সেই আমি? পাব না। তাহলে আর এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী?”
“তাহলে আপনিও আমাদের মতই মনে করেন মরলেই সব চুকে বুকে গেল?”
“অ্যাদ্দিন তো তাই দেখে এলুম। কাছের, দূরের কত মানুষকে তো মরতে দেখলুম। কাউকে তো নতুন চেহারায় ফিরে আসতে দেখিনি এ পর্যন্ত। যাচাই না করে বিশ্বাস করি কী করে বলুন দেখি? আমার ঠাকুরও তো যাচাই করতে বলতেন। সেসব তো আপনি জানেন নিশ্চয়ই?”
“হ্যাঁ, শুনেছি কিছু কিছু। বিপ্লব যখন ছোট ছিল তখন আমার গিন্নী ওকে কিছু বইপত্তর কিনে দিয়েছিল মিশনের। সেখানেও দেখেছি কিছু কিছু।”
“কিন্তু ছেলে তো ও লাইন ধরেনি?”
“ছেলে আমার লাইনও ধরেনি।”
“তা কেন বলছেন? যা শুনেছি তাতে ছেলে তো আপনার বামপন্থীই।”
“ছিল এককালে। এখন বোধহয় ভোগপন্থী।”
“নিশ্চিত? আমার কিন্তু সন্দেহ আছে।”
“আপনি আর আমার ছেলেকে দেখলেন কতটুকু?”
“যেটুকু দেখেছি তা থেকেই বলছি, মাস্টারমশাই। অত হতাশ হবেন না। ও ছেলে ভোগবাদী হবে না। আপনার অংশ ওর মধ্যে খুব জোরালো।”
“আপনি ওকে শেষ দেখেছেন বছর দশেক আগে। তখন আমারও তাই মনে হত। তারপর তো সে ছেলে বদলে গেল। পুরোটা ওর দোষ নয় অবশ্য। ওদের কলেজে সেই যে ওর বন্ধুটাকে পিটিয়ে মেরে দিল বদমাশগুলো… তাইতে বিপ্লব বড় আঘাত পেয়েছিল। সেই থেকেই…”
“আপনি ভোগবাদী বলছেন কেন? হায়দরাবাদ চলে গেছে বলে?”
“ঠিক তা নয়। এখানে থাকতেই তো কেমন একা একসেড়ে হয়ে গেল। আমার পার্টি না-ই করল। যদি অন্য কোন পার্টিও করত আমার দুঃখ থাকত না, মহারাজ। রাজনীতি করতেই হবে, তাও বলছি না। কিন্তু ও যে আসলে পালিয়ে গেল। আমার দুঃখ সেইখানে। এখানে থাকল, না হায়দরাবাদে থাকল, না লন্ডনে থাকল সেটা বড় কথা না। বড় কথা হচ্ছে নিজের কেরিয়ার, নিজের পরিবার, নিজের টাকা, নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স এসব নিয়েই পড়ে থাকল, নাকি অন্যের সুখ দুঃখের কথা ভাবল? কমিউনিস্ট যদি না-ও হয়, কেবল নিজের জন্যে বাঁচাটা কি বাঁচা? আপনিই বলুন?”
“ভোগবাদের হাত বড় লম্বা, মাস্টারমশাই। তার জাল ভারী সূক্ষ্ম। সে জালে আপনার ছেলে ধরা পড়েছে হয়ত। কিন্তু আপনি দেখবেন, ও বেরিয়ে আসবে ঠিক।”
“আসবে? বলছেন আসবে?”
“নিশ্চিত।”
“আপনার কথাই যেন সত্যি হয়। এটুকু যেন দেখে যেতে পারি।”
“কেন পারবেন না? এখনই চলে যাওয়ার কথা ভাববেন না, মাস্টারমশাই। আপনার এখনো অনেক কাজ বাকি।”
গলামন নদীর ঘাটে বসে পাঁচ বছর আগে এমন এক সন্ধ্যায় পাগল মহারাজের সাথে সেই কথোপকথন রবীনের মনে পড়ে। “ছেলেটা ফিরে এসেছিল, রাখতে পারলাম না,” আপন মনে বলে।
“কী গো? একা একা বইস্যা কী বিড়বিড় করতাছ?”
ফাল্গুনীর গলার আওয়াজে চমকে ওঠে রবীন।
“আয়, বোস। একটা বিড়ি দে তো। মাথাটা টিপটিপ করতাছে।”
ফাল্গুনী দুজনের বিড়ি ধরিয়ে জিজ্ঞেস করে “তোমার সাথে কে একটা বইস্যাছিল না? ছাদ থিকা দ্যাখলাম মনে হইল?”
“হুম। বিপ্লব।”
“তা গেল কই?”
“বাড়ি চইল্যা গেল।”
“ও মা! এইটুক বইস্যাই চইল্যা গেল?”
বিড়িতে দুটো টান মারতেই রবীনের বুকটা কেমন জ্বালা করতে লাগল। মাথাটাও মনে হল ছেড়ে যাওয়ার বদলে কেমন ভারী হয়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে ফেলতে ইচ্ছে করল। সেই অবস্থাতেই আরেকটা জোর টান মেরে ধোঁয়া ছেড়ে বলল “এই প্রাইমারি স্কুলের বুথটায় আজকে বলর ভুয়ো ভোটারগুলো মার খেয়েছে, না?”
“হ্যাঁ। যা মার মেরেছে না। মেরেই ফেলত। পুলিশ এসে উদ্ধার করেছে। তাও একজনের পা ভেঙে গেছে।”
“মানুষ আর কদ্দিন সহ্য করবে?”
“বলর তো তারপরেও লজ্জা নেই। নাটু যারা মারায় নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের বাড়ি গিয়ে থ্রেট দিয়ে এসেছে। বিজয় মিছিল করে এসেই নাকি ওদের দেখে নেবে।”
রবীন বিড়িটা অর্ধেক খাওয়া অবস্থাতেই ছুঁড়ে ফেলে দিল। মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে, বুকের জ্বলুনি বেড়েই চলেছে। চোখ বন্ধ করে চুলগুলোর গোড়া ধরে টানতে টানতে রবীন বলল “এবার আর বিজয় মিছিল হবে না।”
“কী গো, রবীনদা? কী হল? মাথাটা খুব ব্যথা করছে?”
রবীন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে পারে শুধু।
“চলো, বাড়ি চলো। তোমায় দিয়ে আসি।”
“আরে কিচ্ছু হয়নি। একটু চা খেতে পারলেই…”
“আচ্ছা, তুমি বসে থাকো এইখানে।”
ফাল্গুনী দৌড়ে রিকশা স্ট্যান্ডের চায়ের দোকান থেকে এক ভাঁড় ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে আসে। কয়েক চুমুক খেয়ে মাথার ব্যথাটা যেন একটু কমেছে মনে হয় রবীনের। তবে হাতে পায়ে তেমন জোর পাওয়া যায় না। বুকের জ্বালাটা কমে, কিন্তু পুরোপুরি যায় না। কাশি আসে, ফাল্গুনী ভাবে বিষম খেল বুঝি। খানিকটা কেশে নিয়ে চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে রবীন বলে “বোধহয় ঘাম বসে ঠান্ডা লেগে গেছে, বুঝলি?”
“তাই হবে। যা গরম পড়েছে।”
চা শেষ করে রবীন বলে “নে, এবার তুই চা খেয়ে নে। তারপর চ বাড়ি গিয়েই বসি। শরীরটা ঠিক সুবিধের লাগছে না। একটু আগেই ঠিক ছিলাম…”
“তুমি চলো। আমি আর খাব না, বাড়ি থেকে এক কাপ খেয়েই বেরিয়েছি।”
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে রবীন টলে গেল। ফাল্গুনী না ধরলে পড়েই যেত।
“কী গো? মাথা ঘোরাচ্ছে নাকি?”
“হ্যাঁ, ঘুরে গেল হঠাৎ।”
ফাল্গুনী কপালে হাত ছুঁইয়ে বলে “জ্বর তো নেই মনে হচ্ছে। যা-ই হোক, তুমি বাড়িই চলো।”
রবীন মন্থর পায়ে ফাল্গুনীর সাথে হাঁটতে শুরু করে।
“তুমি কী বলছিলে? বিজয় মিছিল হবে না?”
“না রে। হবে না।”
“কিন্তু আমরা তো বহুদিন এখানে হারিনি, রবীনদা?”
“শেষ হেরেছিলাম চুরাশির ভোটে। কিন্তু এবার হারব।”
“তুমি নিশ্চিত?”
“নিশ্চিত। বিপুল ভোটে হারব।”
ফাল্গুনী চুপ করে যায়।
“আরো বলি শোন। এবারে মমতা আমাদের থেকে বেশি সিট পাবে।”
ফাল্গুনী হেসে ফ্যালে।
“হেসে নে, হেসে নে। খুব কঠিন দিন আসছে। আমি থাকব কিনা জানি না, তোরা তো থাকবি। তোদেরই সামলাতে হবে।”
রবীন বাড়ি ঢুকে বিপ্লবকে দেখতে পেল না। ফাল্গুনীই জিজ্ঞেস করল “বৌদি, বিপ্লব কোথায়? কতদিন দেখিনি ওকে।”
“এরা বাপ ব্যাটায় কী যে করে! দুজনে দিব্যি একসাথে হাঁটতে গেল। কিছুক্ষণ পরেই দেখি ছেলে একা ফিরে এল। জিজ্ঞেস করলাম ‘বাবা কোথায় রে?’ সে কিছু না বলে দুদ্দাড় করে উপরে চলে গেল।”
“রবীনদার তো শরীরটা খারাপ।”
রবীন ক্ষীণ কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল কিচ্ছু হয়নি, কিন্তু জোনাকি ততক্ষণে শুরু করে দিয়েছে।
“দেখেছিস কাণ্ড? বললে কোন কথা শোনে? সারাদিন রোদের মধ্যে টো টো করে ঘুরে বেড়াতে বারণ করেছিলাম। তার জন্যে কি মুখ ঝামটা সহ্য করতে হল! এখন বোঝো। আর অদ্ভুত ছেলেও জুটেছে আমার কপালে। অসুস্থ বাবাকে রাস্তার মধ্যে ফেলে চলে এল। তুই দেখতে না পেলে কী হত বল তো?”
রবীন এতক্ষণে গলা তুলে বলতে পারে “আঃ! কী হচ্ছে কি? বিপ্লব যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ আমার শরীর ভালই ছিল। খামোকা ওকে দোষ দিচ্ছ কেন?”
জোনাকির চেঁচামেচি শুনে বিপ্লব নেমে আসে।
“কী হয়েছে বাবার, ফাল্গুনীকাকু?”
“আরে! আয় আয়, তোকে একটু দেখি” বলে ফাল্গুনী বিপ্লবকে পাশে বসায়। “তেমন কিছু হয়নি। ঐ মাথাটা ঘোরাচ্ছিল আর কি। আসলে এই গরমে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি গেছে তো।”
“তা এত দৌড়াদৌড়ি না করলেই তো হয়।”
“এটা তুই কী বললি, বিপ্লব? তুই তোর বাবাকে চিনিস না? রবীনদার তো পার্টিটাই জীবন। এটা ছাড়া লোকটা বাঁচতে পারে?”
“বাবাকে চিনি?” বাঁকা হেসে বিপ্লব বলে। “ভাবতাম চিনি। এখন দেখছি ততটা চিনি না। যাকগে।”
বলে আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। ফাল্গুনী অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে, রবীনের দিকে তাকাতে চায় না। রবীনও চোখ বুজে ফ্যালে।
ভাল লাগলে টাকা দিতে পারেন Google Pay / Paytm / BHIM বা অন্য UPI অ্যাপের মাধ্যমে journopratik@okhdfcbank কে
অথবা
নেট ব্যাঙ্কিং বা অন্য উপায়ে নিম্নলিখিত অ্যাকাউন্টে
Pratik Bandyopadhyay
A/c No. 14041140002343
HDFC Bank
Branch: South Calcutta Girls’ College
IFS Code: HDFC0001404
MICR Code: 700240048