প্রখর তপন তাপে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা কাঁপে

হুগলি জেলায় বসে এই লেখা শুরু করার সময়ে আলিপুর আবহাওয়া দপ্তর জানিয়ে দিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই বৃষ্টি হবে দক্ষিণবঙ্গে। সেইসঙ্গে কমবে তাপমাত্রা, তাপপ্রবাহও স্তিমিত হবে। সত্যি কথা বলতে, এমনটা যে হবে তা আলিপুর কদিন ধরেই বলছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার যাঁরা ভাগ্যনিয়ন্তা তাঁরা হয় আবহাওয়াবিদ্যার উপর জ্যোতিষশাস্ত্রের চেয়ে বেশি ভরসা করেন না, অথবা কোনো কারণে স্কুলগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার ভীষণ তাড়া ছিল। নইলে ২৭ এপ্রিল (বুধবার) নবান্নে তাপপ্রবাহ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরেই ২ মে (সোমবার) থেকে গরমের ছুটি শুরু করে দেওয়ার সিদ্ধান্তের কোনো ব্যাখ্যা হয় না।

গত কয়েক দিনে শিক্ষামন্ত্রকের দুটো সিদ্ধান্ত খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। প্রথমটা গরমের ছুটি এগিয়ে আনা, দ্বিতীয়টা কলেজে ভর্তি কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইনে করা। কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে উচ্চমাধ্যমিকের ফল বেরোবার পর কলেজে ভর্তি নিয়ে চমকপ্রদ সব কাণ্ড হয়েছিল। পরীক্ষায় যত নম্বরই পান না কেন, তৃণমূল ছাত্র পরিষদকে মোটা টাকা প্রণামী না দিলে কলেজে ভর্তি হওয়া যাচ্ছে না – এমন অভিযোগ উঠেছিল। পছন্দের বিষয়ে অনার্স নিতে গেলে কোথাও কোথাও ৪০-৫০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে, এমনও শোনা যাচ্ছিল। তারপর চালু হয় কলেজের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভর্তি। কারণ এ দেশে গত দুই দশকে দুর্নীতির একমাত্র সমাধান হিসাবে জনপ্রিয় হয়েছে অনলাইন ব্যবস্থা, সে ব্যবস্থা সকলের নাগালের মধ্যে কিনা তা নিয়ে আলোচনা করলে লোকে বোকা এবং সেকেলে বলে। কিন্তু বোধহয় সে ব্যবস্থাও দুর্নীতিমুক্ত করা যায়নি, তাই এবার সোজা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভর্তি হবে শোনা যাচ্ছে। যতক্ষণ না ব্যাপারটা চালু হচ্ছে ততক্ষণ এর অসুবিধাগুলো জানা যাবে না। ফলে এই মুহূর্তে ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলেই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তাই সংবাদমাধ্যমেও তাঁদের প্রতিক্রিয়াগুলো ঘটা করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মজার কথা, গরমের ছুটি এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাঁরা কী ভাবছেন তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের উৎসাহ তুলনায় কম। কারণটা সোশাল মিডিয়া দেখলেই দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্তে পুরোপুরি খুশি হয়েছেন এমন কাউকে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছে। বলা বাহুল্য, অফলাইন প্রতিক্রিয়াও খুব আলাদা হবে না। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম অত্যন্ত সাবধানী। প্রতিবেদনের শেষ প্যারায় “অমুক শিক্ষক সংগঠন বলেছে এতে তমুক অসুবিধা হবে। কিন্তু তমুক শিক্ষক সংগঠন এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে” লিখেই ক্ষান্ত দিচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে এমনিতে শিক্ষাবিদের ছড়াছড়ি। অনেকে এত বিদ্বান যে শিক্ষা ছাড়াও নাটক, সিনেমা, সঙ্গীত, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত খবরের কাগজের উত্তর-সম্পাদকীয় স্তম্ভে লিখে থাকেন। কারো কারো মতে এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ কাকে ভোট দেবেন তা-ও এঁরা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। অথচ কোভিডের প্রতাপে প্রায় দু বছর বন্ধ থাকার পর খোলা স্কুল, কলেজ ফের টানা দেড় মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গেল – এ নিয়ে শিক্ষাবিদদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

কিছু বামপন্থী ছাত্র সংগঠন কয়েক মাস আগে পথে নেমেছিল স্কুল, কলেজ অবিলম্বে খোলার দাবিতে। যখন খুলে গেল, তখন একে আন্দোলনের সাফল্য বলেও সোচ্চারে দাবি করেছিল। এখন পর্যন্ত তারাও চুপ। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক সংগঠনগুলোর কী অবস্থা তা নিয়োগ থেকে বদলি – সব ক্ষেত্রে শোষিত মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের একলা লড়াই বা অস্থায়ী অরাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করে লড়াই করা দেখলেই টের পাওয়া যায়। যে নিখিলবঙ্গ শিক্ষক সমিতি বাম আমলে এমন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিল যে অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত বাজেট বক্তৃতায় সরকারি বেতন পাওয়া মাস্টারদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করার নিদান দিয়েও পরে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই সমিতির অস্তিত্ব এখন টের পাওয়া যায় কেবল সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবৃতি থেকে। তা সেই সমিতি বলেছে আপাতত সাতদিনের ছুটি দিয়ে পরীক্ষা ইত্যাদি আশু কাজগুলো শেষ করে নিয়ে তারপর ছুটি দিলে ভাল হত। আরও দু-একটি শিক্ষক সংগঠন ক্ষীণ স্বরে এরকম নানা পরামর্শ দিয়েছে। মমতা ব্যানার্জির সে পরামর্শ শুনতে বয়ে গেছে। তিনি অবিসংবাদী জননেত্রী, তিনি যখন মনে করেছেন এই গরমে স্কুল করা যায় না, তখন যায় না।

গত বছর অতিমারীর কারণে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হয়নি। এ বছরের মাধ্যমিক শেষ করা গেছে, উচ্চমাধ্যমিকেরও লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে নবান্নের সভার দিন। কিন্তু একাদশ শ্রেণির প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শুরু হওয়ার কথা ছিল আজ থেকে। সরকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে সেসব মাথায় রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। স্কুলের পরীক্ষা আর বোর্ডের পরীক্ষা গুরুত্বের দিক থেকে এক নয় – এমনটা ভাববার কী-ই বা দরকার? ঠিক দুটো অনুচ্ছেদের সরকারি নির্দেশে ছুটির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাতিল পরীক্ষাগুলো কবে হবে না হবে তা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করা হয়নি। ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের এই শিক্ষাবর্ষের প্রথম সামেটিভ পরীক্ষা ৭ মের মধ্যে শেষ করতে হবে – সরকারি নির্দেশ ছিল। সে নির্দেশও চোখের পলকে বাতিল হল। মানে যে ছেলেমেয়েরা কোনো পরীক্ষার মুখোমুখি হয়নি সেই ২০২০ সাল থেকে, তাদের প্রথম পরীক্ষাটাও বাতিল হল। নিজের নির্দেশ বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিল সরকার নিজেই। এসব অবশ্য ইদানীং প্রায়ই হয়। এমনকি আগের নির্দেশের সাথে পরের নির্দেশের সাযুজ্য বজায় রাখার প্রয়োজনও বোধ করে না পশ্চিমবঙ্গ সরকার। অনেকসময় সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেন, কয়েক ঘন্টা পরের সরকারি সার্কুলারেই তা বেশ খানিকটা বদলে যায়।

যাক সে কথা। লক্ষ করার মত বিষয় হল, এই হঠাৎ ছুটিতে পড়াশোনার যে ক্ষতি হবে সরকার তা বোঝে না এমন নয়। বোঝে বলেই বলা হয়েছে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস চলতে পারে। এমনিতেই বহু বেসরকারি স্কুল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্দেশ মেনে গরমের ছুটি শুরু করছে না বলে জানিয়েছে। তারা কেউ কেউ অত্যধিক গরমের কারণে অনলাইন ক্লাস নেবে। আইসিএসই, সিবিএসই-র অধীন স্কুলগুলোর পরীক্ষাও চলবে। তার মানে দেড় মাস লেখাপড়া বন্ধ থাকবে শুধু পশ্চিমবঙ্গের সরকারি এবং সরকারপোষিত স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীদের। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও যাদের পক্ষে অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব নয় তারা বঞ্চিত হবে। সুতরাং অতিমারীর সময়ে যে ডিজিটাল বিভাজন শুরু হয়েছিল, সরকার জেনেশুনে তা বাড়িয়ে তুললেন।

ক্ষুব্ধ অভিভাবকদের অনলাইন এবং অফলাইন প্রতিক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে, তাঁরা যথারীতি স্কুলশিক্ষকদের সৌভাগ্যে বিরক্ত ও ঈর্ষান্বিত। “এরা আর কত ছুটি খাবে” জাতীয় মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া চলছে। তৃণমূল সরকারের আমলে নিয়োগের অভাবে যতগুলো ক্লাস নেওয়ার কথা, যতগুলো খাতা দেখার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে হয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। উপরন্তু সরকার নাগরিকদের শ্রীবৃদ্ধির যতরকম পরিকল্পনা নিয়েছেন সেসবের দায়িত্বও তাঁদেরই ঘাড়ে। গত কয়েক বছর প্রবল গরমে যতবার সরকার গ্রীষ্মাবকাশ বাড়িয়েছেন, ততবার নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কিন্তু স্কুলে যেতে হবে। অর্থাৎ গরমে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন না। এতৎসত্ত্বেও রাজ্যসুদ্ধ বাবা-মা ভাবছেন “এরা আর কত ছুটি খাবে”। অথচ অধিকাংশ মাস্টারমশাই, দিদিমণি এই ছুটি চান না – লেখাপড়ার ক্ষতির কথা ভেবে তো বটেই, তাঁরা যে ক্রমশই গণশত্রু বলে প্রতিপন্ন হচ্ছেন সেই দুশ্চিন্তাতেও। চিন্তাটা অমূলক নয়। এই প্রখর তপন তাপে সরকারের সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল, সে আলোচনা করতে গিয়ে যেসব বিকল্পের কথা বলছেন অনেকে, তা থেকে রাজ্যের স্কুলগুলো কী অবস্থায় আছে সে সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণার অভাব এবং সে কারণে মাস্টাররা মহা সুখে আছেন – এই ধারণার প্রাধান্য প্রকট হচ্ছে।

যেমন অনেকেই সকালে স্কুল করার কথা বলছেন। এঁরা সম্ভবত জানেন না, স্কুল সার্ভিস কমিশন চালু হওয়ার পর থেকে রাজ্যের স্কুলগুলোতে স্থানীয় শিক্ষক-শিক্ষিকার পরিমাণ অনেক কমে গেছে। অনেকেই স্কুলে আসেন ৩০-৪০ কিলোমিটার বা তারও বেশি দূর থেকে ট্রেন, বাস, আরও নানারকম যানবাহনে। সম্প্রতি উৎসশ্রী নামে বদলির যে প্রকল্প চালু হয়েছে তাতে ইতিমধ্যেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, মামলাও চলছে। ফলে সে সুবিধা নেওয়ার সুযোগ মোটেই খুব বেশি মানুষের হয়নি। হয়ত কোনো স্কুলে ৫০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা, উৎসশ্রীর সুবিধা নিয়ে এসেছেন জনা চারেক। সঙ্গে আরও জনা পাঁচেক স্থানীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা থাকা সম্ভব। পঞ্চাশ জনের ক্লাস যদি এই জনা দশেককে নিতে হয় সকালের স্কুলে, তাহলে কেমন পড়াশোনা হবে? নাকি দূর থেকে আসা মাস্টারদের স্কুলেই রাত কাটানোর দাবি করা হচ্ছে? মুখ্যমন্ত্রীর মর্জিই যেখানে আইন সেখানে অদূর ভবিষ্যতে হয়ত এমন নিয়মও হতে পারে। তখন মাস্টাররা কেমন টাইট হল তা দেখে অন্য পেশার লোকেরা প্রভূত আনন্দ পাবেন।

আসলে একটা তৈরি করা সমস্যার সমাধান খুঁজে চলেছি আমরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবার গ্রীষ্মে একদিনও কালবৈশাখী হয়নি দক্ষিণবঙ্গে, তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেলেছে কোথাও কোথাও। কিন্তু এমন তো নয় যে পশ্চিমবঙ্গ ছিল শীতের দেশ, বিশ্ব উষ্ণায়ন জায়গাটাকে রাতারাতি থর মুরুভূমি করে তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গে গরম চিরকালই পড়ত, কিন্তু গরমের ছুটি কবে থেকে কবে অব্দি থাকবে সেই সিদ্ধান্তগুলো নিজেদের বিবেচনা অনুযায়ী স্কুল কর্তৃপক্ষই নিতেন। সাধারণত দক্ষিণবঙ্গের স্কুলগুলোতে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে টানা ২০-২৫ দিন ছুটি থাকত, স্কুল খুলতে খুলতে এসে যেত বর্ষা। উত্তরবঙ্গের স্কুলেও স্থানীয় আবহাওয়া বুঝে গরমের ছুটি দেওয়া হত। আর ছুটির দিনক্ষণ শিক্ষাবর্ষের গোড়াতেই ঠিক হয়ে যেত, ফলে পড়াশোনা এবং পরীক্ষার নির্ঘণ্ট রাতারাতি বদলাতে হত না। বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষায় দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ হয়েছে। কবে পরীক্ষা হবে, কবে ছুটি দেওয়া হবে, ছাত্রছাত্রীদের কী অ্যাক্টিভিটি টাস্ক দেওয়া হবে – সবই ঠিক হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। ফলে যথেষ্ট সহনীয় আবহাওয়ার জলপাইগুড়ি জেলার স্কুলের সঙ্গেই ২ মে থেকে ছুটি শুরু হয়ে যাচ্ছে পুরুলিয়া জেলার স্কুলের। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় প্রতি বছরই দীর্ঘায়িত হচ্ছে গরমের ছুটি। এগারো বছর কেটে গেল, এখনো গরমের ছুটির দিন নির্দিষ্ট করতে পারল না রাজ্য সরকার।

এতদ্বারা সরকারি ও সরকারপোষিত স্কুলগুলোকে সবদিক থেকে পঙ্গু করে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারি শিক্ষার রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে কিনা সে প্রশ্নে না গেলেও একটা প্রশ্ন অনিবার্য। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০২২ গ্রীষ্মের মত পরিস্থিতি অদূর ভবিষ্যতে তো আরও বাড়বে। তাহলে কি এবার থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীন স্কুলগুলো গরমকালে বন্ধই থাকবে? ভারত তথা পৃথিবীর যে যে অঞ্চলে প্রচণ্ড গরম পড়ে, সেখানকার ছেলেমেয়েরা কি স্কুল যায় না? নাকি রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে পথপ্রদর্শক হতে চাইছে?

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে

১৪৬ বছর ধরে ক্ষমতা দেখিয়ে চলেছে বুলডোজার

 “বুলডোজার, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?”

রাজধানী দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেরও তোয়াক্কা না করা বুলডোজারে বাড়িঘর, দোকানপাট গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল যাঁদের, তাঁরা এই প্রশ্ন করেছিলেন কিনা জানি না। তবে বৃন্দা কারাত নিশ্চিত জানতেন, বুলডোজার কখনো পথ হারায় না। যন্ত্র হলেও সে নিজের পক্ষ সম্পর্কে রীতিমত সচেতন। সেই ১৮৭৬ সাল থেকে সে ক্ষমতা প্রদর্শনের কাজ করে যাচ্ছে।

সে বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী রাদারফোর্ড বি হেস আর ডেমোক্র্যাট স্যামুয়েল টিলডেনের লড়াইতে বারবার এসে যেত বুলডোজারের কথা। বুলডোজ করা বলতে বোঝানো হত কৃষ্ণাঙ্গ ভোটারদের উপর অত্যাচার করে, ভয় দেখিয়ে তাদের ভোটদানে বিরত করা। অবাক হচ্ছেন? ভেবেছিলেন চড়াম চড়াম ঢাকের বাদ্যি আমাদের নিজেদের আবিষ্কার? তা-ও কি হয়? আমরা না অহিংস জাতি? বরং বলা যায় আমেরিকা যেখানে, বুলডোজার সেখানে। ওসামা বিন লাদেনের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ও দিয়েই। আমেরিকা সমর্থিত ইজরায়েলের সেনাবাহিনীকেও গাজায় প্যালেস্তিনীয় যুবকের মৃতদেহ বুলডোজার দিয়ে পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। আবার আফগানিস্তানের প্রাক্তন সিআইএ এজেন্ট গুল আগা শেরজাই, যে এখন তালিবান সরকারের শরিক, তার নাঙ্গারহার প্রদেশের শাসক থাকার সময়ে (২০০৫-২০১৩) নামই হয়ে গিয়েছিল বুলডোজার। কারণ প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে গেলেই সাধারণ মানুষ তার কাছে অসমাপ্ত রাস্তা তৈরি করার আবেদন জানাত। শেরজাই নাকি পত্রপাঠ বুলডোজার চালিয়ে কাজ শুরু করে দিত।

আসলে চাষবাসের কাজে লাগবে বলে তৈরি বুলডোজারের ব্যবহার ক্রমশই শহুরে হয়ে উঠেছে। পালোয়ানরা পেশি ফোলায়, ক্ষমতাশালীরা বুলডোজার ফলায়। জরুরি অবস্থার সময়ে ভারতভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠা সঞ্জয় গান্ধীও পুরনো দিল্লির সৌন্দর্যায়নের নাম করে ওই যন্ত্র চালিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে এই এপ্রিল মাসেই সঞ্জয়ের ডান হাত আমলা জগমোহনের (সেই জগমোহন, যিনি ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যার সময়ে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল ছিলেন এবং পরে বিজেপিতে যোগ দেন) উদ্যোগে লালকেল্লা, জামা মসজিদ এবং এবং তুর্কমান গেট সংলগ্ন এলাকা চিহ্নিত করা হয় বস্তি উচ্ছেদ করে সৌন্দর্যায়নের জন্য। তা করতে গিয়ে অশান্তি দেখা দিলে ওই এলাকার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হয়, কিন্তু তুর্কমান গেটের বাসিন্দারা নাছোড়বান্দা। ১৮ এপ্রিল পুলিস প্রতিবাদীদের উপর গুলি চালায়, অনেকের মৃত্যুও হয়। বিবিসির মত বিদেশি সংবাদমাধ্যমের মতে, বেশকিছু প্রতিবাদীকে বুলডোজার দিয়ে পিষেও দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন শাহীনবাগ: কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে…

অতএব যোগী আদিত্যনাথের বুলডোজার, মধ্যপ্রদেশের খারগোনে শিবরাজ সিং চৌহানের বুলডোজার বা দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীর — ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা মেনেই এগিয়েছে। তবে আরেকটা ব্যাপারেও ইতিহাস দারুণ ধারাবাহিক। তা হল গা-জোয়ারি শাসককে শেষপর্যন্ত বুলডোজ করে দেওয়া। এই বিধির বাঁধন কাটবার মত শক্তিমান বুলডোজার সম্ভবত এখনো তৈরি হয়নি।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

ক্রিকেটের লুপ্তপ্রায় সৌন্দর্যের নাম উমরান

ক্রিকেটের মরশুম বদলে গেছে। আগে ক্রিকেট মরশুমের সূচনা বলতে বোঝাত অঘ্রাণ মাস। যখন সন্ধে না নামতেই শিশির পড়তে শুরু করে, গা শিরশির করে ভোরের দিকে। আর মরশুমের শেষ, যখন মাঘের শীত বাঘের গায়। মাঝের মাসগুলোতে ইডেন উদ্যানে বসত টেস্ট বা একদিনের ক্রিকেটের আসর। প্রবীণ ক্রিকেটপ্রেমীরা এখনও শোনান ভাগবত চন্দ্রশেখরের ম্যাচ জেতানো স্পেলের কথা বা সোনালি চুলের টনি গ্রেগকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা। আমাদের প্রজন্মের কাছে অমূল্য স্মৃতি নয়ের দশকের মাঝামাঝি হিরো কাপের সেমিফাইনাল, ওই দশকের গোড়ায় দুর্বার গতির অ্যালান ডোনাল্ড আর অফসাইডের চিনের প্রাচীর জন্টি রোডসকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা। মরশুম দীর্ঘায়িত হয়েছে অনেকদিন হল। ২০০১ সালে যেদিন অস্ট্রেলিয়ার সর্বনাশ সম্পূর্ণ হল হরভজনের হ্যাটট্রিক আর রাহুল দ্রাবিড়-ভিভিএস লক্ষ্মণের যুগলবন্দিতে, সেদিন চৈত্র মাস। অবশ্য গত শতাব্দীতেই জৈষ্ঠ্যের প্রখর তপন তাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে ইডেন থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ জিতে নিয়ে গেছে অর্জুনা রণতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। ঠান্ডা পানীয়ের কোম্পানি টুর্নামেন্টের টাইটেল স্পনসর হলে যা হয়! এরপর আরও দুটো দশক কেটে গেছে। এখন খেলা হয় সারা বছর, আর ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে বড় উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রিমিয়ার লিগ– আইপিএল। তাই এবারও কাঠফাটা গরমে ইডেনে বসবে ক্রিকেটের আসর– আইপিএল প্লে অফ।

শুধু মরশুম নয়, খেলাটাও বদলে গেছে বিস্তর, আবিশ্ব। সারা বছর ক্রিকেটের যুগে বিশ্রামের সময় নেই, গতি আসবে কোথা থেকে? অতএব, এখন চাহিদা আস্তে বল করতে পারা জোরে বোলারের। স্লোয়ার, চেঞ্জ অফ পেস ইত্যাদি বাহারি নামের মন্থরতা আবিষ্কৃত হয়েছে। স্পিন শিল্পে শান দিয়ে আরও ধারালো হয়ে ওঠারও সময় নেই। তাই চাহিদা জোরে বল করতে পারা স্পিনারের, যার বল সাধারণত সোজা যাবে, ঘুরলেই রহস্য তৈরি হবে। শুধু কি তাই? এখন ক্রিকেট খেললে গ্লেন ম্যাকগ্রা, কোর্টনি ওয়ালশ-রা বিশেষ পাত্তা পেতেন না। কারণ তাঁরা ব্যাট করতে পারতেন না একেবারেই। এখন প্যাট কামিন্সের মতো বোলারেরও ব্যাট হাতে ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা থাকা দরকার। সুনীল নারিনকেও ইনিংসের শুরুতে বা মিডল অর্ডারে চার-ছক্কা হাঁকাতে জানতে হয়। অর্থাৎ, অসামান্য বোলার বা ব্যাটারের চেয়ে মাঝারি মানের অলরাউন্ডার বেশি প্রার্থনীয়।

ফলে ক্রিকেটের আদি অকৃত্রিম সম্পদ– কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়া ফাস্ট বোলার, যে কোনও পরিবেশে বল দু’দিকে সুইং করানোর ক্ষমতাসম্পন্ন মিডিয়াম ফাস্ট বোলার, খাঁটি লেগ স্পিন বা অফ স্পিনের রহস্যে ব্যাটারদের নাজেহাল করে দেওয়া স্পিনার, নিখুঁত ডিফেন্সসম্পন্ন এবং ছবির মত কভার ড্রাইভ মারতে পারা ব্যাটাররা ডোডোপাখি হয়ে যাচ্ছেন। কেবল কুড়ি বিশের ক্রিকেটে নয়, পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে বা টেস্টেও তাঁদের পক্ষে দলে টিকে থাকা শক্ত হচ্ছে। বরং এইসব গুণ থাকা দোষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে অনেকের ক্ষেত্রে। ভুবনেশ্বর কুমারের মতো সুইং শিল্পীর যেমন টেস্ট কেরিয়ার বলে কিছু হলই না। কারণ প্রাক্তন ক্রিকেটার, ধারাভাষ্যকার, সাংবাদিক– সকলে সিদ্ধান্ত করে ফেললেন, এ সুইং সহায়ক পিচ ছাড়া সুবিধা করতে পারবে না। অথচ স্রেফ লম্বা, বেশি বাউন্স আদায় করতে পারেন– এই যুক্তিতে হাতে গোনা কয়েকটা বলার মতো পারফরম্যান্স নিয়েই একশো টেস্ট খেলে ফেললেন ইশান্ত শর্মা (জোরে বোলারদের মধ্যে একশোর বেশি টেস্ট খেলার পরেও উইকেট পিছু ৩২-এর বেশি গড় ইশান্ত ছাড়া কেবল জাক কালিসের, কিন্তু তিনি ব্যাট হাতে তেরো হাজার রানও করেছেন)। ব্যাট করতে পারেন বলে রবীন্দ্র জাদেজা টেস্টেও রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো প্রবল শক্তিধর এবং মেধাবী বোলারের জায়গা দখল করে রাখতে পেরেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ।

অর্থাৎ, ছোট ছোট মাঠে ঘণ্টায় ১৩০-১৪০ কিলোমিটার গতির বল আর দড়কচা ‘মিস্ট্রি’ স্পিনারদের বিরুদ্ধে পেশিবহুল ব্যাটারদের চার, ছক্কার বন্যা– এই হল আজকের ক্রিকেটোৎসব। যে দলের ব্যাটাররা ব্যর্থ হবেন, তাঁরা হারবেন। সেদিন প্রতিপক্ষের বোলারদের মনে হবে অসাধারণ, পরের দিনই হয়তো অতি সাধারণ দেখাবে। এই মরশুমে যাকে মনে হচ্ছে জিনিয়াস, পরের মরশুমেই সে ভিড়ে হারিয়ে যাবে। নামটা স্বপ্নিল অসনোদকর, পল ভালথাটি, মনপ্রীত গোনি, বরুণ চক্রবর্তী– যা খুশি হতে পারে। এমনকী, রতিতেও ক্লান্তি আসে, আর এই জিনিস দিনের পর দিন দেখতে হলে ক্লান্তি আসবে না? লাইভ সম্প্রচারের জাঁকজমক যাই-ই প্রমাণ করার চেষ্টা করুক, আইপিএল দেখতে দেখতেও দর্শকের ক্লান্তি আসে। সম্প্রচারকারী, বিজ্ঞাপনদাতা এবং আইপিএল কর্তৃপক্ষ সে কথা বিলক্ষণ জানে। তাই এবারের আইপিএলে প্রত্যেক ম্যাচে যত্ন করে দেখানো হচ্ছে, ম্যাচের দ্রুততম বলটা কে করল। সেই বোলারের জন্য এক লক্ষ টাকা পুরস্কারও থাকছে। বারবার কে পাচ্ছেন সেই পুরস্কার? ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কেউ নন, কোনো অস্ট্রেলিয়ানও নন, এমনকী নিউজিল্যান্ডের লকি ফার্গুসনও নন। পরপর ছ’টা ম্যাচে এই পুরস্কার পেয়েছেন সানরাইজার্স হায়দরাবাদের উমরান মালিক।

আগেই বলেছি, বিশ্ব ক্রিকেটে এখন যথার্থ ফাস্ট বোলার, অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে যে কোনো পিচে গড়ে ৯০ মাইলের (প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার) বেশি গতিতে বল করতে পারেন এরকম বোলার বিরল। নিজেদের সেরা দিনে যশপ্রীত বুমরা আর মহম্মদ শামি পৌঁছে যান ওই গতিতে। মাঝে মাঝে নতুন বলে মিচেল স্টার্ক আর কামিন্সও পারেন। উমরান কিন্তু নিয়মিত ওই গতিতে বল করছেন, ১৫০ কিলোমিটারের গণ্ডিও পেরিয়ে যাচ্ছেন প্রায়ই। উমরানের মন্থরতম বলটাও ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটারের আশপাশে থাকে। মুম্বইয়ের প্রবল গরমে এত জোরে বল করছেন কী করে? বিস্মিত হর্ষ ভোগলের এই প্রশ্নের উত্তরে উমরান বলেছেন, আমাদের জম্মুতে তো প্রচণ্ড গরমেও খেলি। ওতে কষ্ট হয় না, বরং মজা লাগে। কিন্তু গতিই শেষ কথা নয়। নইলে ব্রেট লি আর শন টেটের তফাত থাকত না। বলের লাইন, লেংথ ঠিক না থাকলে গতিময় বোলিংয়ে কোনও লাভ হয় না। উমরানের সেখানেও ভুল নেই। নেই বলেই রবিবার (১৭ এপ্রিল) পাঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে শেষ ওভারে একটাও রান না দিয়ে তুলে নিতে পেরেছেন তিন-তিনটে উইকেট, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথমবার। ওই ম্যাচের চার উইকেট নিয়ে আইপিএলে ছ’টা ম্যাচ খেলে ন’টা উইকেট নেওয়া হয়ে গেল।

কিন্তু উমরানের আসল প্রভাব পরিসংখ্যানে ধরা পড়েনি। সত্যিকারের ফাস্ট বোলিং যা করে তার সবটা কখনওই স্কোরবোর্ডে ধরা পড়ে না। ২০১৩-‘১৪ অ্যাশেজ সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে মিচেল জনসন ইংল্যান্ডের কী অবস্থা করেছিলেন, তা কেবল পাঁচ টেস্টে ৩৭টা উইকেট নেওয়ার তথ্য থেকে বোঝা যাবে না। ওই বোলিং দেখলে তবেই বোঝা যায়, ইংল্যান্ডের ব্যাটাররা কেমন মরার আগেই মরে বসে থাকতেন জনসনাতঙ্কে। কেভিন পিটারসেনের মতো বড় ব্যাটার কেমন ছেলেমানুষের মতো আক্রমণাত্মক খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়েছেন, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ক্লাইভ লয়েডের পেস চতুষ্টয়ের কোনও স্পেল দেখুন ইউটিউবে, জেফ থমসনের বোলিং দেখুন, বা কার্টলি অ্যামব্রোসের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এক রান দিয়ে সাত উইকেট তুলে নেওয়া দেখুন। ইডেন উদ্যানে তখনও অখ্যাত শোয়েব আখতারের পরপর দু’বলে রাহুল আর শচীন তেণ্ডুলকরকে আউট করা ফিরে দেখুন। পয়লা বৈশাখ সন্ধ্যায় উমরান কলকাতা নাইট রাইডার্স অধিনায়ক শ্রেয়স আয়ারকে বোল্ড করার পর ছেলেমানুষের মতো উল্লাস করছিলেন যিনি, সেই ডেল স্টেইনের বোলিংয়ের ভিডিও দেখুন। বুঝতে পারবেন ভয়ংকর সুন্দর কাকে বলে। এমন সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন, আর এই নেশা ধরানো সৌন্দর্যেরই মালিক উমরান।

আরও পড়ুন বেলা ফুরোতে আর বসে রইলেন না শেন ওয়ার্ন

তিনি আইপিএলের চার, ছক্কায় ঝলমলে সন্ধেবেলায় ব্যাটারদের প্রাগৈতিহাসিক জঙ্গলে প্রাণ হাতে করে বাঁচা তৃণভোজীদের স্তরে নামিয়ে আনতে পারেন। কেকেআর ম্যাচে শ্রেয়স আর আন্দ্রে রাসেলের বিরুদ্ধে তাঁর বোলিং যে কোনও ক্রিকেট-রসিকের চোখে লেগে থাকবে। শ্রেয়স বারবার লেগের দিকে সরে গিয়ে উমরানকে খেলার চেষ্টা করছিলেন। অফসাইডে সীমানার কাছাকাছি একাধিক ফিল্ডার থাকা সত্ত্বেও এই কৌশল কেন, তা ধারাভাষ্যকাররা বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সম্ভবত, বোর্ডের সঙ্গে চুক্তিই তাঁদের বুঝতে দিচ্ছিল না। কারণ পাড়ার মাঠে টেনিস বলে ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা থাকলেও বোঝা যায় ওটা কৌশল ছিল না, ছিল আত্মরক্ষার তাগিদ। একনাগাড়ে সামান্য শর্টপিচ বল করে ব্যাটারকে ওভাবে কুঁকড়ে দিয়ে, তারপর ইয়র্কারে বোল্ড করে দিতে আমরা দেখেছি ওয়াকার ইউনিসকে। রোমাঞ্চিত হয়েছি। এই রোমাঞ্চ গত দশ বছরে বিশ্ব ক্রিকেট থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে। এখনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না খেলা উমরান সেই রোমাঞ্চ ফিরিয়ে দিচ্ছেন আইপিএলের মঞ্চে।

ওই গতি দর্শককে রোমাঞ্চিত করে, ক্রিকেট দেখার সাবেকি আনন্দ ফিরিয়ে আনে। কিন্তু খেলাটার জন্য কী করে? মাঝারিয়ানাকে উলঙ্গ করে দেয়, খুব ভাল ক্রিকেটার আর মহান ক্রিকেটারের তফাত গড়ে দেয়। পৃথিবীজুড়ে চার, ছয় মেরে বেড়িয়ে ভূয়সী প্রশংসা পাওয়া রাসেল যেমন শুক্রবার ওই একটি ওভারে টের পেয়ে গেলেন তিনি ভিভ রিচার্ডস তো দূরের কথা, গর্ডন গ্রিনিজেরও যোগ্য উত্তরসূরি নন। ব্যাটে-বলে করতেই বিস্তর ঝামেলায় পড়লেন, একটা বাউন্সারে তো মাথা বাঁচাতে একেবারে শুয়ে পড়তে হল। উমরান হাসলেন।

কুড়ি বিশের ক্রিকেটের মুশকিল হলো, উমরানের সৌন্দর্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার উপায় নেই। মাত্র চব্বিশটা বল, তার ওপর সীমানা এত ছোট করা আছে যে চোখ বুজে ব্যাট ছোঁয়াতে পারলেও এক-আধটা ছয় হয়ে যায়। এখন অবধি মাত্র তিনটে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা উমরান দিনে ১৫-২০ ওভার বল করলেও এই গতি বজায় থাকবে কি না, তা ভবিষ্যৎ বলবে। উমরানের আগুনে সৌন্দর্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিপক্ষ ব্যাটারদের দগ্ধ করবে কি না, সে আলোচনাও এখন থাক। আপাতত জম্মুর ছেলের শ্বাসরোধকারী সৌন্দর্য চেটেপুটে উপভোগ করে নিন। যৌবন আর গতি, দুটোই হারিয়ে যায়। বিশেষত জম্মু, কাশ্মীরের যৌবন আগলে বসে থাকা যায় না।

ঋণ: সাহেবদের থেকে শেখা খেলা দেখার অভিজ্ঞতাকে বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অধ্যাপক অভীক মজুমদারের এক সাম্প্রতিক উত্তর-সম্পাদকীয় প্রবন্ধের প্ররোচনায়। দেখা গেল তাতে ভাষাটা বেশি কাব্যিক হল। উমরানের ক্রিকেট কাব্যময়।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

বাংলা মাধ্যম ও বাংলা বিপন্ন, কিন্তু রেডিও জকির হাতে নয়

অভিজ্ঞতাকে যুক্তি হিসাবে খাড়া করায় যাদের আপত্তি আছে, তাদের এ লেখা না পড়াই ভাল। কারণ দর্শন বলে একটা বিষয় সারা পৃথিবীতে পড়ানো হয়। জ্ঞান কী করে আহরণ করা যায়, বা সহজ করে বললে, সত্য জানার উপায় কী, তা দর্শনের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। নানা দার্শনিক ঘরানা এ নিয়ে নানা কথা বললেও কেউই সত্য জানার উপায় হিসাবে অভিজ্ঞতাকে একেবারে অগ্রাহ্য করে না। কিন্তু দর্শন-টর্শন, মাননীয়া রেডিও জকি অয়ন্তিকা ফেসবুক লাইভে যাদের আঁতেল বলেছেন, তাদের বিষয়। কারণ দর্শন নিয়ে গবেষণা করে কর্পোরেটে চাকরি পাওয়া যায় না। দর্শনের ছাত্রছাত্রীরা বিলক্ষণ কর্পোরেটের চাকরি পেতে পারে এবং পায়, কিন্তু তা অন্য কোনো পারদর্শিতার জন্য। উপরন্তু কেবল অয়ন্তিকার সমর্থকরাই যে দর্শনকে আঁতেল ব্যাপার মনে করেন তা নয়, যাঁরা তাঁর বিপক্ষে তাঁরাও দর্শন-ফর্শনের ধার ধারেন না। কিন্তু বর্তমান লেখকের তাতে বয়ে গেছে। সোশাল মিডিয়ার দস্তুর মেনে অয়ন্তিকার পক্ষে বা বিপক্ষে মুচমুচে কথা লিখে চটজলদি লাইক কুড়োনো এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। অয়ন্তিকা যা বলেছেন তার মধ্যে সার কিছু আছে কি, না সবটাই ঘুঁটে? যতটা ঘুঁটে তা দিয়ে উনুন জ্বালানো চলবে কি, নাকি ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে? সেসব তলিয়ে দেখাই এ লেখার উদ্দেশ্য।

যাঁরা অয়ন্তিকার বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত, তাঁদের অনেকের অনেক যুক্তিপূর্ণ মন্তব্য দেখলাম। কিন্তু একটা কথা চোখে পড়ল না। মাননীয়াকে কেউই ধরিয়ে দিচ্ছেন না, যে কর্পোরেটের চাকরি না পেলেই শিক্ষা বৃথা – এর চেয়ে বড় ভুল ধারণা আর হয় না। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য জগতকে জানা, জীবিকা অর্জন করা নয় – রচনাবই মুখস্থ করা এরকম কোনো বক্তব্য রাখছি না। এই চূড়ান্ত বেসরকারিকরণের যুগেও কর্পোরেটের চাকরি নয়, এরকম কত চাকরি আছে নিজেই একবার ভেবে দেখুন। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরের আমলারা কি কর্পোরেটের চাকরি করেন? একেবারে উচ্চপদস্থদের বাদ দিলে, আমলাদের মাইনেপত্তর, অন্যান্য সুযোগসুবিধা কিন্তু এখনো ভারতে যারা বহুজাতিকের চাকরি করে তাদের সমান বা তার চেয়েও ভাল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীরাও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কর্পোরেটের চাকুরে ছিলেন না। তাঁদের লেখাপড়া কি বৃথা গিয়েছে? ডাক্তার, নার্সরা অনেকেই কর্পোরেটের চাকুরে নন। বস্তুত কর্পোরেট হাসপাতালে যে ডাক্তারদের আমরা দেখাই, তাঁরা অনেকেই আসলে সরকারি হাসপাতালে চাকুরিরত। সেই পরিচয়ের কারণে, সেখানে অর্জিত সুনামের ফলেই কর্পোরেট হাসপাতালের মালিকরা ওঁদের নিজের হাসপাতালে নিয়ে যান। অনেক ডাক্তার আবার হাজার পীড়াপীড়ি করলেও যান না। যাঁরা পুলিসে চাকরি করেন তাঁরাও কর্পোরেটের চাকুরে নন, সেনাবাহিনীর লোকেরা তো ননই। স্বাধীনোত্তর ভারতে সম্ভবত সাংবাদিকতাই একমাত্র ক্ষেত্র, যেখানে দূরদর্শন আর অল ইন্ডিয়া রেডিও বাদ দিলে পুরোটাই কর্পোরেটের হাতে (কর্পোরেট শব্দটা যদিও তুলনায় নবীন, আগে প্রাইভেট সেক্টর বা বেসরকারি ক্ষেত্র বলা হত) ছিল। সেই ক্ষেত্রের চেহারাও বদলাচ্ছে, যদিও গতি এখনো মন্থর। ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা’ বলে অশ্রুতপূর্ব একটা কথা উঠে এসেছে, বিশাল কর্পোরেট হাউসের বাইরে ছোট ছোট ওয়েবসাইট, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সাংবাদিকতার পরিসর গড়ে উঠছে। আগামীদিনে সাংবাদিকতার চাকরির জন্যও হয়ত সেগুলোর দিকে যেতে হবে ছেলেমেয়েদের।

সুতরাং বাংলা মাধ্যমে পড়লে কর্পোরেটের চাকরি পাওয়া যাবে না, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে – এই কথাটা আসলে পারিবারিক হোয়াটস্যাপ গ্রুপ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত বন্ধুদের সমসত্ত্ব জনগোষ্ঠীর মতামত, তার বেশি কিছু নয়। তাছাড়া সবাই চাকরি করবেই বা কেন? কেউ খেলোয়াড় হতে পারে। শুধু ক্রিকেট নয়, যত দিন যাচ্ছে এ দেশে অন্য খেলাধুলোতেও রোজগারের পরিমাণ বাড়ছে। কেউ অভিনেতা হবে, কেউ গায়ক বা বাজিয়ে হবে। সকলেরই চোস্ত ইংরেজি বলার দরকার পড়বে কি? কল্পনা করুন, একটি বাঙালি ছেলে শতরান করেছে আর অয়ন্তিকার মত কোনো ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ধারাভাষ্যকার নাক সিঁটকে বলছেন “ভাল করে ইংরেজি বলতে পারে না বলে দ্বিশতরান করতে পারল না।” বা ধরুন একটি মেয়ে চমৎকার গান গায়। বলিউডে অডিশন দিতে গেল, ইংরেজি মাধ্যমে পড়া এক সঙ্গীত পরিচালক বললেন “ইংরেজিটা ঠিক বলতে পারে না তো, তাই সা থেকে পা-তে পৌঁছতে পারছে না।”

হাসছেন তো? হাসবেন না। কোনো ধারাভাষ্যকার এত বোকা নন, কোনো সঙ্গীত পরিচালকও এত মূর্খ নন। তাঁরা পেশাদার লোক, যোগ্যতার দাম দিতে জানেন। ফলে এমনটা কখনো ঘটবে না। কিন্তু ইংরেজি জানা (কেবল ইংরেজি মাধ্যমে পড়া নয়) বাঙালি এভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত, অর্থাৎ ভাল ইংরেজি বলতে পারা আলাদা একটা যোগ্যতা বলে ভাবতে অভ্যস্ত। অয়ন্তিকা যা বলেছেন সেই অভ্যাস থেকেই বলেছেন। বিতর্ক তৈরি হওয়ায় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে তিনি যে দীর্ঘ ফেসবুক লাইভ করেছেন সেখানে এই ভাবনাটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে। তিনি বেশ জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলা মাধ্যমে পড়ে যারা ভাল করে ইংরেজি বলতে পারে না, তারা নির্ঘাত হীনমন্যতায় ভোগে।

কথাটা ঠিক। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া অনেকেও যে জঘন্য ইংরেজি বলে, কেবল টের পায় না যে ভুলভাল বলছে, সে কথা থাক। কিন্তু বিভিন্ন পেশায় দারুণ সফল অনেককেই চিনি যারা এই হীনমন্যতায় ভুগছে। কদিন আগেই আমার মত বাংলা মাধ্যমে পড়া এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে কথা হল। সে-ও বলল, মনে হয় আরও উন্নতি করতে পারতাম গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলতে পারলে। এই হীনমন্যতার কারণ কী? কারণ অন্য বাঙালিরা। আমি কাজ করতাম ইংরেজি কাগজে, বেশকিছু আন্তর্জাতিক ম্যাচের প্রতিবেদন লেখার সুযোগ পেয়েছি। লক্ষ করেছি, সাংবাদিক সম্মেলনে সব রাজ্যের আঞ্চলিক ভাষার সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরাই ইংরেজিতে প্রশ্ন করতে গিয়ে হোঁচট খান। উত্তর ভারতীয়রা সেই কারণে সাধারণত হিন্দিতে প্রশ্ন করেন বা হিন্দি মিশিয়ে বলেন। দক্ষিণ ভারতের অনেকে আবার হিন্দিতেও সড়গড় নন। তাঁরা কিন্তু বুক ফুলিয়ে যেমন ইংরেজি আসে, তেমন ইংরেজিতেই প্রশ্ন করেন। বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব যিনি উত্তর দেবেন তাঁর বা দায়িত্বপ্রাপ্ত মিডিয়া ম্যানেজারের। ইংরেজিটা নেহাত দুর্বোধ্য হলে ওই সাংবাদিকের রাজ্যের ভাল ইংরেজি জানা অন্য সাংবাদিকরা দেখেছি সাহায্য করেন। মাতৃভাষায় প্রশ্নটা জেনে নিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করে বলে দেন। অথচ কলকাতার বাংলা কাগজ, চ্যানেলের সাংবাদিকদের কাউকে কাউকে দেখেছি ইংরেজি বলতে গিয়ে দরদর করে ঘামছেন। যাঁরা ফরসা তাঁদের মুখচোখ লাল হয়ে যেতে দেখেছি। কারণটা আর কিছুই নয়। উনি জানেন ওঁকে নিয়ে পরে হাসাহাসি করবে ওঁর নিজের শহরের সাংবাদিকরাই। হাতে গোনা দু-একজন ভাল ইংরেজি বলা সাংবাদিক সাহায্য করেন, বাকিরা জুলজুল করে তাকিয়ে থেকে সান্ধ্য মদ্যপানের আসরের হাসির খোরাক সংগ্রহ করেন। কারণ তাঁরাও অয়ন্তিকার দলে। মনে করেন কে কত ভাল ইংরেজি বলে তা দিয়ে প্রমাণ হয় কে কত ভাল সাংবাদিক। কলকাতার এক বহুল প্রচারিত বাংলা কাগজের ক্রীড়া সম্পাদক তো এই সেদিনও বলে বেড়াতেন, তাঁর ভাল বাংলা জানা তরুণ সাংবাদিক দরকার নেই। দরকার ভাল ইংরেজি বলতে পারা সাংবাদিক। সে কাগজের প্রতিবেদনের মান এবং ভাষার মান পাল্লা দিয়ে নেমেছে।

পৃথিবীর কটা জাতি ভাল ইংরেজি বলতে পারা আলাদা যোগ্যতা মনে করে সন্দেহ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করতে যাওয়া এক বন্ধুর মুখে শুনেছিলাম, প্রথম দিকে টক দিতে উঠে সে ঘেমে নেয়ে যেত। তারপর তার রিসার্চ গাইড, যাঁর মাতৃভাষা ইংরেজি, একদিন জিজ্ঞেস করেন, তুমি তো যথেষ্ট ভাল ফিজিক্স জানো। বলতে গিয়ে অত ঘাবড়ে যাও কেন? সে উত্তরে জানায়, ইংরেজিটা ভুলভাল হয়ে যায় যদি? ভয় লাগে। তিনি তখন তাকে বলেন, ইংরেজি তোমার মাতৃভাষা নয়। তোমাকে আমরা নিয়েছি পদার্থবিদ্যার জন্যে, ইংরেজির জন্যে তো নয়। ও নিয়ে অত ভেবো না, কাজ চালিয়ে নিলেই হল। বাঙালি অধ্যাপক হলে ও কথা বলতেন না বোধহয়। আমার তো ইদানীং সন্দেহ হয়, সত্যজিৎ রায়ের ইংরেজি উচ্চারণ সাহেবদের মত না হলে বাঙালি বোধহয় তাঁকে বড় পরিচালক বলে মানত না।

এবার অন্য দিকটা দেখা যাক। অয়ন্তিকার বিরোধিতায় বাংলা মাধ্যমে পড়া জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল, এমনকি কর্পোরেট চাকরিতেই বহুদূর উঠেছেন এমন অনেক মানুষকে মুখ খুলতে দেখা গেছে। এটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। মাননীয়ার কথায় যে যুক্তির য আর মেধার ম নেই সে তো আগেই বললাম। নিজের পিঠ বাঁচাতে যিনি বাংলাপক্ষের বাংলায় বাঙালিদের জন্য কাজ সংরক্ষণের দাবিকে সমর্থন করেন, তাঁর যুক্তিবোধ নিয়ে আর শব্দ খরচ করব না। কিন্তু কথা হল এই যে এত বাংলাপ্রেমী ও বাংলা মাধ্যমপ্রেমীর দেখা পাওয়া গেছে, এঁদের অনেকের প্রেমই যে দুষ্মন্তের শকুন্তলার প্রতি প্রেমের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানে অভিজ্ঞানটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিজে পড়েছেন বাংলা মাধ্যমে, তার জন্যে কোথাও হোঁচট খেতেও হয়নি। কিন্তু নিজের সন্তানকে পড়াচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যমে। শুধু কি তাই? সন্তানের দ্বিতীয় ভাষা করেছেন হিন্দি। ছেলের ইংরেজি ও হিন্দি শিক্ষায় কোনো ছিদ্র দিয়ে যাতে বাংলা ঢুকতে না পারে, সে জন্য টিভিতে বাংলা অনুষ্ঠান দেখাও নিষিদ্ধ – এমন বাড়ি মফস্বলেও হয়েছে আজকাল। অয়ন্তিকা জনপ্রিয় এফ এম চ্যানেলে কাজ করেন। মুখের ভাষা শুনলেই বোঝা যায় বাংলা কোনোদিন ঠিক করে শেখেননি, তার জন্যে কিঞ্চিৎ গর্বও আছে। তা সত্ত্বেও ভাঙব তবু মচকাব না ফেসবুক লাইভটি করতে হল কেন? বাজারের চাপ। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বাজার সমীক্ষা করে থাকেন, ফলে জানেন এফ এম চ্যানেলের শ্রোতাদের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গের মফস্বল ও গ্রামের বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা মানুষজন, বিশেষ করে অল্পবয়সীরা। তারা শোনে কিন্তু হিন্দি গান, নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময়ে ইংরেজি, হিন্দি মিশিয়েই কথা বলে। কারণ ওই খিচুড়ি ভাষা না বললে গ্রামের বন্ধুরাও গাঁইয়া ভাববে। এরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে না, কারণ পড়ার সুযোগ পায় না। হয় বাবা-মায়ের সে সামর্থ্য নেই, নয় এলাকায় তেমন স্কুল নেই। এদের চটিয়ে ফেললে এফ এম চ্যানেলের সমূহ ক্ষতি। আর জে ভদ্রমহিলা ইংরেজি মাধ্যমে পড়েও এমনই অশিক্ষিত, অভব্য যে জানেন না, মানুষকে তার দুর্বলতা নিয়ে খোঁচা দিতে নেই। সেই অভব্যতার দায় চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নেবেন কেন? জবাবদিহির আসল কারণ বোধহয় সেইটা।

এখান থেকেই তাহলে এসে গেল পরবর্তী প্রশ্নগুলো। ১) বাংলা মাধ্যমে পড়া পেশাগতভাবে সফল বাবা-মা ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চান কেন? ২) যারা বাংলা মাধ্যমে পড়ে তারাও অনেকে নিজেদের ইংরেজি মাধ্যমের মত করে তুলতে চায় কেন?

এসবের একটা কারণ অবশ্যই ইংরেজি বলার ক্ষমতাকে অকারণ গুরুত্ব দেওয়া, ইংরেজি শিখতে চাওয়া নয়। কারণ কোনো ভাষা শিখতে হলে সব বিষয় সেই ভাষাতেই পড়তে হয়, নইলে শেখা যায় না – এমনটা পৃথিবীর কোথাও প্রমাণ হয়নি। তাছাড়া যে কোনো বাঙালি বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করুন, ইংলিশ মিডিয়ামে কেন পড়ান? উত্তর আসে, আজকালকার দিনে তো ইংলিশটা বলতে না পারলে হবে না। অর্থাৎ ইংরেজি শেখা নয়, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল বেশি ভাল করে শেখা যায় বলেও নয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করা শুধু ইংরেজি বলতে শেখার জন্য। মানে স্কুলটা মূলত স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস। একই যুক্তিতে আজকাল হিন্দিকে বাঙালি শিশুর দ্বিতীয় ভাষা করা হচ্ছে। ভারতের অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলোর মধ্যে মহারাষ্ট্র ছাড়া সবই দক্ষিণে, অথচ বাঙালির নাকি হিন্দি বলতে না পারলে চাকরি হবে না। কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ হলে ভাবনা ছিল না।

কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে এ রাজ্যে বরাবর বাংলা মাধ্যম স্কুল মানে সরকারি স্কুল (সরকারপোষিত স্কুলগুলো সমেত), আর ইংরেজি মাধ্যম স্কুল মানে বেসরকারি স্কুল। ইংলিশটা বলতে না পারলে হবে না – এই যুক্তিতে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দেওয়া বরাবর ছিল। কিন্তু গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকেও, বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ছেলেমেয়েকে পড়তে পাঠানো এক ধরনের বিলাসিতা, সরকারি স্কুলে দিব্যি পড়াশোনা হয় – এই ধারণা চালু ছিল। ফলে এখন যারা বাবা-মা, তাদের বাবা-মায়েরা অনেকেই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েকে সরকারি স্কুলেই পড়িয়েছেন। ছবিটা এই শতকের শুরু থেকে বদলাতে বদলাতে এখন এমন হয়েছে, যে অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলেমেয়েরা প্রায় কেউই আর সরকারি স্কুলে পড়ে না। কলকাতা থেকে মাত্র ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের নবগ্রাম। এখানকার সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে বড় ছেলেদের স্কুলের এক প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক বছর পাঁচেক আগে আমাকে সখেদে বলেছিলেন, আগে আমাদের স্কুলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার, ব্যবসাদার, মুচি, মেথর – সবার ছেলেই পড়ত। এখন শুধু রিকশাওলা, দিনমজুর, মেছো, কশাইদের ছেলেরা পড়ে। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত আর নেই।

কেনই বা থাকবে? একে তো আর সবকিছুর মত স্কুলও ঝাঁ চকচকে না হলে সেখানে পড়াশোনা হয় না, এমন ধারণা বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং পরিকাঠামোর দিক থেকে অনেক সরকারি স্কুলই পিছিয়ে ছিল সেইসময়। উপরন্তু নব্বইয়ের দশক থেকেই স্কুলের পড়াশোনার মান কমাতে বিরাট ভূমিকা নিয়েছে প্রাইভেট টিউশন। সকালে স্কুল যাওয়ার আগে পর্যন্ত এবং বিকেলে স্কুল থেকে ফিরেই ঘরের বাইরে চটির পাহাড় জমিয়ে প্রাইভেট পড়াচ্ছেন সরকারি স্কুলের মাস্টারমশাই, আর স্কুলে গিয়ে অকাতরে ঝিমোচ্ছেন – এ জিনিস আমরা অনেকেই দেখেছি। স্কুলশিক্ষকদের এই সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা এই শতাব্দীর শুরুতে এমন ফুলে ফেঁপে উঠেছিল এবং এতরকম দুর্নীতির জন্ম দিয়েছিল যে ২০০১-০২ আর্থিক বর্ষের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত ঘোষণা করেছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক, অধ্যাপকদের প্রাইভেট টিউশন করা চলবে না। তা নিয়ে শিক্ষকদের সংগঠনগুলো এবং অভিভাবক, ছাত্রছাত্রীদের প্রবল দুশ্চিন্তা ও আপত্তি নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। শেষপর্যন্ত বামফ্রন্ট সরকার ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে উঠতে পারেনি। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছিল প্রাইভেট টিউশন। হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা। অর্থাৎ ব্যাঙের ছাতার মত বিপুল সংখ্যক ঝলমলে বেসরকারি স্কুল।

বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি স্কুলে পড়াশোনার হাল কেমন তা শিক্ষক, শিক্ষিকাদের সাথে কথা বললেই জানা যায়। ক্লাস পিছু ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বরাবরই অসুবিধাজনক ছিল, এ আমলে আবার স্কুলে নিয়োগেও প্রায় দাঁড়ি পড়ে গেছে। রাজ্যে যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব নেই, কিন্তু তাঁরা হয় আদালত চত্বরে পড়ে আছেন, নয় অনশন করছেন কোথাও। কপাল নিতান্ত মন্দ হলে পুলিসের লাঠি, জলকামান হজম করছেন, মরেও যাচ্ছেন কেউ কেউ। যাঁরা স্কুলে আছেন তাঁরা কেবল পড়াবেন আর পরীক্ষা নেবেন, খাতা দেখবেন তার জো নেই। অশিক্ষক কর্মী নিয়োগও অনিয়মিত, ফলে তাদের কাজ ঘাড়ে চাপছে, তার উপর সরকারি প্রকল্পের করণিকও হয়ে উঠতে হবে। শিক্ষাবর্ষে ক্লাসের চেয়ে বেশি সময় যাচ্ছে এই শ্রী, ওই শ্রী, সেই শ্রীর হিসাব রাখতে। গরীব সরকার ওসব কাজের জন্য আলাদা লোক রাখতে পারেন না। মাধ্যমিকের প্রশ্ন ফাঁস না হলে খবর হচ্ছে। কোনো স্কুলে প্রধান শিক্ষক বা টিচার ইন চার্জ জমিদারি কায়েম করে নিয়োগ আটকে দিচ্ছেন। এমন গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম হয়েছে যে নিয়োগ সংক্রান্ত কেসের বিচারপতি তাঁর রায়ের উপর বারবার স্থগিতাদেশ দেওয়া হচ্ছে বলে ডিভিশন বেঞ্চের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট আর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে নালিশ করছেন।

এত ডামাডোল দেখেও কোন বাবা-মা ছেলেমেয়েকে সরকারি স্কুলে পড়তে পাঠাবেন? মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা ভুক্তভোগী। তাই তাঁরাও নিজেদের ছেলেমেয়েদের বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যমে দিচ্ছেন। সরকারের পোয়া বারো। বহু স্কুল ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, সেগুলোকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা খাতে খরচ আরও কমিয়ে ফেলা যাচ্ছে, ভবিষ্যতের কত খরচ বেঁচে যাচ্ছে ভাবুন। তবে মাঝে মাঝে দেখানো দরকার যে সরকার স্কুলগুলোকে নিয়ে ভাবেন। তাই কিছু সরকারি স্কুলকে ইংরেজি মাধ্যম করে দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে হয়ত আরও হবে। এর পাশাপাশি আছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়। কেবল অয়ন্তিকাকে গাল পেড়ে বাংলা মাধ্যমের মান থাকবে?

ভারতের মত বহুভাষিক দেশে কেবল নিজের মাতৃভাষা শিখলে যে চলে না, তা ঠিকই। কিন্তু নিজের ভাষার বারোটা পাঁচ বাজিয়ে দেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। তার প্রমাণ তামিল, মালয়ালম, কন্নড় ভাষাভাষীরা। আজকের ভারতে কোনো বিষয়েই তারা অন্য রাজ্যের লোকেদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। শিল্প, সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞানে বাঙালিদের চেয়ে ঢের এগিয়ে। দুঃখের বিষয় খিচুড়ি ভাষায় কথা না বলেও তারা দিব্যি ইংরেজি আয়ত্ত করে ফেলছে। আর বাঙালি কর্পোরেটের চাকুরে হয়ে উঠতে এত ব্যস্ত যে একসময় বাঙালি পণ্ডিতদের যা বৈশিষ্ট্য ছিল, বাংলা ও ইংরেজিতে সমান মুনশিয়ানা, তা লুপ্তপ্রায়। এখন বাঙালির ভাষা চৌরঙ্গী ছবির স্যাটা বোসকে মনে পড়ায়। বাংলা শেক্সপিয়রের মত, ইংরেজি তুলসীদাসের মত আর হিন্দি রবীন্দ্রনাথের মত। মাননীয়া রেডিও জকির মত লেখাপড়া জানা কূপমণ্ডূক বাঙালি মনে করে হিন্দি, ইংরেজি ছাড়া বাংলা বলে আঁতেলরা। সে বাংলা বঙ্কিমচন্দ্রের। আর খিস্তি হল নবারুণ ভট্টাচার্যের বাংলা। কিন্তু কেবল এফ এমের আর জে নয়, আজকাল সাহিত্যিকরাও খিচুড়ি ভাষাই ব্যবহার করেন। কবিতা পত্রিকায় ওই ভাষায় বাংলা কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ লেখা হয়। কদিন আগে বাংলা ভাষার এক ফেসবুক কাঁপানো কবি খিচুড়ি ভাষায় নামকরণ করা এক অনুষ্ঠানের বিচারক হয়েছেন। সোশাল মিডিয়ায় এক বাঙালি মুসলমান যুবক তা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় কবির পাল্টা যুক্তি ছিল, আপনার নামটাই তো বাংলা নয়।

আর আপনি ভাবছেন বাংলা বিজেপি বা অয়ন্তিকার হাতে বিপন্ন?

নাগরিক ডট নেট-এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে

আরও পড়ুন

হিন্দির হাতে বাংলা বিপন্ন: বাঙালি কি নির্দোষ?

%d bloggers like this: