এক পুত্র আর এক পিতার গল্প বলি। প্রথম জনের বাবা খুন হয়েছিলেন গোরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ মানুষদের হাতে, দ্বিতীয় জনের ছেলে খুন হয়েছিল দাঙ্গাবাজদের হাতে। দ্বিতীয় জনকে আমরা সবাই চিনি — আসানসোলের নূরানী মসজিদের ইমাম ইমদাদুল রশিদি। প্রথম জনের নাম অভিষেক সিং। একবিংশ শতাব্দীতে শোকের আয়ু এক বছরও নয়। অতএব মনে করিয়ে দেওয়া যাক, অভিষেকের বাবা সুবোধ কুমার সিং ছিলেন উত্তরপ্রদেশ পুলিসের ইন্সপেক্টর, একসময় দাদরির আখলাক আহমেদের খুনের ঘটনার তদন্ত করছিলেন। ইমামের ছেলে সিবগাতুল্লা খুন হয়েছিল ২০১৮ মার্চের দাঙ্গায়, ওই বছরেরই ৩ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরের এক অঞ্চলে একটি গরুর মৃতদেহ নিয়ে গোহত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে জনতা উন্মত্ত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে সুবোধ গুলিবিদ্ধ হন। ইমাম রশিদিকে আমরা মনে রেখেছি দাঙ্গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পুত্রশোক অগ্রাহ্য করে হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীর বার্তা দেওয়ার জন্য। মুসলমানদের দিক থেকে বদলা নেওয়ার চেষ্টা হলে আসানসোল ত্যাগ করবেন বলার জন্য। সুবোধপুত্র অভিষেকও পিতৃশোকের মাঝেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছিলেন, বলেছিলেন বাবা শিখিয়ে গেছেন হিন্দু মুসলমান আলাদা নয়। ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত। যেন এমন না হয় যে বহিঃশত্রুর দরকারই হল না, ভারতীয়রা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করে বসল।
কদিন হল ইমাম রশিদি আবার সংবাদের শিরোনামে এসেছেন পুত্র সিবগাতুল্লার খুনের মামলায় সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করার জন্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে এত বড় ত্যাগ দেখে প্রশংসার বন্যা বয়ে যাচ্ছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মনিরপেক্ষ আমরা আপ্লুত। এই তো আমাদের দেশ, ইমামের মত লোকেরাই তো আমাদের আশার আলো, ইত্যাদি বয়ানে সংবাদপত্রের প্রথম পাতা থেকে ফেসবুক ওয়াল পর্যন্ত সবই মুখরিত। একটি সংবাদপত্রে সরকারপক্ষের উকিলের বিবৃতিও বেরিয়েছে। তিনি বলেছেন চার দশকের বেশি ওকালতির অভিজ্ঞতায় কখনো কোনো মৃতের বাবাকে এমন অবস্থান নিতে দেখেননি। যদিও ইমাম সাহেবের এমন আচরণ মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। সিবগাতুল্লার হত্যার পরেই তিনি বলেছিলেন যে একজন হত্যাকারীকে ধরতে পেরেও ছেড়ে দিয়েছেন।
সুবোধ কুমারের ছেলে অভিষেক এবং পরিবারের বাকি সদস্যরা কিন্তু এত মহান নন। আর পাঁচটা খুনের মামলার মত করেই সে মামলা এগোচ্ছে। দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া কাগজের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, সুবোধের খুনে অভিযুক্ত ৪৪ জনের মধ্যে ৩৬ জনের বিরুদ্ধে পুলিস দেশদ্রোহ আইনে মামলা করার অধিকার পেয়েছে এ বছরের ১৬ মার্চ। শোনামাত্রই কেউ কেউ সিদ্ধান্ত করতে পারেন, যোগীর রাজ্যে ন্যায়বিচার হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা হল অভিযুক্তদের মধ্যে মাত্র ছজন জেলে আছে, বাকি সকলেই জামিনে বাইরে। প্রধান অভিযুক্ত বজরং দলের সদস্য যোগেশ রাজও শুরুতেই এলাহাবাদ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বাগড়া দেওয়ায় তার বেরিয়ে আসা হয়নি। বুলন্দশহরের পুলিস এফ আই আর করার সময়েই খুন, হিংসা এবং দেশদ্রোহিতার (সেকশন ১২৪এ) অভিযোগ এনেছিল। কিন্তু পরে আদালত শেষেরটি বাদ দেয়, কারণ রাজ্য সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন পাওয়া যায়নি। সে অনুমোদন পাওয়া যায় ২০১৯ সালের জুন মাসে। তারও প্রায় তিন বছর পরে বুলন্দশহর জেলা আদালত এই অভিযোগ অনুমোদন করেছে। অথচ সারা দেশে কয়েকশো মানুষ, যাঁদের একটা বড় অংশ মুসলমান, এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে কারাবাস করছেন। এদের মধ্যে সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান, ছাত্রনেতা উমর খালিদ, শার্জিল ইমাম আছেন। অশীতিপর ফাদার স্ট্যান স্বামী তো শুনানি ছাড়াই জেলের মধ্যে মারা গেলেন। পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত মানুষটির জন্য তাঁর আইনজীবীরা সামান্য জল খাওয়ার স্ট্রয়ের আবেদন করেও সফল হননি।
অথচ ভারতের বিচারব্যবস্থা কিন্তু অমানবিক নয়। এই তো গতকাল দিল্লির এক আদালত ওঙ্কারেশ্বর ঠাকুরকে জামিন দিয়েছে মানবিকতার কারণে। ওঙ্কারেশ্বর সুল্লি ডিলস বলে একটি অ্যাপ তৈরি করায় অভিযুক্ত, যে অ্যাপে মুসলমান মহিলাদের কাল্পনিক নিলাম করা হয়েছিল। বিচারক ওঙ্কারেশ্বরকে জামিন দিয়ে বলেছেন, অভিযুক্তের এটা প্রথম অপরাধ। তাকে দীর্ঘদিন আটকে রাখলে তার শরীর স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
এ তো পাতিয়ালা হাউস কোর্টের এক বিচারকের মন্তব্য। দেশের হাইকোর্টগুলো পর্যন্ত অত্যন্ত মানবিক। গত শনিবার দিল্লি হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর আর পরবেশ কুমারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতার (হেট স্পিচ) অভিযোগে দায়ের হওয়া পিটিশনের উত্তরে বলেছে, কোনো কথা হেসে বললে অপরাধ হয় না। তাছাড়া ভোটের সময়ে বিদ্বেষমূলক কথা বললেও ক্ষতি নেই।
অর্থাৎ ক্ষেত্র বিশেষে বিচারকরা অত্যন্ত উদার, অত্যন্ত মানবিক। তবে সব ক্ষেত্রে অতটা হওয়া যায় না। ইমাম সাহেবের মত লোকেদের, ভারতের সংখ্যালঘুদের এই তারতম্য বুঝে না নিয়ে উপায় নেই। বিশেষত আজকের ভারতে মহান হওয়া সংখ্যাগুরুর কাছে একটি বিকল্প, সংখ্যালঘুর একমাত্র উপায়। আমাদের মধ্যে যাদের ইমাম সাহেবের প্রশংসা করতে গিয়ে আবেগে গলা বুজে আসে, তারা বুঝতে পারি না যে তিনি ছেলের খুনিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে, তাদের শাস্তি হলে মুহূর্তে সোশাল মিডিয়ার সাহায্যে কেবল আসানসোল কেন, গোটা দেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়তে পারে। দ্যকাশ্মীর ফাইলস-এর চেয়েও দ্রুত প্রতিক্রিয়া হবে। এ দেশ এখন নরকের দক্ষিণ দুয়ারে পৌঁছে গেছে। এখানে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে গণহত্যার ডাক দেওয়া যায়, মুখে হাসিটি থাকলেই হল। এসব আমরা বুঝি না বলেই আসানসোল দাঙ্গার অগ্রণী নেতা বাবুল সুপ্রিয়র তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে দাঁড়ানোর বিরুদ্ধে ইমাম বিবৃতি দিলেন না বললে আমাদের গোঁসা হয়। আমরা কিছুতেই বোঝার চেষ্টা করি না, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের চোখের সামনে এখন এমন কোনো বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি নেই, যারা দাঙ্গার সময়ে তাঁদের ঢাল হয়ে উঠবে বলে ওঁরা আশা করতে পারেন। রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রীর উদ্দেশে “সকলি তোমারি ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি” গাওয়া ছাড়া ইমাম সাহেবদের সামনে কোনো পথ খোলা নেই। ধর্মনিরপেক্ষ সংখ্যাগুরুর সামাজিক নিষ্ক্রিয়তা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তাই তাঁদের বাধ্যতামূলক মহানতার একাকিত্বে বন্দি করেছে।
ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস বাংলাকে বাদ দিয়ে লেখা অসম্ভব। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস বাংলাকে বাদ দিয়ে অনায়াসে লেখা যেত। রেকর্ড বইয়ে সর্বোচ্চ রানের ওপেনিং জুটির তালিকার একেবারে শীর্ষে পঙ্কজ রায়ের নাম ছিল ঠিকই, কিন্তু রেকর্ড বই ইতিহাস নয়। একবিংশ শতাব্দীতে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলার পাকাপাকি জায়গা তৈরি করেছেন দুজন। একজন অবসর নেওয়ার দেড় দশক পরেও সারাক্ষণ সংবাদের শিরোনামে, বাঙালির নয়নের মণি। অর্থাৎ সৌরভ গাঙ্গুলি। অন্যজন কে, বাজি রেখে বলতে পারি, আপনি ভুরু কুঁচকে ভাবছেন।
এই শতাব্দীর প্রথম কয়েক বছরে ফিক্সিং কেলেঙ্কারির বিপর্যয় কাটিয়ে অধিনায়ক হিসাবে সৌরভ যখন ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস বদলে দিচ্ছিলেন, সেই সময়েই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চেন্নাইতে একটি একদিনের ম্যাচে ভারতের হয়ে খেলতে শুরু করেন ঝুলন গোস্বামী। সে বছরই টেস্ট অভিষেক। ঝুলনের শুরুটা সৌরভের মত সাড়া জাগানো হয়নি। প্রথম টেস্টে এই ডানহাতি জোরে বোলার কোনো উইকেট পাননি। কিন্তু গত কুড়ি বছর ধরে ভারতের মহিলা দলের প্রায় সমস্ত স্মরণীয় জয়ে ঝুলনের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ২০০৬ সালে ভারতীয় মহিলারা ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতেন। প্রথম টেস্টে লেস্টারে নৈশপ্রহরী হিসাবে ঝুলন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অর্ধশতরান করেন। আর টনটনের দ্বিতীয় টেস্টে তিনি একাই একশো। প্রথম ইনিংসে ৩৩ রানে পাঁচ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৫ রানে পাঁচ উইকেট। একদিনের ক্রিকেটে ঝুলন প্রকৃতপক্ষে একজন কিংবদন্তি। চলতি বিশ্বকাপে তিনি মহিলাদের বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হলেন, তারপরেই মেয়েদের একদিনের ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম বোলার হিসাবে ২৫০ উইকেটের মালিক হলেন।
যাঁরা মেয়েদের ক্রিকেটের খবর রাখেন তাঁরা জানেন, ভারতের মহিলাদের দলে এই মুহূর্তে দুজন আছেন যাঁরা সর্বকালের সেরাদের মধ্যে পড়েন। কীর্তির দিক থেকে অধিনায়ক মিতালী রাজ যদি মেয়েদের ক্রিকেটের শচীন তেন্ডুলকর হন, ঝুলন অবশ্যই কপিলদেব। দুটো দশক জুড়ে ভারতীয় বোলিংকে নেতৃত্ব দেওয়া কত শক্ত, তা কপিলদেবের চেয়ে ভাল কে-ই বা জানে? ঝুলনের নামটা মাথায় আসেনি বলে জিভ কাটছেন নাকি? কাটবেন না, কারণ দোষ আপনার নয়। শুধু যে মহিলাদের ক্রিকেট টিভিতে অনেক কম দেখানো হয় আর কাগজে অনেক কম লেখা হয় তা-ই নয়, কপিলদেব ১৬ বছরে খেলেছেন ১৩১টা টেস্ট আর ২২৫টা একদিনের ম্যাচ। ঝুলন কুড়ি বছরে ২০১ খানা একদিনের ম্যাচ (২২ মার্চ, ২০২২ তারিখে ভারত বনাম বাংলাদেশ ম্যাচ পর্যন্ত) খেললেও টেস্ট খেলেছেন মাত্র বারোটা। একদিনের ম্যাচের সংখ্যাটাও আসলে কপিলের সাথে তুলনীয় নয়, কারণ কপিলের কেরিয়ারের বেশ খানিকটা সময়ে একদিনের ক্রিকেট ছিল লম্বা টেস্ট সিরিজের শেষ পাতে মিষ্টির মত। কিন্তু ঝুলনের দু বছর আগে অভিষেক হওয়া জাহির খান বারো বছরেই দুশো একদিনের ম্যাচ খেলে ফেলেছিলেন।
ভারতীয় পুরুষদের ক্রিকেটের মহীরুহ যাঁরা, তাঁদের ঝুলিতে একটা জিনিস আছে যা বাংলার গৌরব সৌরভের ঝুলিতে নেই। ২০০৩ সালের ২৩ মার্চ রিকি পন্টিংয়ের অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়া সৌরভের হাতে বিশ্বকাপ ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা দুরমুশ করে চতুর্থবার বিশ্বকাপ জিতেছিল। কিন্তু কপিলদেব বিশ্বকাপ জিতেছেন, সুনীল গাভস্করও সেই দলে ছিলেন। বিশ্বসেরার মেডেল গলায় ঝুলিয়েছে শচীন তেন্ডুলকর আর মহেন্দ্র সিং ধোনিও। ব্যক্তিগত কৃতিত্বে ঝলমলে কেরিয়ারে ঝুলন আর মিতালীর ও জিনিসটার স্বাদ এখনো পাওয়া হয়নি। পেতে গেলে চলতি বিশ্বকাপে দুজনকেই নিজেদের সেরা ফর্মের কাছাকাছি থাকতে হবে। প্রথম চারটে ম্যাচে নীরব থাকার পর পঞ্চম ম্যাচে মিতালীর ব্যাট কথা বললেও পার্থক্য গড়ে দিতে পারেনি। বাংলাদেশ ম্যাচে দল জিতে গেলেও মিতালী আবার ব্যর্থ। ঝুলন মন্দ খেলছিলেন না, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে একেবারেই ফ্লপ, সহজ বাংলাদেশ ম্যাচে ছিলেন স্বমহিমায়। গতবার ফাইনালে উঠেও ইংল্যান্ডের কাছে হারতে হয়েছিল। বাকি রইল দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ। সেটা জিততে পারলে এখনো ভারতের সেমিফাইনালে পৌঁছবার সম্ভাবনা আছে। যদি শেষপর্যন্ত স্মৃতি মান্ধনা, পূজা বস্ত্রকর, শেফালি বর্মার মত তরুণদের সাথে মিতালী, ঝুলন, হরমনপ্রীতদের সুর মিলে যায় তাহলে ৩ এপ্রিল ক্রাইস্টচার্চে প্রথম বাঙালি হিসাবে ঝুলন ছুঁয়ে ফেলবেন ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সঙ্গে থাকবেন শিলিগুড়ির রিচা ঘোষ।
চিন্তা করবেন না। এখন পর্যন্ত ধারাবাহিকতা দেখাতে না পারা ভারতীয় দলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মত ঘটনা ঘটে গেলেও ঝুলনকে আমরা কেউ সেরা বাঙালি ক্রিকেটার বলার ধৃষ্টতা দেখাব না। মহিলাদের ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাক আর না-ই থাক, শিগগির জেনে যাব যে মেয়েদের ক্রিকেটের বোলারদের গড় গতি ছেলেদের চেয়ে কম। আরও নানা তথ্য থেকে প্রমাণ করা খুব কঠিন হবে না যে মেয়েদের বিশ্বকাপ জয় আর ছেলেদের বিশ্বকাপ জয় এক নয়। সেরেনা উইলিয়ামসকে ও দেশে কেউ রাফায়েল নাদাল, রজার ফেডেরার বা নোভাক জোকোভিচের চেয়ে কম বড় খেলোয়াড় ভাবে না। তা বলে আমাদেরও যে ওভাবে ভাবতে হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি।
তাছাড়া সৌরভের বায়োপিক হওয়ার আগেই যে বলিউড ঝুলনের বায়োপিক বানিয়ে ফেলছে, সে কি কম স্বীকৃতি? তাতে আবার ঝুলনের চরিত্রে অভিনয় করছেন ছেলেদের ক্রিকেট দলের অধিনায়কের অভিনেত্রী স্ত্রী। এর চেয়ে বেশি কী-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে ঝুলনের মত একজন শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটারের? ঢ্যাঙা, কালো মেয়ে মাঠে উইকেট তুলতে পারে, রান করতে পারে। কিন্তু পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে যখন তার জীবন নিয়ে তৈরি সিনেমা দেখতে যাব, তখন পর্দায় একটা টুকটুকে মেয়ে না থাকলে চলবে কেন? আমরা মণিপুরি মেরি কমকে পর্দায় দেখি পাঞ্জাবি অভিনেত্রীর অবয়বে, বাংলার ঝুলনকেও সেভাবেই দেখব। দেখে পপকর্ন খেতে খেতে হাততালিও দেব। দেশের ক্রিকেট বোর্ডই যখন মহিলা ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক পুরুষদের ধারেকাছে হওয়া উচিত বলে মনে করে না, দলটার নিয়মিত খেলতে পাওয়া উচিত বলেও মনে করে না, তখন আমরা সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরা সব সমান করে ভাবতে যাব কেন? আমাদের কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখার জন্য কেন ছটফট করব?
বাবুল সুপ্রিয় ও শত্রুঘ্ন সিনহা (ছবি ইন্টারনেট থেকে)
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক, বামফ্রন্ট সরকার মধ্যগগনে। আমার এক পিসতুতো দিদির ছেলে একবার কোনো ক্লাসে উঠলে সেখানেই ঘাঁটি গেড়ে ফেলছে। তা নিয়ে তার বাবা, মা, মামা সকলেই চিন্তিত। আমার সিপিএম কর্মী বাবা সেই দিদির মামা হন, তার উপর পেশায় শিক্ষক। ফলে সে ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে পরামর্শ চাইল। কোনো জবাব দেওয়ার আগেই দিদির ভাইটি আমার বাবাকে বলল “দোষ তো আমার ভাগনার নয়, দোষ তো তোদের (বয়সের তফাত কম হওয়ায় ‘তুই’ সম্বোধনই চালু ছিল)। তোরা মুড়ি মিছরি এক দর কইরা দিছস। এমন ব্যবস্থা করছস যে রিকশাআলার পোলায় আমার ভাগনার পাশে বইস্যা ক্লাস করে। তাতে তার তো কোনো উন্নতি হয় না, কারণ তার ল্যাখাপড়ার কালচার নাই। উল্টা আমাদের ভদ্দরলোকের পোলাগুলার সব্বোনাশ হয়্যা যাইতাছে।” আমার বাবা ভাগ্নে-ভাগ্নী বলতে অজ্ঞান ছিলেন, তাই কোনো কড়া উত্তর দেননি। হেসে বলেছিলেন “অ, নাচতে শেখো নাই বইলা উঠানের দোষ দিতাছ।” বাড়ি ফিরে আমাকে বলেছিলেন “এদের কীরকম মানসিকতা দেখেছিস? রিকশাওলার ছেলে ওর ভাগ্নের সাথে এক ক্লাসে পড়ছে বলে ওর গায়ে ফোসকা পড়ছে। তার জন্যে নাকি ওর ভাগ্নের পড়াশোনা হচ্ছে না।”
এর কৃতিত্ব বা দোষ কতটা বামফ্রন্ট সরকারের জানি না। দেশের অনেক জায়গাতেই সেইসময় পর্যন্ত রিকশাচালকের ছেলেমেয়ে আর চাকুরিজীবী মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়ে এক স্কুলেই পড়ত, একসাথে খেলাধুলোও করত। একই পাড়ায় বিত্তশালীর প্রাসাদপ্রমাণ বাগানওলা বাড়ি থাকত, মধ্যবিত্তের একতলা বাড়ি থাকত, নিম্নবিত্তের টালির চালের বাড়িও থাকত। সেসব বাড়ির মধ্যে বাটি চালাচালির সম্পর্কও থাকত কখনো কখনো। এ কোনো সোনালি অতীতের আষাঢ়ে গপ্প নয়। তখনো বিলক্ষণ শ্রেণি বিভাজন ছিল, তিনতলা বাড়ির মেয়ের সাথে টালির বাড়ির ছেলের প্রেম হত না সিনেমার মত, বিয়েও নয়। কিন্তু এ বাড়ির দাদুর শ্রাদ্ধে ও বাড়ি থেকে চিঁড়ে-দই খাওয়ার লোক থাকত, ও বাড়ির ছেলের বিয়েতে এ বাড়ি থেকে অন্তত একজনের নেমন্তন্ন থাকত। ১৯৯১ সালের পর থেকে পরিস্থিতি বদলাতে বদলাতে এখন সব অলীক। এখন হয় ফ্ল্যাট, নয় ঝুপড়ি। হয় গেটেড কমিউনিটি, নয় বস্তি। যেখানে পাড়া অবশিষ্ট আছে, সেখানেও বাবা-মা কেবল নিজেদের দরের পরিবারের বাচ্চাদের সাথেই মেলামেশা করতে দেন নিজের ছেলেমেয়েকে। চাকুরিজীবীর ছেলের স্কুল আর রিকশাওলার ছেলের স্কুল আলাদা হবে — আমার পিসতুতো দাদার এই ফ্যান্টাসি এখন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। রিকশাচালক, বাড়ির কাজের দিদি, জনমজুরের ছেলেমেয়েরা পড়ছে টিমটিমে সরকারপোষিত স্কুলে, কারণ তাদের বাবা-মায়েদের ওটুকুই সাধ্য। আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়ছে ঝাঁ চকচকে প্রাইভেট স্কুলে। অর্থাৎ মনমোহনী অর্থনীতির তিরিশ বছরে অভূতপূর্ব বৈচিত্র্যহীন ঐক্য তৈরি হয়েছে এ দেশে। ইংরেজিতে যাকে ঘেটো বলে, গোটা দেশটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমন ঘেটোর সমাহার।
কেন এসব কথা লিখলাম? কারণ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের দেশ ভারতবর্ষ বিপন্ন বলে আমরা সকলেই খুব চিন্তিত। একটা করে নির্বাচনের ফল বেরোয়, বিজেপি জেতে, আর আমরা নানা রঙের বিজেপিবিরোধীরা, হতাশ হয়ে বা ক্রুদ্ধ হয়ে বলি “এ দেশটার কিস্যু হবে না। লোকে কেবল হিন্দু-মুসলমান বোঝে। আর কোনো ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামায় না।” এত বড় দেশে প্রত্যেক নির্বাচনেরই যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো থাকে সেগুলোর কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, ধর্মীয় বিভাজনকে প্রধান ইস্যু করে তোলার চেষ্টা নিঃসন্দেহে অনেকটাই সফল হয়েছে। নির্বাচনগুলোর ফলাফলে তার প্রভাব উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। কিন্তু সে বিভাজন দূর করার পথ খোঁজার সময়ে আমরা ভেবে দেখছি না, ধর্মীয় বিভাজনের ইমারত দাঁড়িয়ে আছে অন্য গভীরতর বিভাজনের উপর। আমি আপনার থেকে আলাদা। আমি আপনার চেয়ে বেশি রোজগার করি, আপনার চেয়ে দামি পোশাক পরি, আমার গাড়ি আছে আপনার নেই, অতএব আপনার সাথে আমার মেশা উচিত নয়। আমাকে মিশতে হবে আমার মত লোকেদের সাথে। এই ব্যাপারটা যদি প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে আপনি আমার জানাশোনার বাইরে চলে যাবেন। ক্রমশ আপনার ভালমন্দে আগ্রহ হারাব, তারপর একসময় স্থির বিশ্বাস হবে যে আপনি বাঁচলেন কি মরলেন তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমি কেবল আমার মত লোকেদের সাথে মিশি, আপনি মেশেন আপনার মত লোকেদের সাথে — সমাজ যে এমনভাবে বিভক্ত হওয়াই উচিত, এই ধারণা একবার মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে অন্য যে কোনোরকম বিভাজন তৈরি করা জলভাত। যে অপর, সে অপ্রয়োজনীয়, এমনকি খারাপ — আগে একথা প্রতিষ্ঠা করুন। তারপর অপরের সংজ্ঞাটা দরকার মত বদলাতে থাকুন। সোজা হিসাব।
আমাদের দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় (নাকি সর্বত্রই?) এমনিতেই এক ধরনের অপরায়নের ভিত্তিতে পৃথকীকরণ কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসছে — বর্ণবাদ। তার সাথে বিশ্বায়নের যুগে যোগ হয়েছে শ্রেণিভিত্তিক পৃথকীকরণ, যা এতক্ষণ ব্যাখ্যা করলাম। এই দো-ফসলি জমিতে ধর্মীয় বিভাজনের ফসল ফলানো মোটেই কঠিন নয়। যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য নিয়ে আমাদের গুমোর, সেই বৈচিত্র্য স্থানীয় স্তরে হারিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তৈরি জমিতেই বীজ বুনে ফসল তুলেছে। ভেবে দেখুন, ভারতের বাজার খুলে দেওয়া হল ১৯৯১ সালে, আমরা ‘আপওয়ার্ডলি মোবাইল’ হতে শিখে গেলাম। আর ১৯৮৯ সাল থেকে রক্তক্ষয়ী রথযাত্রার মাধ্যমে লালকৃষ্ণ আদবানি সঙ্ঘের যে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা সারা ভারতে ছড়িয়ে দিতে নেমেছিলেন, তার প্রথম বড়সড় সাফল্য এল ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্যে দিয়ে। ভারতে বহুজাতিকের পায়ের তলার মাটি যত মজবুত হয়েছে, তত মজবুত হয়েছে আরএসএসের মাটি। ১৯২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া আরএসএস বরাবর সাম্প্রদায়িক মতাদর্শে অবিচল থেকে কাজ করে গেছে। কিন্তু দেশভাগ, গান্ধীহত্যার মত ঘটনার পরেও প্রান্তিক শক্তি হয়েই থাকতে হয়েছিল। অথচ কম্পিউটারের ভারতে, উদারীকরণের ভারতে কিনা এই প্রাচীনপন্থী, ধর্মান্ধ সংগঠন ক্রমশ নিজের শক্তি বাড়িয়ে আজকের অপরাজেয় স্থানে পৌঁছতে পারল। একথা বললে ভুল হবে না, যে ভোগ্যপণ্যের বৈচিত্র্য আর বেসরকারিকরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতের রাজনীতিতে ও সমাজে আরএসএসের প্রভাব বেড়েছে। অটলবিহারী বাজপেয়ী আর মোদীর সরকারের রাজনীতি যতটা রক্ষণশীল, তাঁদের অর্থনীতি ততই উদারপন্থী। তথাকথিত খোলা হাওয়ার খোঁজ দিয়েছিল কংগ্রেস, সে হাওয়ায় পাল তুলে দেশকে মাঝসমুদ্রে নিয়ে গেছে আরএসএস। কারণ নব্বইয়ের দশক থেকে যে নয়া উদারবাদী অর্থনীতি সারা পৃথিবীতে চালু হয়েছে নানা চেহারায়, তাতে যে বৈষম্য বাড়ে তা এখন বিশ্বব্যাঙ্কও স্বীকার করে। আর আগেই বলেছি, মূল বৈষম্যটা বাড়লে আর সবরকম বৈষম্য তৈরি করা যায়। অতএব ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করতে হলে ওটাই পথ।
বারবার আরএসএস কেন বলছি? বিজেপি বলছি না কেন? কারণ হিন্দুরাষ্ট্র বিজেপির এজেন্ডা নয়। বিজেপির কোনো দায়িত্বশীল নেতা ওই শব্দটি পারতপক্ষে উচ্চারণ করেন না, কাগজে কলমে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি সহস্রবার দেওয়া হলেও, হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় না। ভীষণদর্শন সাধুসন্ন্যাসী বা হিন্দি বলয়ের কোনো কোনো নেতা ২০২৩ সালের মধ্যে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে বলে কয়েকবার ঘোষণা করেছেন বটে, কিন্তু মোদী বা অমিত শাহের মত কেউ কখনো ওসব বলেন না। বুদ্ধিমান সাংবাদিক, বিশ্লেষকরা যারা ওসব বলে তাদের “ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট” (প্রান্তিক ব্যক্তি) বলে দাগিয়ে দেন। হিন্দি ভাষায় জনপ্রিয় প্রবাদ হল “হাথি কে দাঁত। খানে কে ঔর, দিখানে কে ঔর।” অর্থাৎ হাতি যে দাঁত দিয়ে খায়, সে দাঁত দেখায় না। আরএসএস অত্যন্ত বলশালী হাতি বৈ তো নয়। বিজেপিবিরোধী দল, বুদ্ধিজীবী, বিশ্লেষক, আমরা চুনোপুঁটিরা — সকলেই বিস্তর আলাপ-আলোচনা করছি, ফন্দি আঁটছি, বিজেপিকে কী করে নির্বাচনে হারানো যায় তা নিয়ে। আর অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করছি, বিচার বিভাগ থেকে সংবাদমাধ্যম, নির্বাচন কমিশন থেকে পুলিসবাহিনী — সবই “ওদের” লোকে ভর্তি। এই “ওরা” যে বিজেপি নয়, আরএসএস, তা বুঝতে পারলে এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না।
আরএসএস নিজেকে বলে সামাজিক সংগঠন, অর্থাৎ বর্তমান ভারতে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা শুধু দলীয় রাজনীতির নয়, স্রেফ নির্বাচনী রাজনীতির তো নয়ই। লড়াইটা সামাজিক। আরএসএস নিজে সেভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের বিরুদ্ধে একশো বছর ধরে লড়ে এসেছে, দলীয় রাজনীতিকে সেই লড়াইয়ের একটা ফ্রন্টে পরিণত করেছে। আর আমরা ভাবছি, যেনতেনপ্রকারেণ আরএসএসের রাজনৈতিক শাখাকে ভোটে হারিয়ে দিলেই ঝামেলা চুকে যাবে।
আরএসএসের সমান বয়সী একটি রাজনৈতিক দল ছিল ভারতে — ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। সে দল ভাঙতে ভাঙতে শতধা বিভক্ত। প্রাচীন সংগঠনে এরকম ভাঙাগড়া হয়েই থাকে। কিন্তু মজার কথা, আরএসএসের মধ্যেও নানা দ্বিধা দ্বন্দ্ব আছে। তবু তারা এখনো ‘সঙ্ঘ পরিবার’। সর্বত্র বজরং দলের সাথে বিজেপির মতে মেলে না; বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রবীণ তোগাড়িয়াও প্রকাশ্যে মোদীর নিন্দা করেছেন। মাঝেমধ্যে খোদ আরএসএস বেসুরো গায়। অথচ মূল লক্ষ্য থেকে এরা কেউ কখনো সরে না। মুসলমান বিদ্বেষে সবাই এককাট্টা, রামমন্দির নিয়ে সবাই এককাট্টা। বিরোধীদের আঁচড়াতে, কামড়াতে, খুন করতে সবাই সমান উদ্যোগী। কমিউনিস্টরা কে বেশি কমিউনিস্ট তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করে প্রচুর শক্তিক্ষয় করেন, করতে করতে শুধু ল্যাজের ডগা পড়ে আছে। সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যদের ওসব বদভ্যাস নেই।
আরও যা গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে রাখতে, হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন সার্থক করতে আরএসএস শুধু বিজেপির উপর দায়িত্ব দিয়ে বসে নেই। তারা জানে, সমস্ত প্রতিষ্ঠান কুক্ষিগত হওয়া সত্ত্বেও, ইলেকটোরাল বন্ডের কল্যাণে টাকার অঢেল জোগান থাকা সত্ত্বেও এত বড় দেশে সব নির্বাচন জেতা অসম্ভব। বিজেপি হেরে গেলেই হিন্দুরাষ্ট্র ফসকে যাবে? তা হতে দেওয়া যায় না। তাই “সেটিং” থাক আর না-ই থাক, অন্তত আরএসএসের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন নয়, শক্তিশালী বিরোধী হিসাবে তেমন কিছু দলের উপস্থিতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কীভাবে করা হল তা হয়ত অতিদূর ভবিষ্যতে কোনো পরিশ্রমী গবেষক উদ্ঘাটন করবেন, কিন্তু আপাতত দেখাই যাচ্ছে, যিনি রথযাত্রায় আদবানির পাশে ছিলেন, আনন্দ পট্টবর্ধনের বিখ্যাত তথ্যচিত্র রাম কে নাম-এ যাঁকে আদবানির মঞ্চে মাইক হাতে দেখা যায়, সেই শত্রুঘ্ন সিনহা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দল তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে সংসদে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। যে বাবুল সুপ্রিয় দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন বলে বহু মানুষ অভিযোগ করেন, সোশাল মিডিয়ায় বাঙালি মুসলমানদের বিদেশি বলেছেন একাধিকবার, তিনি বিজেপি থেকে তৃণমূলে এসে প্রথম এগারোয় জায়গা পাচ্ছেন। প্রার্থী হচ্ছেন এমন আসনে, যেখানে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট। অবশ্য তৃণমূলের সর্বময় কর্ত্রী বহু আগেই রাখঢাক না করে বলেছিলেন তাঁর সমস্যা বিজেপিকে নিয়ে, আরএসএসকে নিয়ে নয়। গান্ধীজির বাঁদরদের মত মুখ, চোখ, কান বন্ধ করে থাকা পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ এবং বিপ্লবী মানুষ সে কথা শুনতে বা দেখতে পাননি, তাঁর দল সম্পর্কে মানুষকে সাবধানও করেননি। নিশ্চয়ই সে কারণেই মমতা আত্মবিশ্বাসী, যে বালিগঞ্জ কেন্দ্রের সংখ্যালঘু মানুষ বাবুলকে ভোট দিন আর না-ই দিন, ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা নিশ্চয়ই দেবেন। আসানসোলের সংখ্যালঘু মানুষ শত্রুঘ্নকে ভোট না দিলেও ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুরা নিশ্চয়ই দেবেন। কারণ বিজেপিকে ভোট না দিলেই যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত বেঁচে যাবে — এ বিশ্বাস বহু মানুষের। তাঁরা আরএসএসকে দেখতে পান না। যাঁদের দেখিয়ে দেওয়া দায়িত্ব তাঁরা দেখতে দেন না।
শুধু তৃণমূল কংগ্রেস নয়। বিলীয়মান কংগ্রেসের জায়গা নেবে বলে যে দলটার উপর গত কয়েকদিন বহু বিজেপিবিরোধী মানুষ ভরসা করতে শুরু করেছেন দেখছি, সেই আম আদমি পার্টি দুটোর জায়গায় দশটা রাজ্যে ক্ষমতায় এলেও আরএসএসের ক্ষতি নেই। বহু কমিউনিস্টও দেখছি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দিল্লি সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজকর্ম দেখে আপ্লুত। মনমোহনী অর্থনীতির আমলে বামপন্থীদেরও যে নিজেদের রাজনীতি গুলিয়ে গেছে তার এর চেয়ে ভাল প্রমাণ সম্ভবত নেই। তাঁরা ভেবেও দেখছেন না, কেজরিওয়াল যা করছেন তা আসলে রাজীব গান্ধীর আমলের কংগ্রেসসুলভ কাজ। তফাতের মধ্যে কংগ্রেসের মত দুর্নীতি আপ দলে নেই। কেজরিওয়াল একাধিকবার বলেছেন, তিনি বামপন্থী নন, দক্ষিণপন্থীও নন। কার্যক্ষেত্রেও দেখা গেছে, তিনি হয় কোনো রাজনৈতিক অবস্থান নেন না, নয় আরএসএসের পছন্দের অবস্থান নেন। দিল্লি দাঙ্গায় তাঁর দল কোনো সক্রিয়তা দেখায়নি। উপরন্তু নিজের দলের মুসলমান কাউন্সিলর তাহির হুসেনের পাশেও দাঁড়ায়নি। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার সমর্থন করেছিল। অর্থাৎ আপ আপনাকে ভাল রাস্তা দিতে পারে, ভাল স্কুল ও হাসপাতাল দিতে পারে, শস্তায় জল ও বিদ্যুৎ দিতে পারে। তবে তাদের শাসিত রাজ্যে গণহত্যা হয়ে গেলে তারা মাথা ঘামাবে না। অর্থাৎ আপ হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার পথে বাধা নয়।
যেমন বাধা নন ওড়িশার নবীন পট্টনায়ক। মমতা, কেজরিওয়াল, নবীন — এঁরা কেবল ‘গোদি মিডিয়া’ নয়, ভারতের সব মিডিয়ার মতেই দারুণ ভাল। কারণ এঁরা “গুড গভর্ন্যান্স” (সুশাসন) নামক একটি জিনিস সরবরাহ করেন। সেটি দুলালের তালমিছরির মত এক অরাজনৈতিক অমৃত। এঁদের দেখিয়ে মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে — সুশাসন মানে হল রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল ও ভর্তুকি। কর্মসংস্থান নয়, আইনশৃঙ্খলা নয়, জাতীয় রাজনীতির ইস্যুতে সঠিক অবস্থান নেওয়াও নয়। এই মানদণ্ড মেনে নিতে অসুবিধা না থাকলে কিন্তু মানুষ যোগী আদিত্যনাথকে আবার ভোট দিল বলে রাগ করা চলে না। কারণ রাস্তাঘাট নিয়ে ওই রাজ্যের মানুষের বিশেষ অভিযোগ নেই। স্কুল, হাসপাতাল না দিতে পারলেও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার বিনামূল্যে রেশন দিয়েছে। কোভিডে মৃতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণও দিয়েছে।
ভারতে একজন বিরোধী নেতা আছেন, যিনি মানেন লড়াইটা আসলে সামাজিক এবং বলেন যে লড়াই আসলে আরএসএসের বিরুদ্ধে। তিনি রাহুল গান্ধী। কিন্তু সমস্যা হল, তিনি সোশাল মিডিয়ার নেতা। ইদানীং দিব্য বাগ্মী হয়ে উঠেছেন, কিন্তু রাস্তায় নামেন কালেভদ্রে। ইউটিউব, ফেসবুক আর টুইটারে লাইকের মূল্য যে রাজনীতির ময়দানে শূন্য — তা তিনি বোঝেন বলে মনে হয় না। বহু বিজেপিবিরোধীর একটি পাহাড়প্রমাণ ভ্রান্তি আছে। তা হল, বিজেপি শাসনের ভিত্তি সোশাল মিডিয়া। একশো বছর ধরে আরএসএসের তৃণমূল স্তরে গিয়ে প্রকাশ্যে ও গোপনে কাজ করার ব্যাপারে কোনো ধারণা না থাকাই এই ভ্রান্তির মূলে। সম্ভবত রাহুলও এতেই ভোগেন। গত কয়েক বছরে রাহুলের কথাবার্তা থেকে বোধ হয়, তিনি বোঝেন মৌলিক বিভাজনগুলোর সাথে লড়াই না করে উপরিতলের ধর্মীয় বিভাজন দূর করা যাবে না। আরএসএসকে হারানোও যাবে না। কিন্তু সে ক্ষমতা তাঁর তো নেই বটেই, তাঁর দলেরও নেই। প্রাক-স্বাধীনতা যুগের কংগ্রেস বা লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সময়কার কংগ্রেসেও দেশের ধনীদের যথেষ্ট উপস্থিতি থাকলেও সাধারণ, গরীব মানুষের সাথে কিছু সংযোগ ছিল। ইন্দিরার সময় থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়েছে, যার শীর্ষবিন্দু ছিল জরুরি অবস্থা। কিন্তু সে আমলেও অর্থনৈতিকভাবে কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের রাস্তায় থাকার প্রচেষ্টা ছিল। রাজীবের সময় থেকে তা-ও কমতে শুরু করে, নরসিমা-মনমোহনে এসে কংগ্রেসের সর্বার্থে উচ্চকোটির দক্ষিণপন্থী পার্টি হওয়া শুরু হয়। আবার নরসিমার এক সময়কার মিডিয়া উপদেষ্টা পিভিআরকে প্রসাদ লিখেছেন, নরসিমার নাকি ইচ্ছে ছিল বিজেপির আগেই অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করা। সেই উদারপন্থী অর্থনীতি আর হিন্দুত্বের সহাবস্থানের গল্প। এমনি এমনি তো তাঁকে ভারতের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী বলেন না কেউ কেউ। কংগ্রেস এখনো সেই পথেই চলেছে, রাহুল একা চাকা উল্টোদিকে ঘোরাবেন কী করে?
তাহলে আরএসএসের বিরুদ্ধে সামাজিক লড়াই লড়বে কারা? লালুপ্রসাদ, মুলায়ম সিং, মায়াবতীদের রাজনীতি নির্বাচনী লড়াইয়ে আর ফল দিচ্ছে না মানে তো এই নয়, যে দেশের নিম্নবর্গীয় মানুষ এখন খুব ভাল আছেন। জাতপাতের বৈষম্য বরং গভীরতর হয়েছে, শ্রেণিবৈষম্যের কথা আগেই বলেছি, আর ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য তো ভয়াবহ স্তরে পৌঁছেছে। এইসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে একযোগে লড়ার নতুন রাজনীতি করবে কারা?
কেবল ভোটের পাটিগণিতে কিন্তু এ আঁধার থেকে মুক্তির পথ পাওয়া যাবে না।
স্কুল স্তর থেকে অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে অল্টনিউজ পশ্চিমবঙ্গে
সম্প্রতি অল্টনিউজের কর্ণধার প্রতীক সিনহা সোশাল মিডিয়ায় ঘোষণা করেছেন, তিনি কলকাতার বাসিন্দা হয়েছেন। অল্টনিউজ এবার পশ্চিমবঙ্গেও কাজ করবে। হঠাৎ এই সিদ্ধান্তের কারণ কী? এ কি কোনো স্বল্পমেয়াদি সিদ্ধান্ত, নাকি এর পিছনে আছে দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা? নাগরিক ডট নেটের প্রতীককে জানালেন অল্টনিউজের প্রতীক।
নাগরিক: প্রথমেই পশ্চিমবঙ্গে আপনাকে এবং অল্টনিউজকে স্বাগত জানাই। সেইসঙ্গে একটা অনুযোগও করব। আমাদের কিন্তু অল্টনিউজকে গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে বেশি দরকার ছিল। কারণ নির্বাচনের সময়ে ভুয়ো খবরের উপদ্রব বড্ড বেড়ে যায়। তাই আমার প্রথম প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গে বা বাংলায় অল্টনিউজকে বিস্তৃত করার সিদ্ধান্তটা এই সময়ে কেন নেওয়া হল?
প্রতীক: আমার মনে হয় আমাদের পশ্চিমবঙ্গে আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুটা ভুল ধারণা থেকে এই অনুযোগটা তৈরি হয়েছে। দেখুন, ভুয়ো খবরের উপদ্রব দেশের সব ভাষাতেই সমান। অথচ আমরা একটা ক্রাউড ফান্ডেড ছোট স্টার্ট-আপ। সব রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তো আমাদের কলকাতায় আসার কারণ এটা নয় যে পশ্চিমবঙ্গ ভুয়ো খবরের সবচেয়ে বড় টার্গেটগুলোর অন্যতম। আমাদের উদ্দেশ্যটা একটু বিশদে বলি?
নাগরিক: নিশ্চয়ই…
প্রতীক: অল্টনিউজ চালু হয়েছে পাঁচ বছর হল। যারা এটা চালু করেছিল তারা নানারকম কাজের লোক। আমি যেমন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লোক। আগের পনেরো বছর আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারই ছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে এই কাজটায় এসেছি সামাজিক প্রভাব আছে এমন কিছু করব ভেবে। আমরা যারা অল্টনিউজ শুরু করেছিলাম, সকলেই চাইতাম আমাদের নিজেদের যে পারদর্শিতাগুলো আছে, সেগুলোকে সমাজের কাজে লাগাব। আর আমরা দেখেছিলাম যে ভারতীয় সাংবাদিকতায় ক্রস ডিসিপ্লিন বিশেষজ্ঞ বলে কিছু নেই। মানে ধরুন, যিনি বিজ্ঞান নিয়ে সাংবাদিকতা করেন, তাঁর কিন্তু বিজ্ঞানের ডিগ্রি নেই। বা টেক জার্নালিস্টের প্রযুক্তির ডিগ্রি নেই। আমরা বুঝেছিলাম, আমাদের যার যা টেকনিকাল জ্ঞান, সেগুলো ব্যবহার করে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এমন একটা জিনিস করতে পারি যা সেই সময়ে অন্তত এ দেশে আর কেউ করছিল না। ২০১৭ সালে আমরাই প্রথম এ দেশে মিথ্যা তথ্য চিহ্নিত করার কাজটা শুরু করি। কিন্তু সেটুকুই আমাদের লক্ষ্য ছিল না। আমরা আশা করেছিলাম সামগ্রিকভাবে সমাজে ভুয়ো তথ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারব।
কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন, সমস্ত বড় বড় ইস্যুতে ভুয়ো খবর, মিথ্যা তথ্যকে চিহ্নিত করতে এত পরিশ্রম করি আমরা… এখন আরও অনেক সংগঠন করে… তা সত্ত্বেও কিন্তু সমাজে কোনো বদল আসেনি। সমাজ এখনো পাঁচ বছর আগের মতই মিথ্যা তথ্য গিলে চলেছে। বরং প্রতিদিন এগুলো বাড়ছে বললেও ভুল হয় না। তার ফলে সমাজে কী তীব্র মেরুকরণ হয়েছে আমরা দেখতেই পাচ্ছি। গত এক-দেড় বছরে আবার ভুয়ো খবর, মিথ্যা তথ্যের সাথে যুক্ত হয়েছে হেট স্পীচ। এ থেকে প্রমাণ হয়, এতদিন ধরে অসত্য গিলতে গিলতে সমাজ এতটাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে যে হেট স্পীচ হজম করতে কোনো অসুবিধাই হচ্ছে না। ছ বছর আগেও যদি হরিদ্বার বা ছত্তিশগড়ের হেট স্পীচের মত ঘটনা ঘটত, অনেক বেশি মানুষ অবাক হতেন বা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন।
ফলে আমরা বুঝতে পেরেছি, এই যে একের পর এক আর্টিকেল প্রকাশ করে যাচ্ছি, এটা যথেষ্ট নয়। আরও বেশি কিছু করা দরকার। উন্নততর প্রযুক্তি তো দরকার বটেই, তা নিয়ে আমরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, মানুষকে এই ব্যাপারে শিক্ষিত করা বেশি জরুরি। আপনি ইউরোপের দিকে তাকান। বিশেষ করে ফিনল্যান্ড, ডেনমার্কের মত দেশে ইতিমধ্যেই ভুয়ো খবর চিহ্নিত করা স্কুলের পাঠক্রমে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানে ওরা এ সম্বন্ধে মানুষকে ছোট থেকে শিক্ষিত, সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছে; ব্যাপারটাকে স্রেফ সাংবাদিকতার ব্যাপার বলে ভাবছে না। আমরা ওই দিকে এগোতে চাইছি। পশ্চিমবঙ্গে আসার মূল উদ্দেশ্য এই দিকটা নিয়ে কাজ করা। পাশাপাশি সাংবাদিকসুলভ যে কাজ আমরা পাঁচ বছর ধরে করছি সেটা তো করে যাবই।
নাগরিক: তা এই কাজ শুরু করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ উর্বর জমি বলে মনে হল কেন?
প্রতীক: এই কাজটা আমরা একটা ভৌগোলিক অঞ্চল বেছে নিয়ে শুরু করতে চেয়েছিলাম। আমরা দেখতে চাই যে একটা বড় অঞ্চলের মানুষকে ব্যাপকভাবে তথ্যসাক্ষর (information literate) বা মিডিয়াসাক্ষর (media literate) করে তোলা যায় কিনা। তা এটা করতে গেলে এমন একটা রাজ্য দরকার, যেখানকার সরকার আমাদের কাজটাকে সমর্থন না করলেও অন্তত আমাদের বিরোধিতা করবে না। সেদিক থেকে আমাদের তিনটে রাজ্যের কথা মাথায় ছিল — কেরালা, তামিলনাডু আর পশ্চিমবঙ্গ। এই কাজে রাজনৈতিক স্থিরতার গুরুত্বটা আশা করি বুঝতে পারছেন। মানুষকে এই ব্যাপারে শিক্ষিত করে তোলা তো দু-এক দিনের কাজ নয়, রাজনৈতিক বিরোধিতা সামলে দীর্ঘ সময় ধরে এটা করে যাওয়া মুশকিল। তো আমরা শেষমেশ এখানেই করব ঠিক করলাম, তার একটা বড় কারণ এই প্রোজেক্টটার মাথা আমি। আমি বাংলা ভাষাটা অন্তত বলতে পারি; তামিল, মালয়ালম পারি না। দ্বিতীয়ত, পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক গুরুত্ব ক্রমশ বাড়ছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের, তেমনি আসামের, তেমনই বিহারের। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ আর বিহারের যে বিয়াল্লিশটা করে আসন, সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। কেরালায় হয়ত আমাদের কাজের জমি কিছুটা তৈরি ছিল। কারণ ওখানকার সিপিএম সরকার স্কুলের পাঠক্রমে তথ্যসাক্ষরতার কোর্স চালু করবে বলে ঘোষণা করেছে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ অব্দি ভাষা আর রাজনৈতিক গুরুত্ব — এই দুটো কারণেই আমরা পশ্চিমবঙ্গকে বেছে নিলাম বলা যায়।
নাগরিক: এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা হয়েছে কি?
প্রতীক: না, এক্ষুণি সরকারের সাথে আলোচনা করার কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রথমে আমরা নিজেরা একটা কাঠামো দাঁড় করাতে চাই। কিছু এনজিও, প্রাইভেট স্কুল ইত্যাদির সঙ্গে কাজ করে আমরা আগে একটা পাঠক্রম তৈরি করতে চাইছি। সত্যি কথা বলতে, আমাদের এই কাজটা করতে করতেই শিখতে হবে কী করে কী করা যায়। কারণ আমার তো শিক্ষাজগতের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করছি। আমরা আপাতত এক বছরের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি। আমি নিজে এই কদিন আগেই কিছু ক্লাস ইলেভেন, টুয়েলভের ছেলেমেয়েকে একটা ট্রেনিং কোর্স করালাম।
নাগরিক: ব্যাপারটা কতটা কঠিন হতে পারে বলে মনে হচ্ছে?
প্রতীক: ব্যাপারটা অনেকটাই অন্যরকম। যেমন ধরুন, ছোটদের তথ্য সংগ্রহ করা আর বড়দের তথ্য সংগ্রহ করার ধরনটা কিন্তু আলাদা। ফলে আমাদের এমন একটা পাঠক্রম তৈরি করতে হবে যেটা ছোটদের ভাল লাগবে। বড়দের যদি আমি রাজনৈতিক ভুয়ো খবর নিয়ে বলি, তাঁরা আগ্রহী হবেন। কিন্তু ছোটরা উৎসাহ পাবে না। সুতরাং আমাদের ভাবতে হবে কী করে এমন একটা পাঠক্রম তৈরি করা যায় যা ছোটদের টানতে পারবে, তথ্য সম্পর্কে তাদের আরও বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারবে। যেসব দেশ এই কাজটা শুরু করে দিয়েছে তাদের কিছু কিছু পদ্ধতি আমরা নিশ্চয়ই অনুসরণ করতে পারি, কিন্তু বেশিরভাগটাই নিজেদের নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর সাথে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক তফাত বিস্তর। ধরুন ফিনল্যান্ডের সাক্ষরতার হার ৯৫%-এর আশেপাশে। তাদের মত করে এখানকার মানুষকে শেখাতে গেলে তো চলবে না। ফলে আমাদের পথ আমাদেরই আবিষ্কার করতে হবে।
নাগরিক: একটু পরিষ্কার করে নিই, তাহলে আপনারা এখানে মানুষকে তথ্যসাক্ষর করার কাজটা করবেন, কিন্তু অল্টনিউজ হিন্দির মত অল্টনিউজ বাংলা পরিষেবা চালু হচ্ছে না?
প্রতীক: না না, তা নয়। অল্টনিউজ বাংলা চালু হচ্ছে। কারণ এখানে মানুষকে তথ্যসাক্ষর করতে হলে শেখানোর ভাষাটা বাংলা হতেই হবে। একেবারে শিশু শুধু নয়, বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের কথা ভাবুন। আমি যদি তাদের শেখাতে যাই, ওদের মধ্যে যারা ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ নয় তাদের জন্যে বাংলা রিসোর্স লাগবে তো। অল্টনিউজ বাংলাকে দিয়ে সেই কাজটা হবে। মানে অল্টনিউজ বাংলা আমাদের এই বড় কাজটারই একটা অংশ হয়ে উঠবে বলতে পারেন।
নাগরিক: অদূর ভবিষ্যতে অন্য আঞ্চলিক ভাষাতেও এরকম উদ্যোগ নেওয়ার কোনো ভাবনা আছে কি?
প্রতীক: আপাতত নেই। বড়জোর গুজরাটি ভাষায় কাজ করতে পারি, কারণ আমি নিজে গুজরাটি ভাষাটা জানি, আমার অনেক সহকর্মীও গুজরাটি। আমাদের একটা ছোট গুজরাটি পরিষেবা আছেও, যেখানে সামান্য কিছু ভিডিও দেওয়া হয়। খুব বেশি হলে সেটাকে একটা পূর্ণাঙ্গ পরিষেবায় পরিণত করতে পারি। তার কারণ আমাদের মত ছোট স্টার্ট-আপের পক্ষে একেবারে নিশ এরিয়াতে কাজ করাই সম্ভব। যেমন এতদিন আমরা স্রেফ ভুয়ো খবর, মিথ্যা তথ্য নিয়ে কাজ করেছি, অন্য কিছুতে ঢুকিনি। এখন হেট স্পীচ নিয়ে কাজ শুরু করছি। সবে ‘আনহেট’ বলে একটা প্রোজেক্ট ঘোষণা করেছি। আর এই শিক্ষা নিয়ে কাজটা শুরু করছি। নিজেদের এর বেশি ছড়ানোর সামর্থ কোথায়? তাছাড়া দেখুন, আলাদা আলাদা ভাষায় পরিষেবা চালু করে যে অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে খুব বেশি সুবিধা হবে তা নয়। এই যে এতদিন ইংরেজি ভাষায় আমরা কাজ করছি, এতে কজন ইংরেজি জানা লোককে প্রভাবিত করা গেছে? সমাজে মেরুকরণ এত মারাত্মক, যে বিরাট অংশের মানুষকে কিছুই বুঝিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। অতএব আমাদের অন্য রাস্তা নিতে হচ্ছে। আমি জানি না সফল হবে কিনা, কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন যেভাবে আমরা এই সমস্যার সাথে লড়ছি তাতে তেমন সুবিধা হচ্ছে না।
নাগরিক: আচ্ছা, আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে? ভুয়ো খবর কি ইংরেজি ভাষায় বেশি তৈরি হয়, নাকি আঞ্চলিক ভাষাগুলোতে?
প্রতীক: সব ভাষাতেই সমানভাবে তৈরি হয় এবং অন্য ভাষায় অনুবাদ হয়ে যায়। মনে রাখবেন, মিথ্যা তথ্য কিন্তু ভুল তথ্য নয়। মানে ওগুলোর জন্ম ভুল করে হয় না, সংগঠিতভাবে তৈরি করা হয়। ফলে বাংলায় তৈরি ভুয়ো খবর মুহূর্তের মধ্যে তেলেঙ্গানায় বা গুজরাটে গিয়ে পৌঁছয়। কোন ভাষায় বেশি মিথ্যা তথ্য উৎপাদন হয় তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়াও অসম্ভব, কারণ কে যে ভুয়ো খবর তৈরি করছে তা কিছুতেই খুঁজে বার করা যায় না। আই টি সেল কি একটা ঘরে বসা কয়েকটা লোক, নাকি সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা কয়েকশো লোক? এর উত্তর কারোর কাছে নেই।
নাগরিক: বিশেষ করে উদারপন্থী বৃত্তের মধ্যে একটা কথা আজকাল খুব বলা হয়। মানুষ তা-ই বিশ্বাস করে যা সে বিশ্বাস করতে চায়। অল্টনিউজ করতে গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কি কথাটা ঠিক বলে মনে হয়? যেমন ধরুন, আপনাদের অ্যাপে তো সন্দেহজনক তথ্য আপলোড করে সেটা ভুয়ো কিনা তা জেনে নেওয়ার একটা ব্যবস্থা আছে। সেটা কতজন ব্যবহার করেন?
প্রতীক: ওই ব্যবস্থা তো আছেই। তা বাদে আমাদের একটা হোয়াটস্যাপ নম্বরও আছে। সেখানেও একই কাজ করা যায়। বেশকিছু লোক এগুলো ব্যবহার করেও থাকেন। তবে সব মিলিয়ে সংখ্যাটা আর কত? এই মুহূর্তে ভারতে ৫০০ মিলিয়নের বেশি হোয়াটস্যাপ ব্যবহারকারী আছেন। তার মানে এতগুলো মানুষের কাছে ভুয়ো খবর পৌঁছানোর সম্ভাবনা আছে। অল্টনিউজ মাসে এক মিলিয়ন ইউজার পায়। তো বুঝতেই পারছেন, আমরা একটা ভগ্নাংশের কাছেও পৌঁছতে পারছি না। আমার মনে হয় না ফ্যাক্ট চেকিং সাংবাদিকতা কোনোদিনই এমন জায়গায় পৌঁছবে, যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ফ্যাক্ট চেক করবেন। সেই কারণেই আমরা এই রাজ্যে যা করতে এসেছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
নাগরিক: সারা ভারতেই স্বাধীন সাংবাদিকতা যাঁরা করেন, তাঁদের অভিযোগ হল, ক্ষমতাশালীরা এই স্বাধীন সাংবাদিকদের কাজে প্যাঁচে পড়ার সম্ভাবনা আছে দেখলেই কেস ঠুকে দিয়ে কোণঠাসা করেন। আপনাদেরও তো এরকম অভিজ্ঞতা হয়। এই ঝামেলাটা কীভাবে সামলান?
প্রতীক: হ্যাঁ, আমার সহকর্মী এবং অল্টনিউজের কো-ফাউন্ডার মহম্মদ জুবেরের নামেই তো আলাদা আলাদা জায়গায় চারটে এফ আই আর হয়ে বসে আছে। সবকটাই হাস্যকর অভিযোগ। আমাদের বিরুদ্ধে দৈনিক জাগরণ কাগজের একটা মানহানির মামলাও চলছে। লিগাল নোটিস তো আসতেই থাকে। মানে যথেষ্ট হয়রানি চলে। তবে আমরা খুবই সতর্ক হয়ে কাজ করি। প্রত্যেককে বারবার বলা হয়, মাথা গরম থাকার সময়ে কিছু লিখবে না। কোনোকিছু নিয়ে উত্তেজিত থাকলে, রাগ পড়ে যাওয়ার পর লেখো। আমাদের রিপোর্টগুলোতে আমরা প্রসঙ্গ থেকে একেবারেই যেন সরে না যাওয়া হয় সেদিক কড়া নজর রাখি। নির্দিষ্ট করে বলি, আমরা লেখায় অত্যন্ত কম বিশেষণ ব্যবহার করি।
নাগরিক: ক্রাউড-ফান্ডেড ফ্যাক্ট চেকিংয়ের ব্যবসায়িক ভবিষ্যৎ কেমন বলে আপনার মনে হয়?মানে টাকা রোজগার করতে না পারলে তো কাজটা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
প্রতীক: এই মুহূর্তে আমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এই অতিমারী, লকডাউন ইত্যাদিতেও আমাদের মাইনে কমাতে হয়নি। যথেষ্ট মানুষই টাকা দিয়ে পড়ছেন। তবে কমবেশি তো হয়েই থাকে। কয়েকটা ফ্যাক্টরের উপর ব্যাপারটা নির্ভর করে, যেমন অর্থনীতির অবস্থা কেমন? লোকের হাতে কতটা অতিরিক্ত অর্থ আছে? তাছাড়া আমাদের একটা বড় সুবিধা হল আমরা এমন একটা ভাষায় কাজ করি, যে ভাষা ব্যবহারকারীদের মাথাপিছু আয় শুধু আঞ্চলিক ভাষা পড়তে পারেন যাঁরা, সেইরকম মানুষের চেয়ে সাধারণত বেশি হয়। ফলে আমার ধারণা, কেবল আঞ্চলিক ভাষায় এরকম কোনো ওয়েবসাইট চালানো অনেক বেশি কষ্টসাধ্য হবে।
আইপিএল আজকের তরুণ ক্রিকেট দর্শকদের কাছে জলভাত। কিন্তু আমাদের মত যারা পরিণত বয়সে আইপিএল শুরু হতে দেখেছে ২০০৮ সালে, তাদের বড় বিস্ময় লেগেছিল। আমার সেই বিস্ময় বেড়ে গিয়েছিল শেন ওয়ার্ন সম্পর্কে একটা কথা শুনে।
সদ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়া ওয়ার্ন সেবার আইপিএলের সবচেয়ে শস্তা দল জয়পুরের রাজস্থান রয়্যালসের একাধারে অধিনায়ক ও কোচ। নিলামের পর দলগুলোর যা চেহারা হয়েছিল, তাতে অনেকেরই ধারণা ছিল হইহই করে চ্যাম্পিয়ন হবে হায়দরাবাদের তারকাখচিত ডেকান চার্জার্স। আর জয়পুরের দলটার জায়গা হবে শেষের দিকে। ডেকান চার্জার্সের মালিক হায়দরাবাদের মহা বিত্তবান রেড্ডিরা। তাঁরা আবার ওই শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ইংরেজি কাগজ ডেকান ক্রনিকলেরও মালিক। সেই কাগজের প্রতিনিধি হিসাবে মুম্বাইতে একটা আইপিএল ম্যাচ কভার করতে গিয়ে এক সর্বভারতীয় কাগজের সাংবাদিকের সাথে আলাপ হল। তার মুখেই শুনলাম রাজস্থান রয়্যালসের প্রায় অখ্যাত স্বপ্নিল অসনোদকর, রবীন্দ্র জাদেজা, ইউসুফ পাঠানদের সাথে ওয়ার্নের দারুণ ঘনিষ্ঠতা। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের এইসব চারাগাছের জন্য নাকি ওয়ার্ন বটবৃক্ষ হয়ে উঠেছেন। আমি এবং আমার কাগজের অগ্রজ সাংবাদিক কথাটা প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কারণ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের উন্নাসিকতা জগদ্বিখ্যাত। শোনা যায় কেউ কেউ প্রবল বর্ণবিদ্বেষীও। যেহেতু ডেকান চার্জার্সে সেবার চাঁদের হাট, আমরা নিজেরাও দেখেছি, টিম ফ্লাইটে ভারতীয় ক্রিকেটাররা একসঙ্গে বসেন। অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, হার্শেল গিবসরা নিজেদের মধ্যেই আড্ডা মারেন। আর ওয়ার্নের মত মহাতারকা অসনোদকরদের পাত্তা দেবেন, এ-ও কি সম্ভব? কিন্তু সেই সাংবাদিক বন্ধুর বিস্তারিত বিবরণ শুনে অবিশ্বাস করার উপায় রইল না।
সে বলল, প্রথম দিকে দলের ভারতীয় ক্রিকেটাররা ওয়ার্নের সাথে কথা বলতেই ভয় পেত। একে তিনি অত বড় ক্রিকেটার, তার উপর ইউসুফরা ইংরেজি বলায় একেবারেই সড়গড় নন। সাপোর্ট স্টাফের কারোর থেকে এই সমস্যার কথা জানতে পেরে ওয়ার্ন সকলকে বলেন, যে ভাষায় তোমরা স্বচ্ছন্দ সেই ভাষাতেই আমার সাথে কথা বলবে। আমি তোমাদের দেশে কাজ করতে এসেছি, আমার দায়িত্ব বুঝে নেওয়া।
শেন ওয়ার্ন বড় ক্রিকেটার বরাবরই মানতাম, কারণ গণ্ডমূর্খ না হলে মানতে সবাই বাধ্য। তাঁর প্রতি যে বিরূপতা ছিল, তা বিদায় নিল সেইদিন।
কেন ছিল বিরূপতা?
আসলে আমাদের কৈশোর ও প্রথম যৌবন কেটেছে ওয়ার্নের বোলিং দেখতে দেখতে। বলা ভাল, শচীন বনাম ওয়ার্ন দ্বৈরথ দেখতে দেখতে। আমাদের খেলা দেখতে শেখায় দল নির্বিশেষে নৈপুণ্যকে কুর্নিশ জানানোর পাঠ খুব বেশি ছিল না। আজকের কদর্য পার্টিজানশিপের সূচনা সে আমলেই হয়েছিল। আসলে আমাদের জন্যে কোনো মতি নন্দী লিখতেন না, প্রাঞ্জল বিশ্লেষণে বাঙালি পাঠককে বুঝিয়ে দিতেন না শচীন, সিধুরা অনায়াস দক্ষতায় তাঁকে মাঠের বাইরে পাঠালেও ওয়ার্ন একজন ক্ষণজন্মা শিল্পী। আমাদের সময়ে ইডেন উদ্যান থেকে রেডিওতে ভেসে আসত না ক্রিকেটরসিক অজয় বসুর কণ্ঠ। আমাদের টিভির ইডেন তখন কাগজের ভাষাতেও গার্ডেন্স হয়ে গেছে। ক্রিকেটের রোম্যান্স অনুভব করতে আমরা শিখলাম কই? ওয়ার্নের বলে শচীনের তিনরকম সুইপ, ক্রিজ ছেড়ে কোণাকুণি বেরিয়ে এসে ওয়াইড লং অন দিয়ে ছয় মারায় আমরা হাততালি দিয়েছি মূলত ভারতীয় ব্যাটার অস্ট্রেলিয় বোলারের বলে চার আর ছয় মেরেছে বলে। আমাদের মধ্যে যারা ইংরেজিতে দড় ছিল না, তারা পিটার রোবাকও পড়তে পারেনি। ওয়ার্ন কত বড় শিল্পী তা বোঝা দূরে থাক, শচীন কত বড় শিল্পী তা-ও তারা তখন বড় একটা বুঝতে পারেনি। তাছাড়া আমাদের সময়টা সুনীল গাভাসকর, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথদের যুগ নয়। বিপক্ষ দলের প্রিয় ক্রিকেটারের নামে বিশ্বসেরা ব্যাটার নিজের ছেলের নাম দেবেন, সে সংস্কৃতি তখন ক্রমশ লুপ্ত হচ্ছে; আগ্রাসন শব্দটা চালু হয়ে গেছে। কখন ব্যাটার একটা মনোরম লেট কাট মারবে বা স্পিনারের একটা বল ব্যাটারকে হাস্যকরভাবে পরাস্ত করবে, আর উইকেট পড়ুক না পড়ুক ওই বলটাই মনে রেখে দেবে দর্শক — সেসব দিন তখন চলে গেছে। আমরা দীর্ঘকাল খেলায় জয়, পরাজয়ের পরেও যে কিছু থাকে তা অনুভব করিনি। অস্ট্রেলিয়া যখন ১৯৯৭-৯৮ মরসুমে ভারত সফরে এল, ওয়ার্ন নিজের খাবার হিসাবে সেদ্ধ বিনের টিন নিয়ে এসেছেন দেশ থেকে — এই খবর পড়ে আমরা যারপরনাই উত্তেজিত হয়েছি। আমাদের উত্তেজিত করা হয়েছে। কাগজে লেখা হয়েছে এটা ভারতের অপমান, শচীন আমাদের সবার হয়ে এর প্রতিশোধ নেবেন। তাই সে মরসুমে যেখানে অস্ট্রেলিয়াকে পেয়েছেন, ক্ষমতার শীর্ষে থাকা শচীন সেখানেই ওয়ার্নসুদ্ধু অজিদের একেবারে দুরমুশ করে দেওয়ায় আমরা কিছুটা অতিরিক্ত আনন্দ পেয়েছি।
কিন্তু আমাদের একটা জিনিস ছিল যা পূর্বসুরীরা পাননি। সেটা হল কেবল টিভি। তাই আমরা ভারতীয় ব্যাটিংয়ের হাতে ওয়ার্নের নাকানি চোবানি খাওয়া (১৪ টেস্টে ৪৩ উইকেট; গড় ৪৭.১৮, ৫ উইকেট মাত্র একবার) যেমন দেখেছি, তেমনি পৃথিবীর যে কোনো মাঠে, যে কোনো ধরনের পিচে অন্য দেশগুলোর মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া দেখার সৌভাগ্যও হয়েছে। ১৯৯২ সালে সিডনিতে ভারতের বিরুদ্ধে যখন ওয়ার্নের অভিষেক হল, তখনো আমাদের এখানে ঘরে ঘরে কেবল টিভি ছিল না। সোনালি চুলের একটা ২২ বছরের ছেলেকে বেধড়ক মারছেন রবি শাস্ত্রী আর শচীন — এই দৃশ্য আমরা কেবল রাতের খাবার খেতে খেতে দূরদর্শনের হাইলাইটসে দেখেছি। পরের বছর মাইক গ্যাটিংকে বোকা বানানো ‘শতাব্দীর সেরা বল’-ও লাইভ দেখেছিল খুব অল্পসংখ্যক ভারতীয়।
কিন্তু পুরনো সুরার মত স্বাদু, অবসরের দিকে এগিয়ে চলা ওয়ার্নের ২০০৫ সালে এজবাস্টনে অ্যান্ড্রু স্ট্রসকে জোকারে পরিণত করা বলটা আমরা অনেকেই লাইভ দেখেছি।
ভাগ্যিস দেখেছি! উসেন বোল্টের দৌড়, মাইকেল ফেল্পসের সাঁতার, রজার ফেডেরারের টেনিস দেখার মত যে কটা জিনিস যখন ঘটেছে তখনই দেখেছি বলে আমাদের মধ্যে যারা আশি-নব্বই বছর বাঁচবে তারা শেষ বয়সে গর্ব করতে পারবে, তার একটা হল ওয়ার্নের বোলিং।
তাঁর কিন্তু আব্দুল কাদিরের মত রহস্যময় গুগলি ছিল না। কিন্তু যে বলের পর বল একই জায়গায় ফেলতে পারে এবং একই জায়গা থেকে লেগ ব্রেক কখনো বেশি, কখনো কম ঘোরাতে পারে — তার গুগলিটা তেমন জোরদার না হলেই বা কী? কেবল বল ঘোরানোর পরিমাণের হেরফের করে যে ওয়ার্ন একটা দলের গোটা ব্যাটিং ধসিয়ে দিতে পারতেন, তা সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছে অস্ট্রেলিয়ার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড। কখনো অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বল নিশ্চিন্তে প্যাডে নিতে গিয়ে পায়ের পিছন দিয়ে বোল্ড হয়েছেন স্ট্রস, তো কখনো বল বেশি ঘুরবে ভেবে ব্যাট বাড়িয়ে দিয়ে মাটিতে পড়ে দ্রুত গতিতে সোজা চলে আসা ফ্লিপারে এল বি ডব্লিউ হয়েছেন ইয়ান বেল। ভারত ছাড়া অন্য দলের বিরুদ্ধে ওয়ার্ন ডানহাতি ব্যাটারকে ওভার দ্য উইকেট বল করলেই তাঁকে মনে হত সাক্ষাৎ নিয়তি। যখন ইচ্ছা একটা বল ভাসিয়ে দেবেন লেগ স্লিপের দিকে, অত দূরে যাচ্ছে দেখে ব্যাটার নিশ্চিন্তে ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাববেন অথবা চার মারার মোক্ষম সুযোগ ভেবে সুইপ করতে যাবেন। আর অমনি বলটা মাটিতে পড়ে বিদ্যুৎ গতিতে উল্টো দিকে ঘুরে স্টাম্প ভেঙে দেবে। এভাবে বোকা বনেছেন মাইকেল আর্থারটনের মত দুঁদে ব্যাটারও। ভারতীয়দের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র এমএসকে প্রসাদকেই এরকম অপ্রস্তুতে পড়তে হয়েছিল।
আবার রাউন্ড দ্য উইকেট বল করা ওয়ার্নের বিরুদ্ধে অতি সাবধানী হতে গিয়ে হাসির পাত্র হয়ে পড়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের ক্রেগ ম্যাকমিলান।
আমাদের কেবল টিভি ছিল, এখন ইউটিউবও আছে। যতবার খুশি এইসব মুহূর্ত দেখা যায়। অনেকে যেমন বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেবের গান বারবার শোনে; ফিরে ফিরে দেখে সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল বা কুরোসাওয়ার ছবি।
কিন্তু ওয়ার্ন আবার ওতেও শেষ হন না। বাউন্ডারির বাইরেও তিনি একজন বেহিসাবী শিল্পী। জীবন ভোগ করবার, নিজেকে অপচয় করবার বিপুল ক্ষুধা তাঁর। এ ব্যাপারে ওয়ার্নের তুলনা চলতে পারে একমাত্র দিয়েগো মারাদোনার সাথে। ওয়ার্ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যত উইকেট নিয়েছেন, ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলোকে মুখরোচক খবর আর ছবি জুগিয়েছেন বোধহয় তার চেয়েও বেশি। কখনো একাধিক যৌনকর্মীর সাথে যৌন অ্যাডভেঞ্চার, কখনো এলিজাবেথ হার্লির সাথে প্রেম। কখনো বুকিকে দিয়ে দেন পিচ সম্পর্কে তথ্য, কখনো নিষিদ্ধ ডাইইউরেটিক নিয়ে বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ হারান। তিনি উপস্থিত থাকলে পাদপ্রদীপের আলো তাঁকে ছেড়ে থাকতে পারত না। আবার সেই আলোয় এক ঝাঁক অর্বাচীনকে আলোকিত করে তারকাখচিত আইপিএল জিতে নিয়েছিলেন ওয়ার্ন। মতি নন্দীর হয়ত সে ঘটনা দেখলে মনে পড়ত বুড়ো আর্চি ম্যাকলারেনের এক দল অপেশাদারকে নিয়ে ওয়ারউইক আর্মস্ট্রংয়ের সর্বগ্রাসী দলকে হারিয়ে দেওয়ার কথা। মহাকাব্য তো নয়ই, এ যুগ এমনকি খণ্ডকাব্যের যুগও থাকছে না। এখন ফেসবুক কবিতার যুগ, তাই টি টোয়েন্টিতেই কাব্যিকতা খুঁজতে হয় আমাদের। এ যুগে ওয়ার্ন বেমানান। তাঁর ধারাভাষ্য তাই অনেকেরই মনঃপূত হয়নি, রিচি বেনোর মত যত বড় ক্রিকেটার তত বড় ধারাভাষ্যকার হয়ে উঠতে যে ওয়ার্ন পারবেন না তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। তবে তাতে শিল্পী ওয়ার্নের দাম কমে না।
লেগস্পিন এমনিতেই বড় কঠিন শিল্প। বলা হয়, জন্মগত প্রতিভা না থাকলে ও জিনিসটা হয় না। ওয়ার্নের প্রজন্মে অত্যাশ্চর্যভাবে বিশ্ব ক্রিকেটে ছিলেন তিনজন সর্বোচ্চ মানের স্পিনার — ভারতের অনিল কুম্বলে, পাকিস্তানের মুস্তাক আহমেদ আর অস্ট্রেলিয়ার ওয়ার্ন। এঁদের অবসরের পরে পাকিস্তানের ইয়াসির শাহ ছাড়া আর তেমন লেগস্পিনার উঠে আসেননি। আসলে চটজলদি ক্রিকেটের রমরমার যুগে ওয়ার্নের মত বিপুল প্রতিভা না থাকলে লেগস্পিন করে টিকে থাকাই মুশকিল। এখন ফ্লাইট দিলে, লেগ ব্রেকের পর লেগ ব্রেক করে গেলে ছোট্ট মাঠে ব্যাটারের কাজ সহজ হয়ে যাবে। ওয়ার্ন পারতেন ওসব করেও একদিনের ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করতে, বিশ্বকাপে (১৯৯৯) সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হতে। টি টোয়েন্টিতেও ৭৩ ম্যাচে ওভার পিছু আটের কম রান দিয়ে সত্তরটা উইকেট নিয়েছিলেন। অ্যাডাম জাম্পা, আদিল রশিদরা পারবেন না। আর টি টোয়েন্টিতে ভাল করতে না পারলে আজকাল টেস্ট খেলার সুযোগও পাওয়া শক্ত। এখন বন্যেরা বনে সুন্দর, লেগস্পিন ইউটিউবে। ওয়ার্নকে আর ক্রিকেটের দরকার ছিল না বোধহয়।
বেলা ফুরোতেই তিনি চলে গেলেন। অন্য অনেক ব্যাপারে ওয়ার্ন একেবারেই অস্ট্রেলিয়সুলভ ছিলেন না, কিন্তু ঠিক সময়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারে খাঁটি অস্ট্রেলিয়। তাঁর শেষ টেস্ট সিরিজ ছিল ২০০৬-০৭ অ্যাশেজ। আর্মস্ট্রংয়ের সেই দলের পর অস্ট্রেলিয়া প্রথমবার ৫-০ অ্যাশেজ জিতল। সেটা সম্ভব হত না অ্যাডিলেডে দ্বিতীয় টেস্টের পঞ্চম দিন সকালে ওয়ার্ন ইংল্যান্ডের কোমর ভেঙে না দিলে।